আরব্য রজনীর গল্পের সেই রাজার কথা আমরা অনেকেই জানি, যিনি প্রতিদিন সকালে একটি করে নতুন বিয়ে করতেন। যদিও সেটা নিছকই গল্প, কিন্তু ইতিহাসে এমন অনেক রাজা-বাদশাহর সন্ধান পাওয়া যায়, যারা যথেচ্ছ বৈবাহিক জীবন যাপন করতেন। বর্তমানে অবশ্য এ ধরনের অনুশীলন অনেকটাই বন্ধ হয়ে এসেছে। কিন্তু এই আধুনিক যুগেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমন কিছু পুরুষের সন্ধান পাওয়া যায়, যাদের কেউ কেউ শতাধিক বিয়ে করেছেন। চলুন জেনে নেই এ ধরনের কিছু মানুষের কথা।
জাইয়াওনা চানা, ভারত (৩৯ স্ত্রী)
ভারতের জাইয়াওনা চানার পরিবারটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরিবার হিসেবে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। তার স্ত্রীর সংখ্যা ৩৯ জন, সন্তান-সন্ততির সংখ্যা ৯৪ জন, পুত্রবধূদের সংখ্যা ১৪ জন এবং দৌহিত্র-দৌহিত্রির সংখ্যা ৩৩ জন। চানা তার পরিবার নিয়ে অত্যন্ত গর্বিত। তিনি মনে করেন, অনেক বেশি সংখ্যক স্ত্রী থাকার কারণে তার দেখাশোনা করার মানুষের কখনো অভাব হবে না। ফলে তিনি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন।
জাইয়াওনা চানার জন্ম ১৯৪৫ সালে, ভারতের মিজোরাম প্রদেশের একটি গ্রামে, যা বাংলাদেশ ও মায়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত। ১৭ বছর বয়সে তিনি প্রথম বিয়ে করেন। তার প্রথম স্ত্রী জাথিয়াঙ্গি তার চেয়ে বয়সে তিন বছরের বড়। এরপর থেকে তিনি নিয়মিত বিয়ে করতে শুরু করেন। তিনি একই বছরে সর্বোচ্চ ১০টি বিয়ে করেছিলেন। চানা তার ১৮১ জন সদস্যের বিশাল পরিবার নিয়ে ১০০টি কক্ষ বিশিষ্ট চার তলা একটি ভবনে বসবাস করেন।
চানা নিজে নিচতলার একটি বড় শয়নকক্ষে থাকেন। প্রতিদিন তার সাথে কোন স্ত্রী থাকবে, সেটি একটি তালিকা অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। তার অপেক্ষাকৃত তরুণী স্ত্রীরা একই তলার অন্য কক্ষগুলোতে থাকে, আর বয়স্ক স্ত্রীরা দোতলায় একটি বড় হলরুমে থাকে। দিনের বেলা তিনি সবসময় একই সাথে ৭-৮ জন স্ত্রী নিয়ে চলাচল করেন। চানার ৩৯ স্ত্রীর মধ্যে ২২ জনেরই বয়স ৪০ এর নিচে। তার সর্বকনিষ্ঠ স্ত্রীর বয়স ৩৫ বছর। তার স্ত্রীদের দাবি, তারা সবাই তাকে ভালোবাসেন এবং সবার মধ্যে বেশ মিলমিশ আছে।
জাইয়াওনা চানা নিজেকে খ্রিস্ট ধর্মের একটি শাখা ‘চানা পল’ এর প্রধান বলে দাবি করেন, যে শাখাটি তারা বাবার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। খ্রিস্টধর্মে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ হলেও এই শাখাটিতে বহুবিবাহের অনুমতি আছে। এই শাখাটির অনুসারীর সংখ্যা মাত্র ২,০০০ হলেও, তাদের আশা খুব শীঘ্রই তারা বিশ্বের অন্যতম প্রধান ধর্মে পরিণত হবে। জাইয়াওনা চানার সবচেয়ে বড় পরিবারের সংবাদটিকে রিপ্লি’জ বিলিভ ইট অর নট তাদের ২০১১ সালের ভুক্তিতে বিশ্বের সবচেয়ে অদ্ভুত ঘটনার তালিকায় ১১ নম্বরে স্থান দেয়। চানার বয়স ৭২ বছর হলেও তিনি আরও বিয়ে করার মাধ্যমে পরিবারের আকার আরো বৃদ্ধি করার আকাঙ্খা ব্যক্ত করেন।
সালাহ আল-সায়েরি, সৌদি আরব (৫৮ স্ত্রী)
সালাহ আল-সায়েরি একজন ব্যবসায়ী। তার স্ত্রীর সংখ্যা মোট ৫৮ জন। তবে তিনি সবার নাম মনে করতে পারেন না। ইসলাম ধর্মে এক সাথে চারজনের বেশি স্ত্রী রাখার অনুমতি নেই, তাই ধর্মকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য তিনি প্রথম তিন স্ত্রীকে ঠিক রেখে কয়দিন পরপর চতুর্থ স্ত্রীকে তালাক দিয়ে নতুন করে বিয়ে করেন। সে হিসেবে যেকোনো সময় তার সর্বাধিক স্ত্রীর সংখ্যা মাত্র ৪, কিন্তু মোট স্ত্রীর সংখ্যা ৫৮।
আল-সায়েরি প্রথম বিয়ে করেছিলেন মাত্র ১৪ বছর বয়সে। এরপর থেকে প্রায় প্রতি বছরই তিনি একটি করে বিয়ে করেছেন। তার পুত্র ১০ জন এবং কন্যা ২২ থেকে ২৮ জনের মধ্যে। সংখ্যাটি তিনি নিজেও নিশ্চিত না। তার সবার নামও তিনি জানেন না। তবে তিনি একটি তথ্য পরিষ্কার ভাবে জানাতে পেরেছেন। সেটা হলো, এতগুলো বিয়ে করতে এবং স্ত্রীদেরকে তালাক দেওয়ার পর তাদের মোহরানা শোধ করতে তার সর্বমোট ১৬ লাখ মার্কিন ডলার খরচ হয়েছে।
টাকা সায়েরির জন্য খুব বড় কোনো ব্যাপার না। গাড়ি ব্যবসার বদৌলতে তার সম্পত্তির অভাব নেই। তার স্ত্রীদের মধ্যে যেন কোনো ঝামেলা সৃষ্টি না হয়, সেজন্য তিনি চার স্ত্রীকে পৃথক পৃথক ভিলাতে রাখেন। তালাক পাওয়ার পর তার প্রায় সব স্ত্রীরই আবার নতুন করে বিয়ে হয়েছে। তবে এত বেশি সংখ্যক স্ত্রী এবং তাদের নতুন পরিবারের কারণে অনেক সময় সামাজিক সমস্যাও সৃষ্টি হয়। তার ছেলেমেয়েদের সবার সাথে সবার পরিচয় নেই। তার দুই ছেলে এবং দুই মেয়ে স্কুলে পড়াশোনার এক পর্যায়ে জানতে পেরেছিল যে, তারা একই পিতার সন্তান।
ওয়ারেন জেফস, যুক্তরাষ্ট্র (৮০ স্ত্রী)
ওয়ারেন জেফস ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উটাহ অঙ্গরাজ্যের FLDS (Fundamentalist Church of Jesus Christ of Latter-Day Saints) নামক মৌলবাদী চার্চের প্রধান। তার পূর্বে তার বাবা ছিলেন এই চার্চের প্রধান। বাবার মৃত্যুর পর জেফস চার্চের প্রধান হন এবং বাবার চালু করা ধর্মবিশ্বাস অনুশীলন করে যান। খ্রিস্টান ধর্মে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ হলেও তিনি দাবি করেন, চার্চের জন্য নিয়োজিত ব্যক্তিদেরকে স্বর্গলাভের জন্য কমপক্ষে তিনটি বিয়ে করতে হবে। এর বাইরে যে যতবেশি বিয়ে করবে, সে স্বর্গের ততবেশি নিকটবর্তী হবে।
চার্চের প্রধান হিসেবে জেফস এলাকার সবার সামাজিক জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। অপ্রাপ্তবয়স্কদেরকে বিয়ে দেওয়া, আত্মীয়দের মধ্যে বিয়ে দেওয়া, অপরাধের শাস্তিস্বরূপ একজনের স্ত্রীকে অন্যজনের কাছে হস্তান্তর করা সহ অসংখ্য অপরাধের জন্য তিনি দায়ী ছিলেন। তার নিজের স্ত্রীর সংখ্যা ছিল ৮০ জন। এর মধ্যে ১৮ জন ছিল তার সৎ মা, যাদেরকে তিনি তার বাবার মৃত্যুর পরে বিয়ে করেন। তার বাবার স্ত্রীর সংখ্যা ছিল ২০ জন। এদের মধ্যে শুধু দুজনকে জেফস বিয়ে করেননি।
জেফসের বিরুদ্ধে শিশুদের উপর যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ, সমকামিতা, অজাচার সহ অসংখ্য অভিযোগ ওঠে। এমনকি, তার নিজের দুই সন্তানও তার বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ তোলে। ২০০৬ সালে উটাহ কোর্ট থেকে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে তিনি আত্মগোপন করেন। ফলে এফবিআই তাকে তাদের সেরা দশ ওয়ান্টেড লিস্টে স্থান দেয়। পরবর্তীতে তিনি এফবিআই’র হাতে গ্রেপ্তার হন। বিচারে তার যাবজ্জীবন এবং আরো ২০ বছরের কারাদন্ড হয়। বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন।
বেল্লো আবুবকর, নাইজেরিয়া (৯৭ স্ত্রী)
মোহাম্মদ বেল্লো আবুবকর, যিনি বাবা মাসাবা নামেই বেশি পরিচিত, তিনি ছিলেন নাইজেরিয়ার এক বিতর্কিত কবিরাজ। তিনি সর্বমোট ১০৭টি বিয়ে করেন, যাদের ১০ জনকে তালাক দেওয়ার পরেও তার স্ত্রীর সংখ্যা ছিল ৯৭ জন। তাদের সবাইকে নিয়ে তিনি একই বাড়িতে বসবাস করতেন। তার সর্বমোট সন্তান-সন্ততির সংখ্যা ছিল ২০৩ জন।
ইসলাম ধর্মে সর্বোচ্চ চারটি বিয়ে করার অনুমতি আছে, তা-ও স্ত্রীদের অধিকারের ক্ষেত্রে পুরোপুরি সমতা রক্ষা করতে পারার শর্তে। কিন্তু বেল্লো আবুবকর, যিনি একসময় স্থানীয় ইমাম ছিলেন, ইসলামের অপব্যাখ্যা করে দাবি করেন, যেহেতু চারটির বেশি বিয়ে করার কোনো শাস্তি কুরআনে বর্ণিত হয়নি, তাই যতো খুশি ততো বিয়ে করা যাবে। ২০০৮ সালে, যখন তার স্ত্রীর সংখ্যা ছিল ৮৬ জন, তখন স্থানীয় শরিয়া কোর্টের নির্দেশে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বিচারে তাকে ৮২ স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়, কিন্তু বেল্লো তাতে রাজি হননি। শরিয়া কোর্টে তার মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করলেও পরবর্তীতে নাইজেরিয়ার হাইকোর্ট তাকে মুক্ত করে দেয়।
বেল্লো অধিকাংশ বিয়েই করেছিলেন তার কাছে চিকিৎসা নিতে আসা মেয়েদেরকে। তবে তার বক্তব্য অনুযায়ী, তিনি না, বরং মেয়েরাই তাকে বিয়ে করতে আগ্রহী হয়। ২০০৮ সালে তার গ্রেপ্তারের পর আল-জাজিরার সাথে সাক্ষাৎকারে তার স্ত্রী এবং সন্তানদেরকে তার পক্ষ অবলম্বন করতে দেখা যায়। তার এক স্ত্রী বলেন, অধিকাংশ মানুষই দুই স্ত্রীকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কিন্তু তিনি যেহেতু ৮৬ স্ত্রীকে নিয়ে কোনো সমস্যা ছাড়াই সংসার করতে পারছেন, তাহলে বুঝতে হবে যে, আসলেই তার মধ্যে কিছু একটা আছে। ২০১২ সালে এক সাক্ষাৎকারে বেল্লো বলেন, তিনি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বিয়ে করে যাবেন। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
অ্যসেন্টাস ওগোয়েল্লা আকুকু, কেনিয়া (১০০’র অধিক স্ত্রী)
কেনিয়ার সমাজ বহুগামিতার জন্য বিখ্যাত। কয়েক দশক আগে সম্পদশালী কেনিয়ান পুরুষদের অনেকেই একাধিক বিবাহ করত। কিন্তু তাদের কেউই অ্যাসেন্টাস আকুকুর ধারেকাছে ঘেঁষতে পারেনি। আকুকুর সর্বমোট স্ত্রীর সংখ্যা শতাধিক। তার সন্তান-সন্ততির সংখ্যা দুইশোরও বেশি। তার ছেলেমেয়েদের সংখ্যা এত বেশি যে, তিনি শুধু তাদের পড়াশোনার জন্য পৃথক একটি বিদ্যালয় এবং তাদের প্রার্থনার জন্য একটি চার্চ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
আকুকুর ডাকনাম ছিল ডেঞ্জার আকুকু। যুবক বয়সে তিনি মেয়েদের কাছে অতিরিক্ত আকর্ষণীয় ছিলেন বলেই এই নামকরণ। তিনি প্রথম বিয়ে করেন ১৯৩৯ সালে। এরপর ৭০ বছর ধরে তিনি তার বিয়ে করার অভ্যাস অব্যাহত রাখেন। তবে এত বেশি বিয়ে করলেও শেষ পর্যন্ত সবাইকে তিনি ধরে রাখেননি। অধিকাংশ স্ত্রীকেই তিনি বিভিন্ন সময় অনৈতিকতার অভিযোগে ডিভোর্স দেন। ২০১০ সালে ৯৪ বছর বয়সে যখন তিনি মৃত্যু বরণ করেন, তখন তার স্ত্রীর সংখ্যা ছিল ১২ জন।