[২য় পর্ব পড়ুন]
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে একটি স্বতন্ত্র ইউক্রেনীয় জাতির গঠনপ্রক্রিয়া বহুলাংশে সম্পন্ন হয়, কিন্তু বর্তমান ইউক্রেনের ভূখণ্ড সেসময় চারটি অংশে বিভক্ত ছিল — সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ‘সোভিয়েত ইউক্রেন’, পোল্যান্ডের অধীনস্থ ‘পশ্চিম ইউক্রেন’ (গালিৎসিয়া ও ভোলিন), রুমানিয়ার শাসনাধীন ‘উত্তর বুকোভিনা’ এবং হাঙ্গেরির নিয়ন্ত্রণাধীন ‘জাকারপাত্তিয়া’। সোভিয়েত ইউক্রেনে সোভিয়েত কমিউনিস্টরা একটি ‘সোভিয়েতকৃত’ (Sovietized) ইউক্রেনীয় জাতি সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল এবং সেই প্রচেষ্টা বহুলাংশে সফলও হয়েছিল, কিন্তু ১৯৩০–৩৩ সালের দুর্ভিক্ষ ও ১৯৩৭–৩৮ সালের শুদ্ধি অভিযানের কারণে ইউক্রেনীয় জনসাধারণের একাংশ সোভিয়েত সরকারের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। পোলিশ ও রুমানীয় ইউক্রেনে ইউক্রেনীয়দের জোরপূর্বক আত্মীকরণের (forced assimilation) প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছিল, কিন্তু এসবের ফলে উক্ত অঞ্চলে উগ্র ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদ বিস্তার লাভ করছিল। চেকোস্লোভাক ইউক্রেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতা লাভ করে, কিন্তু শীঘ্রই হাঙ্গেরীয় দখলদারিত্বের অধীনে চলে যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা: পোলিশ ইউক্রেনের বিভাজন এবং জার্মান–ওইউএন মৈত্রী
এমতাবস্থায় ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মানি ও জার্মানির আশ্রিত রাষ্ট্র স্লোভাকিয়া পোল্যান্ড আক্রমণ করে এবং এর মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধ শুরুর এক সপ্তাহ আগে জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে একটি অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, এবং এই চুক্তির গোপন শর্তাবলি অনুযায়ী জার্মান ও সোভিয়েতরা পূর্ব ইউরোপে নিজেদের প্রভাব বলয় নির্ধারণ করে নেয়। ১৭ সেপ্টেম্বর সোভিয়েত সৈন্যরা পোল্যান্ডে প্রবেশ করে। পোল্যান্ড কিংবা সোভিয়েত ইউনিয়ন কেউই একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেনি, এবং সোভিয়েত সৈন্যরা দ্রুতগতিতে পোল্যান্ডের পূর্বাঞ্চলের অংশবিশেষ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। উক্ত অঞ্চলের ভিতরে ছিল গালিৎসিয়ার সিংহভাগ এবং ভোলিনের পশ্চিমাংশ, অর্থাৎ পোলিশ ইউক্রেনের সিংহভাগ ভূখণ্ড। গালিৎসিয়া ও ভোলিনের অবশিষ্টাংশ জার্মানির অধীনে চলে যায়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক গালিৎসিয়ার বৃহদাংশ ও পশ্চিম ভোলিন অধিকারের ঘটনাটিকে পোলিশ জাতীয়তাবাদীরা এবং সোভিয়েতবিরোধীরা ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক পোল্যান্ড আক্রমণ’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকে। অন্যদিকে, সোভিয়েত দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, এটি ছিল পোল্যান্ডের পূর্বাঞ্চলে বসবাসরত ‘ভ্রাতৃসুলভ’ ইউক্রেনীয় ও বেলারুশীয়দের জার্মান আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত রাখার জন্য পরিচালিত একটি ‘অভিযান’। ১৯৩৯ সালের অক্টোবরে উক্ত ভূখণ্ডে ‘পশ্চিম ইউক্রেনের জনসভা’ (রুশ: Народное Собрание Западной Украины, ‘নারোদনোয়ে সোব্রানিয়ে জাপাদনোয় উক্রাইনি’; ইউক্রেনীয়: Народні Збори Західної України, ‘নারোদনি জবোরি জাহিদনোয় উক্রায়নি’) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং উক্ত সভার প্রস্তাব অনুযায়ী ১৯৩৯ সালের নভেম্বরে উক্ত ভূখণ্ড সোভিয়েত ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত হয়।
উল্লেখ্য, উক্ত ভূখণ্ডের সিংহভাগ ১৯১৯–২১ সালের পোলিশ–সোভিয়েত যুদ্ধের সময় পোল্যান্ড সোভিয়েত ইউক্রেনের কাছ থেকে দখল করে নিয়েছিল। এজন্য সোভিয়েত ইউক্রেন ও প্রাক্তন পোলিশ ইউক্রেন উভয় অঞ্চলের জনসাধারণের সিংহভাগই এই একত্রীকরণকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করে। তদুপরি, ১৯৪০ সালের জুনে সোভিয়েত ইউনিয়ন রুমানিয়াকে একটি চরমপত্র প্রদান করে এবং বেসারাবিয়া ও উত্তর বুকোভিনা অঞ্চলদ্বয়কে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে হস্তান্তর করার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। রুমানিয়া সোভিয়েত চাপের মুখে নতি স্বীকার করে এবং অঞ্চল দুটিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে হস্তান্তর করে। ইউক্রেনীয়–অধ্যুষিত উত্তর বুকোভিনা ও বেসারাবিয়ার অংশবিশেষ সোভিয়েত ইউক্রেনের সঙ্গে যুক্ত হয়।
অন্যদিকে, গালিৎসিয়া ও ভোলিনের যে অংশ জার্মানির অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, সেই অংশে জার্মানরা ইউক্রেনীয়দের সীমিত মাত্রায় ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক অধিকার প্রদান করে, কিন্তু উগ্র জাতীয়তাবাদী ও বর্ণবাদী গ্রুপ ‘ওইউএন’ ছাড়া অন্য সকল ইউক্রেনীয় রাজনৈতিক সংগঠনকে নিষিদ্ধ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই ‘ওইউএন’ জার্মানির সঙ্গে গোপন সহযোগিতায় লিপ্ত ছিল এবং জার্মানি কর্তৃক পোল্যান্ড আক্রমণের পর তারা আক্রমণকারী জার্মান সৈন্যদেরকে সহায়তা করে। কিন্তু দলটির মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রবল হয়ে ওঠে এবং ১৯৪০ সালে ‘ওইউএন’ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এদের মধ্যে আন্দ্রি মেলনিকের নেতৃত্বাধীন ‘ওইউএন–এম’ ছিল তুলনামূলকভাবে কম উগ্রপন্থী, কিন্তু স্তেপান বান্দেরার নেতৃত্বাধীন ‘ওইউএন–বি’ ছিল চরম উগ্রপন্থী। অবশ্য দুটি দলই জার্মানদের সঙ্গে সহযোগিতায় লিপ্ত ছিল।
জার্মান–সোভিয়েত যুদ্ধ: সোভিয়েত ইউক্রেনে জার্মান দখলদারিত্ব এবং ইউক্রেনীয় ভূখণ্ডের একত্রীকরণ
১৯৪১ সালের ২২ জুন জার্মানি এবং জার্মানি কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ও জার্মানির সঙ্গে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ রাষ্ট্রগুলো (ইতালি, রুমানিয়া, হাঙ্গেরি, ফিনল্যান্ড, স্লোভাকিয়া ও ক্রোয়েশিয়া) অতর্কিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর আক্রমণ চালায় এবং ‘ওইউএন’–এর দুইটি শাখা এই আক্রমণে জার্মানিকে সমর্থন করে। যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিপর্যস্ত হয় এবং ১৯৪১ সালের নভেম্বর নাগাদ সমগ্র সোভিয়েত ইউক্রেন জার্মানির দখলে চলে যায়। সোভিয়েত ইউক্রেনীয় সরকার সোভিয়েত রাশিয়ার ভূখণ্ডে আশ্রয় গ্রহণ করে। ‘ওইউএন’–এর দুই শাখা এবং সোভিয়েত ইউক্রেনের, বিশেষত প্রাক্তন গালিৎসিয়ার, কিছু উগ্র ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদী ধারণা করেছিল যে, জার্মানি যেহেতু সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পোল্যান্ড উভয়েরই শত্রু, সেহেতু তারা ইউক্রেনীয়দের মিত্র হবে এবং তাদের সহায়তায় ইউক্রেনীয়রা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র স্থাপন করতে পারবে।
কিন্তু শীঘ্রই তাদের ধারণা ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়। জার্মানির উগ্র বর্ণবাদী ও উগ্র জাতীয়তাবাদী সরকার ইউক্রেনীয়–সহ সকল স্লাভিক জাতিকে জার্মানদের চেয়ে নিচু জাতের ‘অবমানব’ হিসেবে বিবেচনা করত। ইউক্রেন সম্পর্কে তাদের পরিকল্পনা ছিল: তারা ইউক্রেনকে একটি জার্মান কৃষি উপনিবেশে পরিণত করবে, ইউক্রেনের সিংহভাগ জনসাধারণকে নিশ্চিহ্ন করবে এবং ইউক্রেনীয় জনসাধারণের অবশিষ্টাংশকে জার্মানদের দাসে পরিণত করবে। ইউক্রেন দখলের পর জার্মানরা গালিৎসিয়াকে জার্মান–অধিকৃত পোল্যান্ডের অন্তর্ভুক্ত করে, উত্তর বুকোভিনাসহ ইউক্রেনের একাংশকে রুমানিয়ার কাছে হস্তান্তর করে এবং ইউক্রেনের বাকি অংশকে একটি জার্মান প্রদেশে রূপান্তরিত করে। জার্মান দখলদারিত্বের ফলে ইউক্রেনের অন্তত ৫২ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়, এবং জার্মানরা অন্তত ২২ লক্ষ তরুণ–তরুণীকে ‘দাস শ্রমিক’ হিসেবে ইউক্রেন থেকে জার্মানিতে প্রেরণ করে।
জার্মানি কর্তৃক সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের পরপরই ‘ওইউএন–বি’ লভোভ শহরে একটি স্বাধীন ইউক্রেনীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করে, কিন্তু জার্মানরা শীঘ্রই এই প্রচেষ্টাকে ভণ্ডুল করে দেয় এবং ওইউএন–বি নেতাদের গ্রেপ্তার করে। অবশ্য ওইউএন–এম আর ইউক্রেনীয়দের একাংশ জার্মানদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে থাকে, এবং ইউক্রেনে জার্মান প্রশাসন ও পুলিশি কার্যক্রম পরিচালনায় (এবং গণহত্যার ক্ষেত্রে) জার্মানদেরকে সহায়তা করে। তদুপরি, জার্মানি কর্তৃক ওইউএন–বির স্বাধীন ইউক্রেনীয় রাষ্ট্র স্থাপনের প্রচেষ্টা ধূলিসাৎ করার পর ওইউএন–বি কিছু সময়ের জন্য জার্মানদের বিরুদ্ধে স্বল্প মাত্রার গেরিলা যুদ্ধে লিপ্ত হয়, কিন্তু পরবর্তীতে তারা আবার জার্মানির সঙ্গে সহযোগিতা করতে আরম্ভ করে। তদুপরি, তারা ইউক্রেনে অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধরত সোভিয়েত গেরিলাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, এবং হাজার হাজার পোলিশ, ইহুদি, রুশ ও ভিন্নমতাবলম্বী ইউক্রেনীয়কে খুন করে। সামগ্রিকভাবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে অন্তত ৩ লক্ষ ইউক্রেনীয় প্রত্যক্ষভাবে জার্মানির পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
অন্যদিকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে প্রায় ৭০ লক্ষ ইউক্রেনীয় সোভিয়েত সশস্ত্রবাহিনী এবং সোভিয়েত গেরিলা দলগুলোর পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ১৯৪৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন অক্ষশক্তির কাছ থেকে ইউক্রেন পুনর্দখল করে নেয়। উত্তর বুকোভিনা পুনরায় সোভিয়েত ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত হয়, এবং গালিৎসিয়া ও ভোলিনের প্রায় সম্পূর্ণ অংশকে সোভিয়েত ইউক্রেনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। তদুপরি, সোভিয়েত ইউনিয়ন হাঙ্গেরির কাছ থেকে জাকারপাত্তিয়া দখল করে নেয় এবং সেটিকেও সোভিয়েত ইউক্রেনের সঙ্গে যুক্ত করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এবং বিশ্বযুদ্ধ শেষে স্বাক্ষরিত বিভিন্ন চুক্তি ও সমঝোতার মাধ্যমে মিত্রশক্তি, পোল্যান্ড, রুমানিয়া ও চেকোস্লোভাকিয়া সোভিয়েত ইউক্রেনের সম্প্রসারণকে স্বীকৃতি প্রদান করে। সর্বোপরি, ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সোভিয়েত ইউনিয়নের পাশাপাশি সোভিয়েত ইউক্রেনও জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে।
সামগ্রিকভাবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল ইউক্রেন এবং ইউক্রেনীয়দের জন্য একটি অত্যন্ত ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ নাগাদ ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদীদের পুরনো স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটে – ইউক্রেনীয়–অধ্যুষিত সমস্ত ভূখণ্ড একটি একক রাষ্ট্রকাঠামোর অধীনে একত্রিত হয়। এর মধ্য দিয়ে কিয়েভস্কায়া রুশের পতনের প্রায় ৭ শতাব্দী পর কিয়েভস্কায়া রুশের সমস্ত ভূখণ্ড আবার একত্রিত হয়। অবশ্য ইউক্রেনীয় ভূখণ্ডের একত্রীকরণ ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা সম্পন্ন হয়নি। বস্তুত ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদীরা সেই লক্ষ্যের ধারেকাছেই পৌঁছাতে পারেনি। সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট সরকারের অধীনে এই লক্ষ্য পূরণ হয় এবং স্বাভাবিকভাবেই ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদীরা এতে সন্তুষ্ট ছিল না।
পশ্চিম ইউক্রেন বিদ্রোহ: স্নায়ুযুদ্ধের ‘প্রায় অজ্ঞাত’ প্রক্সি যুদ্ধ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ওইউএন–বি ‘ইউপিএ’ বা ‘ইউক্রেনীয় বিদ্রোহী সেনাবাহিনী’ (ইউক্রেনীয়: Українська повстанська армія, ‘উক্রাইনস্কা পোভস্তানস্কা আর্মিয়া’) নামক একটি সশস্ত্র গ্রুপ গঠন করে এবং সোভিয়েত ইউক্রেনের পশ্চিমাংশে সোভিয়েত কেন্দ্রীয় সরকার ও সোভিয়েত ইউক্রেনীয় সরকারের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে। এই গ্রুপটির অন্তত কয়েক লক্ষ সদস্য ছিল এবং স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, তদানীন্তন পশ্চিম জার্মানি ও ইতালির গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ গ্রুপটিকে সহায়তা প্রদান করে। ১৯৪০–এর দশকের শেষ নাগাদ এই বিদ্রোহের মাত্রা স্তিমিত হয়ে আসে, কিন্তু ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ইউপিএর মধ্যে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ চলতে থাকে। এই যুদ্ধে ইউপিএর হাতে ৮,০০০ থেকে ২৫,০০০ সোভিয়েত সৈন্য এবং অন্তত ৩০,০০০ বেসামরিক মানুষ নিহত হয়। অন্যদিকে, সোভিয়েত সৈন্যদের হাতে প্রায় ১,৫৫,০০০ ইউপিএ সদস্য নিহত হয় এবং ১,৩০,০০০ থেকে ২ লক্ষ ইউপিএ সদস্য/সমর্থক গ্রেপ্তার হয়।
বস্তুত ‘পশ্চিম ইউক্রেন বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত এই যুদ্ধটি ছিল অত্যন্ত রক্তক্ষয়ী একটি যুদ্ধ এবং স্নায়ুযুদ্ধের একেবারে প্রথম প্রক্সি যুদ্ধগুলোর মধ্যে একটি। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক না কেন, এই রক্তাক্ত যুদ্ধটি ইতিহাসের ‘প্রায় অজ্ঞাত’ একটি অধ্যায় হিসেবেই রয়ে গেছে। পশ্চিমা বিশ্ব এই যুদ্ধে তাদের ভূমিকার ব্যাপারে কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করেছিল, এবং ২০১৭ সালের আগে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ‘সিআইএ’ এই যুদ্ধে তাদের ভূমিকার কথা স্বীকার করেনি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সোভিয়েত ইউক্রেন: সম্প্রসারণ, জাতীয়তাবাদ এবং স্বাধীনতা
১৯৫৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে ‘পেরেইয়াস্লাভ সভা’র ৩০০ বছর পূর্তি জাঁকজমকের সঙ্গে উদযাপিত হয়। ১৬৫৪ সালে অনুষ্ঠিত পেরেইয়াস্লাভ সভায় পোল্যান্ড–লিথুয়ানিয়ার অন্তর্ভুক্ত ইউক্রেনীয় ভূখণ্ডের কসাকরা রাশিয়ার কাছে সুরক্ষা প্রার্থনা করেছিল, এবং এই ঘটনাটিকে সোভিয়েত সরকার রুশ ও ইউক্রেনীয় জাতির মধ্যেকার ‘স্থায়ী’ ঐক্যের নিদর্শন হিসেবে উদযাপন করে। একই বছর সোভিয়েত কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন কারণে ক্রিমিয়া উপদ্বীপকে সোভিয়েত রাশিয়া থেকে সোভিয়েত ইউক্রেনের কাছে হস্তান্তর করে। সেসময় ক্রিমিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী ছিল জাতিগত রুশ, কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়া ও সোভিয়েত ইউক্রেন যেহেতু একই রাষ্ট্রের অংশ ছিল, সেহেতু সেসময় এই সিদ্ধান্ত বিশেষ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেনি।
১৯৫০, ১৯৬০ এবং ১৯৭০–এর দশক জুড়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে সোভিয়েত ইউক্রেনের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। এসময় সোভিয়েত কেন্দ্রীয় সরকারে ইউক্রেনীয় কমিউনিস্টদের অংশগ্রহণের মাত্রা পূর্বের চেয়ে বহুগুণে বৃদ্ধি পায়, এবং সোভিয়েত ইউক্রেনের স্বায়ত্তশাসনের মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। সোভিয়েত ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি অত্যন্ত শিল্পায়িত, বিদ্যুতায়িত, প্রযুক্তিগতভাবে অগ্রসর এবং অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। বস্তুত সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে সোভিয়েত রাশিয়ার পর সোভিয়েত ইউক্রেন ছিল সবচেয়ে প্রভাবশালী ও শক্তিশালী প্রজাতন্ত্র।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইউক্রেনীয় উগ্র জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলো মূলত পশ্চিমা বিশ্বে আশ্রয় নিয়েছিল। সেখানে তারা পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বিস্তৃত সহায়তা লাভ করে। পশ্চিমা বিশ্বের উদ্দেশ্য ছিল এই সংগঠনগুলোকে ব্যবহার করে সোভিয়েত ইউক্রেনে বিচ্ছিন্নতাবাদের সৃষ্টি করা। একই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে এবং সোভিয়েত ইউক্রেনে ১৯৩০ ও ১৯৪০–এর দশকের তুলনায় রাজনৈতিক স্বাধীনতার মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে, এবং এর ফলে সোভিয়েত ইউক্রেনের অভ্যন্তরে কমিউনিজমবিরোধী ও জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা প্রসার লাভ করার সুযোগ পায়। এক্ষেত্রে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এবং পশ্চিমা বিশ্বে অবস্থানরত ইউক্রেনীয় উগ্র জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১৯৭০–এর দশকে সোভিয়েত অর্থনীতিতে স্থবিরতা দেখা দেয় এবং ১৯৮০–এর দশক নাগাদ সোভিয়েত অর্থনীতির সমস্যার মাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর প্রতিক্রিয়ায় ১৯৮০–এর দশকের মাঝামাঝি নাগাদ সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিস্ট পার্টির মহাসচিব মিখাইল গর্বাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়ন জুড়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচির প্রবর্তন করেন। কিন্তু উক্ত অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি সোভিয়েত অর্থনীতিতে উন্নতি ঘটাতে ব্যর্থ হয় এবং এর ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন জুড়ে কমিউনিজমবিরোধী অসন্তোষের মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। তদুপরি, গর্বাচেভের রাজনৈতিক সংস্কারের ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নে ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর থেকে সব ধরনের বিধিনিষেধ বিলুপ্ত হয়, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন জুড়ে উগ্র জাতীয়তাবাদী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীরা এই রাজনৈতিক স্বাধীনতার সুযোগকে পূর্ণরূপে কাজে লাগায়।
সোভিয়েত ইউক্রেনেও উগ্র জাতীয়তাবাদীরা ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং বিদেশে অবস্থানরত ইউক্রেনীয় উগ্র জাতীয়তাবাদীরা সোভিয়েত ইউক্রেনের রাজনৈতিক ঘটনাবলিকে প্রভাবিত করতে শুরু করে। তদুপরি, ১৯৮৬ সালে সোভিয়েত ইউক্রেনে সংঘটিত চেরনোবিল পারমাণবিক বিপর্যয়ের ফলে ইউক্রেনীয় জনসাধারণের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ১৯৯০ সালের মার্চে সোভিয়েত ইউক্রেনে প্রথম বারের মতো মুক্তভাবে বহুদলীয় আইনসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ইউক্রেনীয় কমিউনিস্টরা বিজয়ী হয়, কিন্তু তাদের মধ্যে সংস্কারপন্থীদের প্রাধান্য ছিল বেশি এবং ১৯৯০ সালের ১৬ জুলাই সোভিয়েত ইউক্রেনীয় আইনসভা ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করে।
বস্তুত ১৯৯০ সাল নাগাদ এটি স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হচ্ছিল যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবে। এই পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য গর্বাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নকে একটি নতুন ফেডারেশনে রূপান্তরিত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং এই উদ্দেশ্যে ১৯৯১ সালের মার্চে সোভিয়েত ইউনিয়নের ৯টি ইউনিয়ন প্রজাতন্ত্রে (যেগুলোর মধ্যে সোভিয়েত ইউক্রেনও ছিল) একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। এই গণভোটে সোভিয়েত ইউক্রেনের জনসাধারণের প্রায় ৭১% সোভিয়েত ইউনিয়নকে একটি নতুন ফেডারেশনে রূপান্তরিত করার পক্ষে ভোট দেয়।
কিন্তু ১৯৯১ সালের ১৯–২১ আগস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিস্ট পার্টির একটি কট্টরপন্থী অংশ অভ্যুত্থান ঘটিয়ে গর্বাচেভকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার চেষ্টা করে। এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় গর্বাচেভ প্রকৃত ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন এবং মূল ক্ষমতা চলে যায় সোভিয়েত রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ও গর্বাচেভের তিক্ত রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বোরিস ইয়েলৎসিনের কাছে। ইয়েলৎসিন সোভিয়েত ইউনিয়নকে বিলুপ্ত করে ফেলার পক্ষপাতী ছিলেন, সুতরাং গর্বাচেভ কর্তৃক আয়োজিত গণভোটের ফলাফল সোভিয়েত ইউনিয়নকে নতুন রূপে বজায় রাখার পক্ষে গেলেও উক্ত পরিকল্পনা আর বাস্তবায়িত হয়নি।
এমতাবস্থায় ১৯৯১ সালের ২৪ আগস্ট সোভিয়েত ইউক্রেনের আইনসভা ইউক্রেনের স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং এর মধ্য দিয়ে বর্তমান ইউক্রেন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ১৯৯১ সালের ১ ডিসেম্বর ইউক্রেনের স্বাধীনতার ওপর একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হয় এবং একই সঙ্গে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রার্থীদের সকলেই ইউক্রেনের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছিলেন, এবং গণভোটে ইউক্রেনীয় জনসাধারণের প্রায় ৯২% স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দেয়। ইউক্রেনের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও ইউক্রেনীয় আইনসভার সভাপতি লিওনিদ ক্রাভচুক ইউক্রেনের প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালের ৮ ডিসেম্বর রাশিয়া, ইউক্রেন ও বেলারুশ ‘সিআইএস গঠন সংক্রান্ত চুক্তি’তে স্বাক্ষর করে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নকে বিলুপ্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। ২৫ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি ঘটে।
১৯৯০–এর দশকে রাশিয়া ও ইউক্রেন: দ্বন্দ্বের সূচনা
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি ঘটে এবং রাশিয়া ও ইউক্রেন দুইটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এর ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে যে সমস্যাগুলো সুপ্ত অবস্থায় ছিল, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো রুশ–ইউক্রেনীয় সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে।
প্রথমত, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের প্রাক্কালে ইউক্রেনের প্রায় ১ কোটি ১৩ লক্ষ অধিবাসী (অর্থাৎ ইউক্রেনের জনসংখ্যার প্রায় ২২%) ছিল জাতিগত রুশ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এরা রাতারাতি নিজেদেরকে একটি ভিন্ন রাষ্ট্রে আবিষ্কার করে। তদুপরি, ইউক্রেনে বসবাসরত জাতিগত ইউক্রেনীয়দের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যে রুশপ্রীতি বিদ্যমান এবং তাদের একটি বৃহৎ অংশ রুশভাষী। বস্তুত ইউক্রেনের জনসাধারণের অন্তত এক–তৃতীয়াংশ রুশভাষী। কিন্তু ইউক্রেনের স্বাধীনতা লাভের পর ইউক্রেনীয় সরকার রুশ ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা প্রদান করেনি, এবং এটিকে ইউক্রেনে বসবাসরত জাতিগত রুশ ও রুশভাষীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তাদের প্রতি জাতিগত, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য হিসেবে বিবেচনা করে।
দ্বিতীয়ত, সোভিয়েত কেন্দ্রীয় সরকার ১৯২০–এর দশকে নভোরোসিয়া অঞ্চলকে (বর্তমান ইউক্রেনের দনেৎস্ক, লুহানস্ক, দনিপ্রোপেত্রোভস্ক, মিকোলাইভ, ওদেসা ও খারকিভ অঞ্চল) এবং ১৯৫০–এর দশকে ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত করে। নভোরোসিয়া অঞ্চলের জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জাতিগত রুশ এবং সিংহভাগ অংশ রুশভাষী। ক্রিমিয়ার জনসংখ্যার সিংহভাগ জাতিগত রুশ এবং রুশভাষী। এই পরিস্থিতিতে রুশ জাতীয়তাবাদীরা সোভিয়েত কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক নভোরোসিয়া ও ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্তকরণকে ইউক্রেনের নিকট ‘জাতিগত রুশ ভূমির সমর্পণ’ হিসেবে বিবেচনা করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে এই সমস্যাটি তেমন গুরুতর ছিল না, কারণ সেসময় রাশিয়া ও ইউক্রেন ছিল একই রাষ্ট্রের অংশ।
কিন্তু ইউক্রেন স্বাধীন হওয়ার পর ইউক্রেনীয় সরকার কর্তৃক জাতীয়তাবাদী নীতি গ্রহণ এবং জাতিগত রুশ ও রুশভাষীদের প্রতি বৈষম্যের কারণে রাশিয়া ও ইউক্রেনের রুশ জাতীয়তাবাদীরা ক্ষুব্ধ হয়। বস্তুত ১৯৯০–এর দশকে ক্রিমিয়া ও নভোরোসিয়ায় রুশপন্থীরা ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার প্রচেষ্টা চালায়, কিন্তু রুশ সরকারের নিষ্ক্রিয়তার কারণে তাদের প্রচেষ্টা সাফল্যমণ্ডিত হয়নি।
তৃতীয়ত, ক্রিমিয়ায় রুশ নৌঘাঁটির অবস্থান এবং প্রাক্তন সোভিয়েত কৃষ্ণসাগরীয় নৌবহরের মালিকানা নিয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি হয়। ইউক্রেন উক্ত নৌবহরের সম্পূর্ণ অংশ দাবি করছিল এবং এই সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল যে, ক্রিমিয়ায় অবস্থিত রুশ নৌঘাঁটি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে কৃষ্ণসাগরে রুশ কৌশলগত অবস্থান মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ত এবং রাশিয়ার ভূমধ্যসাগরে প্রবেশের সুযোগ বহুগুণে সীমিত হয়ে পড়ত।
চতুর্থত, প্রাক্তন সোভিয়েত সশস্ত্রবাহিনীর পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডারের এক বিরাট অংশ ইউক্রেনের ভূখণ্ডে মোতায়েন ছিল, এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ইউক্রেন কার্যত যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পর বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পারমাণবিক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু চেরনোবিল বিপর্যয়ের পর ইউক্রেনীয় জনসাধারণের মধ্যে তীব্র পারমাণবিক অস্ত্রবিরোধী মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছিল এবং এই প্রেক্ষাপটে ইউক্রেনীয় সরকার উক্ত পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার রাশিয়ার কাছে হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু প্রায় অর্ধেক পারমাণবিক অস্ত্র রাশিয়ার কাছে হস্তান্তর করার পর ইউক্রেনীয় সরকার আকস্মিকভাবে হস্তান্তর প্রক্রিয়া স্থগিত রাখে। বিষয়টি রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে।
সর্বোপরি, স্বাধীনতা লাভের পরপরই ইউক্রেন নিজেকে একটি ‘ইউরোপীয়’ রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং ‘ইউরেশীয়’ পরিচিতিকে বর্জন করে। ইউক্রেন পশ্চিমাপন্থী পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে শুরু করে, মার্কিন–নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ‘ন্যাটো’তে যোগদানের প্রক্রিয়া শুরু করে এবং রুশ প্রভাবাধীন ‘সিআইএস’ জোটের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে অস্বীকৃতি জানায়। সিআইএস সম্পর্কে রাশিয়া ও ইউক্রেনের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ভিন্ন। রাশিয়া সিআইএসভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর একটি যৌথ সশস্ত্রবাহিনী গঠন, যৌথ নাগরিকত্ব ব্যবস্থা স্থাপন এবং যৌথ সীমান্ত প্রতিরক্ষা বাহিনী নির্মাণের পক্ষপাতী ছিল, কিন্তু ইউক্রেন এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এবং সিআইএসে যোগদান থেকে বিরত থাকে।
এমতাবস্থায় রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রায় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল, কিন্তু পরিস্থিতির কারণে উভয়েই দ্বন্দ্ব এড়িয়ে যায়। এসময় রাশিয়া তীব্র রাজনৈতিক সঙ্কট, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, সামাজিক অবক্ষয় ও অভ্যন্তরীণ নৈরাজ্যে বিপর্যস্ত ছিল, এবং পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে ও তাদের কাছ থেকে বিস্তৃত অর্থনৈতিক সহায়তা লাভ করতে আগ্রহী ছিল। এসময় পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়ার ওপর ব্যাপক হারে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয় এবং রুশ পররাষ্ট্রনীতির গতিপ্রকৃতি অনেকাংশে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী পরিচালনা করতে থাকে। অন্যদিকে, ইউক্রেনও সেসময় তীব্র রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যায় বিপর্যস্ত ছিল এবং এই পরিস্থিতিতে রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়ার আগ্রহ তাদের ছিল না।
এই পরিস্থিতিতে রাশিয়া সাধারণভাবে ইউক্রেনে বসবাসরত জাতিগত রুশ ও রুশভাষীদের পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করে এবং ক্রিমিয়া ও নভোরোসিয়াকে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের চাপে ইউক্রেন তার অবশিষ্ট পারমাণবিক অস্ত্র ধ্বংস করতে বাধ্য হয়। ১৯৯৭ সালে রাশিয়া ও ইউক্রেন প্রাক্তন সোভিয়েত কৃষ্ণসাগরীয় নৌবহরকে ভাগাভাগির বিষয়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছায়। এই চুক্তি অনুযায়ী উক্ত নৌবহরের সিংহভাগ রাশিয়ার হস্তগত হয়, বিনিময়ে রাশিয়া ইউক্রেনের বৈদেশিক ঋণের অংশবিশেষ মওকুফ করে দেয়। তদুপরি, ক্রিমিয়ায় অবস্থিত রুশ নৌঘাঁটিকে ইউক্রেন ২০ বছরের জন্য রাশিয়ার কাছে ইজারা প্রদান করে, এবং রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে একটি ‘বন্ধুত্ব, সহযোগিতা ও অংশীদারিত্ব চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৯৪ সালে নির্বাচিত ইউক্রেনের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি লিওনিদ কুচমা ন্যাটো ও রাশিয়ার মধ্যে সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজার রেখে চলার প্রচেষ্টা চালান। ইউক্রেন ১৯৯৪ সালে ন্যাটোর ‘পার্টনারশিপ ফর পিস প্রোগ্রামে’ যোগদান করে এবং ১৯৯৯ সালে ‘সিআইএস ইন্টারপার্লামেন্টারি অ্যাসেম্বলি’তে যোগদান করে।
১৯৯০–এর দশক জুড়ে ইউক্রেন ও রাশিয়ায় দুটি প্রক্রিয়া পরস্পরের সমান্তরালে চলতে থাকে। স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই ইউক্রেন ব্যাপক অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখোমুখি হয় এবং যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনৈতিক সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব এই সুযোগকে ব্যবহার করে ইউক্রেনের অভ্যন্তরে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের জন্য বিস্তৃত পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ইউক্রেন যেন আর কখনো কমিউনিজম এবং রাশিয়ার অধীনে ফিরে না যায়, সেজন্য পশ্চিমা বিশ্ব ও তাদের ইউক্রেনীয় সমর্থকরা ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদের বিস্তারকে বেগবান করতে থাকে।
তদুপরি, সোভিয়েত আমলের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষিপ্রগতিতে ব্যক্তিগত মালিকানাধীনে নিয়ে আসার ফলে ইউক্রেনে একটি নব্য অভিজাত শ্রেণির (oligarchs) সৃষ্টি হয়, যাদের ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক স্বার্থ সরাসরি পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার ওপর নির্ভরশীল এবং এরা ইউক্রেনে পশ্চিমা প্রভাব বিস্তারের প্রধান ‘প্রতিনিধি’ হয়ে ওঠে। এই গুটিকয়েক অভিজাত (oligarch) কার্যত ইউক্রেনের ক্ষমতার প্রকৃত নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে, কারণ নিজেদের বিপুল সম্পদের বদৌলতে এরা ইউক্রেনের প্রচারমাধ্যম, রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সিংহভাগের নিয়ন্ত্রণ লাভ করে।
এসময় রাশিয়াতেও একইভাবে পশ্চিমাপন্থী অভিজাত শ্রেণির উত্থান ঘটেছিল, কিন্তু ইউক্রেনে অনুসৃত পশ্চিমা নীতির সঙ্গে রাশিয়ায় অনুসৃত পশ্চিমা নীতির পার্থক্য ছিল: পশ্চিমারা ইউক্রেনে ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদের বিস্তারকে সোৎসাহে সমর্থন করে, কিন্তু রাশিয়ায় রুশ জাতীয়তাবাদের বিস্তারের তীব্র বিরোধিতা করে এবং সেটিকে ‘রুশ সাম্রাজ্যবাদ’ হিসেবে চিহ্নিত করে। বস্তুত পশ্চিমাপন্থী রুশ লিবারেলরা ১৯৯০–এর দশকে ‘জাতীয়তাবাদী’ বা ‘দেশপ্রেমিক’ শব্দগুলোকে নেতিবাচক হিসেবে উপস্থাপন করত। কিন্তু ইউক্রেনের মতো রাশিয়ায় পশ্চিমাপন্থী অভিজাতদের শাসন স্থায়ী হয়নি, কারণ ১৯৯৯ সালে রাশিয়ায় অনেকটা আকস্মিকভাবেই একটি নতুন শ্রেণির উত্থান ঘটে এবং রাশিয়ার ইতিহাস এক নতুন মোড় নেয়।
সামগ্রিকভাবে, বর্তমান ইউক্রেনীয় ভূখণ্ডে বসবাসকারী রুশ জাতির অংশকে মূল রুশ জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে পোলিশ ও লিথুয়ানীয়রা যে প্রচেষ্টা শুরু করেছিল এবং ঊনবিংশ শতাব্দীতে অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয়রা যে প্রচেষ্টাকে বেগবান করেছিল, সোভিয়েত কমিউনিস্টরা সেই প্রচেষ্টাকে পূর্ণতা প্রদান করে এবং এর ফলে বিংশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ ইউক্রেনীয় জাতি রুশ জাতির প্রচ্ছন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়। জাতি দুইটির মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টির কারণের কোনো অভাব ছিল না — ক্রিমিয়া, কৃষ্ণসাগরীয় নৌবহর, ইউক্রেনে রুশ ভাষার অবস্থান, জাতিগত রুশ ও রুশভাষীদের প্রতি ইউক্রেনীয় সরকারের আচরণ, নভোরোসিয়া, প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্য — রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ সৃষ্টির জন্য এগুলো এবং আরো নানা কারণ ছিল। এই ঐতিহাসিক পটভূমিতে একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে তিক্ত দ্বন্দ্ব আরম্ভ হয়, এবং বর্তমানে দনবাসে চলমান যুদ্ধ এই দ্বন্দ্বের বাস্তবিক প্রতিফলন মাত্র।