বাদশাহ বাবর: হিন্দুস্তানের পথে

বাদশাহ বাবর সবসময়ই হিন্দুস্তানের প্রতি এক বিশেষ আকর্ষণ অনুভব করতেন। ১৫০৪ সালে কাবুল জয়ের পর তিনি হিন্দুস্তানের নাম এতবার শোনেন যে, তিনি হিন্দুস্তান জয়ের বিশেষ ইচ্ছা পোষণ করতে থাকেন। কাবুলেই এসে তিনি জানতে পারেন, তাঁর পূর্বপুরুষ তাইমূরও এক সময় হিন্দুস্তান অধিকার করেছিলেন। হিন্দুস্তান জয়ের এই অদম্য ইচ্ছা বাবরকে অস্থির করে তুলতে থাকে। তিনি অবশেষে হিন্দুস্তানে অভিযান চালানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। তবে তখনো তাঁর হিন্দুস্তানে অভিযান চালানোর মতো উপযুক্ত কোনো সেনাবাহিনী ছিলো না, না ছিলো উপযুক্ত অস্ত্রশস্ত্র। এমনকি তখন পর্যন্ত তিনি সেনাবাহিনী নিয়ে হিন্দুস্তানের দিকে যাওয়ার মতো নিরাপদ কোনো পথের কথাও জানতেন না। কিন্তু ১৫০৫ সালে তিনি সেনাবাহিনী নিয়ে হিন্দুস্তানের দিকে বেরিয়ে পড়েন। এসময় তাঁর প্রস্তুতি কিংবা অভিযানের ধরন দেখে মনে হয় না তিনি আসলেই সে সময়ে হিন্দুস্তান জয়ের ব্যাপারে আশান্বিত ছিলেন। তাঁর অভিযানের ধরন দেখে বরং মনে হয় তিনি হিন্দুস্তান জয়ের সম্ভাবনা যাচাই করতে চাইছিলেন। কিন্তু সেনাবাহিনীকে সেকথা জানতে দেন নি।

বাদশাহ বাবর; Source: Wikimedia Commons

১৫০৫ সালে বাদশাহ বাবর সর্বপ্রথম তাঁর হিন্দুস্তান অভিযান পরিচালনা করেন। এ সময় তিনি কাবুল থেকে রওয়ানা দিয়ে বাদাম চাশমা আর জগদলিক হয়ে আদিনাপুরে পৌছান। আদিনাপুর থেকে কাবুল আর হিন্দুস্তানের সীমান্ত এলাকা নিংগনহরে পৌঁছান বাবর। এই এলাকাতে এসেই তিনি তাঁর জীবনের প্রথম কোনো হিন্দুস্তানী এলাকা দেখেন। তাঁর কাছে হিন্দুস্তান একটি নতুন আর ভিন্ন কোনো পৃথিবীর মতো মনে হচ্ছিলো। তিনি তাঁর আত্মজীবনী ‘বাবরনামা’-তে লিখেন,

‘লোকেদের (হিন্দুস্তানী) রীতি-রেওয়াজ আমার কাছে নতুন ছিলো। উপজাতিদের, যাযাবর শ্রেণির লোকদের দলগুলোর জীবনযাত্রার ঢং সম্পূর্ণ অন্যরকম ছিলো। প্রতি পদে পদে আমাকে বিস্মিত হতে হচ্ছিলো। প্রকৃত সত্য তো এই যে, ওখানকার ভূমিই ছিলো বিস্ময়কর।’

কাবুল থেকে রওয়ানা দেয়ার পূর্বেই বাবর তাঁর সৎ ভাই নাসির মির্জার নেতৃত্বে একটি অগ্রবর্তী বাহিনী পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এই অগ্রবর্তী বাহিনীর সাথে বাবরের আদিনাপুরে দেখা হলো। তিনি পুরো বাহিনী নিয়ে জুলশহল হয়ে কুশগম্বুজের পাহাড়ি উপত্যকায় পৌছান। একই সালে, অর্থাৎ ১৫০৫ সালেই বাবর খায়বার পার হয়ে জাম পাহাড় পাড়ি দেন। জাম পাহাড় পাড়ি দেয়ার পর বাবরের বাহিনীর সামনে যে স্থান পরে, তার নাম হলো বিলগ্রাম। হিন্দুস্তান আক্রমণের জন্য এই স্থান থেকেই সিন্ধু নদ পাড়ি দিতে হবে। কিন্তু বাবরের কাছে সিন্ধু নদ পাড়ি দেয়ার মতো উপযুক্ত প্রস্তুতি ছিলো না। তাই তিনি সিন্ধু নদ এড়িয়ে হিন্দুস্তানের মূল ভূখন্ডে যাওয়ার অন্য উপায় খুঁজছিলেন। তখন বাবরেই এক সেনাপতি জানালেন সিন্ধু এড়িয়ে হিন্দুস্তানে যাওয়ার রাস্তা তিনি জানেন। বাবরের এই সেনাপতির নাম ছিলো বকী ছগানিয়ানী। বকী ছগানিয়ানীর পথ অনুসরণ করতে হলে বাবরকে কোহাত হয়ে যেতে হবে।

বর্তমানে খাইবার পাস; Source: telchar.com

বাবর কোহাতে প্রবেশ করতে চাইলে তাঁকে বাঁধা দেয়া হলো। কোহাতের অধিবাসীরা এক্ষেত্রে এক ব্যতিক্রমধর্মী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলো। তারা বাবরের সেনাবাহিনীর অগ্রযাত্রার পথে অসংখ্য গবাদিপশু ছেড়ে দিয়েছিলো। বাবরের সেনাবাহিনী এবং কোহাতবাসী- দু’পক্ষই জানতো এই বাঁধা নিতান্তই মামুলী। সামান্য কিছুক্ষণের মাঝেই বাঁধাদানকারীদের বন্দী করা হলো। এর পরের ঘটনা ‘বাবরনামা’ থেকেই জেনে নেয়া যাক।

‘তাদের সবাইকে একত্রিত করা হলো (বন্দী করার পর)। তারা প্রাণভয়ে কাঁপছিল। আমি আমার প্রতি তাদের বিশ্বাস জন্মানোর জন্য বললাম, আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কোনো ক্ষতি করা হবে না। তাদের বিশ্বাস অর্জনের পর তারা আমার অধীনতা স্বীকার করে নিলো। আমি তাদের সবাইকে মুক্ত করে দিলাম।’

কোহাতে বাদশাহ বাবর দু’দিন অবস্থান করেছিলেন। কোহাতবাসী পরবর্তীতে বাবরের প্রতি তাদের বিশ্বস্ততা প্রদর্শন করেছিলো। কিন্তু যে কারণে বাবরের কোহাত জয় করা হলো, সেই উদ্দেশ্য পূরণ হলো না। কোহাত থেকে সিন্ধু নদ এড়িয়ে হিন্দুস্তানের মূল ভূখন্ডে যাওয়ার কোনো রাস্তা খুঁজে পাওয়া গেলো না।

কোহাতে বাদশাহ বাবর; Source: Wikimedia Commons

পরিস্থিতি বদলে যাওয়ায় বাবর তাঁর সেনাপতিদের জন্য সাথে আলোচনায় বসলেন পরবর্তীতে কী করণীয় তা নির্ধারণ করতে। আলোচনা সভায় বংগাশ আফগান নয়তো বননু আক্রমণের প্রস্তাব উঠলো। এসব অঞ্চল তখনো বাবরের আনুগত্য স্বীকার করে নি। বাবর ইয়ার হুসাইনের নেতৃত্বে একটি সেনাবাহিনীকে সিন্ধু এড়িয়ে হিন্দুস্তানে যাওয়ার নিরাপদ রাস্তা খোঁজার দায়িত্ব দিয়ে মূল সেনাবাহিনী নিয়ে বংগাশের দিকে অগ্রযাত্রা করলেন।

বাবর কোহাত আর হংগুর পাহাড়ি উপত্যকার উঁচু পাহাড় ঘেড়া রাস্তা দিয়ে বংগাশের দিকে চলতে লাগলেন। পথে স্থানীয় আফগানরা বাবরের চলাচলের রাস্তায় বাঁধা সৃষ্টি করতে চাইলে খুব সহজেই তাদের দমন করা হয়। তবে কিছু উদ্ধত স্থানীয় উপজাতির লোকেরা হিংস্র হয়ে বাবরের সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করলে এখানে কিছু আফগানদের হত্যা করা হয়। এরপরই সব শান্ত হয়ে যায়। তবে আফগানরা বাবরের প্রতি এমনভাবে আনুগত্য স্বীকার করলো, যার জন্য তিনি নিজেও প্রস্তুত ছিলেন না। চলুন বাবরের জবানীতেই জেনে নেয়া যাক,

‘তারপর এক বিস্ময়কর দৃশ্য সামনে এলো। এ দৃশ্য বিস্ময়কর হওয়ার সাথে সাথে কৌতুহলজনকও ছিলো। তা ছিলো সমস্ত আফগানের দল পঙ্গপালের মতো মাটিতে শুয়ে পড়লো। তারা তাদের মুখ ঘাসের সাথে রগড়াচ্ছিলো আর কিছু ঘাস দাঁত দিয়ে কেটে কেটে খাচ্ছিলো।’

হংগুর পাহাড়ি এলাকা। বর্তমানে এ এলাকাটি পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত; Source: zindapakistan.com

বাবর এই এলাকায় তাঁর পথপ্রদর্শক মালিক বুদাশকে তাদের এমন কাজ করার কারণ জানতে চাইলে মালি বুদাশ উত্তর দেন, এটাই আফগান উপজাতিদের ঐতিহ্যবাহী রীতি। তারা যদি কারো বিরোধীতা ত্যাগের ব্যাপারে একমত হয়, তখন এভাবে মুখ দিয়ে ঘাস কেটে খেয়ে আত্মসমর্পণ ও আনুগত্যের ঘোষণা দেয়। এর প্রতিকী অর্থ হলো, তারা আজ থেকে আপনার গরু। আপনি তাদের সামনে যেমন ইচ্ছা তেমন আচরণ করতে পারবেন! বাবর আফগান উপজাতির লোকেদের এমন রীতিতে বেশ অবাক হয়েছিলেন।

এরপর মালিক বুদাশের পরামর্শে নিহত আফগানদের কাঁটা মাথা দিয়ে ছোট স্তম্ভ তৈরি করা হয়। পাহাড়ি রীতিনীতির সাথে অভ্যস্ত মালিক বুদাশ জানতেন, এর ফলে বাবরের এই স্থান ত্যাগের পরেও তারা বাবরের অনুগত হয়ে থাকবে।

বাবর দ্রুতই এই এলাকা ত্যাগ করে সামনে এগোতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু স্থানীয় আফগানদের প্রতিরোধের কারণে তা অসম্ভব হয়ে উঠছিলো। বাবর মনেপ্রাণে চাইছিলেন কোনো প্রকার রক্তপাত এড়িয়ে সামনে এগিয়ে যেতে। কিন্তু স্থানীয় প্রতিরোধের কারণে তা সম্ভব হচ্ছিলো না। বাবরের হংগু যাওয়ার পথে বাবরের সেনাবাহিনীকে বাঁধা দিতে যেয়ে আরো ১৫০/২০০ স্থানীয় আফগান সৈনিক নিহত হলো। তাদের কাটা মাথা দিয়ে এখানেও একটি ছোট্ট স্তুপ তৈরি করা হয়। এর পরপরই বিদ্রোহীরা বাবরের আনুগত্য স্বীকার করে।

হংগুতে পৌছে বাবর এক রাত সেখানে অবস্থান করেন। এরপর তিনি থাই হয়ে বংগাশের দিকে এগুতে লাগলেন। বাবরের সেনাবাহিনীর চলাচলের রাস্তা মোটেও মসৃণ ছিলো। যাত্রাপথের প্রায় পুরোটাই এবড়ো থেবড়ো পাহাড় আর উপত্যকা পাড়ি দিতে হয়েছিলো তাঁকে।

বাবরের বাহিনী বননুর পাহাড়ি এলাকা পাড়ি দেয়ার সময় আবারো স্থানীয় বিদ্রোহীদের মুখোমুখি হন। তাদের দমন করতে বাবর জাহাঙ্গীর মির্জার নেতৃত্বে একটি বাহিনী সামনে পাঠিয়ে দেন। বিদ্রোহীরা খুব সহজেই ঠান্ডা হয়ে যায়। এখানেও ছিন্ন মস্তকের একটি স্তুপ তৈরি করা হয়। ছিন্ন মস্তকের স্তুপের কথা শুনে একটু নির্মম মনে হলেও সেই প্রেক্ষাপটে আর কিছুই করার ছিলো না। পাহাড়ি উপজাতির দুর্ধর্ষ যোদ্ধারা শুধুমাত্র এভাবেই ঠান্ডা হতো তখন।

বননু শহরের বর্তমান একটি দৃশ্য; Source: pk.geoview.info

বাবর বননুর এলাকা ত্যাগ করে যখন আবার সামনে অগ্রযাত্রা শুরু করলেন তখন তাঁর সাথে একটি হিন্দুস্তান থেকে আগত আফগান ব্যবসায়ীর দলের সাথে দেখা হলো। এই কাফেলার সরদার খ্বাজা খিজির সুহন্দ বাদশাহ বাবরের পূর্বপরিচিত ছিলেন। বাবর তার কাছে সিন্ধু এড়িয়ে হিন্দুস্তানে যাওয়ার পথ জানতে চাইলে তিনি জবাব দেন এই সময় তা সম্ভব না। ‘বাবরনামা’-র বর্ননানুসারে,

‘তাঁর হিঁদুস্তান (হিন্দুস্তান) যাত্রার বিবরণ থেকে যে তথ্য আমি জানলাম তা হলো, তিনি সঠিক সময়ে হিঁদুস্তান থেকে ফিরে এসেছেন এবং আমি ভুল মৌসুমে সে পথে যাত্রা করেছি। তাঁর দেওয়া তথ্যানুসারে নদী না পেরিয়ে এখন হিঁদুস্তানে যাওয়া অসম্ভব। তিনি যখন এসেছিলেন, তখন নদী শুকনো ছিলো। আর আমি যখন যাবো তখন আমাকে বিক্ষুব্ধ নদী পাড়ি দিতে হবে।’

খ্বাজা সুহন্দের তথ্য যাচাইয়ের পর বাবর বুঝতে পারলেন এবারের মতো তাঁকে হিন্দুস্তান অভিযানের পরিকল্পনা ত্যাগ করতে হবে। তিনি কাবুল ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।

বাবরের কাবুলে ফিরে আসার পর বেশ কিছু ঘটনা ঘটলো। বাবর তাঁর কাছে পরাজিত সেই বিদ্রোহী পাহাড়ি উপজাতি সরদারদের উচ্চ মর্যাদা প্রদান করে তাদের সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে নিলেন। এতে তাদের আবার বিদ্রোহ করার কোনো ন্যূনতম সুযোগও তিনি আর রাখলেন না।

১৫০৬ সালের জুন মাসের দিকে বাবর হেরাতের শাসক বাইকারা বংশের হুসাইন মির্জার সাথে একটি চুক্তি করে একত্রে উজবেক শাসক শায়বানী খানের উপর আক্রমণ চালানোর জন্য কাবুল ত্যাগ করেন। কিন্তু কাবুল ত্যাগের কয়েকদিন পরেই তিনি হুসাইন মির্জার মৃত্যুসংবাদ শুনতে পান। হুসাইন মির্জার মৃত্যুর পর তাঁর দুই পুত্র যৌথভাবে পিতার সিংহাসনের উত্তরাধীকারী হন। কিন্তু তারা তাদের পিতার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন ছিলেন না। কাজেই বাবরের শায়বানী খানের উপর আক্রমণ চালানোর ইচ্ছা পরিপূর্ণ হলো না। তিনি কাবুল ফিরে আসেন।

হেরাতের ‘হেরাত মজজিদ’, আফগানিস্তান; Source: beautifulglobal.com

এর কিছুদিন পরেই হেরাতে শায়বানী খান আক্রমণ চালান। এই আক্রমণে হুসাইন মির্জার দুই পুত্রই মৃত্যুবরণ করেন।

১৫০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাস। এই সময়ে বাবর আবারো হিন্দুস্তানের দিকে নিজের মনোযোগ দেন। তিনি কাবুল থেকে সড়কপথে সুর্খ-রবাত হয়ে কুরসাল এলাকায় গিয়ে পৌছান। কাবুল থেকে লাঘমানের এলাকায় যাওয়ার সময়ে বাবর আবারো পাহাড়ি উপজাতির লোকদের দ্বারা বাধাগ্রস্থ হলেন। এসব পাহাড়ি উপজাতির লোকেরা এই এলাকা দিয়ে যাতায়াতকারী পথিক বা বাণিজ্যিক কাফেলার উপর আক্রমণ চালিয়ে লুন্ঠন আর হত্যাকান্ড চালাতো। বাবর তাই শুধু তাদের দমন করেই ছেড়ে দিলেন না, বরং তাদের উচ্ছেদ করে এলাকাগুলো পর্যন্ত খালি করার আদেশ দিলেন। তাদের উচ্ছেদের পর তারা যেন পুনরায় এখানে ফিরে আসতে না পারে, সেকারণে তিনি কয়েকদিন এই এলাকায় অবস্থান করলেন।

লাঘমানের পাহাড়ি এলাকা। লাঘমান বর্তমান আফগানিস্তানের অন্তর্ভূক্ত; Source: Wikimedia Commons

লাঘমানের এলাকায় বাবরের কাজের সমাপ্তির পর তিনি মিল কাফির এলাকায় এসে পৌঁছানোর পর বাবর কাবুল থেকে তাঁর গুপ্তচরদের মাধ্যমে কিছু খবর পান। বাবরের কাবুলে অনুপস্থিতির সুযোগে শায়বানী খান সেখানে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করছিলেন। বাবর আর দেরি না করে দ্বিতীয়বারের মতো হিন্দুস্তান অভিযানের পরিকল্পনা বাতিল করে কাবুলে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি পাশাগড়ের মোল্লা বাবার নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর বড় একটা অংশকে কাবুলে পাঠিয়ে দেন। আর নিজের সাথে থাকা সেনাবাহিনীর অপর অংশ নিয়ে মন্দখার, শেলাব আর অতার এলাকার দিকে রওয়ানা দেন। এসব অঞ্চল থেকে ছোটখাট কিছু বিদ্রোহের খবর পাওয়া যাচ্ছিলো। কাবুলে যদি সত্যিই সমস্যা জট পাকাতে থাকে, তাহলে সব দিক থেকেই বাবরকে নিরাপদ অবস্থানে যেতে হবে। তিনি পেছনে কোনো বিদ্রোহের সম্ভাবনা রেখে যেতে চান না।

১৫০৯ সালের ডিসেম্বর মাস। বাবর মির্জা খান বেগের নিকট থেকে একটি পত্র পেলেন। তাতে স্পষ্ট করে লেখা ছিলো, পারস্যের শাহ ইসমাইলের নিকট যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বাবরের চিরশত্রু শায়বানী খান মারা গিয়েছেন! এই পত্রের আগেও বাবরের কাছে আরেকটি পত্র এসেছিলো, তাতে লেখা ছিলো পরাজয়ের পর শায়বানী খানের মাথা শাহ ইসমাইল ধড় থেকে আলাদা করে ফেলেছে। শায়বানী খানের মৃত্যুতে বাবর খুশি হয়েছিলেন নিশ্চয়ই। কিন্তু সেই সাথে তিনি কিছুটা হতাশও হয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে নিজের আত্মজীবনী ‘বাবরনামা’-তে তিনি লিখেছেন,

‘খবর নিঃসন্দেহে অপুষ্ট ছিলো, তবে তা আমার আকাঙ্ক্ষার অপূর্ণকারী ছিলো। আমি নিজে বহুকাল ধরে শায়বানীর সঙ্গে সামনা-সামনি মোকাবিলার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে আসছিলাম। যদি শাহ ইসমাইলের হাতে শায়বানীর মৃত্যু হয়, তাহলে আমার অংশে বদলা নেয়ার জায়গাটা আর কোথায় অবশিষ্ট রইলো?’

মির্জা খান বেগের পাঠানো পত্রে আরো কিছু ব্যাপার উল্লেখ করা ছিলো। ‘বাবরনামা’ থেকে সরাসরিই তা উল্লেখ করা যাক,

‘উজবেকদের মধ্যে ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেছে। তারা সবাই আমু এলাকা সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করে চলে গেছে। আমু-র, তা সে উজবেক নেতা হোক কিংবা সাধারণ মানুষ হোক, তারা আমুর সাথে সাথে কুন্দুজ ছেড়েও পালিয়ে যাচ্ছে। প্রায় ২০,০০০ সৈন্য মরগুয়া থেকে কুন্দুজ এলাকা পর্যন্ত উজবেক শূন্য করে তুলছে।’

মির্জা খান বেগের পরবর্তী পত্রটি ছিলো আরো চমকপ্রদ। পারস্যের শাহ ইসমাইল বাবরকে তাঁর সাথে দেখা করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন! শাহ ইসমাইল আরো জানিয়েছেন, তিনি বাবরকে নিজের পূর্বপুরুষের ভূমি পুনরুদ্ধার করার জন্য সামরিক সহযোগীতা প্রদান করবেন।

বাদশাহ বাবরের চিরশত্রু উজবেক শায়বানী খান; Source: Wikimedia Commons

বাবর দ্রুত কুন্দুজ পৌঁছে যান। কুন্দুজ পৌছে তিনি তাঁর চাচা মাহমুদ মির্জার পরাজয়ের খবর পান। মাহমুদ মির্জা খোরাসানে আত্মগোপন করে ছিলেন তখন। শাহ ইসমাইলের সাথে লড়াইয়ের পূর্বে কোনো এক যুদ্ধে শায়বানী খান তাকে অকশায় পরাজিত করেছিলো। এইসময় বাবর তাঁর বেশ কিছু সৈন্যের খবর পান যারা বিভিন্ন যুদ্ধে শায়বানী খানের হাতে বন্দী হয়েছিলো। শায়বানীর মৃত্যুর পর এসব যোদ্ধারা মুক্তি লাভ করেন। সংখ্যার দিক দিয়ে তারা প্রায় ২০,০০০ জন!

বাবর মাত্র ৫,০০০ যোদ্ধা নিয়ে কুন্দুজ এলাকায় গিয়েছিলেন। এই ২০,০০০ যোদ্ধা তাঁর বাহিনীতে পুনরায় যোগ দেয়ায় কুন্দুজে বাবরের সৈন্য সংখ্যা ২৫,০০০ এ গিয়ে দাঁড়ায়! বাবর দ্রুত কুন্দুজ অতিক্রম করে হিসারে পৌঁছানোর জন্য যাত্রা করলেন। এই এলাকা তখনও উজবেক সুলতান মেহেদি ও হামজার অধীনে ছিলো। বাবরের হিসার যাত্রার খবর শুনেই তারা যা বোঝার বুঝে নিলেন। তারা হিসার থেকে বাইরে এসে বাবরের আনুগত্য স্বীকার করে নিলেন। হিসার দখলের কিছুদিন পরেই বাবর বুখারা দখল করে নেন।

পারস্যের শাহ ইসমাইল বাবরকে সামরিক সহায়তার কথা বলেছিলেন। তবে সেটা অবশ্য শুধু মুখের কথাই না। তিনি আক্ষরিক অর্থেই বাবরকে সামরিক সাহায্য দিয়েছিলেন। এই সাহায্য যে তিনি বাবরের প্রতি ভালোবাসার কারণে বিনাস্বার্থে দিয়েছেন তা কিন্তু না। আসলে সেই সময় শিয়া মতালম্বী পারস্যের সাথে উসমানী খিলাফতের (অটোমান সাম্রাজ্য) অবিরাম যুদ্ধ চলছিলো। যুদ্ধে শিয়াদের অবস্থান ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছিলো। তাই শিয়া শাহ ইসমাইল চাচ্ছিলেন মধ্য এশিয়ায় তাঁর স্থায়ী একজন মিত্র তৈরি করে নিতে, যাতে বিপদের সময় তিনি সহযোগীতা পেতে পারেন। অন্তত এই অবস্থার উদ্ভব যেন না হয় যে, উসমানী খলিফা নিজেই বাবরের সাথে সম্পোর্কোন্নয়ন করে ফেলেন। এতে পারস্য দু’দিক থেকে চাপে পড়ে যাবে। শাহ ইসমাইল আসলে এক দূরদর্শী চাল দিয়েছিলেন। বাবর হয়তো শাহ ইসমাইলের পরিকল্পনা বোঝেন নি, নয়তো তিনি সমরকন্দের স্বপ্নে আক্ষরিক অর্থেই বিভোর ছিলেন। কারণ ১৫১১ সালে তিনি পারস্যের বাহিনীর সহায়তায় আবারো সমরকন্দের দখল করে নেন। কিন্তু সমরকন্দবাসী এবার আর বাবরকে ভালো চোখে দেখেননি। সমরকন্দবাসী তাদের শত্রুর প্রতিও আনুগত্য স্বীকার করতে পারে, কিন্তু শিয়াদের প্রতি আনুগত্য! অসম্ভব!

পারস্যের শাহ ইসমাইলের একটি ছবি; Source: azernews.az

বাদশাহ বাবর অবশ্যই শিয়া মতালম্বী ছিলেন না। তিনি ইসলামের বিশুদ্ধ চিন্তাধারায় বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু যেহেতু তিনি শিয়াদের সহায়তা নিয়েছেন, কাজেই পারস্যের শাহ অবশ্যই শিয়া মত সমরকন্দে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করবেন, এই ভয়েই সমরকন্দবাসী বাবরকে প্রত্যাখ্যান করেছিলো। সমরকন্দবাসীর এই ভয় অমূলক ছিলো না।

পারস্যের শাহের সহায়তা নেয়া যে বাবরের জন্য বিরাট এক ভুল ছিলো, বাবর তৃতীয়বার সমরকন্দ দখলের দুই বছর পর তা হাড়ে হাড়ে টের পান। ১৫১৩ সালের এপ্রিল মে মাসের দিকে উবাইদ খাঁ বা উবাইদুল্লাহ নামক একজন উজবেক নেতার কাছে তাকে পরাজয় বরণ করতে হয়। এ যুদ্ধে বাবরের পরাজয় প্রসঙ্গে খ্বান্দ আমীয় উল্লেখ করেছেন, এ যুদ্ধে বাবরের সেনাসংখ্যা ছিলো প্রায় ৪০,০০০ আর উবাইদ খাঁ-র বাহিনীতে মাত্র ৩,০০০ সৈন্য ছিলো। কিন্তু মুহাম্মদ মজিদ তুরখান এ যুদ্ধে বাবরের সৈন্যসংখ্যা মাত্র ৫০০ জন উল্লেখ করেছেন। আর এই দ্বিতীয় মতটিই বেশি গ্রহণযোগ্য।

বাবর হয়তো মাত্র ৫০০ সৈন্য দিয়ে একটি বীরোচিত জয় অর্জন করে সমরকন্দবাসীদের এটা বলে আশ্বস্ত করতে চেয়েছিলেন যে, পারস্যের সহায়তা শুধুমাত্র শহরটিকে দখল করার জন্য প্রয়োজন ছিলো। এখন আর সমরকন্দে পারস্য বাহিনী বা পারস্যের সহায়তার কোন প্রয়োজন নেই। কিন্তু তিনি সেই সুযোগও পেলেন না। সমরকন্দবাসী তাকে চিরদিনের জন্য প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা যুদ্ধে বাবরকে কোনো সহায়তাই করে নি।

এ পরাজয়ের পর বাবর বেশ ভালোই বুঝতে পারেন, সমরকন্দের দরজা তাঁর জন্য চিরজীবনের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি সমরকন্দ ত্যাগ করে হিসারের দিকে অগ্রযাত্রা করলেন। বাবরের সমরকন্দ ত্যাগের কিছুদিন পরেই সমরকন্দবাসী উজবেকদের আনুগত্য স্বীকার করে। বাবরের আবেগের সাথে জড়িত সমরকন্দ আজও আধুনিক উজবেকিস্তানের একটি অংশ হিসেবে টিকে আছে!

হিসার আর কুন্দুজে কিছুদিন অবস্থান করে বাবর অবশেষে ১৫১৪ সালের শেষের দিকে কাবুলে ফিরে আসতে সক্ষম হন। ১৫১৯ সালের ফেব্রুয়ারির দিকে বাবর আবারো হিন্দুস্তানের দিকে তাঁর সমস্ত মনোযোগ নিবন্ধ করেন।

তথ্যসূত্র

১। বাবরনামা- জহির উদ দিন মুহাম্মদ বাবুর (অনুবাদ: মুহাম্মদ জালালউদ্দীন বিশ্বাস)

২। হুমায়ুননামা- মূল গুলবদন বেগম (অনুবাদ: এ কে এম শাহনাওয়াজ)

৩। মোগল সাম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায়- সাহাদত হোসেন খান

এই সিরিজের আগের পর্বসমূহ

১। প্রাক-মুঘল যুগে হিন্দুস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা

২। তরাইনের যুদ্ধ: হিন্দুস্তানের ইতিহাস পাল্টে দেওয়া দুই যুদ্ধ

৩। দিল্লী সালতানাতের ইতিকথা: দাস শাসনামল

৪। রাজিয়া সুলতানা: ভারতবর্ষের প্রথম নারী শাসক

৫। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: খিলজী শাসনামল

৬। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: তুঘলক শাসনামল

৭। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: তৈমুরের হিন্দুস্তান আক্রমণ ও সৈয়দ রাজবংশের শাসন

৮। দিল্লী সালতানাতের ইতিকথা: লোদী সাম্রাজ্য

৯। রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর গঠন এবং গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস

১০। রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত কিছু অস্ত্রশস্ত্র

১১। জহির উদ-দিন মুহাম্মদ বাবুর: ‘একজন’ বাঘের উত্থান

১২। বাদশাহ বাবরের কাবুলের দিনগুলো

ফিচার ইমেজ: vintagehandmadeleatherbags.com

Related Articles

Exit mobile version