ফ্রেডেরিক উইলিয়াম আর সোফি ডরোথির চোদ্দ সন্তান জন্মেছিল, তাদের চারজনই শিশুকালে মারা যায়। বেঁচে থাকা সন্তানদের মাঝে জ্যেষ্ঠ কন্যা উইলহেলমিনা, আর তার তিন বছরের ছোট ক্রাউন প্রিন্স ফ্রেডেরিক। ফ্রেডেরিক ছিলেন কিছুটা খর্বকায় এবং শীর্ণদেহী, যার কারণে বাবা তাকে বিদ্রুপ করে ডাকতেন ছোট্ট ফ্রিটজ (Diminutive Fritz)। ফ্রেডেরিক যেখানে লেখাপড়া অপছন্দ করতেন, ফ্রিটজ সেখানে ছিলেন লেখাপড়ার প্রতি বেশ আগ্রহী । তার অন্তরে শিল্প-সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ, জীবনের সূক্ষ্ম আনন্দগুলো যাকে স্পর্শ করত। বাবা যেখানে রাজকীয় পরিচ্ছদ ছেড়ে ঘরে বোনা জামা পরিধান করতেন, যেখানে ফ্রিটজের পছন্দ ছিল কারুকার্য করা মূল্যবান পোশাক। ফলে বাবার সাথে তার মনের মিল ছিল না। অস্থির ফ্রিটজ তাই একদণ্ড শান্তি খুঁজে পেতেন উইলহেলমিনার কাছে। ভাইয়ের প্রতি বোনের স্নেহ আর আদরের কমতি ছিল না। তাদের এই সম্পর্ক আজীবন অটুট ছিল।
উইলহেলমিনার শৈশবও খুব ভাল কাটেনি। শৈশবে যে পরিচারিকা তার দেখভাল করতেন তিনি পান থেকে চুন খসলেই নির্মমভাবে রাজকন্যাকে পেটাতেন। ফলে উইলহেলমিনার শরীরে দাগ পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু মা সোফি ডরোথি এসবের কোনো খোঁজ খবর রাখতেন না। এমন চলতে থাকলে বিচিত্র ছিল না যে উইলহেলমিনা পঙ্গু হয়ে যেতেন। তবে সৌভাগ্যজনকভাবে সেই পরিচারিকা একবার রানীর সামনে মুখ ফস্কে বলে ফেলে যে যেকোনো দিন রাজকুমারীর হাত-পা ভেঙে যেতে পারে। রানীর এবার টনক নড়ল। কেন পরিচারিকা এই কথা বলল? ফলে ঘটনা প্রকাশ হয়ে পড়ে। উইলহেলমিনার জন্য নতুন পরিচারিকা নিয়োগ দেয়া হলো।
ভবিষ্যত রাজা
ফ্রিটজকে পোহাতে হচ্ছিল অন্য ঝামেলা। ফ্রেডেরিক উইলিয়ামের চোখে কঠোর চরিত্রই রাজা হবার পূর্বশর্ত।তার কাছে রাজাকে হতে হবে দক্ষ ও শক্তিশালী যোদ্ধা এবং কুশলী সেনাপতি। তিনি সচেষ্ট হলেন বড় ছেলে ফ্রেডেরিকের মধ্যে এসব গুণের সমাবেশ ঘটাতে। রাজপরিবার থাকত ব্র্যান্ডেনবার্গের উত্তর-পশ্চিমে ভুস্তাহাউজেন (Wsusterhausen) প্রাসাদে। চারদিকের রুক্ষ শুষ্ক প্রকৃতিতে প্রতিদিন ফ্রিটজের ঘুম ভাঙত কামানের মহড়ার শব্দে। বাবা যখন তখন তাকে নিয়ে চলে যেতেন রাজ্যের নানা দিকের সেনাঘাঁটিতে। রাস্তার প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে ফ্রিটজের মনে হত তার হাড়গোড় মনে হয় গুঁড়া-গুঁড়া হয়ে যাচ্ছে। তার চোখে সারাক্ষণ ভাসত বার্লিন আর পটসড্যামের জমকালো প্রাসাদ।
ফ্রিটজের ছয় বছর বয়সে তার জন্য অভিজাত পরিবারের একশত ছেলের আলাদা একটি সেনাদল গঠন করা হল। খুব দ্রুত এদের সংখ্যা বাড়িয়ে একটি রেজিমেন্টে পরিণত করা হয়, ফ্রেডেরিক নিযুক্ত হন তাদের কর্নেল। সাত বছর বিভিন্ন বিষয়ে তাকে পড়ানোর জন্য শিক্ষক নিযুক্ত হয়। তাদের প্রতি রাজার পরিষ্কার নির্দেশ ছিল ধরে-বেঁধে যেভাবেই হোক রাজপুত্রকে কঠোর একজন সেনানায়ক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু কীসের কী, ফ্রেডেরিক পড়ে রইলেন শিল্পকলা নিয়ে। একবার এক শিক্ষক রাজপুত্রকে ল্যাটিন বই পড়ানোর সময় রাজা উপস্থিত হন। ল্যাটিন ছিল ফ্রেডেরিক উইলিয়ামের চোখের বালি। আর যায় কোথায়, তিনি বই ছুঁড়ে ফেলে দেন আগুনে। হাতের কাছে পেলে ল্যাটিন শিক্ষকের কী অবস্থা করতেন তা সহজেই অনুমেয়। তবে তিনি পরিস্থিতি বুঝতে পেরে আগেই ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালান। আরেকবার রাজা ফ্রিটজকে দেখলেন বাঁশি বাজিয়ে স্বরচিত গান গাইতে। তিনি নাকি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, এই ছেলে তো রাজা হবার যোগ্য নয়, সে হবে কবি।
এসব কারণে বাবার সাথে ফ্রিটজের দূরত্ব বাড়তে থাকে। বাবার হাতে প্রায়শই নিগ্রহের শিকার হতে হয়। ছেলেকে অনেক সময় ফ্রেডেরিক ছেলেকে শারীরিকভাবে আঘাত করতেন, এমনকি জনসমক্ষেও। বোন উইলহেলমিনা আর মা সোফি ডরোথি তাকে বাঁচাতে চেষ্টা করতেন বলে তাদের প্রতিও রাজা নারাজ ছিলেন। ফলে ছেলের শাস্তি প্রায়ই বড় বোনের উপর বর্তাত। এদিকে ফ্রিটজের জন্মের প্রায় দশ বছর পর ফ্রেডেরিকের আরেকটি পুত্রসন্তান জন্মে, অগাস্টাস উইলিয়াম। ফ্রেডেরিক তাকে নিজের মতো করে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখলেন। তার মনে হতে লাগল ফ্রিটজ মরে গেলেই ভাল, তাহলে অগাস্টাসকে সিংহাসনে বসিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত হতে পারবেন। তবে ফ্রিটজের সুকুমার প্রবৃত্তি নষ্ট করার চেষ্টায় তিনি ক্ষান্ত দিলেন না। চৌদ্দ বছর বয়সে ফ্রিটজ বাবার গর্বের পটসড্যাম জায়ান্ট রেজিমেন্টের একটি দলে ক্যাপ্টেন হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি বাস করতে শুরু করেন পটসড্যামের রাজপ্রাসাদে।
ইংল্যান্ডের সাথে মিত্রতার চেষ্টা
আগেই বলা হয়েছে, প্রুশিয়ার রানী সোফি ডরোথি অত্যন্ত উচ্চবংশীয়। তার বাবা ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জর্জ, আর ভাই প্রিন্স অফ ওয়েলস হিসেবে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। দ্বিতীয় জর্জের ছেলে ডিউক অফ গ্লচেস্টার ফ্রেডেরিক রাজসিংহাসনের দ্বিতীয় উত্তরাধিকারী। আর মেয়ে অ্যামেলিয়াও রাজকন্যা হিসেবে যেকোনো রাজপরিবারের জন্য কাঙ্ক্ষিত পাত্রী। সোফি ডরোথি তাই উইলহেলমিনাকে ফ্রেডেরিকের সাথে আর অ্যামেলিয়াকে ফ্রিটজের সাথে বিয়ে দেয়ার কথা ভাবলেন। কিন্তু ফ্রেডেরিক উইলিয়াম আর সোফির ভাই কেউ কাউকে দেখতে পারতেন না। এদিকে প্রথম জর্জের চোখেও প্রুশিয়া আস্তাকুড় ছাড়া আর কিছু না। প্রুশিয়ার রাজা আবার রাজা নাকি, ছোহ!
সোফি কিন্তু উইলহেলমিনা আর ফ্রিটজের বিয়ের আশা ছাড়েননি। কৌশলগতভাবে কিন্তু এই বন্ধন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হত, কারণ এই দ্বৈত বিয়ের ফলে ইংল্যান্ড আর প্রুশিয়া অনেকটা একীভূত হয়ে যেত। তাই ইউরোপিয়ান পরাশক্তিগুলোর অনেকেই এর বিরোধী ছিল। ফ্রেডেরিককে তারা বিপদজনক আর মানসিকভাবে অসুস্থ মনে করত, তার ক্রমবর্ধমান সামরিক বাহিনী নিয়েও তাদের মধ্যে উৎকণ্ঠা ছিল। এহেন ফ্রেডেরিক ইংল্যান্ডের সাহায্য পেলে তিনি কখন কী করে বসেন তার ঠিক আছে!
ইংল্যান্ডের রাজদরবার কিন্তু এই বিয়েকে ইতিবাচকভাবেই দেখছিল। বিশেষ করে সুন্দরী উইলহেলমিনা আর ডিউক অফ গ্লচেস্টারের বিয়েতে তারা আগ্রহী ছিল। তাদের দৃষ্টিতে এর ফলে প্রুশিয়ার সিংহাসনের ডিউক অফ গ্লচেস্টারের দাবি তৈরি হবে। অ্যামেলিয়া এবং ফ্রিটজের ব্যাপারে তাদের কিছুটা দোনোমনা ছিল, যদিও এর ফলে অ্যামেলিয়া ভবিষ্যতে প্রুশিয়ার রানী হতেন। অন্যদিকে উইলহেলমিনার বিয়েতে ফ্রেডেরিক উইলিয়ামের আপত্তি ছিল না, যেহেতু এই বিয়ে উইলহেলমিনাকে ইংল্যান্ডের ভবিষ্যত রানীর আসনে অধিষ্ঠিত করবে। কিন্তু ফ্রেডেরিক আর অ্যামেলিয়ার বিয়েতে তার ছিল ঘোর আপত্তি। রাজকুমারী অ্যামেলিয়ার মাধ্যমে ফ্রিটজ যে প্রভূত অর্থ সম্পদ লাভ করবেন তা দিয়ে রাজপুত্র যে অবাধ আমোদপ্রমোদে মেতে উঠবেন না সে নিশ্চয়তা কোথায়? আবার অ্যামেলিয়া পুত্রবধু হয়ে আসলে ইংলিশ রাজকীয় আদবকেতা যে প্রুশিয়ান রাজদরবারে অনুপ্রবেশ করবে না তা-ও বা কীভাবে ফ্রেডেরিক বুঝবেন? এর ফলে সকল প্রকার বিলাসব্যসন পরিহার করে চলা এবং সেই মতো পরিবারকে চালানোর প্রচেষ্টা অবশ্যই হুমকির সম্মুখীন হবে।
বিয়ে নিয়ে দড়ি টানাটানি চলতে থাকে। সোফি আভাসে-ইঙ্গিতে প্রথমে ভাইয়ের কানে কথা তুলেছিলেন। প্রথম জর্জ ও তার উপদেষ্টা পরিষদ বহুদিন বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখে। সোফি ডরোথি আশায় বুক বেঁধে রইলেন, কিন্তু ইংল্যান্ড থেকে সেরকম আশাব্যঞ্জক কোনো খবর আসছিল না। এদিকে স্বামীও এই সম্বন্ধে যে খুব আগ্রহী তা-ও নয়। অবশেষে ইংল্যান্ড থেকে এরকম একটি বার্তা দেয়া হয় যে দ্বৈত বিয়ের ব্যাপারে তারা কথা বলতে আগ্রহী, কিন্তু ফ্রেডেরিক উইলিয়ামের এক গোঁ। বিয়ে হলে হবে উইলহেলমিনার, ফ্রিটজের পুত্রবধু করে তিনি অ্যামেলিয়াকে আনবেন না। প্রথম জর্জ সাফ জানিয়ে দিলেন বিয়ে হলে দুটি একসাথে, না হলে কোনোটিই নয়।
ফ্রেডেরিক কি আর হুমকিতে কান দেন! তিনিও এককথা বলে দেন, বিয়ে হবে উইলহেলমিনার, ফ্রিটজের না। ফলে সৃষ্টি হলো অচলাবস্থা। ১৭২৭ সালে প্রথম জর্জের মৃত্যু হলে দ্বিতীয় জর্জ হিসেবে সোফির ভাই অভিষিক্ত হন, কিন্তু পরিস্থিতির কোনো অগ্রগতি হলো না। মায়ের পরামর্শে অ্যামেলিয়ার প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করে ফ্রিটজ রানী ক্যারোলাইনের কাছে চিঠি পাঠান, কিন্তু বরফ গলল না।
অবহেলা আর অপমান
নিজ গৃহেও ফ্রিটজ আর উইলহেলমিনার অবস্থা দিনকে দিন খারাপ হচ্ছিল। ফ্রেডেরিকের ছিল বাতের সমস্যা, এর সাথে যোগ হয়েছিল অবিরাম মদ্যপান। তার আচার-আচরণে অসংলগ্নতা চলে আসছিল, মেজাজ হয়ে উঠছিল আগুনের মতো। নিজের স্ত্রী, ছেলেমেয়ে সবাইকে নিরন্তর গালাগালি করতেন তিনি। সবচেয়ে বেশি অত্যাচার চলত ফ্রিটজ আর উইলহেলমিনার প্রতি। অনেক সময় তাদের খাবার বন্ধ করে দেয়া হত, বা উচ্ছিষ্ট দেয়া হত খাবার হিসেবে। ফ্রিটজকে তিনি শারিরিকভাবে লাঞ্ছিত করতেন, মাঝে মাঝে উইলহেলমিনাকেও ছাড়তেন না। ১৭২৯ সালে পাঁচ সপ্তাহের জন্য তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন, এর পর পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে মোড় নেয়।
পটসড্যামে থাকার সময় ফ্রিটজ কিছুটা শান্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু এখানেও তাকে তটস্থ থাকতে হত কখন বিনা নোটিশে ফ্রেডেরিক এসে হাজির হন। একদিনের কথা, ফ্রিটজ তার পছন্দের মহামূল্যবান একটি ফরাসি পোশাক পরে মনের সুখে বাঁশি বাজাতে ব্যস্ত। এমন সময় ঘনিষ্ঠ বন্ধু সেনাবাহিনীর অফিসার ক্যাটে ছুটতে ছুটতে হাজির। ফ্রেডেরিক এই মাত্র প্রাসাদে প্রবেশ করেছেন। তাড়াহুড়ো করে পোশাকের উপর মিলিটারি কোট চাপাতে না চাপাতেই রাজা কক্ষে ঢুকে পড়লেন। তার বাজপাখির চোখকে ফাঁকি দেয়া কি এতই সহজ! ফরাসিদের তিনি এমনিতেই ঘৃণা করতেন, তাদের পোশাকের ঠাই হলো আগুনে। ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজে তিনি অনেক ফরাসি বই পেয়ে গেলেন, সব নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করতে এক বিক্রেতার হাতে তুলে দেয়া হলো।
পালানোর চেষ্টা ও পরিণতি
ফ্রিটজের প্রতি বাবার অত্যাচারের চূড়ান্ত রূপ দেখা গেল ১৭৩০ সালের জুনে। মূলবার্গ (Miihlberg) শহরে পোল্যান্ডের রাজার আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে অভ্যাগতদের সামনে ফ্রিটজকে তার বাবা চূড়ান্তভাবে অপমান করেন। সাথে থাকা লাঠির কয়েক ঘা তিনি সবার সামনেই ফ্রিটজের গায়ে লাগিয়ে দেন। ফিরে এসে ফ্রিটজ ঠিক করলেন- আর নয়, এবার তিনি পালাবেন। ক্যাটেসহ আর কয়েকজন সেনা অফিসারকে নিয়ে দল পাকিয়ে তিনি ইংল্যান্ডে চলে যাবার পাঁয়তারা করলেন। ফ্রিটজের এক সঙ্গীর বড় ভাই ১৭৩০ সালের ৫ আগস্ট রাজার কাছে এই খবর ফাঁস করে দেন।
ফ্রেডেরিক তো রেগে আগুন। তার আদেশে ফ্রিটজ আর ক্যাটেকে আটক করে কুস্ট্রেন (Küstrin ) দুর্গে বন্দী করে রাখা হলো। তারা যেহেতু সেনাবাহিনীর পদপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন, সেজন্য ফ্রেডেরিক তাদের বিরুদ্ধে বিনা অনুমতিতে বাহিনী ত্যাগের চার্জ আনলেন, যা ছিল দেশদ্রোহের শামিল। প্রথমে ৬ নভেম্বর ক্যাটেকে শিরশ্ছেদ করে হত্যা করা হয়। রাজার আদেশে ফ্রিটজকে বাধ্য করা হলো এই দৃশ্য দেখতে। বলা হয়, তিনি ক্যাটের মাথা বিচ্ছিন্ন হবার আগেই সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন।
ফ্রেডেরিক ছেলেকেও প্রাণদণ্ড দিতে চেয়েছিলেন কি না তা নিয়ে মতভেদ আছে। কেউ কেউ বলে, তিনি বিচারকদের চাপ দিয়েছিলেন যাতে ফ্রিটজের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়। ভাইকে সমর্থন করায় তিনি উইলহেলমিনাকে নির্মমভাবে প্রহার করেন। ফ্রিটজ বেঁচে যান ইউরোপিয়ান রাজাদের হস্তক্ষেপে। হলি রোমান এম্পেরর ষষ্ঠ চার্লস ফ্রেডেরিককে স্মরণ করিয়ে দেন, কোনো রাজপুত্রের বিচার করার ভার কেবল এম্পেররের অধীনস্থ পরিষদের। ফ্রিটজকে বন্দি রাখা হয় নভেম্বরের ১৮ তারিখ পর্যন্ত। তারপর তাকে ক্ষমা করা হলেও সামরিক পদবী কেড়ে নেয়া হয়। বার্লিনে ফিরতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে তাকে কুস্ট্রিনেই সামরিক এবং প্রশাসনিক কাজের কঠিন প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু হল।
উইলহেলমিনার বিয়ে
২০ নভেম্বর ১৭৩১।
বার্লিনে প্রুশিয়ান রাজকুমারী উইলহেলমিনার আর হলি রোমান এম্পায়ারের প্রিন্সিপ্যালিটি বেইরুথের (Baireuth) মারগ্রেভের (শাসকের উপাধি) বিয়ে হলো। বেইরুথের মারগ্রেভ হনজোলার্ন বংশের বলে প্রুশিয়ান রাজপরিবারের আত্মীয় ছিলেন। বিয়েতে যোগ দিতে ভাই ফ্রিটজকে স্বল্পকালের জন্য বার্লিনে আসার অনুমতি দেয়া হয়। অনেকে দাবি করেন, উইলহেলমিনা বিয়েতে রাজি হয়েছিলেন ভাইয়ের প্রতি নমনীয়তা দেখাবার শর্তে। তবে মোটামুটিভাবে তার দাম্পত্য সম্পর্ক লম্বা সময় সুখেরই ছিল। তিনি ও তার স্বামী মিলে ভাঙাচোরা চেহারার বেইরুথকে পাল্টে দিয়েছিলেন অসামান্য সব স্থাপত্যে। উইলহেলমিনার পৃষ্ঠপোষকতায় বেইরুথ হয়ে উঠেছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যতম পীঠস্থান।
ভাই ফ্রিটজের সাথে উইলহেলমিনার সম্পর্ক সবসময় বজায় ছিল। তিনি ছিলেন ফ্রিটজের সবচেয়ে বড় আস্থার জায়গা। ১৭৪৫ সালে অস্ট্রিয়ান সম্রাজ্ঞী মারিয়া থেরেসার সাথে দেখা করার সূত্র ধরে ফ্রিটজের সাথে মনোমালিন্যও তাদের সম্পর্কে কোনো দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেনি। ফ্রিটজ প্রুশিয়ার রাজা হলে দক্ষিণ জার্মানিতে তার চোখ কান ছিলেন উইলহেলমিনা। ১৭৫৮ সালের ১৪ অক্টোবর উইলহেলমিনার মৃত্যু ফ্রিটজকে তীব্রভাবে আঘাত করে। ফ্রিটজ তার জীবনে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়সহ অনেকের মৃত্যুই প্রত্যক্ষ করেছিলেন, কিন্তু বলা হয় উইলহেলমিনার প্রস্থান তাকে আহত করেছিল সবচেয়ে বেশি। এতটাই যে বাকি জীবন তিনি সেই ক্ষত বয়ে চলেন। বোনের মৃত্যুর দশম বার্ষিকীতে তিনি উইলহেলমিনার সম্মানে পটসড্যামে তার গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদে সানুসি’র (Sanssouci) সামনেই একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেন।