জলদস্যুদের রোমাঞ্চকর জীবন ও গুপ্তধন নিয়ে মানুষের আগ্রহ চিরন্তন। কয়েকশো বছর আগের এই পৃথিবীতে বণিকরা ব্যবসা-বাণিজ্য করতে, আবার কখনও অভিযাত্রীরা কোনো রোমাঞ্চকর অভিযাত্রায় অংশ নিতে সমুদ্রপথকেই বেছে নিতেন। যদিও সেই সমুদ্রপথে ছিল পদে পদে বিপদ। প্রতিকূল আবহাওয়া তো বড় বাঁধা ছিলই, তার চেয়েও ভয়ঙ্কর ছিল জলদস্যুদের নিষ্ঠুর আক্রমণ। আজ থেকে তিনশো বছর আগে জলদস্যুদের এড়িয়ে সমুদ্রপথে কোনো জাহাজ পাড়ি দেওয়া একপ্রকার অসম্ভবই ছিল। সে সময় জ্যামাইকার পোর্ট রয়্যাল কিংবা ফ্লোরিডার সেন্ট অগাস্টিন- বিশ্বের এ ধরনের অনেক সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল ছিল জলদস্যুদের অভয়ারণ্য।
তিনশো বছর পর সেসব জলদস্যুদের স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে গড়ে উঠেছে আস্ত এক জাদুঘর। ফ্লোরিডা আমেরিকার সবচেয়ে পুরনো বন্দর শহর। অতীতে এই বন্দরে পা পড়েছে কুখ্যাত সব জলদস্যুর। ফ্লোরিডা উপকূলের ক্যাস্তিলো দে সান মার্কোসো অঞ্চল ছিল জলদস্যুদের নিরাপদ ঘাঁটি। আমেরিকায় স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক সময়কালে স্যার ফ্রান্সিস ড্রেক ও রবার্ট সেরিলসের মতো জলদস্যুরা এখানে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি চালিয়েছিলেন। তারা ক্যাস্তিলো দে সান মার্কোসোর গোপন দুর্গে জাহাজ থেকে লুট করে আনা মালপত্র, সোনাদানা লুকিয়ে রাখতো। পাইরেট বা জলদস্যুদের নিয়ে মিউজিয়াম তৈরি করার জন্য এর চেয়ে আদর্শ জায়গা আর কী হতে পারে?
প্যাট ক্রস নামের স্বনামধন্য এক লেখক, যিনি একাধারে একজন উদ্যোক্তা এবং একসময় ফ্লোরিডার স্থানীয় এক ক্রীড়া দলেরও নির্বাহী পদে ছিলেন, তিনি ২০০৫ সালে ফ্লোরিডার কি ওয়েস্টে এই পাইরেটস এন্ড ট্রেজার মিউজিয়ামটি প্রতিষ্ঠা করেন। ছোটবেলা থেকেই জলদস্যুদের নিয়ে লেখা জীবনকাহিনী প্যাটকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করতো। তখন থেকে পাইরেটদের নিয়ে লেখা নানা গল্পকাহিনী তার সংগ্রহশালায় স্থান পেতে থাকে।
জলদস্যুদের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র থেকে শুরু করে তাদের ছবি ও তাদের লুট করে আনা জিনিসপত্র সংগ্রহ করা তার নেশা হয়ে দাঁড়ায়। পরবর্তী সময়ে বিশ্বের যে প্রান্তে গিয়েছেন সেখানেই জলদস্যুদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র ও বিভিন্ন সময় উদ্ধার হওয়া জলদস্যুদের বেশকিছু রত্নভান্ডার দিয়ে প্যাট তার সংগ্রহশালা সাজাতে থাকেন। তার সংগ্রহশালায় এমন কিছু নিদর্শন আছে যা ৩০০ বছরেরও পুরনো।
কিন্তু জাদুঘরটি কি ওয়েস্টে খুব বেশি দিন স্থায়ী ছিল না। ৫ বছর পর জাদুঘরটি কি ওয়েস্ট থেকে সরিয়ে সেন্ট অগাস্টিনের ক্যাস্তিলো দে সান মার্কোসে স্থাপন করা হয়। এর নতুন নামকরণ হয় ‘সেন্ট অগাস্টিন পাইরেট অ্যান্ড ট্রেজার মিউজিয়াম’। কিছুদিন বন্ধ থাকার পর ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে জাদুঘরটি পুনরায় খুলে দেয়া হয়। সেন্ট অগাস্টিন জাদুঘরে একবার গিয়ে ঢুকলেই যেন কোনো অদৃশ্য টাইম মেশিনে চেপে পৌঁছে যাওয়া যায় ৩০০ বছর আগের পৃথিবীতে, যখন জলদস্যুরা স্বমহিমায় বিরাজ করছে। সমুদ্রপথে ছিল যাদের অবাধ বিচরণক্ষেত্র। সময়টাকে জলদস্যুদের স্বর্ণযুগ বলে অভিহিত করা হয়।
এখানে ৩০০ বছরের সেই পুরনো ইতিহাসকে দর্শকদের সামনে তুলে ধরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। জাদুঘরে ৮০০ এর বেশি বিশ্বের প্রাচীন ও দুষ্প্রাপ্য সব নিদর্শন রয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে কুখ্যাত সব জলদস্যুর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য নিদর্শনগুলোর এই বিপুল সম্ভার সত্যিই বিস্ময়কর। এখানে দর্শকরা প্রাচীনকালের জলদস্যুদের জীবনকাহিনী, তাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র ও বিভিন্ন নিদর্শনের সাক্ষী হতে পারেন। ছোট-বড় সকল বয়সী মানুষের জন্য এ জাদুঘর এক মজার ও শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা।
জাদুঘরে ৪৮টি পৃথক প্রদর্শনী অঞ্চলে জলদস্যুদের নানা নিদর্শন স্থান পেয়েছে। এ সংগ্রহশালায় কী নেই? সতেরো শতকে ক্যাপ্টেন টমাস থিও’র রত্নবাক্স, ১৬৯৯ সালের সমুদ্রযাত্রায় ক্যাপ্টেন লঙ্গিসের লগবুকে তখনকার দোর্দন্ড প্রতাপশালী জলদস্যু ক্যাপ্টেন কিডের বিবরণ এবং তার শেষ যাত্রার কিছু দুর্লভ জিনিস এই জাদুঘরের সংগ্রহশালায় রয়েছে। পাওয়া যাবে পৃথিবীর প্রাচীনতম ‘WANTED’ পোস্টারও যা ১৬৯৬ সালে জলদস্যু হেনরি এভেরিকে ধরে আনার জন্য ইংল্যান্ডের রাজা বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। পুরস্কার মূল্য ছিল তখনকার দিনে ৫০০ পাউন্ড।
জাদুঘরের আর এক আকর্ষণ সপ্তদশ শতকের দুর্ধর্ষ ইংরেজ জলদস্যু ব্ল্যাক বিয়ার্ডের জলি রজার পতাকাবাহী তিনটি জাহাজের একটি কুইন অ্যানি’স রিভেঞ্জ-এর অংশবিশেষ এখানে স্থান পেয়েছে। সে জাহাজ থেকে উদ্ধার হওয়া জলদস্যুদের ব্যবহৃত বন্দুক ও সোনার তৈরি বিভিন্ন নিদর্শন দেখতে পাওয়া যাবে। জলি রজার পতাকাবাহী জাহাজের প্রধান মাস্তুলের মাথায় ওড়া সেই ভয়ঙ্কর কালো পতাকা, যাতে জ্বলজ্বল করতো মড়ার খুলি ও দুটো হাড়। দূর থেকে যা দেখে আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়তো জাহাজের নাবিক ও যাত্রীরা। উনিশ শতকে জলদস্যুদের জাহাজে ব্যবহৃত দুটো জলি রজার পতাকা এখানে প্রদর্শিত হয়। ফ্রান্সিস ড্রেক, ব্ল্যাক বিয়ার্ড, জ্যাক র্যাকহাম, ব্ল্যাকবার্টের মতো ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা সব দুঃসাহসী জলদস্যুর জীবনপুঞ্জি দিয়ে সাজানো হয়েছে একটি পৃথক প্রদর্শনীকক্ষ।
জাদুঘরে আরও আছে জলদস্যুর ব্যবহৃত বেশ কয়েকটি জাহাজের রেপ্লিকা। ঘুরে বেড়ানো যায় জাহাজের অলিন্দে-অলিন্দে। উঁকি দিয়ে দেখা যায় ক্যাপ্টেনের কেবিন। সেখানে কিছু সময় কাটিয়ে ডেকের নীচটা ঘুরে আসা যায়। নাবিকেরা ডেকের নীচে কীভাবে জীবনযাপন করতো তা দেখা দর্শকদের এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। জাহাজের কামান ঘরটিও দেখার মতো। দর্শকদের জন্য সপ্তদশ শতকের এই কামানঘর থেকে বৈদ্যুতিক উপায়ে কামান থেকে গোলার আওয়াজ বের হওয়ার শব্দ শোনানোর ব্যবস্থা রয়েছে।
তখনকার দিনে জলদস্যুরা যে ধরনের পোশাক পরতেন দর্শকদের জন্য সেই সাজেরও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। দর্শকরা চাইলে নিজেদেরকে জলদস্যুর সাজে মাথায় টুপি, জলদস্যুদের ব্যবহৃত পতাকা এবং কামানের রেপ্লিকার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে একজন জলদস্যু হিসেবে ভেবে নেয়ার রোমাঞ্চকর জীবনের অভিজ্ঞতা অর্জন করার যাবতীয় ব্যবস্থা রয়েছে এই জাদুঘরে।
জাহাজ ছাড়াও এই জাদুঘরে তিনশো বছরের পুরনো সব যানবাহনের রেপ্লিকা রাখা আছে। এ যানগুলোর সাহায্যে দর্শকরা জাদুঘরের বিভিন্ন স্থান ঘুরে বেড়াতে পারেন। জলদস্যুদের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত জ্যামাইকার পোর্ট রয়্যালের মতো স্থান জাদুঘরে উঠে এসেছে। এখানে দর্শকরা প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো পোর্ট রয়্যালের সেই দিনগুলোতে চলে যেতে পারেন। জলদস্যুদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল পোর্ট রয়্যালের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নাম না জানা আরও অনেক কুখ্যাত জলদস্যুদের গল্প জানা যাবে।
এই জাদুঘরের আলাদা একটি বিভাগ স্থানীয় বেশ কিছু নিদর্শন দিয়ে সাজানো হয়েছে। তার মধ্যে স্থান পেয়েছে স্থানীয় জলদস্যুদের ব্যবহৃত পিস্তল, তলোয়ার এবং স্বর্ণমুদ্রা, যা এ নগরীর প্রাচীন ইতিহাসকে দর্শকদের সামনে তুলে ধরে। তখনকার কুখ্যাত সব জলদস্যু যারা সেন্ট অগাস্টিনকে তাদের লুটতরাজের মূল হাব হিসেবে ব্যবহার করতেন, তাদের বেপোরোয়া জীবনের এক চিত্তাকর্ষক দিক দর্শকদের সামনে তুলে ধরা হয়। তখন তারা এতটাই বেপোরোয়া ও প্রভাবশালী ছিলেন যে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে এই শহর তারা দুবার দখল করেন এবং শহরের বিভিন্ন জায়গায় লুটতরাজ চালান। এরপর শহরজুড়ে বিজয় উৎসব পালন করেন। সে গল্পও ডিজিটাল প্রদর্শনীর মাধ্যমে এখানে উপস্থাপিত হয়েছে। সেসব দিনকে স্মরণ করে বছরের একটি বিশেষ দিনে জাদুঘরের সামনে থেকে বের হয় বিশেষ কার্নিভাল। এ কার্নিভালে অংশগ্রহণরত সকলে জলদস্যুর সাজে নিজেদের সাজিয়ে তোলেন।
সবশেষে ব্ল্যাক বিয়ার্ডের শেষ সমুদ্র যুদ্ধের গল্প নিয়ে নির্মিত ডিজনীর পুরষ্কারপ্রাপ্ত তথ্যচিত্র দেখানো হয়। এছাড়া জাদুঘরে হলিউডের জনপ্রিয় চরিত্র ক্যাপ্টেন হুক ও জ্যাক স্প্যারোর মতো চরিত্রের দেখা মিলবে। ইতিহাসের মুখোমুখি হওয়ার জন্য আয়োজন করা হয় এক ঘন্টার এডুকেশনাল ট্যুর। গাইড হিসেবে সঙ্গে পাওয়া যায় এক নাবিককে। জাদুঘরে ঘোরা শেষ করে দর্শকদের কেনাকাটা করার জন্য রয়েছে গিফট শপ, জলদস্যুদের নিয়ে লেখা বই, কমিক্স, এমনকি সিনেমার সিডিও। সুভ্যেনির হিসেবে পাওয়া যায় পুরনো শতাব্দীর গয়না, মুদ্রা ও জামাকাপড়। জাদুঘরের এসব উচ্চ প্রযুক্তির, ইন্টারেক্টিভ প্রদর্শনীগুলো সমস্ত বয়সের দর্শকদের কাছে এক মনোমুগ্ধকর অভিজ্ঞতা।
জলদস্যুদের সম্পর্কে আরও জানতে পড়ুন এই বইটি
১. ভাইকিং জলদস্যু