অ্যালকোহলে বিষপ্রয়োগ: মার্কিন সরকারের এক ব্যর্থ ও নির্মম পদক্ষেপ

তারা কারও সাথে দেখা করলে পান করে, কোনো কিছুতে অংশগ্রহণ করলে পান করে। আলাপচারিতায় যখন কোনো অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে, তখনও তারা পান করে। বাজারে পণ্য দামাদামির পর যখন মনমতো পণ্য হাতে পায়, তখনও পান করে। ঝগড়ার পর স্বাভাবিক হতে তারা পান করে। আবহাওয়া উষ্ণ থাকলেও তারা পান করে, আবহাওয়া শীতল থাকলেও তারা পান করে। নির্বাচনে জেতার পর আনন্দ-উল্লাস করার সময় তারা পান করে। তাদের সকালের শুরুটা হয় পানের মধ্য দিয়ে, ঘুমানোর আগে তারা পান করে ঘুমায়। জীবনের একেবারে প্রথমদিকে তারা পান করার অভ্যাস গড়ে তোলে, যেটি চলতে থাকে মৃত্যুর আগপর্যন্ত।

উপরের কথাগুলো ‘অ্যা ডায়েরি ইন আমেরিকা’ বইয়ের কথা। বইটির লেখক ব্রিটিশ পর্যটক ফ্রেডেরিক মেরিয়েতের, যিনি আমেরিকা ভ্রমণের পর তাদের মাত্রাতিরিক্ত পানাসক্তি দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি আরও বলেছিলেন, “অ্যালকোহল পান করার আগে তারা কোনো কাজ করতে পারে না।

হচজআপবকআ
আমেরিকানদের অ্যালকোহল আসক্তি নিয়ে নতুন কিছু বলবার নেই; image source: sunshinetodaytt.com

পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই বৈধ উপায়ে হোক কিংবা অবৈধ উপায়ে, অ্যালকোহল পান করা হয়। কিন্তু আমেরিকায় এত বেশি পরিমাণে পান করা হতো যে, সেটি বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করেছিল। আমেরিকায় যখন শিল্পবিপ্লব চলছিল, তখন প্রতি সপ্তাহের সোমবারে শ্রমিকদের একটি বড় অংশ কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকত। এর কারণ ছিল রোববার সপ্তাহান্তে তারা রাতের বেলা এত বেশি অ্যালকোহল পান করত যে, মঙ্গলবার পর্যন্ত তারা মদের নেশায় চুর হয়ে থাকত। এভাবে শিল্পকারখানাগুলোতে উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটত। এই ধরনের সমস্যা তো ছিলই, এর পাশাপাশি মাত্রাতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবনের জন্য অসংখ্য সামাজিক সমস্যাও তৈরি হয়েছিল। একজন ব্যক্তি যা আয় করত, তার একটি বড় অংশ ব্যয় হয়ে যেত অ্যালকোহলের পেছনে। ফলে স্ত্রী-সন্তানদের অনেক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার পয়সা জুটত না। শুধু তা-ই নয়, অনেক স্বামী মাতাল অবস্থায় ঘরে ফিরে স্ত্রীকে নির্যাতন করত। আমেরিকায় সর্বপ্রথম অ্যালকোহলবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন নারীরা।

অতিরিক্ত অ্যালকোহল-আসক্তি মার্কিন প্রশাসনের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তারা উপায় খুঁজতে থাকে, কীভাবে এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। কিন্তু কার্যকর সমাধান হাতে ছিল না বললেই চলে। শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, এমন আইন প্রণয়ন করা হবে, যার মাধ্যমে পানযোগ্য অ্যালকোহলের উৎপাদন, বিক্রয় কিংবা পান সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হবে। ১৯১৯ সালে ৬৬ তম কংগ্রেসে মার্কিন আইনসভায় এই প্রস্তাব তোলা হয়। প্রস্তাবটি বিপুল সমর্থন পেয়ে আইনসভায় পাশ হয়। মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের জুডিসিয়াল চেয়ারম্যান অ্যান্ড্রু ভোলস্টিডের নামানুসারে এই আইনের নাম দেয়া হয় ‘দ্য ভোলস্টিড অ্যাক্ট’। আইনের মাধ্যমে ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতীত অন্য সকল প্রকার অ্যালকোহল পান নিষিদ্ধ করা হয়। কোরাইজা, ফ্যারিনজাইটিস কিংবা ‘লা গ্রিপ্পি’ রোগের চিকিৎসার জন্য অল্প পরিমাণ ‘মেডিক্যাল অ্যালকোহল’-এর প্রয়োজন হতো। তবে এ ধরনের অ্যালকোহলও নিরুৎসাহিত করার জন্য দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল।

িতজচজআজআ
অতীতে মার্কিন শ্রমিকেরা সোমবার কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকত। কারণ, রবিবারের মদের নেশার ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারত না তারা; image source: historycrunch.com

মার্কিন সরকারের এই আইন প্রণয়নের পর দেশটিতে পানযোগ্য অ্যালকোহল উৎপাদন, বন্টন, বিক্রি কিংবা বহনের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। কিন্তু পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে অবৈধভাবে সীমান্ত দিয়ে অ্যালকোহল পাচার হতে শুরু করেছিল। আমেরিকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বোচ্চ চেষ্টা করছিল যাতে এসব অবৈধ অ্যালকোহল জনগণের হাতে পৌঁছাতে না পারে। বিভিন্ন অভিযানে অনেকবার বিপুল পরিমাণ চোরাই অ্যালকোহল জব্দ করে মার্কিন নিরাপত্তারক্ষীরা। তবে বাইরের দেশ থেকে চোরাই পথে আসা পানযোগ্য অ্যালকোহলের দাম তৎকালীন মার্কিন সমাজের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী খুব বেশি ছিল। ফলে মার্কিন সমাজের উঁচু শ্রেণীর ধনী ব্যক্তিরা ছাড়া কেউই চোরাই অ্যালকোহল পানের সামর্থ রাখত না। কিন্তু সমাজের অ্যালকোহন পানকারী জনসংখ্যার এক বড় অংশ ছিল নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর, যাদের বেশি দাম দিয়ে অ্যালকোহল পানের সামর্থ্য ছিল না। তাহলে তাদের ক্ষেত্রে কী হয়েছিল?

আমেরিকার অসংখ্য শিল্পকারখানায় ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যালকোহল’ ব্যবহার করা হতো। মূলত বিভিন্ন রাসায়িক কারখানায় দ্রবণে ও অনেকক্ষেত্রে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ পরিষ্কার করার জন্য কিংবা সুগন্ধি উৎপাদনে তরল অ্যালকোহল প্রয়োগ করা হতো। এসব এ্যালকোহলে এমন কিছু উপাদান (মূলত মিথাইল) যোগ করা হতো, যেগুলো মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এতটাই ক্ষতিকর যে, মানবদেহে এসব উপাদান যদি প্রবেশ করে কোনোভাবে, তাহলে ভুক্তভোগীর স্নায়ুতন্ত্রে গুরুতর সমস্যা দেখা দেবে, ভুক্তভোগী ব্যক্তি অন্ধ কিংবা পঙ্গু হয়ে যেতে পারে, আরও বেশি পরিমাণে প্রবেশ করলে মারা যাওয়া অবশ্যম্ভাবী। তবে ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যালকোহল’-এ যদি খুব কম পরিমাণ মিথানল ও অন্যান্য ক্ষতিকারক উপাদান মিশ্রিত থাকে, তাহলে যথাযথ পরিশোধনের মাধ্যমে সেই অ্যালকোহল পানের উপযোগী করা সম্ভব। কিন্তু এটি বেশ জটিল, একটু ভুলেই সমস্ত প্রক্রিয়া নস্যাৎ হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা আছে।

হতপগপগপগ
‘দ্য ভোলস্টিড অ্যাক্ট’ এর বিরুদ্ধে মার্কিনিদের আন্দোলন; image source: curious.com

নিম্ন এবং মধ্যবিত্ত অ্যালকোহল পানকারীদের বিশাল চাহিদার কথা চিন্তা করে অবৈধ অ্যালকোহল ব্যবসায়ীরা ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যালকোহল’ সংগ্রহ করত, এরপর নিজেরাই গোপনে পরিশোধনের চেষ্টা চালাত। মূলত এই অবৈধ ব্যবসায়ীদের বিজ্ঞান বিষয়ক জ্ঞান খুব বেশি ছিল না, তাই তাদের পরিশোধন প্রক্রিয়া ছিল ত্রুটিপূর্ণ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যালকোহল নিজেদের মতো করে নামেমাত্র পরিশোধন করে এরপর সেই অ্যালকোহল ‘হুইস্কি’ নাম দিয়ে অবৈধভাবে বিক্রি করত। এই অ্যালকোহলের দাম ছিল পাচারকৃত অ্যালকোহলের তুলনায় অনেক কম। সমাজের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ অনায়াসে এসব কিনে নিজেদের নেশার জগতে হারিয়ে যেতে পারত। কিন্তু তাদের ধারণাও ছিল না, নিজেদের অজান্তেই তারা বিষপান করছে। ১৯২০ সালের দিকেই অসংখ্য মানুষ অজানা কারণে মৃত্যুবরণ করতে শুরু করে।

মার্কিন সরকার লক্ষ্য করে, আইন করে নিষিদ্ধ করার পরও মার্কিন জনগণ ঠিকই অ্যালকোহল পান করছে। তারা দেখতে পায়, মূলত ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যালকোহল পরিশোধন করে পানের মাধ্যমে জনগণ নিজেদের চাহিদা মেটাচ্ছে। এরপর সরকার ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যালকোহল পান থেকে জনগণকে বিরত রাখতে একটি ‘নির্মম’ সিদ্ধান্ত নেয়। তারা গোপনে সমস্ত শিল্পকারখানাকে নির্দেশ দেয়, যেন পূর্বের তুলনায় আরও বেশি করে বিষাক্ত উপাদান মেশানো হয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যালকোহলে। শিল্পকারখানাগুলো সরকারের নির্দেশানুযায়ী গোপনে আরও বেশি পরিমাণে মিথানল মিশিয়ে দেয় তাদের ব্যবহারযোগ্য অ্যালকোহলে। মার্কিন সরকারের পরিকল্পনা ছিল, আরও বেশি করে মিথানল মেশানোয় এখন আর পরিশোধনের মাধ্যমেও ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যালকোহল পানের উপযোগী করা সম্ভব হবে না। ফলে কেউ যদি না জেনে এই অ্যালকোহল পান করে, তবে সে হয় মারা যাবে, নয়তো গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়বে। এভাবে কিছু মানুষ যদি পানের পর মারা যায় কিংবা গুরুতর অসুস্থ হয়ে যায়, তাহলে বাকিরা সতর্ক হয়ে যাবে, অ্যালকোহল পান থেকে বিরত থাকবে।

সরকারের এই সিদ্ধান্ত ছিল একইসাথে ভুল এবং নির্মম। সরকার জানত, এই সিদ্ধান্তের কারণে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারাবে। অবৈধ ব্যবসায়ীরা পরিশোধনের মাধ্যমে এই অ্যালকোহল বিষাক্ত হওয়ার পরও ‘পানের উপযোগী’ বলে চালিয়ে দেয়, ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে। ক্রেতারাও নিরুপায় হয়ে এই বিষাক্ত অ্যালকোহল কিনে নেয়। এরপর পানের পর পানকারীরা গণহারে অসুস্থ হতে শুরু করে। ১৯২৬ সালে বছরের প্রথম রাত উদযাপন করতে গিয়ে অসংখ্য পানকারী বিষাক্ত অ্যালকোহলের আশ্রয় নেয়, এরপর গণহারে মারা যেতে শুরু করে। নিউ ইয়র্কসহ অন্যান্য বিভিন্ন শহরের হাসপাতাল রোগীতে ভরে যায়। মার্কিন সরকারের এই সিদ্ধান্তের কারণে আনুমানিক দশ হাজার নাগরিক মৃত্যুবরণ করে। অবশেষে ১৯৩৩ সালে বিশাল সমালোচনার মুখে মার্কিন সরকার ‘দ্য ভোলস্টিড অ্যাক্ট’-এ পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়। অ্যালকোহল পানের বৈধতা ফিরিয়ে দেয়া হয়।

গচজপবককব
নিষিদ্ধ করার পরও অ্যালকোহল পান থেমে ছিল না; image source: vox.com

আমেরিকার সরকার অ্যালকোহলে বিষাক্ত উপাদান মিশ্রণের সিদ্ধান্তের স্বপক্ষে বলেছিল, যেহেতু পানকারীরা জানত সরকার বিষাক্ত উপাদান মিশ্রিত করার আদেশ দিয়েছে, তারপরও জেনে-শুনে নিজেদের হত্যার পথ বেছে নিলে সরকারের কিছুই করার থাকে না। সেই সময় গণহারে মৃত্যুর কারণ জানার জন্য যখন মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়েছিল, তখন সেই বোর্ডের সদস্যরা মার্কিন সরকারের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন। ধীরে ধীরে আমেরিকার জনগণ ‘দ্য ভোলস্টিড অ্যাক্ট’ বাতিলের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে, সরকারও বুঝতে পারে যে- এই সিদ্ধান্ত লাভের চেয়ে ক্ষতিই বয়ে এনেছে। অনেক ইতিহাসবিদ আমেরিকার এই সিদ্ধান্তকে ‘লিগ্যালাইজড মার্ডার’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

Related Articles

Exit mobile version