বিংশ শতাব্দীতে যুদ্ধবিগ্রহ কতটা আধুনিক এবং প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে কতটা উন্নত হতে যাচ্ছে, তার প্রথম সাক্ষী বলা যেতে পারে প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে। কিন্তু পেছনের দিকে তাকালে বিভিন্ন সময়ের যুদ্ধবিগ্রহের ইতিহাসের দিকে আমরা কিছুটা ভিন্ন চিত্রও দেখতে পাই। সময়ের সাথে সাথে যুদ্ধের সরঞ্জাম এবং অস্ত্রশস্ত্রের উন্নতির রেখা যতই ঊর্ধ্বগামী হোক না কেন, যুদ্ধ মানেই সবসময় মনুষ্য শক্তির উপর নির্ভরতা চলে আসে। ট্যাংক, মেশিনগান, পারমাণবিক বোমা যতই থাকুক না কেন, প্রতিটি যুদ্ধের সাথে মিশে থাকে হাজারো মানুষের আত্মাহুতি, শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা। চরম প্রতিকূলতার মাঝেও যারা লড়াই করে, জান বাজি রাখে। অধিকন্তু, যুদ্ধের সরঞ্জামাদি এবং গোলাবারুদের উন্নতির পরেও, মানুষ যুদ্ধের সরঞ্জামাদি পরিবহন, যোগান, যোগাযোগ এবং কখনো কখনো বন্ধু হিসেবে পাশে রাখার জন্যও পশুপাখি এবং জীবজন্তুর উপরে নির্ভরশীল ছিল।
একটি যুদ্ধে কী পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ দরকার হতে পারে, তা কল্পনা করা অনেকটা অসম্ভবই বটে! প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রায় একশ বছর পরে, আজ যদি বেলজিয়াম এবং ফ্রান্সের পুরোনো রণক্ষেত্রগুলো খুঁড়ে দেখা হয়, তাহলে এখনো প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধে ব্যবহৃত বিপুল পরিমাণ অস্ত্রাগারের খোঁজ পাওয়া যেতে পারে। সংখ্যা ধরে হিসেব করতে গেলে চোখ অনেকটা ছানাবড়াও হয়ে যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ভারদনের যুদ্ধে প্রায় ৩২ মিলিয়ন শেল বা কার্তুজ গুলি ছোঁড়া হয়েছিল! অন্যদিকে যুদ্ধের প্রস্তুতি স্বরূপ ‘সোমি যুদ্ধের‘ প্রস্তুতি হসেবে ব্রিটিশ ব্যারেজ থেকে ১.৫ মিলিয়ন শেল ছোঁড়া হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ আর্মি সর্বমোট প্রায় ২৫০ মিলিয়ন শেল ব্যবহার করেছিল!
পরিবহন এবং যোগাযোগে ভারবাহী পশু
এই বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ পরিবহনের জন্য রেল, ট্রাক, জাহাজ ব্যবহৃত হতো। তবুও প্রতিকূল পরিবেশে অস্ত্র এবং সেনা পরিবহনের জন্য মানুষকে শত-হাজার ঘোড়া, গাধা, গরু, এমনকি কুকুর এবং উটের উপরেও নির্ভর করতে হয়েছে। যুদ্ধে আক্রমনের ক্ষেত্রে তো বটেই, মৃতদেহ টানার ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হতো ঘোড়া।
সম্মুখ সমরে কিম্বা পেছনে লক্ষ লক্ষ যোদ্ধাদের খাবারদাবার এবং গোলাবারুদ সরবরাহ করার জন্য সেই সময়ে চারপেয়ে ভারবাহী পশুগুলোকেই বেছে নেওয়া হতো। কখনো যুদ্ধক্ষেত্রে সামনে কাদা বা নুড়িপাথর থাকলে সেক্ষেত্রে ভার বহনের জন্য খচ্চর বা ঘোড়াকে ব্যবহার করা হতো। এমনকি ব্রিটিশ সেনাবাহিনী গর্ব করে বলতে পারে, তাদের সেনাবাহিনী একাধারে সর্বাপেক্ষা আধুনিক এবং এই সমৃদ্ধ সেনাবাহিনীর জন্য পরিবহন ও সরবরাহের কাজে ব্যবহৃত একটি আদর্শ সমর ঘোড়াশৈলী রয়েছে। এই সমর ঘোড়া পরিচালিত করার জন্য ব্রিটিশ সেনাদের একটি বিশেষ আর্মি সার্ভিস ছিল। ১৯১৮ সালের নভেম্বর মাসের হিসেব অনুযায়ী, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ৫ লক্ষ ঘোড়া ছিল। ঘোড়াগুলো রণাঙ্গনে প্রতিমাসে ৩৪ হাজার টন মাংস এবং ৪৫ হাজার টন রুটি বিতরণে সাহায্য করেছিল।
এসব পশুপাখিরও খাবার এবং পানির প্রয়োজন ছিল। ব্রিটিশ ঘোড়াগুলো প্রতিমাসে প্রায় ১৬ হাজার টন গবাদি খাবার পরিবহন করেছিল। যুদ্ধের সব পক্ষ হিসেব করলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ৬ মিলিয়ন ঘোড়া নিযুক্ত হয়েছিল। এসব প্রাণীর দেখাশোনার জন্য ছিল বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনা। তারা যুদ্ধের আগেই তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ থেকে জানত, কীভাবে এসব পশুপাখির যত্ন নিতে হয়। এমনকি তারা আধুনিক চাষ পদ্ধতিতেও অভিজ্ঞ ছিল।
লক্ষ লক্ষ ঘোড়া-গাধা-খচ্চর যদি না থাকত, তাহলে যুদ্ধে জয় বা যুদ্ধ এড়ানো এক প্রকার অসম্ভবই হয়ে পড়ত। মানুষের পাশাপাশি এসব পশুপাখিরও অনেক ক্ষয়ক্ষতি হতো। শারীরিক অক্ষমতা, রোগ, দুর্ভিক্ষ আর শত্রুপক্ষের আক্রমনের কারণে চারপেয়ে এসব জন্তুর প্রানহানির হার ছিল অনেক বেশি। যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার ঘোড়াকে ব্রিটিশ বণিক হাসপাতালগুলোতে এক বছরের বেশি সময় ধরে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এর মাঝে বেশিরভাগই ছিল মাঠ পর্যায়ের হাসপাতাল।
মেশিনগান, তীর-ধনুক, কাঁটাতারের বেড়া থাকার পরেও, নিরবচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অশ্বারোহী বাহিনীর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মন্সের যুদ্ধে অশ্বারোহী সৈন্যবাহিনী বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। জার্মান সীমান্তে অনুপ্রবেশের জন্য রাশিয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে একঝাঁক সৈন্য পাঠিয়েছিল, যারা কিনা কেবলই অশ্বারোহী যোদ্ধা।
বার্তা প্রেরণ এবং যোগাযোগ রক্ষায়
যুদ্ধের সময় ভার বহনের জন্যই হোক বা সমর যুদ্ধে অংশগ্রহণ- উভয়ক্ষেত্রেই জীবজন্তুদের উপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নির্ভরশীলতা ছিল উল্লেখযোগ্য। এর পাশাপাশি যোগাযোগ রক্ষার কাজেও পশুপাখিদের ব্যবহার করা হতো। ফ্রন্ট লাইনে বার্তা বাহনের জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুরদের ব্যবহার করা হতো। বিশেষ করে জার্মান বাহিনী দ্বারা কুকুর বেশি ব্যবহার করা হতো। এটি দাবি করা হয় যে, ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ঘোড়ার পাশাপাশি যোগাযোগ বা বার্তা বাহনের জন্যে কুকুরের ব্যবহার তেমন একটা কম ছিল না, এমনকি ট্রেঞ্চের মধ্যে এদেরকে অনেক বেশি আদর দেওয়া হতো এবং কখনোবা মানুষের চাইতেও বেশি রেশন দেওয়া হতো!
যুদ্ধক্ষেত্রে বার্তা প্রেরণের ক্ষেত্রে সবচাইতে প্রচলিত ছিল পায়রা। বার্তাবাহক এই পায়রাগুলোকে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো, এই পায়রাগুলোর গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার থেকেও বেশি। সমর যুদ্ধ থেকে সদর দফতরে বার্তা প্রেরণে, রেডিও বা টেলিযোগাযোগের চাইতে পাখিদের উপরেই বেশি নির্ভর করা হতো। কারণ, যুদ্ধের সময়ে টেলিযোগাযোগ বা রেডিওতে বার্তা প্রেরণ নিরাপদ মনে করা হতো না। প্রতিপক্ষ চাইলেই রেডিও বা টেলিফোনে আড়ি পেতে বার্তা চুরি করতে পারে।
দুর্ঘটনা বা সামরিক কাজে জরুরি অবতরণের সময়ে বার্তাবাহক হিসেবে নৌযান, সাবমেরিন এবং মিলিটারি বিমানে নিয়মিতভাবে বেশ কিছু পায়রা ব্যবহার করা হতো। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একদল পায়রার একটি ইউনিট, একেকটি যোগাযোগকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হতো। ব্রিটেনের একদল পায়রা বিশেষজ্ঞ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ৭২টি পায়রাকেন্দ্র সরবরাহ করেছিল।
জার্মান নাগরিক জুলিয়াস নেবরোনার কর্তৃক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত একটি পায়রার বুকে ছোট্ট ক্যামেরা বেঁধে আকাশ থেকে যুদ্ধক্ষেত্রের ছবি তোলার কাজে ব্যবহার হতো। স্বয়ংক্রিয় টাইমার কৌশল ব্যবহার করে দূর থেকে এই ক্যামেরার মাধ্যমে ছবি তোলা হতো।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বার্তা বাহন, খাবার-অস্ত্র বহনের পাশাপাশি যোদ্ধাদের মানসিক উৎসাহ যোগানেও জীবজন্তু গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে দীর্ঘদিন একসাথে অবস্থানের ফলে কোনো কোনো প্রাণীর সাথে সৈন্যদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এসব জীবজন্তু তাদেরকে সাহস যোগাত, কখনোবা যোদ্ধা এবং ঘোড়ার প্রতিরূপ তাদেরকে আরো উজ্জীবিত করে তুলত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কেন্দ্রীয় শক্তিধর দেশগুলো, বিশেষ করে জার্মানি, ব্রিটেন এবং উপনিবেশিক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে রক্তচোষা অক্টোপাস হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। এমন একটি ছবি ব্যবহার করে ফরাসি সেনাবাহিনীকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
যুদ্ধের ময়দানে বন্ধু যখন জীবজন্তু
বিভিন্ন রেজিমেন্ট এবং সেনাবাহিনী ভীতি দূর করতে এবং সাহসিকতা বজায় রাখতে প্রায়ই জীবজন্তুকে সাহসিকতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করত। এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রে সৌভাগ্যর প্রতীক হিসেবেও জীবজন্তু বহন করা হতো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে একটি কানাডিয়ান স্থলবাহিনী তাদের সাথে একটি কালো ভালুককে ইউরোপে নিয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে এটিকে লন্ডন চিড়িয়াখানায় স্থানান্তর করা হয়েছিল এবং এই ভাল্লুকের অনুপ্রেরনা থেকে বিখ্যাত কাল্পনিক চরিত্র ‘উইনি দা পুহ’ সৃষ্টি হয়েছিল।
মানুষ এবং পশুপাখির মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের অনেক গল্প আছে। যুদ্ধক্ষেত্রে এসব পশুপাখির সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সৈন্যদেরকে যুদ্ধ শেষে সুন্দর জীবনের কথা মনিয়ে করিয়ে দিত, কখনোবা মনুষ্য সংগঠিত যুদ্ধের ধ্বংসলীলার মধ্যে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা যোগাত।
কেবল যে যুদ্ধের ময়দানে জীবজন্তুগুলো এতটা দুর্ভোগের শিকার হয়েছিল তা নয়, বাড়িতে পোষা জীবজন্তুগুলোও যুদ্ধকালীন দুর্দশার শিকার হয়েছিল। ব্রিটেনের অনেক প্রাণীই আক্রমনের শিকার হয়ে মারা যায়, অন্যদিকে খাদ্য দুর্ভিক্ষের কারণেও বিভিন্ন জীবজন্তু মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। যুদ্ধে ঘোড়া এবং অন্যান্য ভারবাহী জীবের পরিমাণ ক্রমশ কমে যেতে থাকল, তখন সার্কাস এবং চিড়িয়াখানার জীবজন্তুকে অবাধে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার হয়েছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অবদানের জন্য সামরিক সম্মানে সম্মানিত যেসব পশুপাখি
সার্জেন্ট স্টবি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সবচাইতে বেশি সম্মানিত এবং পদক সজ্জিত কুকুর। স্টবিই একমাত্র কুকুর যাকে যুদ্ধের ময়দানে সার্জেন্ট উপাধি দেওয়া হয়েছিল। বোস্টন টেরিয়ার ১০২তম পদাতিক, ২৬তম ইয়াংকি ডিভিশনে কুকুর স্টবি প্রথম দিকে মাস্কট হিসেবে অংশ নিয়েছিল, যুদ্ধ শেষে কুকুরটি একটি পুরদস্তুর কুকুর যোদ্ধা হয়ে যুদ্ধ শেষ করে। কুকুরটিকে যুদ্ধের সম্মুখ সমরে নিয়ে আসা হয়েছিল এবং এটি গ্যাস আক্রমণের শিকার হয়ে আহত হয়েছিল। এর ফলে কুকুরটির গ্যাসের প্রতি এক প্রকার সংবেদনশীলতা তৈরি হয়েছিল, পরবর্তীতে যা কিনা তার সহযোদ্ধাদেরকে গ্যাস আক্রমণের পূর্বাভাস দিতে সাহায্য করত। এটি আহত যোদ্ধাদের খুঁজে বের করার কাজও করত, এমনকি স্টবি জার্মান এক গুপ্তচরকে ধরতে সাহায্য করেছিল, যে কিনা মিত্রবাহিনীর কাঁটাতারের সীমানা ভেদের পায়তারা করছিল। সার্জেন্ট স্টবিকে নিয়ে হলিউডে নির্মিত হয়েছে অ্যানিমেশন সিনেমা স্টবি এন আমেরিকান হিরো।
ভারদুনের যুদ্ধে আমেরিকান সেক্টরে বার্তাবাহনের অবদান রাখার জন্য ‘চের আমি’ নামের একটি পায়রাকে মেডেল প্রদান করে সম্মানিত করা হয়েছিল। পায়রাটি তার শেষ মিশনে বুকে গুলি খাওয়ার পরেও সফলভাবে বার্তা প্রেরণ করে ১৯৪ আমেরিকান সৈন্যর জীবন বাঁচিয়েছিল।
যুদ্ধে মানুষ এবং সৈন্যদের আত্মত্যাগ অনস্বীকার্য। তবে তাদের পাশাপাশি বিভিন্ন জীবজন্তুর বীরত্বপূর্ণ অবদানও যুদ্ধক্ষেত্রে অপরিসীম। সামরিক বাহিনীর সাথে সাথে এসব জীবজন্তুর কথাও স্মরণ করা উচিৎ। প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে সমরাস্ত্র যতই আধুনিক হোক না কেন, এসব পশুপাখির সাহায্য ছাড়া হয়ত অনেক যুদ্ধ জয় বা যুদ্ধ এড়ানো অসম্ভব হয়ে পড়ত।
ফিচার ইমেজ: imgrum.org