তাকে ছাড়িয়ে আর কিছু নেই এই পৃথিবীতে, এই ধরিত্রীর বুকে তার থেকে উঁচু কিছুই নেই। উপরে শুধুই আকাশ। তাকে ঘিরে রয়েছে দুই পাশে দুটি ছোট্ট ভূখন্ড। দক্ষিণে নেপাল আর উত্তরে তিব্বত। মাঝে সে স্থির দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে, সোজা, উঁচু, সবাইকে ছাড়িয়ে যেন আকাশকে আলিঙ্গন করতে চায়। নেপালীরা তাকে ডাকে ‘সাগরমাথা’ বলে। তিব্বতীরা ডাকে ‘কুমুলুংমা’ নামে, যার অর্থ পৃথিবীর জননী। কিন্তু সারা বিশ্বের মানুষ এই নামে তাকে খুব একটা চেনে না। আমরা তাকে চিনি ‘মাউন্ট এভারেস্ট’ নামে। হিমালয় পর্বতমালার সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্ট। পৃথিবীর সর্বোচ্চ এই গিরিশৃঙ্গের নাম রাখা হয়েছিল জর্জ এভারেস্ট নামক প্রাক্তন এক সার্ভেয়ার জেনারেলের নামে। কীভাবে এই শৃঙ্গের নামকরণের সাথে জর্জ এভারেস্টের নাম জড়িয়ে গেলো সেসব অজানা কাহিনী নিয়ে সাজানো আজকের এই লেখা।
জর্জ এভারেস্টের জন্ম ১৭৯০ সালের ৪ জুলাই, যুক্তরাজ্যের ওয়েলসের ব্রেকনকশায়ারে। পিতা-পিতামহ সকলেই ছিলেন সুপরিচিত। বাবা উইলিয়াম ট্রিসট্রাম এভারেস্ট ছিলেন একজন সলিসিটর। জর্জ এভারেস্ট রয়্যাল আর্মি কলেজ এবং উইলউইচের রয়্যাল মিলিটারি একাডেমীতে পড়াশোনা করেন। সামরিক স্কুলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ করে জর্জ ১৮০৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। তিনি বেঙ্গল আর্টিলারিতে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন লাভ করেন।
সাত বছর তিনি বাংলায় কাটান। ইন্দোনেশিয়ার জাভার জরিপের জন্য দু’বছর (১৮১৪-১৮১৬) সেখানে কাটিয়ে আবার বাংলায় ফিরে আসেন। এই সময় তিনি গঙ্গা ও হুগলির আশেপাশের অঞ্চলগুলোর জরিপের কাজে ব্রিটিশদের সহায়তা করেন।
সেসময় জলপথ ছিল যাতায়াতের একটি উল্লেখযোগ্য মাধ্যম। বিভিন্ন নদীতে গাছ পড়ে মাঝে মাঝে এসব পথ বন্ধ হয়ে যেত। জর্জের কিছু সুপারিশ কার্যকর করে প্রশাসনের কর্মকর্তারা এক্ষেত্রে বেশ সুফল পেয়েছিলেন। ১৮২৭ সালে জর্জ রয়্যাল সোসাইটির ‘ফেলো’ হন। এই সময় সমগ্র ভারতবর্ষে বেশ জমিয়ে শাসন চালাচ্ছিলো ইংরেজরা। কিন্তু এই পুরো ভূখন্ড সম্পর্কে ততটুকু ওয়াকিবহাল ছিল না ব্রিটিশ সরকার। ফলে ইংরেজ সরকার ভূখন্ড জরিপের কাজে হাত দেয়। জরিপ হলো কোনো দেশের বা অঞ্চলের কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে সঠিক তথ্য বের করার এক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি।
জর্জ এভারেস্টের প্রসঙ্গে বলতে গেলে আরও একজনের প্রসঙ্গে না বললেই নয়। তিনি হলেন উইলিয়াম ল্যাম্বটন। ১৭৫৩ সালে ইংল্যান্ডের ডারহামে তার জন্ম বলে অনুমান করা হয়। তিনিই ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম ‘গ্রেট ট্রাইগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভে’র (জিটিএস) প্রবর্তক। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের পর ১৮২১ সালে এই ভারতবর্ষে প্রথম সার্ভে রীতি চালু হয়। পাহাড়ের চূড়া মাপার ক্ষেত্রে অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশ, চৌম্বকক্ষেত্র প্রভৃতি নির্ণয় করা প্রয়োজন পড়ে। এ কারণে জিটিএস খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যবস্থা।
১৮০৬ সালে কর্নেল উইলিয়াম ল্যাম্বটনের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় এই উপমহাদেশে গ্রেট ট্রাইগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভের কাজ শুরু হয়। ১৮১৮ সালে হায়দ্রাবাদে ল্যাম্পটনের প্রধান সহকারী হয়ে বছর পাঁচেক কাজ করেছিলেন জর্জ। তাদের সঙ্গে ছিল ৩৬ ইঞ্চির একটি বড় থিয়োডোলাইট, যার সাহায্যে ল্যাম্বটন ও জর্জ এভারেস্ট জিটিএস পদ্ধতিতে এই উপমহাদেশে জরিপের কাজ এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এভারেস্ট এবং ল্যাম্পটন বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বুঝতে পেরেছিলেন, নেপালের জঙ্গলে ওই যন্ত্রকে ৩০ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চতায় না বসানো গেলে পর্বতশৃঙ্গগুলোর উচ্চতা পরিমাপ করা কঠিন হবে।
১৮২৩ সালের ২০ জানুয়ারি ৭০ বছর বয়সে ল্যাম্বটন মৃত্যুবরণ করেন। এই সময় ব্রিটিশ সরকার জর্জ এভারেস্টকে সার্ভে অব ইন্ডিয়ার সুপারিন্টেনডেন্ট নিযুক্ত করে। ল্যাম্বটনের মৃত্যুর পর সরকার এই জরিপের দায়িত্ব দেন জর্জ এভারেস্টকে। এই কাজে তাকে সহায়তা করার জন্য তখনকার কলকাতা হিন্দু কলেজের তরুণ গণিতবিদ রাধানাথ শিকদারকে নিযুক্ত করেন জর্জ। ল্যাম্বটনের অসমাপ্ত কাজ শেষ করার ব্যাপারে উদ্যোগী হলেন জর্জ এভারেস্ট। ১৮০৬ সালে উইলিয়াম ল্যাম্বটন দক্ষিণ ভারতে যে জরিপ কাজ শুরু করেন তা পরবর্তীতে জর্জ এভারেস্ট এগিয়ে নিয়ে যান। ১৮৩০ সালে জর্জ এভারেস্টকে সার্ভেয়ার জেনারেল পদে পদোন্নতি দেয়া হয়।
১৮৩০-৪৩ সাল পর্যন্ত জর্জ ব্রিটিশ ভারতের সার্ভেয়ার জেনারেল পদে নিযুক্ত ছিলেন। এ সময় তিনি দক্ষিণ ভারত থেকে নেপাল পর্যন্ত বৃত্তাকৃতির গ্রেট ট্রাইগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভের মধ্য দিয়ে প্রায় ২,৪০০ কিলোমিটার বা ১,৪৯১ মাইল পর্যন্ত এক বিস্তৃত জরিপ করে ব্রিটিশ সরকারের কাছে বেশ প্রশংসা অর্জন করেন।
জর্জ বরাবরই ছিলেন অনুসন্ধিৎসু মনের একজন ব্যক্তি। শুধু তা-ই নয়, তিনি একজন উদ্ভাবকও ছিলেন। ভারতবর্ষের সার্ভেয়ার জেনারেল হিসেবে তার কর্মময় সময়ে তিনি তার ব্যবহৃত সরঞ্জামগুলোতে অনেক পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করেছিলেন, যা জরিপের কাজকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে। এই কাজের জন্য তিনি হেনরি ব্যারো নামের একজন ব্যক্তিকে নিযুক্ত করেন এবং সেসব যন্ত্রপাতি তৈরি করার জন্য স্থানীয় এক ভারতীয়কে নিযুক্ত করেন।
তিনিই প্রথম ভারতের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত বিশাল এলাকা সম্বলিত পাহাড়ী অঞ্চলগুলোর উপর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ব্যাপক সার্ভে শুরু করেন। একপর্যায়ে জর্জ হিমালয়ের সবচেয়ে উচ্চ শৃঙ্গের অবস্থান নির্ণয় করার সিদ্ধান্ত নেন। সুযোগ সুবিধাবিহীন, পদে পদে বিপদ থাকা সত্ত্বেও জর্জ এই কাজটি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি কাজটি সমাপ্ত করতে সক্ষম হননি। কারণ তার আগেই চাকরি থেকে অবসর নেয়ার সময় উপস্থিত হওয়ায় এই কাজ তিনি শেষ করে যেতে পারেননি।
প্রায় ১৮৪৩ সাল পর্যন্ত ভারতবর্ষের বিভিন্ন ধরনের জরিপের কাজে সুদূরপ্রসারী কিছু কাজকর্ম করেন জর্জ। প্রায় ২৫ বছর ধরে তিনি এই উপমহাদেশে ত্রিকোণমিতিক জরিপের কাজ এগিয়ে নিয়ে যান। জরিপের কাজে বিজ্ঞানীদের সাহায্যের জন্য ‘গ্রেট ট্রাইগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভের’ ওপর তিনি উল্লেখযোগ্য কাজ করেন। তার উল্লেখযোগ্য কাজগুলোর মধ্যে আছে হিমালয় হতে কুমারিকা অন্তরীপ পর্যন্ত বিস্তৃত পটভূমির মধ্যরেখার পরিমাপ, টেলিগ্রাফ লাইন, জরিপের কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির মানোন্নয়ন প্রভৃতি। ১৮৪৩ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে জর্জ এভারেস্ট চলে যান ইংল্যান্ডে এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন।
জর্জ এভারেস্টের অবসরের পর এই পদে নিযুক্ত হন কর্নেল অ্যান্ড্রু স্কট ওয়াগ। তার অধীনে নতুন উদ্যমে শুরু হয় হিমালয় জরিপের কাজ। কিছুদিনের মধ্যেই ওয়াগ হিমালয়ের কিছু বরফে ঢাকা পর্বতশৃঙ্গের উচ্চতা পরিমাপ ফেলেন। এই সময়ে তিনি পর্যবেক্ষণ করছিলেন হিমালয়ের একটি শৃঙ্গকে। তার মনে হচ্ছিল, এই শৃঙ্গটি কাঞ্চনজঙ্ঘার চেয়েও উঁচু। কিন্তু তথ্য-প্রমাণ ছাড়া এই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। তাই তিনি কাঞ্চনকে পিক ‘এ’ আর অপরটিকে পিক ‘বি’ হিসেবে চিহ্নিত করে তার সহকর্মীদের তথ্য জোগাড়ের জন্য পাঠালেন। পরবর্তীতে এই শৃঙ্গকে ‘পিক-ফিফটিন’ নামেও অভিহিত করা হয়। সহকর্মীদের দেয়া প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে দেখা গেলো, ‘পিক-ফিফটিন’ শৃঙ্গের উচ্চতা ২৯,০০২ ফুট আর কাঞ্চনজঙ্ঘার উচ্চতা ২৮,১৬৪ ফুট।
কর্নেল ওয়াগ প্রাপ্ত এই তথ্যের যথার্থতা পরীক্ষার জন্য আরো কিছুদিন সময় নিলেন। যখন তিনি নিশ্চিত হলেন যে, কাঞ্চনজঙ্ঘা নয়, বরং হিমালয়ের ‘পিক ফিফটিন’ই সর্বোচ্চ শৃঙ্গ, তখন তিনি এই তথ্য প্রকাশ করলেন বিশ্ববাসীর কাছে।
সাধারণত পর্বতের নাম সেই অঞ্চলের মানুষ যে নামে ডাকে সে নামেই নির্দিষ্ট হবে- এরকম এক নিয়ম চালু করেছিলেন জর্জ এভারেস্ট নিজেই। হিমালয় পর্বতমালার অন্য শৃঙ্গগুলোকে তাদের আঞ্চলিক নামেই বিশ্ববাসী চেনে। কিন্তু হিমালয়ের এই সর্বোচ্চ শৃঙ্গটি যখন আবিষ্কৃত হলো, তখন এর কোনো একক আঞ্চলিক নাম পাওয়া গেলো না কিংবা খোঁজার চেষ্টা করা হলো না। দেশপ্রেমিক কর্নেল ওয়াগ আঞ্চলিক নামের প্রতি উৎসাহ না দেখিয়ে ১৮৫৬ সালে রয়্যাল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটির কাছে এক লিখিত প্রস্তাবে ‘জর্জ এভারেস্ট’-এর নামে এই সর্বোচ্চ পর্তশৃঙ্গের নামকরণ করার জন্য সুপারিশ করেন। এভারেস্ট নিজে কিন্তু এই প্রস্তাবে খুব একটা সম্মত ছিলেন না।
তিনি বরাবরই প্রচারবিমুখ থাকতে ভালোবাসতেন। কিন্তু তার এই বিরোধিতা কেউ খুব একটা আমলে নেননি। ভারতের সার্ভেয়ার জেনারেল হিসেবে জর্জ এভারেস্টের কৃতিত্বকে সম্মান জানিয়েই ১৮৬৫ সালে জর্জ এভারেস্টের নামে পৃথিবীর উচ্চতম পর্বত শৃঙ্গের নাম ‘মাউন্ট এভারেস্ট’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় রয়্যাল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি।
১৮৬১ সালে ব্রিটিশ সরকার জর্জ এভারেস্টকে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করে। ১৮৬২ সালে তিনি রয়্যাল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটির ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। মাউন্ট এভারেস্ট স্বীকৃতির এক বছর পরেই ১৮৬৬ সালের ১ ডিসেম্বর ৭৬ বছর বয়সে লন্ডনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ফিচার ইমেজ: Bro4u.com