হ্যানিবাল যখন আল্পসের পাদদেশে শিবির ফেললেন, সিপিও তখন সাগরপথে ইট্রুরিয়া পৌঁছে সেখান থেকে আল্পস অঞ্চলের দিকে এসে পড়েছেন। এখানে তিনি রোমান সেনাদলের দায়িত্ব বুঝে নেন। সিপিওর অধীনে রোমান বাহিনী প্রথমে পো নদী পার হয়ে এর শাখানদী ট্রিসিনাসের দিকে এগিয়ে এলো। এখানে রোমানদের তৈরি করা একটি সেতু ব্যবহার করে সিপিও নদী পার হয়ে শিবির গড়লেন।
হ্যানিবাল ইতোমধ্যে কাছাকাছি এসে পড়েছেন। তিনি বিপক্ষ দলের অবস্থান স্বচক্ষে দেখতে তার অশ্বারোহী যোদ্ধাদের এক বড় অংশ সাথে নিয়ে বের হলেন। এদিকে সিপিও একই কারণে রোমান ক্যাম্প থেকে রওনা হয়েছেন। পথিমধ্যে দুই দলের দেখা হলে দ্রুত তারা সাথে থাকা স্বল্পসংখ্যক সেনা নিয়েই লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিলেন।
ট্রিসিনাসের সংঘর্ষ
হ্যানিবাল তার সেনাদলের মধ্যভাগে স্প্যানিশ ও দুই পাশে একটু পেছনের দিকে নুমিডিয়ান অশ্বারোহীদের বিন্যস্ত করলেন। সিপিওর সাথে যথেষ্ট ঘোড়সওয়ার ছিল না, তবে হালকা অস্ত্রে সজ্জিত অনেক পদাতিক যোদ্ধা ছিল। তাদের তিনি সামনে রাখলেন এবং গল মিত্রদের দ্বারা গঠিত অশ্বারোহী দল রাখলেন তাদের পেছনে। রোমান ও ল্যাটিন অশ্বারোহী সেনাদের রাখল রিজার্ভ হিসাবে।
হ্যানিবালের অশ্বারোহী বাহিনীর এত তড়িৎ আক্রমণ চালায় যে, রোমান পদাতিকরা তাদের অস্ত্র ব্যবহার করার সময়ই পেল না। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে তারা পেছনে থাকা নিজেদের ঘোড়সওয়ার বাহিনীর উপর পড়ল। দুই দলের অশ্বারোহী যোদ্ধারা যখন পরস্পর লড়াই করছিল, তখন নুমিডিয়ান সেনারা রোমান পদাতিকদের ছত্রভঙ্গ করে দুই পাশ থেকে তাদের অশ্বারোহী বাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। সিপিও নিজেই এসময় আহত হন। লিভির বর্ণনায়, তার ছেলে তাকে রক্ষা করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসে। এই ছেলেই পরে হয়েছিল রোমের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জেনারেল, হ্যানিবালের পরাজয়ের রূপকার, সিপিও আফ্রিকানাস।
যুদ্ধের অবস্থা বেগতিক দেখে সিপিওর নির্দেশে রোমান বাহিনী পিছু হটে যায়। হ্যানিবাল পূর্ণ বাহিনী নিয়ে যখন মূল রোমান ক্যাম্পের কাছে এসে পৌঁছলেন, ততক্ষণে সিপিও সেখান থেকে পিছিয়ে প্ল্যাসেনশিয়া চলে গেছেন। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ট্রিসিনাস ও পোর মধ্যবর্তী সমতলভূমিতে কার্থেজ তার অশ্বারোহী সেনার সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে।
যদিও ট্রিসিনাস পরিপূর্ণ যুদ্ধের কাতারে পড়ে না, তবুও এর গুরুত্ব অনেক। এই ঘটনার পর আশেপাশের গল উপজাতিরা দলে দলে হ্যানিবালের বাহিনীতে যোগদান করে। তদুপরি, এই লড়াইয়ের মাধ্যমে হ্যানিবাল ইটালির এই অঞ্চলে তার একটা অবস্থান তৈরি করে নিতে সক্ষম হন, যেখান থেকে তিনি রোমের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করেন।
ব্যাটল অফ ট্রেবিয়া
সিপিও ট্রেবিয়া নদী পার হয়ে অপরপাশের রুক্ষ পার্বত্য অঞ্চলে ক্যাম্প করলেন। ওদিকে সিসিলি থেকে সেম্প্রোনিয়াস এসে তার সাথে যোগ দিলেন। ছোটখাট সংঘর্ষের পর দুই বাহিনী পূর্ণ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিল। হ্যানিবালের উদ্দেশ্য ছিল সিপিওর অবস্থানের অপর পারে ট্রেবিয়া আর পো নদীর মাঝে সমতলভূমিতে রোমানদের টেনে নিয়ে আসা, যেখানে তিনি তার অশ্বারোহী সেনাদলের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারবেন।
সিপিও আহত থাকায় যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব এসে পড়েছিল সেম্প্রোনিয়াসের কাঁধে। লিভির মতে, সেম্প্রোনিয়াস ছিলেন অনেকটা হঠকারী। সিপিও তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন কার্থেজে বাহিনীর সাথে যতদিন সম্ভব যুদ্ধ মুলতবি করতে, কারণ যত সময় গড়াবে রোমের শক্তি তত বাড়বে। অন্যদিকে পূর্ব অভিজ্ঞতার নিরিখে তিনি জানতেন হ্যানিবালের সাথের গল মিত্ররা যত দ্রুত তার পক্ষে যোগ দিয়েছে, কিছুদিন বাদে তত দ্রুতই তার পক্ষ ত্যাগ করতে পারে। কিন্তু সেম্প্রোনিয়াস তখন ক্ষমতার নেশায় বুঁদ, তিনি যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিলেন।
হ্যানিবালের দলে ছিল ২০,০০০ এর মত পদাতিক ও ১,০০০ ঘোড়সওয়ার, এদের এক বড় অংশ ছিল গল। সেম্প্রোনিয়াস নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন রোমান ও মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত প্রায় ৩৫,০০০-৩৮,০০০ পদাতিক ও ৪,০০০ অশ্বারোহী সেনার। ট্রেবিয়ার প্রান্তরে গাছগাছালি ছাওয়া এক জায়গাতে হ্যানিবাল কার্থেজিনিয়ান কমান্ডার ম্যাগোর অধীনে কিছু সংখ্যক অশ্বারোহী ও পদাতিক লুকিয়ে রাখলেন। তারপর তিনি নুমিডিয়ান সেনাদেরকে পাঠালেন নদী পার হয়ে রোমান শিবিরের প্রহরীদের আক্রমণ করতে। তার কৌশল ছিল নুমিডিয়ানরা আক্রমণ করে আস্তে আস্তে পেছনে সরে আসবে, রোমান সেনারাও তাদের অনুসরণ করবে। এভাবে তাদেরকে তিনি তার পছন্দের স্থানে নিয়ে আসতে পারবেন, যেখানে তার মূল বাহিনী ও ম্যাগোর সাহায্যে তাদের চারিদিক দিয়ে ঘিরে ধরবেন।
হ্যানিবালের সেনারা খুব ভোরে খাওয়া দাওয়া সেরে নিয়ে রোমান বাহিনী নাস্তা করার ঠিক আগে তাদের আক্রমণ করে। সেদিন ছিল প্রচণ্ড ঠান্ডা, তুষার পড়ছিল অবিরাম। অভুক্ত রোমানরা খরস্রোতা ট্রেবিয়া পার হয়ে যুদ্ধের মূল স্থানে পৌঁছতে পৌঁছতে কাহিল হয়ে পড়ে। কার্থেজিনিয়ানরা সেখানে অবস্থান নিয়েছিল পদাতিক সেনাদেরকে মধ্যভাগে রেখে দুই পাশে অশ্বারোহী ও হস্তিবাহিনী সাজিয়ে। সেম্প্রোনিয়াস দ্রুত সেনা বিন্যাস করলেন। রোমান পদাতিকরা কার্থেজের পদাতিকদের মুখোমুখি দাঁড়াল, তাদের পেছনে ও দুই পাশে সেম্প্রোনিয়াস নিযুক্ত করলেন অশ্বারোহীদের।
যুদ্ধ শুরু হলে কার্থেজের অশ্বারোহী বাহিনী সংখ্যাধিক্য ও দক্ষতার কারণে রোমান অশ্বারোহীদের সহজেই কাবু করে ফেলে। কিন্তু পদাতিক বাহিনীর মধ্যে তীব্র যুদ্ধ চলতে থাকে। রোমান পদাতিক দল কার্থেজের সেনাবাহিনীর মধ্যভাগকে পরাস্ত করে ফেলে। এরই মধ্যে ম্যাগো তার লুকানোর জায়গা থেকে বের হয়ে রোমান বাহিনীর পেছন ভাগে আক্রমণ করলেন। চারিদিক থেকে আক্রান্ত হয়ে রোমানরা দিশা হারিয়ে ফেলল। প্রায় অর্ধেকের মত হতাহত রেখে পরাজিত রোমান বাহিনী পিছু হটে প্ল্যাসেনশিয়া চলে গেল।
ব্যাটল অফ লেক ট্রেসিমেন
অ্যাপেনাইন পর্বতমালার ঝুঁকিপূর্ণ পথ ধরে হ্যানিবালের সেনাদল ইট্রুরিয়া প্রবেশ করল। উদ্দেশ্য হলো রোমের দিকে এগিয়ে যাওয়া। রোমান কন্সাল ফ্ল্যামিনিয়াস তখন কার্থেজিনিয়ানদের নিকটবর্তী। হ্যানিবাল ইট্রুরিয়া ধরে যাওয়ার সময় চারিদিক ছারখার করে দিয়ে যেতে থাকলে ফ্ল্যামিনিয়াস ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন। সিনিয়র কমান্ডররা বুঝতে পারছিলেন এসবই রোমানদের যুদ্ধে প্রলুব্ধ করার জন্য হ্যানিবালের প্রচেষ্টা। তাই তারা ফ্ল্যামিনিয়াসকে পরামর্শ দিলেন অন্য কন্সাল সার্ভিলিয়াস এসে না পৌঁছনো পর্যন্ত হ্যানিবালের সাথে সংঘাতে না যেতে। কিন্তু ফ্ল্যামিনিয়াস শুনলেন না, তিনি হ্যানিবালকে ধাওয়া করলেন। আর এটাই হ্যানিবাল চাইছিলেন।
কর্টনা পাহাড় আর লেক ট্রেসিমেনের মাঝের রাস্তা দিয়ে কার্থেজিনিয়ানরা এগিয়ে চলল। এখানেই পাহাড় আর লেকের মধ্যে এক সংকীর্ণ এলাকাই হ্যানিবালের কাছে রোমানদের সাথে যুদ্ধের প্রকৃষ্ট স্থান বলে মনে হলো। ২০ জুন, ২১৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এখানেই কর্টনা পাহাড়ে পাদদেশে হ্যানিবাল ছাউনি ফেললেন। ফ্ল্যামিনিয়াস শীঘ্রই কাছাকাছি পৌঁছে গেলেন।
রাতের আঁধারে আফ্রিকান ও স্প্যানিশ পদাতিকদের ক্যাম্পে রেখে বাহিনীর বাকি অংশ নিয়ে হ্যানিবাল পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে দিয়ে ঘুরে রোমান ঘাঁটির পেছনে এসে লুকিয়ে থাকলেন। পরদিন ২১ জুন সকালে কুয়াশার মধ্যে রোমান সেনারা কার্থেজের শিবিরের দিকে এগিয়ে গেল। ঘন কুয়াশার কারণে তাদের চলাচলে অসুবিধা হচ্ছিল। এর মধ্যে কার্থেজের যোদ্ধারা অতর্কিত আক্রমণ করে বসলে রোমানরা সংঘবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। এমন সময় হ্যানিবাল পাহাড়ে আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। রোমান সেনারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল এবং ঠিক কোন জায়গা থেকে তারা আক্রান্ত হচ্ছে তা বুঝতে পারার আগেই অনেক যোদ্ধা মারা গেল। কার্থেজের ১,৫০০ সেনার বিপরীতে রোমের ক্ষয়ক্ষতি ছিল প্রায় দশগুণ। কন্সাল ফ্ল্যামিনিয়াস যুদ্ধক্ষেত্রেই নিহত হন।
অল্পকিছু যোদ্ধা, প্রায় ১০,০০০ জন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। বেঁচে থাকা বাকিরা হলো বন্দি। হ্যানিবাল পরাজিত বন্দি সেনাদের মধ্যে থেকে রোমানদের রেখে অন্যান্য ইটালিয়ানদের ছেড়ে দিলেন এই বার্তা দিয়ে যে তার লড়াই শুধু রোমের সাথে, ইটালিকে রোমের থাবা থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে। এই চাল দিয়ে তিনি রোমের সাথে তার ইটালিয়ান মিত্রদের বিভেদ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। হ্যানিবালের এই কৌশল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছিল এবং দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধের সময় রোমের অধিকাংশ ইটালিয়ান মিত্ররা তাকে সহায়তা করা অব্যাহত রেখেছিল।
ওদিকে সার্ভিলিয়াস এসেছিলেন ফ্ল্যামিনিয়াসকে সাহায্য করার জন্য। অগ্রবর্তী দল হিসেবে তিনি গাইয়াস সেন্টেনিয়াসের নেতৃত্বে ৪,০০০ অশ্বারোহী সেনা প্রেরণ করেন। তাদের বাধা দিতে হ্যানিবাল মাহারবালের অধীনে তার বাহিনীর অশ্বারোহী ও হাল্কা অস্ত্রে সজ্জিত পদাতিকদের এক অংশ পাঠালেন। লেক ট্রেসিমেনের যুদ্ধের কিছুদিন পরেই এই দুই দলের সংঘর্ষে রোমান অশ্বারোহী দলে প্রায় অর্ধেক নিহত হয়, আর বাকিদের কার্থেজিনিয়ান সেনারা বন্দি করে।
এই দুই পরাজয়ের খবর রোমে পৌঁছলে সিনেট ও রোমান সিটিজেনরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। তারা ফ্যাবিয়াস ম্যাক্সিমাসকে ডিক্টেটর হিসেবে নিয়োগ দেয় এবং তার সহকারী হিসেবে মিসিনিয়াসকে নির্বাচিত করে। তিনি অবিলম্বে রোমের প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করলেন এবং কৌশলগত স্থানগুলোতে রোমান সৈন্যদের সংখ্যা বাড়ালেন, এবং রোমে আসার রাস্তায় নদীর উপরের বেশ কিছু সেতু গুঁড়িয়ে দিলেন, যাতে হ্যানিবাল সেগুলি ব্যবহার করে রোমে আসতে না পারেন।
ফ্যাবিয়ান স্ট্র্যাটেজি
ফ্যাবিয়াস জানতেন, হ্যানিবালের অভিজ্ঞ সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করার সামর্থ্য তৈরি হতে রোমানদের প্রয়োজন সময়। কাজেই তিনি হ্যানিবালের সাথে সরাসরি সংঘর্ষ এড়াতে চাইলেন। তিনি বুঝেছিলেন, হ্যানিবাল আশেপাশের এলাকা থেকে তার রসদ সংগ্রহ করছেন। তাই রোমের অধীনস্থ যেসব নগর যথাযথভাবে সুরক্ষিত নয় সেগুলোর সকল অধিবাসীকে শস্য, গবাদিপশু ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার আদেশ জারি করা হলো। হ্যানিবাল যেসব এলাকা দিয়ে যেতে পারেন, সেখানের সমস্ত লোককে বসত ভিটা ও রক্ষিত খাদ্যসামগ্রী পুড়িয়ে ফেলে সরে পড়তে বলা হলো।
সব আদেশ প্রেরণ করে ফ্যাবিয়াস রওনা হলেন তার সেনাদল নিয়ে, যেখানে নতুনভাবে গঠিত আরও দুটি সেনাদল ছিল। পূর্বনির্ধারিত স্থানে তিনি সার্ভিলিয়াসের সাথে দেখা করেন এবং তার বাহিনীকে নিজের সাথে যুক্ত করে নেন। উপকূল অঞ্চল সুরক্ষার ভার নিয়ে সার্ভিলিয়াস রোমে ফিরে যান।
এদিকে ফ্ল্যামিনিয়াসকে পরাজিত করার পর হ্যানিবাল পূর্বদিকে মোড় নিয়ে আবার অ্যাপেনাইন অতিক্রম করলেন। এবার তিনি আম্ব্রিয়ার মধ্য দিয়ে পিসেনামে প্রবেশ করলেন, তারপর ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূল ধরে তার যাত্রা অব্যাহত রাখলেন।পথিমধ্যে কার্থেজের সেনাদল ব্যাপক লুটতরাজ চালাল। লোকালয়ের পর লোকালয় জ্বালিয়ে দেয়া হলো, এর অধিবাসীদের হত্যা বা দাস হিসেবে বন্দি করা হলো। হ্যানিবাল চাচ্ছিলেন রোমের অন্যতম শক্তি, তার সম্পদ ও লোকবলের উৎস ধ্বংস করে দিতে এবং রোমের মিত্রদের মাঝে ত্রাস ছড়িয়ে দিতে, যাতে তারা রোমের পক্ষ ত্যাগ করে।
ফ্যাবিয়াস হ্যানিবালকে অনুসরণ করে স্যামনিয়ামে এসে পৌঁছলেন এবং আপুলিয়ার দিকে এগিয়ে গেলেন। এইসিয়া পৌঁছে তিনি কার্থেজের বাহিনীর দশ কিলোমিটারের মধ্যে তাঁবু ফেললেন। হ্যানিবাল তাকে লড়াইতে প্রলুব্ধ করতে চাইলেও তিনি সেই ফাঁদে পা দিলেন না। তার সাথে ৪০,০০০ এর মতো সেনা ছিল, কিন্তু এরা বেশিরভাগই ছিল আনকোরা। ফ্যাবিয়াস হ্যানিবালের সুদক্ষ সেনাদলের বিরুদ্ধে তাই তখনি কোনো ঝুঁকি নিতে চাইলেন না। তিনি নিরাপদ দূরত্ব থেকে হ্যানিবালকে অনুসরণ করতে থাকলেন এবং সবসময় চেষ্টা করতেন কার্থেজ বাহিনীর থেকে উচ্চভূমিতে ক্যাম্প করার।
হ্যানিবাল স্যামনিয়াম থেকে চলে এলেন ক্যাম্পানিয়াতে। সমস্ত এলাকা জুড়ে তার দল তাণ্ডব চালিয়ে আসলেও ফ্যাবিয়াস দূর থেকে শুধু লক্ষ্যই করে গেলেন। সরাসরি যুদ্ধে জড়ালেন না। তিনি বরং চেষ্টা করতেন হ্যানিবালের বিচ্ছিন্ন কোনো সেনাদল পেলেই আক্রমণ করার এবং পেছন থেকে তার রসদ সরবরাহের রাস্তায় বাধা দেবার।এদিকে শীত চলে আসছিল, সুতরাং হ্যানিবাল সিদ্ধান্ত নিলেন আপুলিয়ার কোনো এক শহরে এই সময়টা কাটিয়ে দেয়ার জন্য। রোমান সেনাবাহিনীর সাথে ছোটখাটো সংঘর্ষ পার হয়ে তিনি জেরুনিয়াম দখল করলেন। শহরের ঠিক বাইরে তিনি একটি প্রতিরক্ষা ঘাঁটি স্থাপন করলেন, এবং শীতকাল কাটানোর জন্য প্রয়োজনীয় রসদ দ্রব্য একত্রিত করার জন্য সেনাদলের একটি অংশকে দায়িত্ব দিলেন। তারা লুণ্ঠিত গবাদিপশু আলাদা করতে লাগল এবং আশেপাশের অঞ্চল থেকে খাদ্যশস্য সংগ্রহ করতে শুরু করল।
ওদিকে ফ্যাবিয়াসের যুদ্ধ এড়ানোর এই কৌশল তার অফিসারদের, বিশেষ করে মিউসিনিয়াসের মধ্যে গভীর অসন্তোষ সৃষ্টি করেছিল। হ্যানিবাল রোমের মিত্রদের অঞ্চল ছারখার করছিলেন, আর ফ্যাবিয়াস শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে গেছেন- এই অভিযোগে তার সাথে মিউসিনিয়াসের তর্ক হয়। এরই মধ্যে ধর্মীয় কিছু আচার অনুষ্ঠান পালনের জন্য ফ্যাবিয়াস রোমে ফিরে যান। মিউসিনিয়াস কম্যান্ডারের দায়িত্ব নেন। যদিও ফ্যাবিয়াস তাকে হ্যানিবালের সাথে সম্মুখ লড়াইতে না নামতে হুঁশিয়ার করেছিলেন, তথাপিও মিউসিনিয়াস তা শুনলেন না। তিনি যখন দেখলেন কার্থেজের বাহিনীর কিছু অংশ আশেপাশের অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে তখন তিনি সেদিকে কিছু সেনা পাঠিয়ে নিজে হ্যানিবালের অগ্রবর্তী ঘাঁটির দিকে অগ্রসর হলেন।
হ্যানিবাল পরলেন উভয় সঙ্কটে। তার বাহিনী দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যাওয়ায় তার পক্ষে মিউসিনিয়াসের উপর সরাসরি আক্রমণ চালান সম্ভব হচ্ছিল না। সে যাত্রায় হাসড্রুবাল নামে এক কম্যান্ডারের অধীনে প্রায় ৪,০০০ কার্থেজিনিয়ান অশ্বারোহী নিকটবর্তী অঞ্চল থেকে তার সাথে এসে যোগ দেয়ায় তিনি নিরাপদে পিছিয়ে গিয়ে জেরুনিয়ামে আস্তানা গাড়লেন। রোমের পক্ষে ৫,০০০ এবং কার্থেজের পক্ষে প্রায় ৬,০০০ যোদ্ধা হতাহত হয়।
মিউসিনিয়াস তার সাফল্যের অতিরঞ্জিত কাহিনি রোমে পাঠালে তারা উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। ফ্যাবিয়াসের সময়ক্ষেপণের কৌশল রোমান সিনেট তিতিবিরক্ত হয়ে পড়েছিল। তারা মিউসিনিয়াসকে স্বাধীনভাবে যুদ্ধ করার ক্ষমতা প্রদান করে। ফ্যাবিয়াস ফিরে এলে দুই জেনারেলের মন কষাকষি হয় এবং তারা নিজ নিজ বাহিনী নিয়ে আলাদা হয়ে যান।
হ্যানিবাল এই সুযোগই খুঁজছিলেন। তিনি মিউসিনিয়াসকে আক্রমণ করার প্রস্তুতি নেন। তিনি ৫০০ অশ্বারোহী ও ৫,০০০ পদাতিক আলাদা করে তাদের ছোট ছোট দলে ভাগ করলেন। এরা রাতের আঁধারে চারদিকের পার্বত্য এলাকাতে লুকিয়ে পড়ল। ভোরে হ্যানিবাল তার মূল বাহিনী নিয়ে মিউসিনিয়াসের ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হলেন। তাকে বাধা দিতে রোমানরা মাঠে নেমে এলে লুকিয়ে থাকা সেনাদল তাদের ঘিরে ফেলে। মিউসিনিয়াসের অবস্থা সঙ্গিন হয়ে পড়ে। সৌভাগ্যক্রমে ফ্যাবিয়াস ঘটনা বুঝতে পেরে তাকে সাহায্য করতে এলে হ্যানিবাল পিছিয়ে যান। এরপর কোনো বড় সংঘর্ষ ছাড়াই শীতকাল পার হলো।
২১৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দের শেষে ফ্যাবিয়াসের ডিক্টেটরশিপের মেয়াদ ফুরালে রোমানরা পরবর্তী বছরের জন্য পওলাস ও ভারো নামে দুই নতুন কন্সাল নিযুক্ত করে। তারা সরাসরি হ্যানিবালের সাথে লড়াইতে নামার প্রস্তুতি নিলেন।
ফ্যাবিয়াসের কৌশল রোমে নিন্দিত হলেও সময়ের নিরিখে এর কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে। পরপর দুইটি যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের পর রোমের দরকার ছিল একটা লম্বা বিরতি, যাতে সে তার ঘর গুছিয়ে নিতে পারে। ফ্যাবিয়াস রোমকে সেই সময় পাইয়ে দিয়েছিলেন। হ্যানিবাল বার বার তাকে যুদ্ধে জড়ানোর চেষ্টা করলেও বিফল হন, এবং এই সময় তিনি রোমের কোন মিত্রকেই নিজের দলে টেনে আনতে পারেননি। সুতরাং সার্বিক বিচারে যুদ্ধ জয় করলেও প্রত্যাশিত ফল হ্যানিবাল এই বছর পাননি।