উনবিংশ শতাব্দীর এক দরিদ্র পরিবার তার জন্ম, যেখানে জগতের কোনো সুখ-শান্তি ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। সারাজীবন বিয়ে করেননি। দারিদ্র্য-হতাশাকে কাটিয়ে নিজ যোগ্যতায় উঠে এসেছেন, নিয়েছেন পিএইচডি ডিগ্রি। জীবনের প্রথম দিককার দিনগুলো কাটিয়েছেন গবেষণা এবং চাকরি করে। কিন্তু জীবনের মাঝসময় থেকে শেষসময় পর্যন্ত করে গেছেন সন্ন্যাসব্রত এবং পরসেবা। আবার ঠিক এই সময়ের মধ্যে লিখেছেন পৃথিবীর তাবৎ গণিতের ইতিহাস, যা তাকে অমর করে রেখেছে। প্রচণ্ড মনবল না থাকলে এরকম জীবন বেছে নেওয়া যায় না। বলছি একজন বাঙালির কথা, নাম বিভূতিভূষণ দত্ত। পার্থিব সুখ এবং ব্যক্তিগত লাভের প্রতি তার আসক্তি ছিল না। সন্ন্যাসী হওয়ার পর তার একটি নাম হয় ‘স্বামী বিদ্যারণ্য’।
১৮৮৮ সালে চট্টগ্রামের কানুনগয়াপাড়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারে জন্মগ্রহণ না করলেও তার বাবা এবং মা দুজনই অত্যন্ত সজ্জন এবং সৎ মানুষ ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই বিভূতিভূষণ দত্তের ভিতর একটি সাধুপুরুষদের মতো ভাবগাম্ভীর্য চলে এসেছিলো। স্কুলে পড়াকালীন অবস্থা থেকেই তিনি কপিনা পরতেন। এটি অনেকটা কটিবস্ত্রের মতো। তখন থেকেই তিনি ধর্মীয় এবং দর্শনবিদ্যার বই পড়তেন এবং রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের লেখনীর দ্বারাও তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন।
পড়ালেখায় তুখোড় ও মেধাবী ছিলেন তিনি। ১৯০৭ সালে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিয়ে বৃত্তি নিয়ে পাস করেন। এরপর প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে) থেকে স্নাতক পাস করেন ১৯১১-১৯১২ সালে। ১৯১৪ সালে সেখান থেকেই মিশ্র গণিত (Mixed Mathematics – তত্ত্বীয় এবং ফলিত গণিতের মিশ্রণ) বিষয়ে তিনি প্রথম শ্রেণীতে স্নাতকোত্তর পাস করেন। ধারণা করা হয়, স্নাতক পাস করার পর তিনি সন্ন্যাসব্রত পালন করার জন্য হরিদ্বার চলে যান। তার বড় ভাই তাকে খুঁজে পান এবং বাড়ি নিয়ে আসেন। তাই ১৯১৩ সালে তিনি স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করতে পারেননি।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত নিয়ে গবেষণা করার জন্য তিনি বৃত্তি লাভ করেন। স্নাতকোত্তর করার সময় তার গবেষণা নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ পায়। এরপর বিভূতিভূষণ দত্ত বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। সেখানে মিশ্র গণিত নিয়ে পড়াতেন তিনি। সেখান থেকে তিনি প্রেমচাঁদ রয়চাঁদ বৃত্তি লাভ করেন এবং পরপরই ইলিয়ট পুরস্কার লাভ করেন। এখান থেকে তিনি গণিত বিষয়ে ডক্টরেট করার সুযোগ লাভ করেন। তার পিএইচডি থিসিসের বিষয় ছিল তরল গতিবিদ্যা। ১৯২০ সালে তিনি তার থিসিস ডিফেন্ড করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।
পড়াশোনায় তিনি ভালো ছিলেন ঠিকই, কিন্তু এত কিছু অর্জনের পরও তার সন্ন্যাসী হওয়ার প্রবণতা এতটুকুও যায়নি। গণিত নিয়ে পড়াশোনার সাথে সাথে তিনি উপনিষদ এবং অন্যান্য দার্শনিক তত্ত্ব নিয়ে নিজের মতামত প্রকাশ করতেন। বিজ্ঞান কলেজে থাকাকালীন একবার তাকে রাসবিহারী ঘোষ প্রফেসরশিপ দিয়ে সম্মান দেয়ার কথা হয়েছিল। কিন্তু প্রথমে তিনি সেটা গ্রহণ করতে রাজি হননি। তার যুক্তি ছিল- এই পদ অত্যন্ত দায়িত্বশীল একটি পদ। কিছুদিন পর তিনি এসব কিছু ছেড়ে সন্ন্যাসব্রত পালন করতে চলে যাবেন এবং সারাজীবন সন্ন্যাসী হয়েই থাকবেন। তাই এই সম্মান এবং পদ তিনি গ্রহণ করতে পারবেন না। তবে উপযুক্ত প্রার্থী না পাওয়ার কারণে একরকম জোর করেই তাকে এই পদে বসানো হয়। প্রায় তিন বছর এই পদে সফলতার সাথে তিনি কাজ করেন। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে কোনো বেতন তিনি গ্রহণ করেননি।
ভারতে গণিতের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করাকে জনপ্রিয় করেন গণেশ প্রসাদ, যিনি ১৯২৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে হার্ডিঞ্জ প্রফেসর হিসেবে নিয়োগ পান। পরবর্তীতে তার অনুপ্রেরণায় বিভূতিভূষণ দত্তও এই বিষয়ে কাজ শুরু করেন এবং ভারতীয় গণিত চর্চার উপর তার চমৎকার কিছু বই ও গবেষণাপত্র প্রকাশ পায়। ভারতীয় গণিত ইতিহাস নিয়ে তার কাজ শুরু হয় বিশ দশকের মাঝামাঝি সময়ে। ১৯২৭ সালে এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটি অব ম্যাথমেটিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন তিনি একটি বক্তব্য পেশ করেন, যার বিষয় ছিল Contrbution of Ancient Hindus to Mathematics। এই বক্তব্যটি পরবর্তীতে Association’s Bulletin-এ প্রবন্ধ হিসেবে প্রকাশ পায়।
এসময় থেকে বিভূতিভূষণ দত্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিদিনকার রুটিন কাজের দিকে মনোযোগ বসাতে পারছিলেন না। ১৯২৯ সালে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। তবে ১৯৩১ সাল থেকে রিডার হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার দিতে যেতেন। তবে ১৯৩৩ সালে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে চূড়ান্তভাবে শিক্ষকতা থেকে অবসরে যান বিভূতিভূষণ দত্ত। এসময় থেকে তিনি সন্ন্যাসীব্রত পালন করেন। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন তিনি। তাকে বিভিন্ন আশ্রমে থাকতে দেখা যেতো। ১৯৩৪ সালের দিকে তাকে ধর্মসিন্ধু বলে একটি আশ্রমে দেখা যায়। সেখানে থাকাকালীন তিনি বই লেখেন “History of Hindu Mathematics” নামে। সন্ন্যাসী হওয়ার পর তার নাম হয় ‘স্বামী বিদ্যারণ্য’। ১৯৩৪ সালেই তিনি তার আগের বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ড লেখেন, History of Hindu Mathematics – Part 2।
নিজের শেষ বছরগুলো বিভূতিভূষণ দত্ত রাজস্থানের পুশকারায় কাটান। ১৯৫৮ সালে তার মা মৃত্যুবরণ করেন। তার প্রায় ছয় মাস পর বিভূতিভূষণ দত্ত এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন।
আমরা যদি বিভূতিভূষণ দত্তের কাজের ক্ষেত্রের দিকে তাকাই তাহলে দেখা যাবে তিনি তিনটি ক্ষেত্রে কাজ করেছেন। ফলিত গণিত, গণিতের ইতিহাস এবং ধর্ম ও দর্শন। ডক্টরেট করার সময় তার তরলগতিবিদ্যা নিয়ে যে গবেষণা ছিল সেখান থেকে বেশ কিছু গবেষণা পত্র বের হয় যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে On the periods of vibrations of a straight vortex pair। গণিতের ইতিহাস নিয়ে তিনি যে বিখ্যাত কাজ করে গিয়েছেন সেখানে প্রাচীন থেকে শুরু করে আধুনিক অনেক বিষয় এবং ঘটনা স্থান পেয়েছে।
যেমন- সেখানে ছিল যুক্তরাষ্ট্র এবং কলকাতার গণিত সমাজ নিয়ে কথা, বাংলা সন, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, বাংলার এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নাল, বেনারসের গণিত সমাজ এবং তাদের অবদান ইত্যাদি। আরবদের থেকে আল-বিরুনি এবং তার আরবি গাণিতিক চিহ্ন, হিন্দু সমাজ থেকে হিন্দু ও আরবদের মিশ্র গাণিতিক প্রতীক, পাই এর গুরুত্ব হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে কী রকম, ভারতে শূন্য আবিষ্কারের ইতিহাস, বর্গমূলের ইতিহাস, অসীম ধারণার ইতিহাস, জৈনদের মহাকাশচর্চা এবং জ্যামিতি নিয়ে তাদের কাজ, বাকশালি গণিত, ব্রহ্মগুপ্তের কাজ ইত্যাদি বিষয় ছাড়াও আরও নানা বিষয় স্থান পেয়েছে তার এই বইতে।
চমৎকার একটি কাজ করে গিয়েছেন বিভূতিভূষণ দত্ত। অনেক সাধারণ মানুষ তার নাম জানেন না। খ্যাতির আড়ালে থেকে অনেকটা নিভৃতেই কাজ করে গিয়েছেন তিনি। মেধা এবং শিক্ষাগত যোগ্যতায় যেভাবে সমসাময়িকদের থেকে এগিয়ে ছিলেন তাতে লোভনীয় কাজের আরও সুযোগ পেতে পারতেন তিনি। কিন্তু সন্ন্যাসী হওয়ার আকুলতা তাকে ছোটবেলা থেকেই পেয়ে বসেছিল। তবুও বিজ্ঞান ও গণিতের প্রতি ভালবাসা এবং দায়িত্ববোধ থেকেই হয়তো সন্ন্যাসী হওয়ার পরও দুটি বই রচনা করে গিয়েছেন, যা পরবর্তীতে বেশ খ্যাতি লাভ করে। বাঙালি লেখকদের মধ্যে এরকম মৌলিক গ্রন্থ বা মাস্টারপিস লেখক হয়তো তেমন নেই, আর কালে কালে কিছু কিছু রচনা হলেও বিভূতিভূষণ দত্তের রচিত বইয়ের সমকক্ষ আর রচনা হয়নি।
তার সমকক্ষ ছিলেন মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বোসের মতো বিজ্ঞানীরা। তাদের মতো তিনি বিজ্ঞানের জন্য মৌলিক কাজ করে যেতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু সেই বই দুটো তাকে অমর করে রাখবে তাতে সন্দেহ নেই। এই বই দুটো রচনা না করলে শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক কাজের মাধ্যমে তিনি আজীবন মানুষের মাঝে বেঁচে না-ও থাকতে পারতেন, কালের গভীরে হারিয়ে যেতে হতো তাকেও।
তথ্যসূত্র
[১] Jones, P.S. (1976). Bibhutibhusan Datta. Historia Mathematica. 3, 77-78.
[২] Gupta, R.C (1980). Bibhutibhusan Datta(1888-1958), Historian of Indian Mathematics. Historia Mathematica. 7, 126-133.
ফিচার ইমেজ – hitory.mcs.st-and.ac.uk