মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। এই উপমহাদেশে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যিনি মহাত্মা গান্ধীর নাম শুনেনি। কেউবা তাকে বাপু বলে ডাকতে পছন্দ করেন। ধুতি আর চাদর পরিহিত কালো ছোটখাটো শুকনো মানুষটা ভারতের জাতির পিতা। অহিংস মতবাদ ও সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রবক্তা গান্ধী। মহাত্মা তার উপাধি। মহান আত্মা যার। উপাধিটি দিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের দিকপাল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আজ আমরা মহাত্মা গান্ধীর জীবনের কিছু অজানা অংশের দিকে আলোকপাত করবো।
গান্ধী কিশোর বয়সে বিয়ে করেছিলেন। করেছিলেন বললে খানিক ভুল হবে, করানো হয়েছিল। কাস্তবাইয়ের সাথে তার ৭ বছর বয়সেই বিয়ে ঠিক হয়। ১৮৮৩ সালে ১৩ বছর বয়সের গান্ধীকে ১৪ বছর বয়সী কাস্তবাইয়ের সাথে বিয়ের বন্ধনে বেঁধে দেয়া হয়। সেই বন্ধন গান্ধী সারাজীবন অটুট রেখেছিলেন। শুধু তাই নয়, গান্ধীর সকল আন্দোলনের অন্যতম অনুপ্রেরণাদাত্রীও ছিলেন কাস্তবাই। যদিও ৩৭ বছর বয়সে গান্ধী নারী সংসর্গ পরিত্যাগ করেন। বৈবাহিক জীবনে কাস্তবাই এবং গান্ধী ৪ ছেলে সন্তানের জন্ম দেন।
ধুতি চাদর পরিহিত নিরামিষভোজী যে গান্ধীকে আমরা জানি তিনি লন্ডনে পড়াশুনাকালীন সময়ে পুরোদস্তর সাহেব ছিলেন। নিয়মিত নাচ এবং বেহালা শিখতেন। কোট টাই পড়ে সাহেবি কায়দার ছড়ি ঘুরাতেন।
গান্ধী সারাজীবনে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছিলেন। ইংরেজিতে Experiment যাকে বলে। তার মধ্যে একটি হলো ধুমপান এবং গোমাংস ভক্ষণ। মা পুতলিবাই এবং দেওয়ান পিতার ঘরে গান্ধীর জন্ম। পুতলিবাই ছিলেন কঠিন ধর্মানুরাগী নারী। তিনি প্রতিদিন উপোস করতেন এবং নিরামিষাশী ছিলেন। ধর্মীয় অনুশাসনে গান্ধী বড় হন। যার ফলে গান্ধীর কখনোই কোন বদভ্যাস ছিল না বরং ছোটবেলা থেকেই মা তাকে জীবে দয়া করা, অহিংসা এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মাঝে পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের কথা শুনাতেন। বিদেশ যাবার কালে মা তাকে পইপই করে শপথ করিয়ে ছিলেন যে তিনি মদ, মাংস এবং নারী হতে বিরত থাকবেন। পরীক্ষা নিরীক্ষাবাদী গান্ধী বড় ভাইয়ের সাথে একবার ধূমপান করলেন কিন্তু ভালো না লাগেনি। এক মুসলিম বন্ধু, শেখ মেহতাব তাকে বুঝিয়েছিলেন যে, ইংরেজরা মাংস খায় বলেই এত বুদ্ধি তাদের, এত দেশ শাসন করতে পারে। আর ভারতীয়রা নিরামিষাশী বলেই এখনো তাদের প্রজা হয়ে আছে। গান্ধী সেই বন্ধুর কথায় প্রভাবিত হয়ে গরুর মাংস খেলেন।
সারাবিশ্বের সকল নেতার অনুপ্রেরণার ব্যক্তিত্ব মহাত্মা গান্ধী ছোটবেলায় খুবই অন্তর্মুখী স্বভাবের ছিলেন। তিনি স্কুল শেষ হলে কোন রকমে দৌড়ে বাড়ি চলে আসতেন। কেননা সহপাঠীদের সাথে একেবারেই মিশতে পারতেন না। লজ্জায় মুখে কথাই আসতো না গান্ধীর, আর বন্ধুই বা বানাবেন কিভাবে। লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে এসেও গান্ধী সেই মুখচোরাই ছিলেন। ব্যবসায় প্রসার ছিল না। প্রসার হবেই বা কিভাবে? আদালতে দাঁড়িয়ে কথা বলতে গেলে তার যে পা কাঁপত। বিপক্ষের উকিল কিছু বললে তিনি আমতা আমতা করে কোন উত্তরই দিতে পারতেন না। এমন উকিলকে কে চাইবে? অগত্যা দক্ষিণ আফ্রিকায় পাড়ি দিলেন গান্ধী।
শুরুর দিকে দক্ষিণ আফ্রিকায় জুলু যুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে সৈনিকদের চিকিৎসাকেন্দ্রে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যোগ দেন। ভাগ্যের ফেরে গান্ধী একটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠানে দেনা আদায়কারীর চাকুরি পেয়ে যান। তখন দক্ষিণ আফ্রিকা ব্রিটিশ এবং ডাচ শাসনাধীন। ভারতীয়রা সংখ্যালঘু হওয়ায় বর্ণ বৈষম্যের শিকার হত। গান্ধী বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন এবং সত্যাগ্রহের ধারণা সেখান থেকেই শুরু। যে ঘটনাটি গান্ধীর ভেতরকার নেতৃত্বের আগুনটি জ্বালিয়ে দেয় –
- ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট থাকা সত্ত্বেও তাকে কালো এবং ভারতীয় বলে ফার্স্ট ক্লাস কামরায় বসতে তো দেয়নি বরং বিষয়টি নিয়ে বিবাদ করায় তাকে ট্রেন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া হয়। এই ঘটনাটি গান্ধীর মনে দাগ কেটেছিল।
স্বদেশী আন্দোলনের সময় সকল বিদেশী পণ্য বিশেষত ব্রিটিশ পণ্য বর্জন করা হয়। এর পথ ধরে তিনি সকল ভারতীয়কে ব্রিটিশ পোশাকের বদলে খাদি পরার আহ্বান জানান। তিনি সকল ভারতীয় পুরুষ ও মহিলা, ধনী ও গরিব মানুষকে দৈনিক খাদীর চাকা ঘুরানোর মাধ্যমে স্বাধীনতার আন্দোলনকে সমর্থন করতে বলেন। এটি এমন একটি কৌশল ছিল যা নিয়মানুবর্তিতা ও আত্মত্যাগের অনুশীলনের মাধ্যমে অনিচ্ছা ও উচ্চাকাঙ্খা দূরীকরণের পাশাপাশি আন্দোলনে মহিলাদের যুক্ত করে, এ সময়ে মহিলাদের করা এ সকল কাজকে অসম্মানজনক বলে মনে করা হত।
লবণের উপর অতিরিক্ত কর আরোপ করায় গান্ধী হাজার হাজার ভারতীয়দের সাথে পায়ে হেঁটে ডান্ডির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। ইতিহাস একে Salt March বলে থাকে। শুধু মাত্র নিজ হাতে লবণ তৈরির জন্য পায়ে হেঁটে ১২ই মার্চ থেকে ৬ই এপ্রিল পর্যন্ত এলাহাবাদ থেকে ডান্ডি পৌছান। এলাহাবাদ থেকে ডান্ডি প্রায় ২৪১ মাইল। সে সময় ব্রিটিশরাজ সেই অপমানের বদলা নিতে ৬০,০০০ ভারতীয়কে গ্রেপ্তার করে। ৬০,০০০ ভারতীয়!
হাঁটা নিয়ে মহাত্মা গান্ধীর বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। গান্ধী জীবনে এত হেঁটেছেন যে তাতে পুরো পৃথিবী দুইবার চক্কর দেয়া সম্ভব। অর্থাৎ দিনে প্রায় ১৮ কিলোমিটার করে হাঁটতেন তিনি।
গান্ধী তার জীবদ্দশায় দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ভারতে সব মিলিয়ে ১৩ বার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। সবচেয়ে বড় সাজার আদেশ পেয়েছিলেন ১৯২২ সালে Young India পত্রিকায় ব্রিটিশ বিরোধী জ্বালাময়ী আর্টিকেল লেখার জন্য তাকে ৬ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয় কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে ১৯২৪ সালেই মুক্তি দেয়া হয়।
গান্ধী আমেরিকা যাননি কখনো। তিনি মনে করতেন, তিনি যেহেতু জাতির পিতা (ভারতীয়রা গান্ধীকে বাপু বলে ডাকতেন), জাতির অধিকাংশ মানুষই গরিব, সেই গরিবের পিতা হয়ে তিনি কিভাবে বিমান ভ্রমণ করবেন? দেশ বিদেশে গান্ধীর অনেক ভক্ত তৈরি হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট হেনরি ফোরড ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম গান্ধী যাকে নিজের সাক্ষরযুক্ত একটি চরকা উপহার দিয়েছিলেন।
গান্ধী নিয়মিত তলস্তয়কে চিঠি লিখতেন। হিটলারের সাথেও বেশ চিঠি চালাচালি দেখা গিয়েছিল। যুদ্ধ বন্ধের অনুরোধ করে গান্ধী হিটলারকে একটি চিঠি লিখলেও তা আর হিটলারের কাছে পৌছায়নি। কারণ ব্রিটিশ সরকার এতে হস্তক্ষেপ করেছিলেন।
আমরা ভালো কাজকে পুরস্কৃত করে থাকি। কিন্তু কিছু কিছু কর্ম থাকে, কিছু কিছু মানুষ থাকেন যারা সকল পুরস্কারের ঊর্ধ্বে, বরং পুরষ্কার তাদের মহৎ কর্মকে খাটো করে। গান্ধী হলেন তেমনি পুরস্কারের ঊর্ধ্বের মানুষ। যাকে নোবেল কমিটি ৫ বার নোবেল মনোনয়ন দিয়েছিল। ১৯৩৭, ১৯৩৮, ১৯৩৯ এবং ১৯৪৭ সালে মনোনয়ন দিলেও ১৯৪৮ সালে শান্তিতে নোবেল গান্ধিরই পাবার কথা ছিল। কিন্তু ২ অক্টোবর আততায়ীর গুলিতে মৃত্যু হওয়ায় গান্ধীকে পুরষ্কার দিয়ে খাটো করা যায়নি।
যে দেশের বিরুদ্ধে গান্ধী সারাজীবন যুদ্ধ করেছিলেন সেই গ্রেট ব্রিটেন তার মৃত্যুর ২১ বছর পর তার সম্মানার্থে স্ট্যাম্পে গান্ধীর ছবি ছাপায়।
গান্ধীর সম্মানে ভারতে ৫৩ টি বড় রাস্তা এবং সারা পৃথিবী জুড়ে ৪৮ টি রাস্তার নামকরণ করা হয় গান্ধীর নামে। শুধু তাই নয়, Time Magazine এর Man of the Year 1930 হয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী।
গান্ধীর শেষকৃত্যে ১০ লক্ষ মানুষের সমাগম হয়েছিল যা প্রায় ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ হয়েছিল। কেন মানুষ ভালবাসবে না এমন মানুষকে?