১
হিন্দুস্তানের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কয়েকজন শাসকের নাম উল্লেখ করতে গেলে যে নামটি তালিকার একবারে উপরের দিকেই থাকবে, তিনি হলেন সুরি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা শের শাহ সুরি। দ্বিতীয় মুঘল সম্রাট হুমায়ুনকে পরাজিত করে ১৫৪০ সালে তিনি হিন্দুস্তানের মসনদে বসেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে শের শাহ সুরি মাত্র ৫ বছর হিন্দুস্তান শাসন করতে পেরেছিলেন। কালিঞ্জর দুর্গ অবরোধের সময় ১৫৪৫ সালের ২২ মে একটি দুর্ঘটনায় হিন্দুস্তানের এ মহান শাসক মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। এ সময় শের শাহের দুই ছেলে জালাল খান ছিলেন পাটনার কাছাকাছি কোথাও, আর আদিল খান ছিলেন রণথম্ভোরে।
এদিকে, শের শাহ সুরির এই হঠাৎ মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারী কে হবে এই প্রশ্নে আফগান অভিজাতদের মাঝে বিভক্তি দেখা যায়। শের শাহ মৃত্যুর পূর্বে তার জ্যেষ্ঠ পুত্র আদিল খানকে মসনদে বসানোর নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন।
কিন্তু, আফগান অভিজাতরা তাদের পরবর্তী শাসক হিসেবে চাচ্ছিলেন শের শাহের কনিষ্ঠ পুত্র জালাল খানকে। আদিল খান ব্যক্তিগতভাবে বিলাসী জীবনযাপন করতেন। মানুষ হিসেবেও তিনি বেশ অলস ছিলেন। তাছাড়া যুদ্ধক্ষেত্রে তার তেমন উল্লেখযোগ্য যোগ্যতা বা অর্জন ছিলো না। এসব কারণে অভিজাতদের বেশিরভাগই তাকে অপছন্দ করতেন।
অন্যদিকে, জালাল খান শের শাহের মতোই যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। তিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে শের শাহের সাথে বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। যুদ্ধের ময়দানে তার বীরত্ব ও অভিজ্ঞতা- দুটোই পরীক্ষিত। আদিল শাহ আর জালাল খানের এই যোগ্যতাগত পার্থক্যের কারণে বেশিরভাগ আমিরই জালাল খানের দিকে ঝুঁকে গেলেন।
তাছাড়া, আমিরদের জালাল খানের পক্ষে যাওয়ার আরেকটি কারণও ছিলো। শের শাহের মৃত্যুর পর মসনদ খালি পড়ে ছিলো। মসনদে খুব দ্রুতই কাউকে দরকার ছিলো। আদিল খান কালিঞ্জর থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছিলেন, সেই তুলনায় জালাল খান অনেক কাছেই ছিলেন। কাজেই সিংহাসনের দাবী নিয়ে তিনিই আদিল খানের আগে পৌঁছাতে পারতেন।
যদিও ঈশা খান, জামাল খান, শেখ মুহাম্মদ ও অন্যান্য অভিজাত আফগান আমিররা মনে প্রাণে চাচ্ছিলেন জালাল খান যেন দ্রুত এসে মসনদ দখল করে, তবুও তারা দূত মারফত আদিল খান আর জালাল খান, দুজনকেই শের শাহের মৃত্যুসংবাদ জানিয়ে পত্র পাঠালেন। এখন যে আগে এসে পৌঁছাতে পারেন!
ভাগ্য জালাল খানের পক্ষেই ছিলো। শের শাহের মৃত্যুর ৫ দিন পর, ১৫৪৫ সালের ২৮ মে, জালাল খান দ্রুত কালিঞ্জর এসে পৌঁছালেন। আদিল খান তখনো কালিঞ্জর এসে পৌঁছাতে পারেননি। তাই আফগান আমিররা জালাল খানকেই নতুন সম্রাট হিসেবে মেনে নিলেন।
জালাল খান সুরি সাম্রাজ্যের সিংহাসনে বসলেন। সিংহাসনে অভিষেক উপলক্ষে নিজের নাম পরিবর্তন করলেন তিনি। জালাল খান থেকে হলেন ইসলাম শাহ। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই ‘ইসলাম শাহ’ নামেই ইতিহাসের পাতায় বেশি পরিচিত হলেন তিনি।
ইসলাম শাহ অধিকাংশ আমিরের সমর্থন নিয়ে সুরি সাম্রাজ্যের মসনদে বসলেন, তবে তার ভাই আদিল খান যে এ সময় চুপ করে ছিলেন তা কিন্তু না। ইসলাম শাহ সিংহাসনে আরোহণ করে কালিঞ্জর থেকে আগ্রায় চলে গেলেন। আদিল খান এ সময় একবার মসনদ দখলের চেষ্টা করলেন। তবে ইসলাম শাহের নিকট পরাজিত হয়ে তিনি পালিয়ে গেলেন।
২
শের শাহ সুরি মৃত্যুর আগে সুরি সাম্রাজ্যের প্রশাসন গুছিয়েই দিয়ে গিয়েছিলেন। তাই ইসলাম শাহকে মসনদে বসে সাম্রাজ্য গঠনের জন্য তেমন কষ্ট করতে হয়নি। তবে এজন্য ইসলাম শাহের যোগ্যতাকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখা উচিত হবে না।
একজন শাসক এবং যোদ্ধা হিসেবে ইসলাম শাহ তার পিতা শের শাহের মতোই যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। তবে তিনি তার পিতার মতো বিচক্ষণ ছিলেন না। আর এই বিচক্ষণতার অভাবে তিনি কিছু ভুল কাজ করে ফেললেন, যা পরবর্তীতে গোটা সুরি সাম্রাজ্যকেই হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছিলো।
আফগানরা স্বভাবগত দিক দিয়েই স্বাধীনচেতা আর বিদ্রোহপ্রবণ। ১৫২৬ সালে পানিপথের প্রান্তরে হিন্দুস্তানের মসনদ হারানোর পরও তাদের এই মনোভাবে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। শের শাহের উত্থানের সময় আফগানরা তার মাঝে তাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলো। এজন্য দলে দলে তারা শের শাহের বাহিনীতে যোগ দেয়। শের শাহ আফগানদের স্বভাব ভালো মতোই জানতেন। তিনি তার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব দিয়ে এসব স্বাধীনচেতা আমিরদের নিয়ন্ত্রণ করতেন।
শের শাহ তার আমিরদের সম্মান দিতেন। তিনি তাদের নিজের সহযোদ্ধা ভাবতেন। কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে অভিজাত সম্প্রদায়ের পরামর্শ নিতেন। পরামর্শ ভালো মনে হলে গ্রহণ করতেন, ভালো মনে না হলে গ্রহণ করতেন না। তবে কোনোভাবেই তাদের অসম্মান করতেন না। এতে শের শাহের আমিররাও তার উপর খুশি থাকতো, আর শের শাহও তাদের উপর খুশি থাকতেন।
কিন্তু, শের শাহের পুত্র ইসলাম শাহ তার আমিরদের দেখতেন সন্দেহের চোখে। তিনি জানতেন তার আমিরদের অনেকেই আদিল খানকে মসনদে দেখতে চায়। সুযোগ পেলেই তারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। তাই তিনি আফগান আমিরদের প্রচন্ড স্বাধীনচেতা মনোভাবকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলেন। যেখানে শের শাহ এসব আমিরদের নিজের সহযোদ্ধার মর্যাদা দিতেন, সেখানে ইসলাম শাহ তাদের নিজের কর্মচারী ভাবতেন। ফলে আফগান আমিররা ধীরে ধীরে ইসলাম শাহের প্রতি অসন্তুষ্ট হতে থাকে।
আফগানরা ধীরে ধীরে ঔদ্ধত্য দেখাতে শুরু করলে তিনি তাদের মর্যাদাও হ্রাস করতে থাকেন। অন্যদিকে নিজের তরুণ কর্মচারীদের পদোন্নতি দিয়ে উপরে তুলতে থাকেন। একপর্যায়ে শের শাহের আমলের অভিজ্ঞ আমিররা বিদ্রোহ করে বসে। এদের মাঝে হয়বত খান আর খাওয়াস খানের বিদ্রোহ উল্লেখযোগ্য। অবশ্য নিজের সামরিক যোগ্যতার দ্বারা ইসলাম শাহ তাদের এই বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
আফগান আমিরদের প্রতি ইসলাম শাহের নানাবিধ কঠোর মনোভাবের কারণে তাকে দুবার গুপ্তহত্যার চেষ্টাও চালানো হয়। ভাগ্যের গুণে দুবারই তিনি রক্ষা পেয়ে যান। কিন্তু এতে যা ক্ষতি হওয়ার তা আগেই হয়েছিলো। আফগান আমিররা সুরি সাম্রাজ্য থেকে আলাদা হয়ে ক্রমেই স্বাধীন হয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিলো।
ইসলাম শাহকে শের শাহের যোগ্য উত্তরাধিকারী হিসেবে ধরা হয়। আফগান আমিরদের প্রতি তার এই কঠোর মনোভাব ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে তিনি বেশ সফল ছিলেন। শের শাহের প্রশাসন ব্যবস্থা, রাজস্ব ব্যবস্থা তিনি ধরে রাখতে পেরেছিলেন। প্রশাসনিক দুর্নীতিবাজরা তার সময়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। সব মিলিয়ে বলা যায়, তিনি তার পিতার মতো করেই সাম্রাজ্য পরিচালনা করছিলেন।
ইসলাম শাহ মাত্র ৯ বছর দিল্লির মসনদে বসে শাসন করতে পেরেছিলেন। ১৫৫৩ সালের ৩০ অক্টোবর তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। আর সেই সাথে পেছনে রেখে গেলেন অন্তর্কলহে দ্বিধাবিভক্ত একদল অভিজাতকে।
৩
ইসলাম শাহের মৃত্যুর পর তার ১২ বছরের পুত্র ফিরোজ শাহ সুরি মসনদে বসলেন। তবে বয়সে তরুণ হওয়ায় দরবারে অভিজাতদের দ্বন্দ্ব সামলাতে পারলেন না। মসনদ যে ছেলেখেলা নয়, তা প্রমাণ করতেই যেন অকাল নিজের জীবনটিও হারালেন। মসনদে বসার মাত্র ৩ দিন পরেই শের শাহের ভাই নিজাম খানের পুত্র মুবারিজ খান এই তরুণ সুলতান ফিরোজ শাহ সুরিকে হত্যা করেন। এরপর নিজেই মুহাম্মদ আদিল শাহ নাম নিয়ে মসনদে বসেন।
আদিল শাহ তার শাসনের শুরুটাই করলেন রক্তপাতের মধ্য দিয়ে। সুরি সাম্রাজ্যের আফগান আমিরদের মাঝে তো আগে থেকেই বিরোধ চলমান ছিলো, আদিল শাহের এই রক্তপাতের কারণে সেই বিরোধ আরো চাঙ্গা হলো।
তবে নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতা প্রমাণ করে আদিল শাহের জন্য তখনো যথেষ্ট সুযোগ ছিলো নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্ব মিটিয়ে সাম্রাজ্যকে শক্তিশালী করার। কিন্তু মসনদে বসেই তিনি উদাসীন হয়ে পড়লেন। চারিত্রিক দুর্বলতার পাশাপাশি তিনি একজন দুর্বল শাসকও ছিলেন।
ফলে আফগান আমিররা আবারও স্বাধীনতার জন্য মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে লাগলো। তারা ধীরে ধীরে সুলতানের উপরেই প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করতে থাকলো। আদিল শাহও বেশ বিরক্ত হন। ফলে তিনিও আমিরদের বেশিদিন স্থায়ী হতে দিতেন না। কিছুদিন পর পরই দরবারে তরুণদের আমির হিসেবে পদোন্নতি দিতেন। এতে পুরনো আমিরদের মাঝে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছিলো। এদিকে নিচু বংশীয় এক হিন্দু, হিমুকে পদোন্নতি দিলে আফগানরা আদিল শাহের প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। তাছাড়া শাসক হিসেবে আদিল শাহের দুর্বলতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে হিমুও ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে উঠছিলো। এটাই আমিরদের মাথাব্যথার অন্যতম একটি কারণ ছিলো।
৪
নতুন আরেক ঝামেলার সূত্রপাত হলো কনৌজের জায়গীর নিয়ে। আদিল শাহ সরমস্ত খান সরওয়ানীকে কনৌজের জায়গীরটি দান করলেন। পূর্বে এই জায়গীরের মালিক ছিলেন শাহ মুহাম্মদ ফারমূলী। আদিল শাহের সিদ্ধান্তে ক্রুদ্ধ হয়ে শাহ মুহাম্মদ ফারমূলীর পুত্র সিকান্দার শাহ দরবার কক্ষেই সরমস্ত খানকে হত্যা করে বসেন। হঠাৎ করেই দরবারের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলো। আদিল শাহ দ্রুত দরবার ত্যাগ করে পালাতে বাধ্য হলেন।
এই ঘটনার পর বিদ্রোহ মনোভাবাপন্ন আমিরদের সাহস বেড়ে গেলো। সম্ভলের প্রশাসক তাজ খান কররানী বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। আদিল শাহ তাকে পরাজিত করে চুনারের দিকে ঠেলে দেন। চুনারে তিনি শক্তি সংগ্রহের চেষ্টা করলে আদিল শাহের সেনাপতি হিমু তাকে তাড়া করেন। তাজ খান কররানী এবার বাংলার দিকে পালিয়ে যান।
আদিল শাহ এবার বেশ সতর্ক হয়ে গেলেন। তিনি বিদ্রোহী আমিরদের বন্দী করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই তালিকায় ছিলেন ইব্রাহীম খান সুরিও। সম্পর্কের দিক দিয়ে তিনি ছিলেন আদিল শাহের ভগ্নিপতি।
ইব্রাহীম সুরিকে গ্রেফতার করা গেলো না। তিনি পালিয়ে বিয়ানার দিকে চলে গেলেন। আদিল শাহের বোনই স্বামীকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করলেন। বিরক্ত আদিল শাহ ঈসা খান নিয়াজীকে পাঠালেন বিয়ানার দিকে। কিন্তু তিনি পরাজিত হলেন। আত্মবিশ্বাসী হয়ে ইব্রাহীম সুরি অগ্রসর হয়ে দিল্লি অধিকার করে নিলেন। আদিল শাহ তখন চুনারে ছিলেন।
ইব্রাহীম সুরি নিজেকে সুরি সাম্রাজ্যের সুলতান হিসেবে ঘোষণা করলেন। সুলতান হিসেবে ‘শাহ’ উপাধী নিয়ে হলেন ইব্রাহীম শাহ সুরি। যা-ই হোক, নিজেকে সুলতান ঘোষণা করে দ্রুত তিনি আগ্রা অধিকার করে নিলেন। সুরি সাম্রাজ্যের বেশ কয়েকজন আমির তার আনুগত্য স্বীকার করলো। এই আনুগত্য তাকে বেশ ভালো সুবিধা দিলো।
৫
এদিকে আদিল শাহ চুনারে বসে আগ্রা আর দিল্লির পতনে হতভম্ব হয়ে দ্রুত দিল্লি অভিমুখে যাত্রা করলেন। যমুনা নদীর নিকট তিনি ইব্রাহীম শাহের মুখোমুখি হলেন। তবে যুদ্ধ হলো না। যুদ্ধ শুরুর আগেই কূটনৈতিকভাবে পরাজিত হলেন তিনি। তার আরও কয়েকজন আমির ইব্রাহীম শাহের আনুগত্য স্বীকার করলে তিনি ভড়কে গেলেন। বাধ্য হয়েই চুনারে ফিরে গেলেন তিনি।
ইব্রাহীম শাহের বিদ্রোহে ব্যাপক উৎসাহিত হয়ে বিদ্রোহ করলেন আরেকজন। তিনি পাঞ্জাবের গভর্নর আহমদ খান সুরি। তিনি ইব্রাহীম শাহের অধীনের থাকা খোদ দিল্লির দিকেই হাত বাড়িয়ে দিলেন। সাথে নিয়ে এলেন দশ হাজার সৈন্যের এক বাহিনী। ইব্রাহীম শাহ ৮০,০০০ সৈন্যের বিশাল এক বাহিনী নিয়ে তাকে বাঁধা দিতে এগিয়ে গেলেন। আগ্রা থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে উভয় বাহিনী মুখোমুখি হলো।
পাঞ্জাবের গভর্নর আহমদ খান সুরি অবশ্য ইব্রাহীম শাহের বিশাল বাহিনী দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন। তিনি ইব্রাহীম শাহের সাথে সন্ধি করতে চাইলেন। বিনিময়ে পাঞ্জাবের স্বাধীনতা দাবী করলেন। ইব্রাহীম শাহ এককথায় এই দাবীকে নাকচ করে দিলেন।
ফলে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ালো। যুদ্ধ শুরু হলো। এবং আশ্চর্যজনকভাবে সাথে বিশাল এক বাহিনী থাকা সত্ত্বেও ইব্রাহীম শাহ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে সম্ভলের দিকে পালিয়ে গেলেন। এদিকে আহমদ খান সুরি সিকান্দার শাহ উপাধী নিয়ে নিজেকে সুলতান ঘোষণা দিলেন।
দিল্লি আর আগ্রাজুড়ে ক্ষমতার এই লড়াই থেকে লাভ নিজেদের ঘরে তুললেন বাংলার গভর্নর মুহাম্মদ খান সুরি আর মালবের গভর্নর সুজাত খান। তারা প্রত্যকেই নিজ নিজ প্রদেশে স্বাধীনতা ঘোষণা করে স্বাধীনভাবে রাজ্য শাসন করতে শুরু করলেন। অবশ্য ১৫৫৫ সালে সুজাত খান মারা যাওয়ায় তার পুত্র বাজ বাহাদুর মালবের শাসক হন। এদিকে একই সালে আদিল শাহের হিন্দু সেনাপতি হিমুর কাছে কালপীর পূর্বে যমুনা নদীর তীরে এক যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন মুহাম্মদ খান সুরি। মুহাম্মদ খান সুরি মারা গেলে তার পুত্র খিজির খানকে আমিররা তাদের নেতৃত্বের আসনে বসালেন। বাহাদুর শাহ উপাধী নিয়ে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে বাংলার দিকে অগ্রসর হলেন তিনি।
যা-ই হোক, এই অরাজকতার ফল দাঁড়ালো এই যে, শের শাহের পুত্র ইসলাম শাহ সুরির মৃত্যুর পর কিছুদিনের মাঝেই সুরি সাম্রাজ্য ভেঙে পাঁচটি ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলো। চুনার থেকে বিহার পর্যন্ত শাসন করছিলেন আদিল শাহ, সম্ভল আর দোয়াব শাসন করছিলেন ইব্রাহীম শাহ সুরি, পাঞ্জাবে সিকান্দার শাহ সুরি, বাংলায় বাহাদুর শাহ আর মালবে বাজ বাহাদুর। প্রত্যেকেরই জীবনের একমাত্র ব্রত ছিলো অন্য চারজনকে হত্যা করে পুরো সাম্রাজ্য অধিকার করা। এ এক বিচিত্র লড়াই!
৬
এদিকে মসনদ নিয়ে এই ইঁদুর-বিড়াল দৌড়ের প্রভাব পড়লো প্রশাসনের উপর। প্রশাসনের দুর্নীতিপ্রবণ কর্মকর্তা যারা শের শাহের ভয়ে ভালো হয়ে ছিলো, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগে তারাও দুর্নীতি করা শুরু করে দিলো। প্রথম ধাক্কাটাই পড়লো রাজস্বের উপরে। রাজস্ব আদায়কারী কর্মকর্তারা নানাভাবে সাম্রাজ্যের রাজস্ব আত্মসাৎ করতে শুরু করে দিলো। কিন্তু হায়! এসব দেখার জন্য শের শাহ তখন আর বেঁচে ছিলেন না।
প্রশাসনের দুর্নীতিগ্রস্থ কর্মকর্তারা প্রজাদের উপর নানাভাবে অত্যাচার নির্যাতন করতে শুরু করে দিলো। শের শাহের সময়ে কৃষকরা তাদের চাষবাস নিয়ে শান্তিতে ছিলো। কিন্তু এ সময় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে সর্বশান্ত হয়ে কৃষকরা শের শাহের সাম্রাজ্য ছেড়ে যেতে লাগলো। ধীরে ধীরে সাম্রাজ্যের অর্থনীতি ভেঙে পড়তে লাগলো।
অস্থিতিশীল রাজনীতি আর ভঙ্গুর অর্থনীতি, এই দুটি জিনিস সাথে নিয়ে কোনো সাম্রাজ্য সামনে এগিয়ে চলতে পারে না। এক্ষেত্রে সাম্রাজ্যটি ভেঙে পড়তে শুরু করে। শের শাহের অবর্তমানে তার সাম্রাজ্যটিও সেই পরিণতির দিকেই এগোচ্ছিলো। তবে দূর থেকে এসবের প্রতি লক্ষ্য রাখছিলেন আরেকজন। তিনিও দ্রুত শের শাহের সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে নিজের অধিকার বুঝে নিতে চান। কাবুলে বসে অস্ত্রে শাণ দিচ্ছিলেন তিনি। সুরি সাম্রাজ্যকে এমন বিশৃঙ্খল অবস্থায় জাপটে ধরার চেয়ে বেশি উপযুক্ত সময় আর কবেই বা পাবেন তিনি!
[এই সিরিজের পূর্বের প্রকাশিত পর্বটি পড়ুন এখানে। সিরিজের সবগুলো লেখা পড়তে চাইলে ক্লিক করুন এখানে।]