যুদ্ধ-বিগ্রহের ইতিহাস নিয়ে কমবেশি আগ্রহ আমাদের অনেকেরই আছে। আর আগেকার দিনের যুদ্ধগুলোর এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলো বিভিন্ন দুর্গ। একেকটি দুর্গ দখল করতে গিয়ে আক্রমণকারী বাহিনীকে যে কতটা সংগ্রাম করা লাগতো, দুর্গের ভেতরে থাকা সেনারা এর প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করতে কতটা কষ্ট করতো- সেই ইতিহাসও আমাদের অনেকের জানা।
আমাদের আজকের আয়োজনও তাই এই দুর্গকে ঘিরেই। আগেকার দিনের দুর্গগুলোর নানা গঠন কৌশল, প্রতিরক্ষা ও ধ্বংসের কাহিনী এবং আরো কিছু ব্যাপার নিয়ে সাজানো হয়েছে পুরো লেখা।
১. অবস্থান নাকি নকশা?
যেকোনো দুর্গের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে তার নকশা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো সেই দুর্গের ভৌগলিক অবস্থান। যদি কোনো উঁচু, খাড়া পাহাড়ের উপর দুর্গটি নির্মাণ করা হতো, তাহলে ভৌগলিক এ অবস্থান দুর্গটিকে শত্রুর হাত থেকে যথেষ্ট নিরাপত্তা প্রদান করতো।
এরকম উঁচু জায়গায় দুর্গ ধ্বংসের জন্য ব্যবহৃত ব্যাটারিং র্যাম, সীজ টাওয়ার ইত্যাদি পরিবহন দুরুহ ছিলো বলেই এসব জায়গায় অবস্থিত দুর্গগুলো দখল করা ছিলো অনেক কঠিন।
২. গেটহাউজ – দুর্গের সর্বাধিক সুরক্ষিত অংশ
দুর্গের কাজ একদিকে শত্রুকে ঠেকানো হলেও স্বপক্ষের মানুষদের ঢোকার জন্য গেটের ব্যবস্থা তো রাখতে হবেই। আর এ গেট ভাঙার দিকেই আক্রমণকারী পক্ষ সবচেয়ে বেশি নজর দিতো। এজন্য এসব গেটেই সর্বাধিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হতো।
গেটের উপরে কিছুটা আলম্বিত প্রতিরক্ষা কক্ষ কিংবা গেটের সামনে উভয় পাশে প্রতিরক্ষা টাওয়ার থাকতো। প্রবেশপথে অনাহুত যাতায়াত প্রতিরোধে বসানো হতো লোহার টানা গরাদ। অতিরিক্ত সুরক্ষিত দুর্গগুলোতে আরো থাকতো ড্র-ব্রিজ, শত্রুকে আটকে ফেলতে কয়েকটি টানা গরাদ, বিভিন্ন ফাঁদ, মৃত্যুরন্ধ্র ইত্যাদি।
৩. বড় জানালার অনুপস্থিতি
আলো-বাতাস চলাচলের জন্য জানালা যেকোনো রুমের অপরিহার্য একটি অংশ। তবে দুর্গের বেলায় এ কথাটা জোর গলায় বলা যাবে না। কারণ জানালা বড় হলে সেটা গলে কোনো না কোনোভাবে শত্রুপক্ষের লোকেরা ভেতরে ঢুকে যেতেও পারে। এজন্য অতীতের দুর্গগুলোর বাইরের দিকের জানালাগুলো হতো খুবই ছোট। তবে সেই জানালা যদি অনেক উঁচুতে কিংবা ভেতরের দিকে হতো, তবে তা বড় করেই বানানো হতো।
আজকের দিনে অনেক দুর্গেই বাইরে, এমনকি ভূমির কাছাকাছি উচ্চতায় বড় জানালা দেখা যায়। এটা আসলে দুর্গগুলো পরিত্যক্ত হবার পর পুনঃনির্মাণের ফসল।
৪. প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা
অতীতে একটি দুর্গের প্রতিরক্ষার জন্য বিভিন্ন রকম ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হতো। একে একে সেসব তুলে ধরছি।
১) পরিখাঃ শত্রুপক্ষের যাত্রাপথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা, মাটির নিচে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে তাদের অনাকাঙ্ক্ষিত আক্রমণ প্রতিরোধ ও দুর্গের দেয়ালকে ক্ষতির হাত থেকে যথাসম্ভব রক্ষা করাই ছিলো পরিখা খননের মূল উদ্দেশ্য।
২) সিরিজ প্রতিরক্ষাঃ দুর্গের ভেতরে শত্রুর প্রবেশ ঠেকাতে ক্রমান্বয়ে বাইরের দেয়াল, পরিখা, ভেতরের দেয়াল, কীপ (এক ধরণের বৃহদাকার সুরক্ষিত টাওয়ার) ও স্ট্রংহোল্ড টাওয়ারের ব্যবস্থা রাখা হতো।
৩) প্রধান ফটকঃ অনেক সময়ই প্রধান ফটকের সাথে থাকতো আরেকটি লোহার গরাদ। শত্রুপক্ষ সেই ফটক ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করলে দেখতে পেত ছোটখাট কোনো উঠান। ততক্ষণে লোহার গরাদটি আটকে দিয়ে আসলে আটকে ফেলা হতো ভেতরে ঢুকতে পারা শত্রুদেরই। এরপর উঠানের চারদিকের প্রাচীরের মৃত্যুরন্ধ্র থেকে ছোঁড়া তীরের আঘাতে প্রাণ হারাতো অনেকেই।
৪) সিঁড়িঃ দুর্গের সিঁড়িগুলো হতো তুলনামূলক সরু এবং ঘড়ির কাটার দিক বরাবর (উপর থেকে নিচে)। মানুষ সাধারণত ডানহাতি হয়ে থাকে। এমন ডিজাইনের ফলে নিচ থেকে উপরে উঠতে থাকা শত্রুর হাত পাশে থাকা দেয়ালে বাধাগ্রস্ত হতো। কিন্তু উপর থেকে নিচে নামা দুর্গের সেনারা সহজেই তাদের হাতের খেল দেখাতে পারতো।
৫) গোপন সুড়ঙ্গঃ দুর্গের অধিবাসীদের নিরাপদে পালানোর ব্যবস্থা করা, বিভিন্ন রসদ লুকিয়ে রাখা, যুদ্ধাস্ত্র আনা-নেয়া ইত্যাদি বিভিন্ন উদ্দেশ্যে বানানো হতো বিভিন্ন গোপন সুড়ঙ্গ।
৬) বার্বিকানঃ অতীতে বিভিন্ন দুর্গের প্রতিরক্ষার জন্য প্রধান ফটকের পূর্বে বর্ধিত আরেকটি অংশ বানানো হতো, যাকে বলা হয় বার্বিকান। মূল দুর্গের মতো এখানেও থাকতো লোহার গরাদ, মৃত্যুরন্ধ্র, ফাঁদের সমাবেশ যা শত্রুকে দুর্বল করতে বেশ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতো।
৭) ড্র-ব্রিজঃ অতীতের যুদ্ধনির্ভর বিভিন্ন সিনেমা দেখতে দেখতে ড্র-ব্রিজের সাথে আমরা অনেকেই পরিচিত। এ ব্রিজের এক অংশ বড় শিকলের মাধ্যমে সংযুক্ত থাকে দুর্গের সাথে, আরেক অংশ সময়মতো নামিয়ে স্বপক্ষের সৈন্যদের ভেতরে ঢোকার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। দরকার ছাড়া এ ব্রিজটি সবসময় উপরেই তোলা থাকতো বিধায় তা শত্রুপক্ষের যাত্রাপথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতো।
৮) দেয়ালঃ দুর্গ অবরোধকারী পক্ষ যখন জোরপূর্বক কোনো দুর্গের ভেতরে প্রবেশ করতে চাইতো, তখন তারা সবসময়ই চিন্তা করতো দেয়াল ভাঙার কথা। এজন্য দেয়ালের দুর্বল অংশ খোঁজার দিকে নজর দিতো তারা। আর এ দুর্বলতা এড়াতে দুর্গের দেয়ালগুলো বানানো হতো অত্যাধিক চওড়া করে। বাইরের দিকের দেয়াল অনেক সময় চার মিটার, এমনকি এর চেয়েও পুরু হবার নজির আছে। ভেতরের কিছু কিছু দেয়াল দুই মিটার, এক মিটার করে পুরু হতো। তবে এক মিটারের কম পুরু দেয়ালের নজির ছিলো সামান্যই।
৫. ধ্বংসের আয়োজন
এতক্ষণ ধরে তো দুর্গ রক্ষার নানা কলাকৌশল নিয়ে কথা বললাম। এবার তাহলে জানা যাক একটি দুর্গ ধ্বংসের জন্য যেসব পদ্ধতির সাহায্য নেয়া হতো সেই সম্পর্কে কিছু কথা।
১) আগুনঃ শুরুর দিকের দুর্গগুলো বানানো হতো কাঠ দিয়ে। তীরন্দাজ বাহিনী আগুনে-তীর নিক্ষেপ করে খুব সহজেই এসব দুর্গে আগুন ধরিয়ে দিতে পারতো। উত্তাপ সহ্য সীমা ছাড়িয়ে গেলে অবশেষে আত্মসমর্পনে বাধ্য হতো দুর্গের বাসিন্দারা। কাঠের দুর্গের এ দুর্বলতার কারণেই পরবর্তী দুর্গগুলো পাথর দিয়ে বানানো শুরু হয়।
২) ব্যাটারিং র্যাম (Battering Ram): পাথরের তৈরি দুর্গের দেয়াল ভাঙা ছিলো বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তুলনামুলক কম পুরুত্বের দেয়ালগুলো পিক-এক্সের (Pickaxe) সাহায্যে ভাঙা সম্ভব হলেও অধিক পুরু দেয়ালের বেলায় সেটি ছিলো অসম্ভব। তখনই ব্যবহার করা হতো ব্যাটারিং র্যাম যাতে একসাথে কয়েকজন মানুষের শক্তি একসাথে কাজে লাগিয়ে ভাঙা হতো দেয়াল কিংবা দরজা।
৩) মই ও বেলফ্রিঃ দুর্গের দেয়ালের বাধা পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে আক্রমণকারী পক্ষ অনেক সময়ই মই দিয়ে দেয়ালে উঠতে চেষ্টা করতো। তবে এক্ষেত্রে মই বেয়ে ওঠা সৈন্যদেরকে তীর ছুঁড়ে, গরম পানি ও তেল ঢেলে, এমনকি সরাসরি উপর থেকে মই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েও প্রতিহত করা হতো।
মইয়ের ব্যবহারে অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটায় একসময় এ উদ্দেশ্যে বেলফ্রির ব্যবহার শুরু হয়। চাকা লাগানো এ যানটি ঠেলে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হতো দুর্গের দেয়ালের কাছ পর্যন্ত, ভেতরে থাকতো সৈন্যরা। দেয়ালের কাছে গেলে ভেতরে থাকা সৈন্যরা তখন মই বেয়ে সহজেই দেয়াল টপকে যেত। বেলফ্রি ঠেকাতে দুর্গের দেয়াল থেকে কিছুটা দূরে মাটি জড়ো করে রাখা হতো যাতে করে ঠেলে ঠেলে যানটিকে দেয়ালের কাছে না আনা যায়।
৪) ক্যাটাপুল্টঃ দুর্গের অবকাঠামো ধ্বংসের জন্য ব্যবহৃত এ যুদ্ধযানটি বেশ সুপরিচিত। এটা থেকে পাথর ও আগুনে গোলা নিক্ষেপ করা হতো। কখনো কখনো আবার মৃত ভেড়া, গবাদি পশু, এমনকি প্লেগে আক্রান্তদেরও দুর্গের উদ্দেশ্যে ক্যাটাপুল্টের মাধ্যমে ছোঁড়ার কথা জানা যায়।
৫) সুড়ঙ্গ খননঃ দুর্গ আক্রমণের আরেকটি অন্যতম উপায় ছিলো সুড়ঙ্গ খনন। এক্ষেত্রে আক্রমণকারী পক্ষ গোপনে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে চলে যেতো দুর্গের দেয়াল, প্রধান ফটকের কাছাকাছি। সেখানে গিয়ে বিষ্ফোরক রেখে সুবিধামতো বিষ্ফোরণ ঘটাতে পারলেই কেঁপে উঠতো পুরো অবকাঠামো। অবশ্য দুর্গের সৈন্যরা যদি কোনোভাবে টের পেয়ে যেত, তাহলে অবশ্য অবস্থা হয়ে উঠতো বেশ গোলমেলে।
৬) ব্যালিস্টাঃ দুর্গের দেয়াল কিংবা ভেতরে থাকা সৈন্যদের উদ্দেশ্যে ছয়টির কাছাকাছি বর্শাকৃতির তীর একবারে নিক্ষেপের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হতো ব্যালিস্টা।
৭) ট্রেবুচেটঃ একটু আগেই আলাপ করা ক্যাটাপুল্টের বড়দাদা বলা যায় ট্রেবুচেটকে। শত্রুর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উদ্দেশ্যে প্রায় ৩০০ মিটার দূরে থেকে ৫০-১০০ কেজি পর্যন্ত কোনোকিছু নিক্ষেপ করা যেত এ যুদ্ধযানের সাহায্যে।
এখন ধ্বংস ও রক্ষার কৌশলের সাথে বোনাস হিসেবে আরো কিছু জিনিস জেনে নেয়া যাক।
১. টয়লেট
প্রকৃতির ডাক এমনই এক ডাক যা উপেক্ষা করার কোনো উপায় নেই। তবে অতীতের বিভিন্ন দুর্গে সেই ডাকে সাড়া দেয়ার ব্যবস্থা দেখে যে কারো বিস্ময়ে মুখ হাঁ হতে বাধ্য।
টয়লেট বলতে এখনকার মতো আলাদা সুব্যবস্থা ছিলো না তখন। একটি বেঞ্চে গর্ত করে রাখা হতো, সেই গর্ত দিয়েই চলে যেতো দুর্গন্ধযুক্ত যত পদার্থ। সাধারণত এগুলোর শেষ গন্তব্য হতো কোনো ভূগর্ভস্থ মলাধার কিংবা দুর্গের আশেপাশের গভীর জলপূর্ণ পরিখা! পরিখাগুলো যেহেতু ছিলো স্থির পানির উৎস, তাই সেই মানববর্জ্যের গন্ধও কিছুদিন পর ছড়িয়ে পড়া শুরু করতো সবদিকে।
প্রাকৃতিক কর্ম সারার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো গোপনীয়তা, নিজের লজ্জা নিবারণের ব্যবস্থা। তবে আগেকার দিনের দুর্গগুলোতে সেই ব্যবস্থাও ছিলো না। সারি সারি গর্তওয়ালা বেঞ্চ পেতে রাখা হতো। যে যার মতো কাজ করছে, পাশেরজনের সাথে গল্প-গুজব করছে, আবার কাজ করছে। মাঝে তো কোনো পর্দার ব্যবস্থাই ছিলো না তখন!
২. বাসযোগ্য পরিবেশের অনুপস্থিতি
দুর্গগুলো বানানো হতো মূলত শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে। তাই বসবাসের সুবিধার চেয়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাই সেখানে প্রাধান্য পেত বেশি। দুর্গের ভেতরটা অধিকাংশ সময়ই ঘোড়ার মলের গন্ধে সয়লাব থাকতো। জানালার আকার খুব ছোট হওয়ায় ভেতরটা থাকতো অন্ধকারাচ্ছন্ন। এছাড়া ভেতরটা প্রায় সময়ই স্যাঁতস্যাঁতে থাকতো, বায়ু চলাচলও ছিলো তুলনামূলক কম।
৩. বিনোদন
দুর্গে থাকা সেনাদের মূল দায়িত্ব ছিলো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। তাই বিনোদনের ব্যবস্থা তেমন একটা থাকতো না তাদের জন্য। যখন শত্রু থাকতো না, তখন বাইরে শিকার করা ছিলো বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। অভ্যন্তরীন খেলাধুলার মাঝে দাবা ছিলো প্রধান। তবে বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম ছিলো খাওয়াদাওয়া। প্রায় সময়ই ভুঁড়িভোজনের আয়োজন করা হতো দুর্গগুলোতে। সেসব আয়োজনে হরেক রকমের খাবারদাবার, বিভিন্ন স্বাদের পানীয়, ভাঁড় আর চারণকবিদের উপস্থিতি দুর্গের রক্ষীদের মনে রঙের ছোঁয়া দিয়ে যেত।