আদিকাল থেকেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীকে সংসারের গন্ডিতে আবদ্ধ করে গৌরবের সকল ক্ষেত্রে একাই আধিপত্য করে গেছে। বিশেষ করে প্রাচীন যুদ্ধকলায় যোগ্যতা, সামর্থ্য, বীরত্ব ছিল পৌরুষের অপর নাম। নারীদের নমনীয় শারীরিক গঠন ও সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে অধিকাংশ সময়ই তাদেরকে দুর্বল প্রতিপন্ন করা হয়। অথচ তলোয়ার চালানো বা তীর-ধনুকে লক্ষ্যভেদ করার কথা কল্পনা করতেই চোখের সামনে ভেসে উঠে ইতিহাসের বইয়ে দেখা কোনো বীরের ছবি। তারপরও যুগে যুগে এমন কিছু সাহসী নারীর আবির্ভাব ঘটেছে যারা সম্মুখ সমরে পরাজিত করেছেন বহু বীরকে। যাদের নেতৃত্ব তাক লাগিয়ে দিয়েছিল প্রাচীন বিশ্বকে। কালের স্রোতে তারা নিজেদের অমর করে রেখেছেন। অহংকারী পুরুষেরা অনেক সময় তাদেরকে হেয় করেছেন আর পরিণতিতে অবধারিতভাবেই পতন স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। আজ তেমনই কয়েকজন দুর্ধর্ষ নারীর গল্প জেনে নেয়া যাক।
১০. জুডিথ
জুডিথ ৯৬০ খ্রিস্টাব্দে দামোত নগরের শাসনকর্তা ছিলেন। তিনি প্যাগান (মতভেদে ইহুদি) ধর্মাবলম্বী ছিলেন। আমহারিক ভাষায় তাকে ‘এসাতো’ বলে ডাকা হয়, যার অর্থ আগুন। তিনি এক্সম নগর আক্রমণ করে ভয়ানক ধ্বংসযজ্ঞ চালান। এক্সম ছিল তৎকালীন ইথিওপিয়ার পবিত্র রাজধানী। জুডিথ একাধারে সব স্মৃতিসৌধ ও গীর্জা ধ্বংস করে এক্সম ও তার আশেপাশের এলাকায় ত্রাসের সৃষ্টি করেন। তিনি রাজবংশের সকল সদস্যকে (সেবার রানীর বংশধরদের) হত্যা করে তাদের সম্পূর্ণ চিহ্ন মুছে দিতে চেষ্টা করেন। তার কর্মকাণ্ড লোকমুখে বর্ণিত হয়ে আসছে এবং বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিলেও তার উল্লেখ রয়েছে। ধারণা করা হয়, তিনি সম্রাটকে হত্যা করে ক্ষমতায় বসেন এবং একটানা চল্লিশ বছর রাজত্ব করেন। উত্তর ইথিওপিয়ার কৃষক সম্প্রদায়ে এখনও তার নির্যাতন ও ইতিহাসের কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। তিনি ইথিওপিয়ার রাজ কোষাগার ডেবরে ডেমো লুটপাট ও রাজার পুরুষ আত্মীয়দের জন্যে তৈরি জেলখানা ধ্বংস করেন বলে ধারণা করা হয়। জুডিথের বর্বরতা এমনই কিংবদন্তীর সৃষ্টি করে যে, আমহারিক ভাষায় সাধারণভাবে তার নামের অর্থ করা হয় ‘ধ্বংস’।
৯. ট্র্যু থি ত্রিন
ট্র্যু থি ত্রিন ৩য় শতকের একজন ভিয়েতনামী যোদ্ধা, যিনি চীনের দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ পরিচালনা করেন। তিনি ভিয়েতনামে ‘ঊ’ রাজত্বের সময় সফলভাবে দখলদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করেন। তিনি থান হোয়া প্রদেশের ট্র্যু সন জেলায় জন্মগ্রহণ করেন (বর্তমানে উত্তর ভিয়েতনামে অবস্থিত)। তার জন্মের সময় এলাকাটি চীনের তিন রাজ্যের অন্যতম পূর্ব ঊ সাম্রাজ্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। খুব অল্প বয়সে এতিম হয়ে ত্রিন তার ভাই ও তার স্ত্রীর নিকট দাসীর ন্যায় বেড়ে উঠেন। মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি সেখান থেকে জঙ্গলে পালিয়ে যান। বাড়ি থেকে পালিয়ে প্রায় ১,০০০ পুরুষ ও নারী সৈনিকের মিলিত বাহিনী গড়ে তোলেন ত্রিন।
ট্র্যু ত্রিন এই বাহিনীর মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে তুলে ভিয়েতনামের একটি এলাকা দখল মুক্ত করতে সক্ষম হন এবং নিজেই স্বতন্ত্র শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি অন্তত ৩০টি ঊ আগ্রাসন সম্পূর্ণ রুখে দেন। লোকমুখে প্রচলিত আছে যে, তিনি হাতির পিঠে চড়ে, গায়ে সোনার বর্ম পরে, হাতে দু’টি তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধে যেতেন। পরবর্তীতে লোককথায় তাকে পৌরাণিক কল্পকাহিনীর এক নারী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। তার জীবনী সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য না থাকায় বোঝা যায়, একসময় তিনি পরাজিত হন এবং ২৪৮ খ্রিস্টাব্দে নিজের জীবনের সমাপ্তি ঘটান।
৮. ব্যুদিক্বা
ব্যুদিক্বা ছিলেন নরফোকের সাধারণ জনগণের রানী। তিনি রোমান সাম্রাজ্যের দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগঠিত বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন। তার স্বামী, নরফোকের রাজা যখন মারা যান, তিনি তার রাজ্য যৌথভাবে তার কন্যা ও রোমান সম্রাটের অধীনে ন্যস্ত করে দেন। কিন্তু রোমানরা এই যৌথ শাসন স্বীকার না করে পুরো সাম্রাজ্য দখল করে। ব্যুদিক্বাকে চাবুক মেরে তাড়িয়ে দেয়া হয় আর তার কন্যারা হয় ধর্ষণের শিকার। শেষ পর্যন্ত নরফোক এবং প্রতিবেশী এলাকার জনগণ তাকে নেতা হিসেবে নির্বাচন করে ও তার নেতৃত্বে রোমানদের ওপর হামলা করে। এ যুদ্ধে তার সেনাবাহিনী ব্যাপক সাফল্য পায়। তারা কামুলোডুনম (Camulodunum) শহর (বর্তমান কোলচেস্টার) সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলেন।
ইতিহাসবিদ কর্নেলিয়ুস টেসাইতাস এর মতে ব্রাইটনরা (নরফোক অধিবাসী) বন্দী গ্রহণ করতে ন্যূনতম আগ্রহী ছিল না। তারা সরাসরি হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। বলা বাহুল্য, রোমান সৈন্য কর্তৃক নিজ রাজকন্যার সম্মানহানির প্রতিশোধ তারা যথেষ্ট বর্বরতার সাথে গ্রহণ করেছিল। সময়ের পরিহাসে প্রচন্ড সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বিদ্রোহী এই রানীর মূর্তি এখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতীক হয়ে সেই শহরেরই দাঁড়িয়ে আছে, যা একসময় তিনি নিজেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিলেন।
৭. ট্র্যুং বোনদ্বয়
ট্র্যুং বোনেরা ছিলেন ভিয়েতনামের সামরিক নেতা। তারা তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে চীনা হান সাম্রাজ্যের আক্রমণ প্রতিহত করতে সমর্থ হন। তাদের এই কৃতিত্বের জন্য তাদেরকে ভিয়েতনামের জাতীয় বীর হিসেবে স্মরণ করা হয়। ভিয়েতনাম একসময় প্রায় হাজার বছর ধরে চীনা দখলে ছিল। সে সময়েই তারা জন্মগ্রহণ করেন। ট্র্যুং ত্রামের স্বামী থি সাক ছিলেন একজন সম্মানিত ব্যক্তি। তিনি গোপনে চাইনিজ বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু হান শাসকেরা এই পরিকল্পনা আন্দাজ করে ফেলে এবং থি সাককে হত্যা করে। এরপরই ট্র্যুং ত্রাম এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। বোন ট্র্যুং ন্যিকে সাথে নিয়ে তিনি তাদের গ্রাম থেকে হানদের ছোট একটি বাহিনীকে বিতাড়িত করেন। এরপর আর তারা থেমে থাকেননি। তারা মূলত মেয়েদের নিয়ে একটি সেনাবাহিনী গঠন করেন। কয়েক মাসের মধ্যেই তারা ভিয়েতনামের বহু এলাকাকে চৈনিক শাসন থেকে মুক্ত করেন এবং ন্যাম ভিয়েত অঞ্চলকে সম্পূর্ণ মুক্ত করেন।
৩৯ খ্রিষ্টাব্দে তারা নিজেদের যৌথভাবে এই স্বাধীন রাজ্যের রানী বলে ঘোষণা করেন এবং টানা দু’বছর ধরে চীনের সব হামলা প্রতিরোধ করেন। শেষ পর্যন্ত হান সাম্রাজ্য ট্র্যুং বোনদের পরাজিত করতে বিপুল সংখ্যক সৈন্য নিয়ে সামরিক বাহিনী গঠন করে। প্রবাদ রয়েছে যে, হান সেনাবাহিনী নারী সৈন্যদলকে পরাজিত করতে পুরোপুরি নগ্ন হয়ে যুদ্ধে আসে, যেন লজ্জায় তারা যুদ্ধে হেরে যায়। বোনদের বীরত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও চীনা সেনাবাহিনী ট্র্যুং সৈন্যদলকে ছাড়িয়ে যায়। নিজেদের সম্মান রক্ষার্থে এবং লাঞ্ছিত হওয়া থেকে বাঁচতে চীনের হাতে ধরা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে দুই রানী খ্রিষ্টীয় ৪৩ সালে হাত্ব (Hát) নদীতে ডুবে আত্মহত্যা করেন।
৬. প্রথম আরতেমিসিয়া
কারিয়ার প্রথম আরতেমিসিয়া ছিলেন পারস্যের পক্ষ থেকে নিযুক্ত আইওনিয়ার শাসনকর্তা এবং ইতিহাসে উল্লেখিত প্রথম নারী নৌবাহিনী প্রধান। সালামিসের যুদ্ধে তার ভূমিকার জন্যে তাকে সবচেয়ে বেশি স্মরণ করা হয়। একমাত্র তিনিই পারস্যের রাজা জারজিসকে সমুদ্রে যুদ্ধ না করে গ্রীক বাহিনীর সাথে স্থলযুদ্ধের পরামর্শ দেন। কিন্তু তিনি সে উপদেশ গ্রহণ না করে জলপথে অগ্রসর হন।
৪৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পাঁচটি জাহাজের প্রধান হিসেবে আরতেমিসিয়া যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে গ্রীকরা তার বিশেষ রণতরী দখলের খুব কাছাকাছি চলে আসে। সেই সময় বাঁচার জন্য তিনি একটি দারুণ ফন্দি আঁটেন। তিনি নিজের একটি জাহাজ নিয়ে পারস্য বাহিনীর আরেকটি জাহাজে আক্রমণ করেন, যাতে গ্রীকরা ধরে নেয় আরতেমিসিয়া তাদের পক্ষে। অন্য জাহাজটি ডুবিয়ে দিতেই গ্রীক বাহিনী তার নৌবাহিনীকে ছেড়ে অন্য দিকে মন দেয়। এদিকে কাছেই এক পাহাড়ের চূড়া থেকে এই দৃশ্য দেখে জারজিস মনে করেন আরতেমিসিয়া শত্রু জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছেন এবং তার সাহসিকতার ভূয়সী প্রশংসা করেন। জারজিস তার যুদ্ধ কৌশলে এতই মুগ্ধ হন যে তিনি বলেন,“আমার পুরুষেরা সব মেয়েমানুষ হয়ে গেছে আর মেয়েরা পুরুষ হয়ে উঠেছে”। আরতেমিসিয়া অন্য জেনারেলদের পরামর্শের বিরুদ্ধে গিয়ে জারজিসকে এশিয়া মাইনরে পিছিয়ে যাওয়ার জন্য বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধে পারস্যের সবচেয়ে বড় পরাজয় ঘটে।
৫. ফু হাও
ফু হাও ছিলেন চীনের সাং রাজবংশের রাজা উ ডিং এর স্ত্রী, যিনি ১২৫০ থেকে ১১৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন এবং সফল নারী সেনাপতি সম্ভবত তিনিই। তিনি একইসাথে সর্বোচ্চ পূজারী এবং সেনাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, সে সময়ের জন্যে যা ছিল এক অভিনব ব্যাপার। ইয়িনঝুতে (সাং রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ, ইয়িন) তার সমাধি সব সম্পদসহ সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় আবিষ্কৃত হয়েছে। সমাধিতে পাওয়া গেছে নানা রকম অস্ত্র ও সমরসজ্জা। আধুনিক পন্ডিতেরা মূলত সাং রাজবংশের ওরাকল অর্থাৎ হাড়ের তৈরি শিল্প নিদর্শনে পাওয়া লেখা প্রাচীন লিপি থেকে তার কথা জানতে পারেন।
প্রাচীন চিত্রে তাকে বহু সামরিক অভিযানে নেতৃত্ব দিতে দেখানো হয়েছে। তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর প্রধান অধিনায়ক। বহু প্রজন্ম ধরে টু-ফ্যাং গোত্র সাং সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গেছে। ফু হাও অবশেষে তাদেরকে একক যুদ্ধে এমনভাবে পরাজিত করেন যে, আর কখনোই তারা সাং সাম্রাজ্যের জন্যে হুমকি হয়ে উঠতে পারেনি। এরপর তিনি প্রতিবেশী ইয়ি, কিয়াং এবং বা-ফ্যাং এর বিরুদ্ধে আরো বড় অভিযান চালান এবং বিশাল সাফল্য অর্জন করেন। বিশেষ করে ‘বা’ এর যুদ্ধ ছিল চীনের ইতিহাসে পাওয়া প্রাচীনতম বড় মাপের গেরিলা হামলা। এই যুদ্ধের বর্ণনায় বা-ফ্যাং বাহিনীকে মরণফাঁদে ডেকে আনতে ফু হাও’র বিশেষ সমরকৌশলের পরিচয় পাওয়া যায়। প্রায় ১৩,০০০ সৈন্য নিয়ে তিনি তার সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর নেতা ছিলেন। এই বিজয়ের কিছুকাল পরেই শারীরিক ক্লান্তি ও দুর্বলতায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং অত্যন্ত সম্মানের সাথে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।
৪. প্রথম আহহোতেপ
প্রথম আহহোতেপ মিশরের নতুন রাজত্ব্ প্রতিষ্ঠাকালে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ধারণা করা হয়, অষ্টাদশ রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে তিনিই কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেন। তার বাবার মৃত্যুর পর রাজপ্রতিভূ হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে তিনি অত্যন্ত প্রভাবশালী জীবনযাপন করেছেন। মিশরে হিসকোস বাহিনীর আগ্রাসনের পর তিনি তার দুই ছেলে কামোসে এবং আহমোসের মাধ্যমে সমগ্র মিশরকে একত্রিত করেন। হিসকোস হানাদারদের মিসর থেকে বিতাড়িত করতে তিনিই ছিলেন মূল চালিকাশক্তি। ৯০ বছরের দীর্ঘ জীবনের পর, যে থিবসকে তিনি সর্বদা রক্ষা করে গেছেন, সেখানেই কামোসের পাশে তিনি সমাধিস্থ হন।
মিসরীয় ঐতিহাসিকেরা সেই সময়ে প্রথম আহহোতেপের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বলা হয়, তিনিই মিসরের রীতিনীতি, নিয়ম-কানুন বাস্তবায়িত করেছেন এবং মিশরের যত্ন নিয়েছেন। তিনি সৈন্যদের দেখভাল করেছেন, প্রহরী হয়ে দেশের রক্ষা করেছেন, পলাতকদের মাতৃভূমিতে ফিরিয়ে এনেছেন। যারা দেশ পরিত্যাগ করেছে তাদেরকেও পুনরায় একত্র করেছেন। মিসরের উত্তরাংশে তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন ও তার বিদ্রোহীদের বহিষ্কার করেছেন।
মৃত্যুর পর তাকে ‘যোদ্ধা রানী’ হিসেবে সম্মানিত করা হয়। হিসকোসদের বিতাড়িত করতে তার ভূমিকার স্বীকৃতি স্বরূপ তার পুত্র তাকে ‘অর্ডার অব ভেলর’ প্রদান করেন। মাছি আকৃতির এই নেকলেস তার সমাধিক্ষেত্র থেকে পাওয়া গেছে। এছাড়া অন্যান্য অস্ত্রের সাথে একটি খোদাই করা কুঠার পাওয়া গেছে, যেখানে দেখানো হয়েছে প্রথম আহমোসে এর আঘাতে এক হিসকোস সৈন্য লুটিয়ে পড়ছে। আমুনরার মন্দিরে প্রথম আহমোসে তার সম্মানে একটি স্টিলা (কাঠের বা পাথরের খোদাই করা স্ল্যাব) স্থাপন করেন, যেখানে তার সামরিক অর্জনের প্রশংসা করা হয়েছে।
৩. সেইন্ট জোয়ান অব আর্ক
ইতিহাসে সেইন্ট জোয়ান অব আর্ক এর আবির্ভাব ঘটে এক অবিশ্বাস্য ঘটনার মধ্য দিয়ে। তিনি ফ্রান্সের যুবরাজের সামনে হাজির হয়ে দাবি করেন, স্বয়ং ঈশ্বরের প্রেরিত বার্তায় তাকে ফ্রান্সকে মুক্ত করতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে করার সংকেত দেয়া হয়েছে। সে সময় ফ্রান্স এবং ইংরেজদের মাঝে প্রায় শতবর্ষের যুদ্ধ চলছে। মুকুটহীন রাজা সপ্তম চার্লস তাকে অরলিয়েন্স (Orléans) এর অবরোধ ক্ষেত্রে পাঠান। মাত্র ৯ দিনে অবরোধ উত্তোলন করতে পেরে তিনি বিরাট স্বীকৃতি লাভ করেন। পরপর বেশ দ্রুত কয়েকটি জয়ের পর তিনি সপ্তম চার্লসকে নিয়ে রাজ্যাভিষেকের উদ্দেশ্যে রেইমসে (Rheims) যাত্রা করেন। মাত্র সতের বছর বয়সে একটি জাতির গোটা সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দান করার কৃতিত্ব ইতিহাসে একমাত্র তারই আছে। দীর্ঘদিন গলা ও মাথায় আঘাতের ক্ষত নিয়েও তিনি দেশকে বারবার জয়ী করেন।
কিন্তু তৎকালীন ধর্মযাজকেরা তার এই ক্রমবর্ধমান প্রভাব মেনে নিতে পারেনি। তাকে অধর্ম তথা খ্রিস্টধর্মের বিরুদ্ধে যাওয়ার অপরাধে দায়ী করে ভুয়া বিচারের সম্মুখীন করা হয় এবং শাস্তিস্বরূপ তাকে শূলে চড়িয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার বহু বছর পর, পোপ সেই বিচার কার্জ অবৈধ ঘোষণা করেন এবং তাকে ‘সন্ত’ হিসেবে ঘোষণা করেন।
২. জেনোবিয়া
সেপটিমা জেনোবিয়া ২৫০ সাল থেকে প্রায় ২৭৫ সাল পর্যন্ত সিরিয়ার শাসনকর্তা ছিলেন। সমরাস্ত্রে সজ্জিত জেনোবিয়া ঘোড়ার পিঠে চড়ে তার সেনাবাহিনীকে যুদ্ধক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতেন। জেনোবিয়ার স্বামী অডেনথাস ছিলেন রোম নিযুক্ত সিরিয়ার শাসনকর্তা। তার মৃত্যুর পর জেনোবিয়া শাসক পদে অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু তিনি রোমান সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগে সিরিয়ার আশেপাশের অঞ্চল এবং মিসরীয় বিদ্রোহ দমন করে মিসর দখল করেন। এ সময় মিসর পুনর্দখলের চেষ্টায় রোমের সম্রাট ক্লডিয়াসের সৈন্যবাহিনী তার কাছে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়। ফলে এশিয়া মাইনরের একটি বড় অংশ থেকে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
আর্মেনিয়া, আরব ও পারস্য তার সাথে মিত্রতা স্থাপন করে এবং তিনি নিজেকে উত্তরাধিকার সূত্রে মিশরের রানী ঘোষণা করেন। ধীরে ধীরে জেনোবিয়া রোমান সাম্রাজ্যের সম্পূর্ণ পূর্বাঞ্চল নিজ শাসনের অধীনে নিয়ে আসেন এবং রোমকে অগ্রাহ্য করে নিজের রাজত্বের সীমানা বৃদ্ধি করেন। ক্লডিয়াসের উত্তরসূরী সম্রাট অরেলিয়ান জেনোবিয়াকে পরাজিত করতে তার সবচেয়ে অভিজ্ঞ সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করে। তারপরও দীর্ঘ চার বছরের যুদ্ধ আর অবরোধের পর অবশেষে রাজধানী শহর পালমায়রার পতন ঘটে।
কথিত আছে জেনোবিয়ার সঙ্গে মিত্র প্রদেশগুলোর আরও ৯ রানীকে শিকল পরিয়ে রোমের রাস্তায় রাস্তায় ঘোরানো হয়। অরেলিয়ান রাজনীতিতে জেনোবিয়ার প্রভাব কমাতে তাকে টাইবুরে (মতান্তরে রোমে) নির্বাসিত করে। নির্বাসিত হলেও অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে, এক রোমান প্রাসাদে তিনি বাকি জীবন অতিবাহিত করেন। তার কন্যারা রোমান প্রভাবশালী পরিবারে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ফলে আরও প্রায় তিন শতাব্দী ধরে রোমান রাজনীতিতে নির্বাসিত জেনোবিয়ার বংশ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছিল। তারই বংশধর মাভিয়া ৩৭০ সাল থেকে ৩৮০ সাল পর্যন্ত এক আরব বেদুইন গোত্রের রানী ছিলেন। তিনি রোমান বাহিনীকে পরাজিত করে তার গোত্রের অনুকূলে শান্তি চুক্তি করেন এবং রোমান সম্রাট ভ্যালেন্সের সেনাপ্রধানের সাথে তার মেয়েকে বিয়ে দিয়ে একটি মজবুত সম্পর্ক স্থাপন করেন।
১. তামার, জর্জিয়া
তামার (কারো কারো মতে তামারা) ছিলেন জর্জিয়ান রাজা তৃতীয় জর্জের কন্যা। তামারের বাবা তার মৃত্যুর পর যেকোনো মতানৈক্য ও বিভেদ রোধে জীবদ্দশায় তাকে যুগ্ম শাসক নিয়োজিত করেন এবং সিংহাসনের উত্তরাধিকার ঘোষণা করেন। তার বাবার মৃত্যুর পর তামার অসামান্য শাসক হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। নারী হওয়ার কারণে শুরুতে স্বাভাবিকভাবেই অভিজাত মহলে নানারকম চক্রান্ত ও কূটচালের সম্মুখীন হয়েছেন তামার, এমনকি বিদ্রোহের আশঙ্কাও দেখা দেয়। কিন্তু অসামান্য বুদ্ধিমত্তা আর কূটনৈতিক দক্ষতায় কোনোরূপ সহিংসতা ছাড়াই তিনি সব অভিযোগকারীদের মনে স্থান করে নেন। প্রজারা ভালোবেসে তাকে ‘রাজাদের রাজা’ ও ‘রানীদের রানী’ উপাধি দিয়েছিলেন।
তামার সামরিক নেতা হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতেন। সেই সাথে সাহিত্য ও শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতায় তার বিশেষ ভূমিকা ছিল। তার শাসনকালে জর্জিয়া সাম্রাজ্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছায়। তার জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা মহাকাব্য ‘দ্য নাইট ইন দ্য প্যানথার’স স্কিন’ আজও জর্জিয়ার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিবেচিত। বর্তমানে জর্জিয়ার সোনালি যুগ হিসেবে ইতিহাসে যে সময়ের বর্ণনা করা হয়, রানী তামার ছিলেন তার সূতিকাগার।
১২০১-১২০৩ সালের মধ্যে জর্জিয়া আর্মেনিয়ার তৎকালীন রাজধানী আনী ও দ্বভিন অধিকার করে নেয়। ১২০৪ সালে তামার তার সেনাবাহিনী নিয়ে ক্বার শহর দখল করেন । একই সময়ে তামার কৃষ্ণ সাগরের দক্ষিণে ত্রেবিজন্ড সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেন, বর্তমানে যার রাজধানী ত্রাবজোন তুরস্কের অন্তর্ভুক্ত। তামার এতটাই জনপ্রিয় ও শক্তিশালী রানী ছিলেন যে তাকে ‘মেপে’ উপাধিতে সম্বোধন করা হতো, যার অর্থ ‘রাজা’ এবং তার স্বামীর উপাধি ছিল ‘রাজসঙ্গী’। অত্যন্ত ক্ষমতাশালী এই রানী ১২১৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে জর্জিয়ান অর্থোডক্স চার্চ তাকে ‘হোলি রাইচাস কুইন তামার’ নামে সম্মানিত করে।