(১ম পর্বের পর থেকে) আজকের সোমালিয়া আর অতীতের সোমালিয়ায় ফারাক বিস্তর। সিয়াদ বারের বামঘেঁষা একতান্ত্রিক শাসন সোমালিয়াকে কিছুটা ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। কিন্তু ওগাদেন যুদ্ধ এবং গোত্রতান্ত্রিক বিভেদকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্র শাসনের অপচেষ্টা সোমালিয়ার জন্য কোনো সুফল বয়ে আনেনি। গণহত্যা, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ আর সংঘাতরত পক্ষগুলোর কারণে অল্প সময়েই সিয়াদ বারের সরকার নড়বড়ে অবস্থায় চলে যায়। ১৯৯১ এর শুরুতে সিয়াদ রাজধানী ছেড়ে পালান, সোমালিয়ার সরকার একরকম বিলুপ্ত হয়ে যায়।
এ লেখায় আমরা দেখব, নব্বই দশকের শুরু থেকে কীভাবে সোমালিয়ার ক্ষমতাধর গোষ্ঠীগুলো অনর্থক রক্তপাতে নিমগ্ন ছিল। ঐক্যের ব্যর্থ প্রচেষ্টা আর জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়েও আলোকপাত হবে।
যুদ্ধরত পক্ষগুলো
সিয়াদ বারের পতনের পর অন্তত ১৩টি গোষ্ঠী সোমালিয়ার ক্ষমতা দখলের সংঘাতে লিপ্ত হয়। দেশটির পরিস্থিতি বুঝতে হলে এই সশস্ত্র দলগুলোর অন্তত নাম জেনে রাখাটা সহায়ক হবে। সবচেয়ে পুরনো সংগঠন হচ্ছে ইসাক গোত্রের সোমালি ন্যাশনাল মুভমেন্ট (এসএনএম)। মোগাদিসুতে মাঝেমধ্যে হানা দিলেও এরা মূলত প্রাক্তন ব্রিটিশ সোমালিয়ায় অবস্থানরত, কারণ সেখানকার আশি ভাগ অধিবাসীই ইসাক গোত্রভুক্ত। নিয়মিত নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আর শৃঙ্খলার কারণে এসএনএম বাকি দলগুলোর তুলনায় সংহত।
স্বঘোষিত স্বাধীন সোমালিল্যান্ড শাসন করে এসএনএম। তাদের শত্রুর তালিকায় রয়েছে জিবুতি সমর্থিত ইসাক গোত্রীয় সংগঠন ইউনাইটেড সোমালি ফ্রন্ট (ইউএসএফ)। পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে অবস্থান করছে গাদ্দুবারসি গোত্রের সংগঠন সোমালি ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (এসডিএ)। এর আবার দুই ভাগ, একদল বিচ্ছিন্নতাবাদী সোমালিল্যান্ডের সমর্থক, আরেক দল বিরুদ্ধে। দারুদ গোত্রীয় ইউনাইটেড সোমালি পার্টি (ইউএসপি)-কেও বাদ দেওয়া চলে না।
১৯৭৮ সালে গঠিত হলেও মাজেরতিন গোত্রের সোমালি স্যালভেশন ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এসএসডিএফ) মূলত ১৯৮৯ থেকে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। বর্তমানে দলটি তিনভাগে বিভক্ত। ইউনাইটেড সোমালি কংগ্রেস (ইউএসসি) হচ্ছে হাওউই গোত্রের সংগঠন। এর আবার দু’টি অংশ; রোমভিত্তিক ইউএসসি এর নেতা আলী মাহদি এবং সোমালিয়া ভিত্তিক ইউএসসি এর নেতা জেনারেল আইদিদ। সোমালিয়ার যুদ্ধে ইউএসসি ছিল প্রধানতম খেলোয়াড় এবং বাকিরা সুযোগ বুঝে ইউএসসির দু’টি পক্ষকে সমর্থন দিয়ে গিয়েছে। উল্লেখ্য, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী রোমভিত্তিক গ্রুপটির সমর্থক।
এছাড়াও আছে সোমালি প্যাট্রিওটিক মুভমেন্ট (এসপিএম)। এর নেতা কর্নেল ওমার জেস। ওগেদান গোত্রের এই সংগঠনটি পূর্বে বারের সমর্থক হলেও পরে নিজেরাই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। সামরিক ক্ষেত্রে এসপিএম আলী মাহদীর সমর্থক। মধ্য সোমালিয়ায় ক্রমাগত যুদ্ধ থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য লেকাসি আর ওরটবলে গোত্র গঠন করেছে সোমালি ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন (এসএনডিইউ)।
সোমালি ন্যাশনাল ফ্রন্ট (এসএনএফ) হচ্ছে একমাত্র অগোত্রীয় সংগঠন। বারের সমর্থকদের এই দলটি শুরুতে ইউএসসিকে টক্কর দেওয়ার মত ক্ষমতা ধরলেও পরে যুদ্ধ হেরে প্রায় বিলীন হয়ে যায়। এছাড়াও রয়েছে দক্ষিণের ডিগিল আর রাহানোয়েন গোত্রের সংগঠন সোমালি ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (এসডিএম)। সামরিক বিচারে দুর্বল হলেও সোমালিয়ার মোট জনসংখ্যার ৪০ ভাগ এই গোত্র দু’টির অন্তর্ভুক্ত। আইদিদ আর আলী মাহদীকে সমর্থন করতে গিয়ে সংগঠনটি দু’ভাগ হয়ে গিয়েছে।
ছোট ছোট সংগঠনের মধ্যে ছিল জেনারেল আইদিদের সমর্থক, কিন্তু দুর্বল সামরিক শক্তির সাউদার্ন সোমালি ন্যাশনাল মুভমেন্ট (এসএসএনএম)। দক্ষিণের অন্যান্য সংগঠনের তালিকায় রয়েছে সোমালিয়ার কৃষ্ণাঙ্গদের সংগঠন সোমালি আফ্রিকান মুকি অর্গানাইজেশন (এসএএমও) এবং নিম্ন জুবা অঞ্চলের অসোমালি জনগণের সংগঠন সোমালি ন্যাশনাল ইউনিয়ন (এসএনইউ)। শেষোক্ত দু’টির সামরিক সক্ষমতা প্রায় শূন্য।
মোগাদিসুর যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ
সিয়াদ বারে দেশ ছাড়লেও তার সাঙ্গপাঙ্গরা এসএনএফ গঠন করে মোগাদিসু কব্জায় রেখেছিল। কিন্তু ইউএসসি, এসএনএমসহ কয়েকটি সংগঠন একত্রে আক্রমণ করে মোগাদিসু দখল করে নেয়। বেশুমার মারামারি, লুটপাট আর হত্যার কারণে ইউএসসি’র প্রতি অন্যান্য মোর্চাভুক্ত সংগঠনগুলো ক্ষিপ্ত হয়ে পক্ষত্যাগ করে। মোগাদিসুতে ইউএসসি’র দুই নেতা- জেনারেল আইদিদ আর আলী মাহদির মধ্যে যুদ্ধ লেগে গেল। অন্তত ১৪ হাজার মানুষ নিহত হয়। এ সুযোগে সৈয়দ হারসি মরগ্যানের নেতৃত্বে এসএনএফ পুনরায় মোগাদিসু অভিমুখে অভিযান শুরু করে। তিনি অবশ্য হেরে যান এবং জেনারেল আইদিদের সাথে দু’দফা সংঘর্ষের ফলে সোমালিয়ার দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে সৃষ্টি হয় দুর্ভিক্ষ আর মানবিক সংকট। অন্তত ১৫ লক্ষ সোমালি দেশে-বিদেশে শরণার্থীতে পরিণত হয়।
জাতিসংঘের আগমন (১৯৯২-১৯৯৫)
উপসাগরীয় যুদ্ধ নিয়ে মেতে থাকায় সোমালিয়ার এ দুর্দশা আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর নজর কাড়েনি। এবারে কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সবাই ছুটে এল। পশ্চিমারা ভেবেছিল, একদল ছেলে-ছোকরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সোমালিয়া তছনছ করছে, এদেরকে শায়েস্তা করা কোনো ব্যাপারই নয়। ফলে, সোমালি সমস্যার কোনো রাজনৈতিক সমাধান ছাড়াই শান্তিরক্ষী পাঠিয়ে দেওয়া হলো। নেতৃত্বে যথারীতি যুক্তরাষ্ট্র। শুরুর কয়েক মাসে অবশ্য বিশেষ গোল বাঁধেনি। ৬০ ভাগ জনগণ ও ৩৫ শতাংশ অঞ্চল ছিল জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রণে। মোগাদিসু ছাড়াও অনেক অঞ্চলে খাদ্য বিতরণ শুরু হয়, কিছুটা শান্ত ভাবও দেখা দিল। তবে এসবই ছিল ঝড়ের পূর্বাভাস।
আইদিদ, ওমার জেস বা হারসি মর্গ্যানের মতো নেতারা সামরিক শক্তিধর ছিলেন, কিন্তু তাদের গোত্রগুলোর নেতৃত্ব ছিল আবার ভিন্ন মানুষদের হাতে। কাজেই সোমালিয়ায় শান্তির পূর্বশর্ত ছিল দু’টি। এক, যুদ্ধলিপ্সু সামরিক নেতাদের নিরস্ত্রীকরণ আর দুই, গোত্রগুলোর নেতাদের মাঝে বোঝাপড়ার মাধ্যমে একটি চলনসই শাসন কাঠামো সৃষ্টি। সোমালিয়ার এসব নেতা ঠিক ইউরোপীয় কায়দায় আলাপ-আলোচনার মর্ম বুঝতেন না। তাদের শান্তি আলোচনার ধরন ছিল দীর্ঘ আলাপ, দিনের পর দিন পুরনো সংঘর্ষ আর ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নিকাশ, ক্ষতিপূরণ আদান-প্রদান ইত্যাদি। জাতিসংঘ আর মার্কিন সমর্থিত মিশনের কর্তারা এসবের গুরুত্ব বোঝেননি। তাদের দরকার দ্রুত সাফল্য।
এর পেছনের রাজনীতিটাও সরল। উপসাগরীয় যুদ্ধ ইরাকে নিদারুণ মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল। কাজেই সোমালিয়ায় দ্রুত আর সফল একটা মিশনের মাধ্যমে ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার ছিল জরুরি। যেনতেন প্রকারে সোমালিদের একটি সমঝোতায় সই করানো ছিল উদ্দেশ্য। যুদ্ধবাজ নেতাদের নিরস্ত্রীকরণ না করেই স্রেফ প্রতিশ্রুতির ওপর ভরসা করাটা যে মারাত্মক ভুল ছিল, তা আজ অস্বীকারের উপায় নেই।
তো সোমালি নেতারা পশ্চিমা পয়সায় আদ্দিস আবাবায় গিয়ে কষে বাজার-সদাই আর ফূর্তি করলেন আর নামকাওয়াস্তে কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফিরে এলেন। কার্যকর কোনো ফল হল না। ওদিকে সশস্ত্র বাহিনীগুলোও আন্তর্জাতিক ত্রাণ ইচ্ছামতো লুটপাট করে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিল। বিরক্ত হয়ে ১৯৯৩ নাগাদ যুক্তরাষ্ট্র তার ২৬,০০০ সৈন্যের অধিকাংশকেই সরিয়ে নেয়। সোমালিয়ায় রইল কেবল জাতিসংঘসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা আর অল্প কিছু সৈন্য। যুক্তরাষ্ট্রের মতো জাতিসংঘের নেতৃত্বেরও সোমালি সমস্যা সমাধানের কোনো বিস্তারিত পরিকল্পনা ছিল না।
আলী মাহদী সুচতুরভাবে আন্তর্জাতিক কর্তাদের সাথে একটা বোঝাপড়া করে শক্তি সঞ্চয় করছিলেন। ওদিকে আইদিদ এতে ক্ষিপ্ত হতে থাকলেন। ফলাফল? মোগাদিসু জুড়ে আবার সংঘর্ষ বেঁধে গেল। যুক্তরাষ্ট্র পুনরায় সেনা পাঠায়। আন্তর্জাতিক শক্তিও ছিল আলী মাহদীর পক্ষে। সোমালি সমাজ আবার বিভক্ত হতে থাকে।
১৯৯৩ এর অক্টোবরে মার্কিন ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার গুলি করে ফেলে দেয় আইদিদের সৈন্যরা। মোগাদিসুর রাস্তায় মার্কিনদের লাশ টেনে-হিঁচড়ে প্রদর্শিত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয়বারের মতো সোমালিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় ক্ষান্ত দেয়। সাথে সাথে পশ্চিমা শক্তিগুলোও তাদের সৈন্য সরিয়ে নিতে থাকে। ১৯৯৪ এর মার্চ নাগাদ দেখা গেল, শান্তিরক্ষী বাহিনীতে কেবল তৃতীয় বিশ্বের দেশের সৈন্যরা রয়েছে। এই দেশগুলোর আর্থিক সক্ষমতা বা সোমালিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার কোনো ইচ্ছা ছিল না। কাজেই, ১৯৯৫ সাল নাগাদ আন্তর্জাতিক শান্তির ফেরিওয়ালারা কোনো অর্জন ছাড়াই সোমালিয়া থেকে পাততাড়ি গোটাল।
বর্তমান সোমালিয়া
ধরে নেওয়া হয়েছিল, আন্তর্জাতিক পক্ষগুলো চলে যাওয়ার পর সোমালিয়া চুরমার হয়ে যাবে। বাস্তবে কিন্তু কিছুটা ভিন্নতা দেখা গেল।
সোমালিয়ার গোত্রপ্রধান আর যুদ্ধবাজ নেতাদের আয়ের একটা বড় উৎস ছিল আন্তর্জাতিক বাহিনী আর সংস্থা। এদের নিরাপত্তা, যাতায়াতের ব্যবস্থা আর বাসস্থানের এন্তেজামের বিনিময়ে বিপুল টাকা তারা আয় করত। আবার আন্তর্জাতিক ত্রাণের চোরাকারবার থেকেও কম অর্থ আসত না। এখন এ উৎস বন্ধ হওয়ায় সোমালিরা দেখল, একটা বাণিজ্যিক ব্যবস্থা না থাকলে তো টেকা কঠিন। অনেক নেতাই তাই বিনিয়োগের মাধ্যমে একটা নিজস্ব অর্থনীতি দাঁড় করিয়ে ফেললেন। গরুর ব্যবসা, মধ্যপ্রাচ্য থেকে পাঠানো অর্থ আর প্রবাসী সোমালিদের বিনিয়োগের সমন্বয়ে সোমালিয়া জুড়ে একটা অপ্রাতিষ্ঠানিক কিন্তু রমরমা বাণিজ্য ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। আন্তর্জাতিক জলসীমায় বাণিজ্য জাহাজের ওপর সোমালি জলদস্যুদের বেদম আক্রমণগুলোও এ সময় থেকেই শুরু হয়।
তবে রাষ্ট্রের অনুপস্থিতি বরাবরই একটা সমস্যা থেকে গেল। জেনারেল আইদিদ ১৯৯৮ সালে নিহত হন। আলী মাহদী ২০০০ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ইউনিয়ন অব ইসলামিক কোর্ট নামক সংগঠন আবার ২০০৬ নাগাদ মোগাদিসুসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে নেয়। পরে মূলত ইথিওপিয়ার সাহায্যে তিন বছর যুদ্ধের পর মোগাদিসু আবার সরকারি নিয়ন্ত্রণে আসে। সেখানে একটা জোড়াতালির সরকার বিরাজ করছে। জঙ্গীগোষ্ঠী আল শাবাবসহ বিভিন্ন যুদ্ধবাজ নেতা সোমালিয়ার আভ্যন্তরীণ অঞ্চলগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।
১৯৯১ সালে সোমালিয়ার উত্তর-পশ্চিমাংশ, অর্থাৎ ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত অংশের নিয়ন্ত্রণ নেয় ইসাক গোত্রের এসএনএম। অন্যান্য কয়েকটি গোত্রের সাথে সমঝোতার সরকার গড়ে স্বাধীন সোমালিল্যান্ড ঘোষিত হয়। অবশ্য সোমালিল্যান্ডের কোনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই। নব্বইয়ের দশকে দুই প্রধান নেতা, মোহাম্মদ ইগাল আর আব্দ-এর রহমান তুর; নিজেদের মধ্যে বিরোধে লিপ্ত হলেও সোমালিল্যান্ডের পরিস্থিতি বর্তমানে বাকি অঞ্চলের তুলনায় শান্ত বলা চলে।