চট্টগ্রামের কাছাকাছি ধুম রেলস্টেশনে হঠাৎ করে লাইনচ্যুত হয়ে যায় একটি মালবাহী ট্রেন। কারা যেন রেল লাইনের ফিসপ্লেট খুলে রেখেছিল। ফলে চট্টগ্রাম অঞ্চলের সাথে পুরো দেশের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে । সেই একই রাতে অন্য একটি দল হামলা চালায় চট্টগ্রামের টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ অফিসে। সব যন্ত্রপাতি গুড়িয়ে দিয়ে তারা আগুন ধরিয়ে দেয় ভবনটিতে। ফলে এবার সম্পূর্ণরূপে বিকল হলো যোগাযোগ ব্যবস্থা। এ দিনটি ছিল ১৮ এপ্রিল, ১৯৩০। চট্টগ্রামে সেদিন রচিত হয়েছিল এক অসীম সাহসিকতার উপাখ্যান; যার শুরুটা হয়েছিল এভাবেই।
সর্বাধিনায়ক মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে মাত্র ৬৫ জন তরুণ, যুবকের একটি দল। পরাক্রমশালী ব্রিটিশ শক্তির হাত থেকে চট্টগ্রামকে স্বাধীন করার অসম্ভব এক স্বপ্ন বুকে লড়াইয়ে নেমেছিল সেদিন। হ্যাঁ, পুরো ভারতবর্ষের তুলনায় চট্টগ্রাম নিতান্তই ক্ষুদ্র একটি অংশ। কিন্তু এ বিপ্লব নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা ব্রিটিশ রাজকেই। ভারতীয় সকল বিপ্লবীদের বিশ্বাসের পালে হাওয়া লাগিয়ে সেদিন চট্টগ্রামে উড়েছিল ভারতীয় পতাকা।
রাত দশটা নাগাদ চট্টগ্রাম পুলিশ লাইনের প্রহরী পুলিশটি দেখল গেইটের দিকে এগিয়ে আসছে দুজন লোক, পেছনে আরও জনা চারেক; সবাই সামরিক উর্দিধারী। সামরিক ইউনিফর্ম তাকে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হলো। এ বিভ্রান্তি কাটিয়ে কোনো প্রশ্ন করার আগেই গর্জে উঠল সামরিক পোশাকধারী অনন্ত সিং আর গনেশ ঘোষের রিভলভার। চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহীদের দুই জেনারেলের গুলিতে সঙ্গে সঙ্গেই লুটিয়ে পড়ল পুলিশ প্রহরীটি। সাথে সাথে চারপাশের বিভিন্ন জায়গা থেকে একত্রে ধ্বনিত হলো- “ইনকিলাব জিন্দাবাদ”, “সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক”, “বন্দে মাতরম”। ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে মনে হলো যেন চারপাশ থেকে শত সহস্র কণ্ঠ হুঙ্কার ছাড়ছে। সেই শ্লোগান শুনে বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল পুলিশ দলের। কে কোনদিকে ছুটে পালালো সে হদিস পাওয়া গেল না। নিখুঁত পরিকল্পনা অনুযায়ীই কাজ হলো। মাত্র ত্রিশ-পঁয়ত্রিশজনের দলটি বিভিন্ন অবস্থান থেকে সমবেত হুঙ্কারে ভড়কে দিতে পেরেছিল পুলিশ বাহিনীকে।
এরপর দ্রুত ছোট ছোট দলগুলি একত্রিত হলো। একদল প্রহরায় দাঁড়িয়ে রইল, অন্যদল ছুটল অস্ত্রাগারের উদ্দেশ্যে। অস্ত্র চাই! বিপ্লবের জন্য শক্তিশালী সব অস্ত্র দরকার। বিদ্রোহ তো সবে শুরু হলো। দখল করতে হবে জেলখানা, ইম্পেরিয়াল ব্যাঙ্ক, কোর্ট-কাছারি; দখল করতে হবে গোটা শহরটিই। গোটা ভারতকে দেখাতে হবে ইংরেজ অপরাজেয় নয়। অস্ত্রাগারের তালা ভাঙতেই চোখ ঝলসে গেল বিপ্লবীদের, থরে থরে সাজানো শত শত মাস্কেট্রি রাইফেল, অসংখ্য রিভলভার আর কার্তুজ! বিজয়োল্লাসে চকচক করছে তাদের চোখ। এরপর ক্ষণকালের জন্য যেন কেঁপে উঠল চট্টগ্রামের আকাশ; গনেশ ঘোষের নির্দেশে সামরিক কায়দায় আকাশের দিক ফাঁকা গুলি ছুড়ল বিপ্লবী তরুণের দল। একে একে তিনবার।
একই সময়ে বিপ্লবের অন্য অধ্যায় শুরু হয়েছে অক্সিলিয়ারী ফোর্স আর্মারীতে। পুলিশ লাইনের মতো এখানে শুধুমাত্র মাস্কেট্রি রাইফেল বা রিভলভার নয়; মজুদ আছে থ্রি নট থ্রি আর্মি রাইফেল যা থেকে একসাথে দশটি গুলি ছোঁড়া যায়। আরো আছে অত্যাধুনিক লুইস মেশিনগান। ব্রিটিশ মিলিটারির সাথে টক্কর দিতে হলে এসব অস্ত্র চাই-ই চাই! তবে এ অস্ত্রাগারের দায়িত্ব মিলিটারির হাতে থাকায় কাজটা যে সহজ হবে না সেটা আগেই আন্দাজ করতে পেরেছিলেন বিপ্লবীরা। আর এজন্যই এ হামলার দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়েছে যুব বিদ্রোহের অন্যতম দুই নায়ক নির্মল সেন ও লোকনাথ বলের উপর। এখানেও একই কৌশল অবলম্বন করা হলো।
সামরিক পোশাকধারী লোকনাথ বলকে দেখে স্যালুট ঠুকল প্রহরী। সে স্যালুটের জবাব দিল লোকনাথ বলের আগ্নেয়াস্ত্র। আগ্নেয়াস্ত্রের আওয়াজ শেষ না হতেই চতুর্দিক থেকে সমবেত কণ্ঠের হুঙ্কার “ইনকিলাব জিন্দাবাদ”, “সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক”। কিন্তু পুলিশ লাইনের মতো এখানে সবাই পালিয়ে যায়নি।
প্রথমেই উদ্যত রিভলভার হাতে ছুটে এলেন সার্জেন্ট মেজর ফেরেল। সাথে সাথে স্তব্ধ করে দেয়া হল তাকে। মৃত্যুমুখে স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে মেজর ফেরেল বলেছিলেন “ডার্লিঙ রিঙ আপ দি পুলিশ স্টেশন”। কিন্তু কীভাবে টেলিফোন করবেন! টেলিফোন ভবন তো ততক্ষণে আগুনে পুড়ে ছাই।
বিপ্লবীদের এবার অস্ত্রাগার খোলার পালা। পরপর দুটি মজবুত লোহার দরজা। দরজা ভাঙতেই সেই একই দৃশ্য। শত শত রাইফেল, রিভলভার, লুইস গান! কিন্তু বিপ্লবীদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল যখন দেখল কোথাও কোনো কার্তুজ নেই। লুইস গান আর দশ শট ওয়ালা রাইফেলের জন্য প্রয়োজনীয় .৩০৩ বোরের কার্তুজ কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দুর্ভাগ্য তাদের! তারা জানতেন না যে, এ অস্ত্রাগারে অস্ত্র আর কার্তুজ একসাথে রাখা হয় না। এ কার্তুজ ছাড়া এখন সবই অচল। এ সময় বাঁধা আসল আবার। হতভম্ব হয়ে সেখানে হাজির হল সার্জেন্ট ব্ল্যাকবার্ন সহ তিন ইংরেজ অফিসার। তারা বুঝে উঠতে পারেননি কে এরা! চায়ই বা কি! আর বুঝে ওঠার আগেই প্রাণ দিতে হল তাদের। এভাবে অক্সিয়ালিরী আর্মারীতে অপারেশনে প্রাণ হারান মোট ছয় জন। সবাই বিপক্ষ দলের।
বিপ্লবীরা যতটা সম্ভব অস্ত্র সংগ্রহের পর জেনারেল লোকনাথ বলের আদেশ শোনা গেল “সেট দ্য আর্মারী অন ফায়ার”। দাউদাউ করে জ্বলে উঠল গোটা অস্ত্রাগার। সাথে সাথে সমবেত কণ্ঠের জয়ধ্বনি “ইনকিলাব জিন্দাবাদ”, “সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক”। এবার পুলিশ লাইনে ফেরার পালা। যেখানে আছেন মাস্টারদা সহ অন্য সকলে।
বিপ্লবীদের আরেকটি দল গিয়েছিল ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের জন্য। সামরিক বাহিনী ও সরকারের পদস্থ সব কর্মকর্তারা ছিল এ ক্লাবের সদস্য। বিপ্লবীদের উদ্দেশ্য ছিল এসকল ইউরোপিয়ানদের জিম্মি হিসেবে ব্যবহার করা, কিংবা কারো কারো মতে জালিয়ানওয়ালাবাগে ব্রিটিশদের করা নৃশংস হত্যার প্রতিশোধ নেয়া। নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেন, বীরেন দে সহ দুঃসাহসী সব বিপ্লবীরা ছিলেন এ অভিযানের দায়িত্বে। কিন্তু দিনটি ছিল গুড ফ্রাইডে, তাই ক্লাবের কোনো সদস্যই উপস্থিত ছিলেন না সেখানে। তথ্যটি জানা ছিল না বিপ্লবীদের। ব্যর্থ মনোরথে ফিরে এলেন তারা। সবগুলো দল এসে জড়ো হল পুলিশ লাইনে।
এ সময় মাস্টারদা জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন এবং অস্থায়ী সামরিক সরকার গঠন করেন। সর্বাধিনায়ক হিসেবে মাস্টারদাকে গার্ড অব অনার প্রদর্শন করা হয়। আবারো আকাশের দিকে মুখ করে গর্জে উঠে অর্ধ শতাধিক রাইফেল। সমবেত কণ্ঠে ঘোষিত হয় স্লোগান। নাইবা পাওয়া গেল লুইস গান বা .৩০৩ বোরের রাইফেল, তবুও সফল বিপ্লবের আনন্দে চনমনে সবাই। সফল হয়েছে এতদিন ধরে লালিত স্বপ্ন; অক্সিলিয়ারী আর্মারী, টেলিফোন ভবন বিধ্বস্ত, পুলিশ ব্যারাক দখলে বাহিরের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা; এখন কেবল ইম্পেরিয়াল ব্যাংক, জেলখানা ইত্যাদি দখল নেয়ার অপেক্ষা।
কিন্তু সবাইকে স্তব্ধ করে দিয়ে ভেসে আসল লুইস গানের আওয়াজ। ডাবল মুডিং জেটিতে বিদ্যমান একটি মাত্র লুইস গান নিয়ে শত্রুপক্ষ এত দ্রুত তৎপর হয়ে উঠবে ভাবেননি কেউই। পজিশন নিয়ে তারাও পাল্টা গুলি ছুড়তে লাগলেন। কিন্তু লুইস গানের বিপরীতে মাস্কেট্রি রাইফেল নিয়ে টেকা সম্ভব নয় ভেবে তারা পুলিশ লাইন ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। আগের মতো এক্ষেত্রেও অস্ত্রাগার পুড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
কিন্তু দুর্ঘটনার শিকার হন এ কাজের দায়িত্বে থাকা হিমাংশু সেন। ভবনে পেট্রোল ঢালার সময় কখন যে তার কাপড়ে আর গায়েও পেট্রোল ছিটকে পড়েছিল টেরই পাননি। আগুন লাগানোর সাথে সাথে আগুন জ্বলে উঠে তার শরীরেও। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতরাতে শুরু করেন হিমাংশু সেন। হিমাংশুর অবস্থা দেখে কোনোরকম পরামর্শ না নিয়েই প্রধান দুই সেনানায়ক গনেশ ঘোষ আর অনন্ত সিংহ তাকে মোটরগাড়িতে তুলে ছুটে যান শহরের দিকে। সাথে যান আনন্দ গুপ্ত ও জীবন ঘোষাল। কিন্তু দুর্ভাগ্য! এই যে তারা বিচ্ছিন্ন হলেন, শত চেষ্টা করেও আর মিলিত হতে পারেননি মূল দলের সাথে।
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর তাদের দেরী দেখে বিপ্লবীদের মনে সংশয় দানা বাঁধতে থাকে। তবে কি পুলিশ ও সামরিক বাহিনী এরই মধ্যে আবার সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে গেছে! এরা চারজন কি তবে ধরা পড়লেন! এসব সংশয়ে পড়ে তারা আত্মগোপনের সিদ্ধান্ত নেন। আরো দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো এরপর অনন্ত সিংহ ও গনেশ ঘোষ ফিরেও এসেছিলেন। কিন্তু ততক্ষণে সব ফাঁকা। দূর থেকে তাদের গাড়ির হেডলাইট বিপ্লবীদের নজর পড়েছিল। কিন্তু পুলিশের গাড়ি ভেবে কোনো সাড়া দেননি কেউ। এরপর অনিরাপদ ভেবে বিপ্লবীরা শহরের দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করেন। সামরিক বাহিনী যেকোনো সময় ঘিরে ধরতে পারে এই ভেবে ছাড়েন পুলিশ লাইনও। তারা পিছু হটতে থাকেন সুলুক বহর পাহাড়ের দিকে।
অথচ বাস্তব চিত্র ছিল তাদের ধারণার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। শহর তখনো সম্পূর্ণ অরক্ষিত। জেটিতে যে কয়জন লুইস গান দিয়ে হামলা চালাচ্ছিল তারাও পালাবে না আত্মসমর্পণ করবে এ নিয়ে সংশয়ে ভুগছিল। শহরে সৈন্য সমাগম ঘটেছিল আরো তিনদিন পর। আহার-নিদ্রা বিহীন এ তরুণ দলের সেই টিকে থাকার সংগ্রাম, জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধ সেসব কাহিনী আরো বীরত্বগাঁথায় পূর্ণ, আরো শিহরন জাগানিয়া। বস্তুত মাষ্টারদা সূর্যসেনের বিপ্লবী জীবনের প্রতিটি পর্বই ভীষণ রোমাঞ্চকর। সেসব গল্প আরেকদিন হবে। আজ ইতিহাসে ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ নামে খ্যাত সেই অবিস্মরণীয় বিপ্লবের কথা বলেই শেষ করা যাক।
সেদিন চট্টগ্রামের এ বিপ্লব হয়তো সম্পূর্ণ সফল হয়নি। কিন্তু এটি গোটা ব্রিটিশ রাজের ভিত্তিতে এক অবিশ্বাস্য রকমের নাড়া দিয়েছিল। সাহস যুগিয়েছিল আরো অগণিত বিপ্লবীকে, তাদের বিশ্বাস যুগিয়েছিল। চট্টগ্রাম পারলে আমরা কেন নয়! মাস্টারদা সূর্যসেন ও তার দল পেরেছেন, পারবো আমরাও। আর এ জন্যে সকল স্বাধীনতাকামী মানুষের হৃদয়ে আজো তাঁরা বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন সাহসিকতার প্রতীক হয়ে, বেঁচে আছেন বিপ্লবের প্রতীক হয়ে।