ইতিহাস নিয়ে জানার মজা হলো, সেই শুরু থেকে এখন পর্যন্ত মানবজাতির ইতিহাসে ঘটে যাওয়া নানাবিধ ঘটনা ইতিহাস বিষয়ক একজন লেখকের হাত ধরে জীবন্ত হয়ে ওঠে। আমরা স্বচক্ষে দেখিনি সেই সময়ের কোনোকিছুই, নিজেদের কানে শুনিনি তাদের মুখ থেকে নির্গত কোনো বাক্য, শুধু দেখেছি তাদের ব্যবহার্য নানাবিধ জিনিসপত্র, দেখেছি তাদের স্মৃতিবিজড়িত সেসব জিনিসেই লুকিয়ে আছে তাদের সম্পর্কে অজানা সব জ্ঞান। আর সেসব অজানার ভেতর থেকেই ইতিহাসবিদগণ উদঘাটন করেন নানা দরকারি তথ্য, যা আমাদের জানার আকাঙ্ক্ষাকে করে তোলে পরিপূর্ণ।
ইতিহাসবিদগণের হাত ধরে এভাবেই ‘কানেক্টিং দ্য ডটস’ কথাটা বেশ চমৎকার এক রুপ পায়। এই পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল, কিন্তু ঝামেলা বাধে যখন সেখানে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নানা অপ-তথ্য মিশিয়ে দেয়া হয়, প্রতিপক্ষকে ফাঁসানো কিংবা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনের জন্য নানা মনগড়া কাহিনী জুড়ে দেয়া হয়। এভাবেই তৈরি হয় ইতিহাসের এমন সব ঘটনার, যেসবের বাস্তবে অস্তিত্ব না থাকলেও মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ার কারণে মানুষ একসময় সেগুলোই বিশ্বাস করতে শুরু করে।
রোর বাংলার নতুন এই সিরিজের মাধ্যমে আমরা ইতিহাসের এমন সব বিষয় নিয়েই আলাপ করব, তুলে ধরব ইতিহাসে প্রচলিত এমন সব মিথ্যা ঘটনাই, সেই সাথে তুলে আনা হবে প্রকৃত সত্য বিষয়টিও!
১) ভাইকিংদের হেলমেটে কি শিং থাকতো?
ভাইকিংদের কথা বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই শুনে থাকবেন। বিশেষত, বর্তমানের আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে বিনোদনের নানা মাধ্যমেই দেখা মেলে তাদের। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই ভাইকিং বলতে আসলে কাদের বোঝায়?
সহজ করে বললে, স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চলের, অর্থাৎ ডেনমার্ক, নরওয়ে ও সুইডেনের সমুদ্রে ভ্রমণকারী একদল মানুষকেই আমরা ভাইকিং বলে চিনি। ৮ম শতকের শেষভাগ থেকে একেবারে ১১শ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত ইউরোপ থেকে শুরু করে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করে তারা। বিভিন্ন এলাকায় তারা অভিযান চালাত, স্থাপন করত নিজ নিজ সম্প্রদায়ের বসতিও, তবে আজকাল বিভিন্ন বিনোদন মাধ্যমে তাদের যতটা ভয়ানক বা যুদ্ধপ্রিয় হিসেবে দেখান হয়, অতটা তারা কখনোই ছিল না।
সে যা-ই হোক, ভাইকিংদের নিয়ে একটা নাতিদীর্ঘ লেকচার হয়ে গেল। আমাদের মূল আলাপ অবশ্য তারা কারা এটা নিয়ে না, সেজন্য গুগলই আছে, বরঞ্চ তাদের একটা সুনির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে।
উপরের ছবিটি আরেকবার দেখুন। দুজন ভাইকিং যোদ্ধার মাথায় যে হেলমেট আছে, তাতে শিংও যুক্ত আছে। কিন্তু… ভাইকিংদের হেলমেটে কি আসলেই শিং থাকতো?
না ! না !! না !!!
সত্যি বলতে, ভাইকিংদের সময়ে তাদের যেসব বর্ণনা পাওয়া গিয়েছে, কিংবা যেভাবে তারা চিত্রায়িত হয়েছে, সেখানে তাদেরকে খালি মাথায় কিংবা আমরা যেসব সাধারণ হেলমেটের সাথে পরিচিত সেসব পরিধানরত অবস্থাতেই দেখা গিয়েছে। প্রত্নতত্ত্ববিদগণ আজ পর্যন্ত ভাইকিং আমলের এমন একটি হেলমেটও খুঁজে পাননি, যেখানে তারা শিংযুক্ত হেলমেট পরে আছে। ‘ভাইকিং হেলমেট’ বলতে যা বোঝায়, তা পরিপূর্ণরুপে এখন পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছে মাত্র একটিই, সেটাও সেই ১৯৪৩ সালে নরওয়ের জের্মুন্ডবু ফার্মে। বলা বাহুল্য, ১০ম শতকের সেই হেলমেটেও কোনো শিং ছিল না।
তাহলে ভাইকিংদের হেলমেটে শিং গজালো কীভাবে?
এজন্য আমাদের চলে যেতে হবে উনিশ শতকে। এই যেমন সুইডেনের চিত্রশিল্পী গুস্তাভ ম্যাল্মস্টর্ম তার চিত্রকর্মে ভাইকিংদের হেলমেট পরিয়ে দিয়েছিলেন। আবার ১৮৭০ এর দশকে জার্মান কম্পোজার ও থিয়েটার ডিরেক্টর রিচার্ড ওয়াগনারের এপিক মিউজিক ড্রামা ‘Der Ring des Nibelungen’ (নিবেলাংয়ের আংটি) মঞ্চস্থ করবার সময় কস্টিউম ডিজাইনার কার্ল এমিল ডোয়েপ্লার প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় জার্মান শিংওয়ালা হেলমেট পরিয়ে দিলেন ভাইকিংদের মাথায়!
গ্রীক ও রোমান ঐতিহাসিকেরা অবশ্য ইউরোপের উত্তরাঞ্চলের মানুষদের মাথায় এমন শিংযুক্ত হেলমেট দেখার কথা জানিয়েছেন। পাশাপাশি সেগুলোতে পাখির ডানা কিংবা হরিণের মাথার মতো একেবারে শাখা-প্রশাখাযুক্ত শিংও থাকতো। তবে, এগুলো কেবলমাত্র উৎসবের সময়ই পরিধান করা হতো। আবার, এই ফ্যাশন ভাইকিং সভ্যতার আগমনের কমপক্ষে এক শতাব্দী আগেই বিলীন হয়ে যায়।
ভাইকিংদের হেলমেটে এই শিং আসার পেছনে আরেকটি কথাও বলা হয়। তৎকালীন ইউরোপের খ্রিস্ট-ধর্মাবলম্বীরা চেয়েছিল ভাইকিংদের যেন আরও বর্বর ও পৌত্তলিক ধরনের দেখায়। ফলে বিভিন্ন চিত্রকর্মেই ভাইকিংদের হেলমেটে শিং জুড়ে দেয়া হয়, যা অনেকটা শয়তানের শিংয়েরই অনুরুপ!
তো… কী বুঝলেন? ভাইকিংদের হেলমেটে কখনোই শিং ছিল না। সবই মিডিয়ার সৃষ্টি!
২) দ্বাদশ শতকের ক্যাথেড্রালে মহাকাশচারী!
ছবিতে দেখা যাচ্ছে একজন মহাকাশচারীকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে স্থাপত্যকর্মের মাধ্যমে। এটা আসলে বর্তমানে অবাক হবার মতো কোনো বিষয় না। তবে আপনি জেনে অবাক হবেন, যে ভবনের গায়ে এই মহাকাশচারীর ভাষ্কর্যটি আছে, সেটি নির্মিত হয়েছে কয়েকশ বছর আগে!
ইন্টারনেটে যখন এই ছবিটি ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন এটা নিয়ে নানা রকম কন্সপিরেসি থিওরি জন্ম নেয়। কিন্তু একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলেই এর সত্যতা বেরিয়ে আসে।
স্পেনের পশ্চিমাঞ্চলের শহর সালামাঙ্কা। এই শহরে রয়েছে দুটি ক্যাথেড্রাল- ওল্ড ক্যাথেড্রাল (দ্বাদশ শতকে যাত্রা শুরু), এবং নিউ ক্যাথেড্রাল (ষোড়শ শতকে যাত্রা শুরু)।
প্রথম যখন এই ছবিটি ভাইরাল হলো এবং মানুষজন সালামাঙ্কার ক্যাথেড্রালেই এই মহাকাশচারীর ভাষ্কর্যটি আছে জানলো, তখন সবাই ধরে নিল- এটা বোধহয় তাহলে দ্বাদশ শতকে তৈরি। কিন্তু প্রায় আটশো বছর আগে কেউ কীভাবে মহাকাশচারীর এতটা নিখুঁত ভবিষ্যদ্বাণী করে যেতে পারবে?
তখন জানা গেল- না, এটা আসলে নিউ ক্যাথেড্রালের। তাহলেও তো একই প্রশ্ন থেকে যায়, শুধু সময়টা কমে নয়শো বছর থেকে চারশো বছর হয়ে যায়।
এরপরই জানা গেল আসল সত্য। মহাকাশচারীর এই ভাষ্কর্যটি দ্বাদশ শতকের তো নয়ই, এমনকি ষোড়শ শতকেরও নয়, এটি ক্যাথেড্রালে যুক্ত হয়েছে ১৯৯২ সালে!
আসলে সেই সময় ক্যাথেড্রালটিতে বেশ কিছু সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ড চালানো হয়। এর সাথে যারা যুক্ত ছিলেন, তারা ভবনের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য সমকালীন নানা শিল্পকর্মও যুক্ত করেন সেই ক্যাথেড্রালে। তাদের মাঝে একটু ব্যতিক্রম ছিলেন জেরোনিমো গার্সিয়া। তাই তিনি একেবারে মহাকাশচারীকেই ধরে আনলেন! অবশ্য তার এই ক্ষুদে ভাষ্কর্য যে এত আলোচনা আর কন্সপিরেসি থিওরির বিষয় হয়ে উঠবে, তা বোধহয় তিনি মোটেও আন্দাজ করতে পারেননি।
(চলবে)