সময়টা ১৯২৫ সালের মধ্য জানুয়ারি, বিকেল ঘনিয়ে নেমে আসছে সন্ধ্যা।
আলাস্কার পশ্চিমের দূরতম প্রান্তে ছোট্ট শহর নোম। আর্কটিক সার্কেলের দুই ডিগ্রি দক্ষিণে, বেরিং প্রণালির কোল ঘেঁষে গড়ে উঠা ঐতিহাসিক গোল্ডরাশের স্মৃতিবিজড়িত এই শহরে ৪৫৫ আলাস্কান ও ৯৭৫ ইউরোপিয়ান সেটলারের আবাস। গ্রামের একমাত্র চিকিৎসক, ডক্টর কার্টিস ওয়েলচ তুষার মাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন এক এস্কিমো মহিলার দিকে। প্রাথমিক সম্ভাষণ শেষে মহিলা তাকে ঘরে নিয়ে গেলো, যেখান ছোট্ট দুই শিশু বিছানায় শুয়ে শ্বাসকষ্টে কাতরাচ্ছে।
ডাক্তার প্রথমে তিন বছরের ছেলেটির কাছে বসে কপালে হাত রাখলেন। প্রচণ্ড জ্বর। “তুমি কি হাঁ করতে পারবে?” তিনি ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলেন।
চেষ্টা করা সত্ত্বেও ভীষণ ব্যথায় কোনো শিশুই তার কথামত হাঁ করতে পারল না। তারপর মাকে কিছু সান্ত্বনা দিয়ে ডক্টর ওয়েলচ বের হয়ে এলেন। কপালে তার চিন্তার ভাঁজ। গত ডিসেম্বর মাস থেকে এরকম আরও অনেক কেস শিশুদের মধ্যে তিনি দেখে আসছেন, এবং কয়েকজন এরই মধ্যে মারা গেছে। শুরুতে টনসিলাইটিস মনে হলেও তার মনে এখন এক ভয়ঙ্কর সন্দেহ উঁকি দিচ্ছে।
দুই এস্কিমো শিশু পরদিন মারা গেলো। বিশ জানুয়ারি একই লক্ষণ দেখা দিলে শিশু বিল বার্নেটকে পরীক্ষা করতে ডক্টর সমর্থ হন। এবার তিনি তার সন্দেহের নিশ্চিত প্রমাণ পান।
ডিপথেরিয়া! ডক্টর ওয়েলচ গত বিশ বছর এই রোগ দেখেননি। ভয়ঙ্কর রকম ছোঁয়াচে এই রোগের একমাত্র চিকিৎসা ডিপথেরিয়া অ্যান্টিটক্সিন। না হলে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। আরও ভয়ের কথা এই রোগ নোম থেকে আশেপাশের অঞ্চলে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। নোমের একমাত্র হাসপাতাল মেইনার্ড-কলম্বাসে মজুত থাকা অ্যান্টিটক্সিন গত বছরেই মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। ডক্টর ওয়েলচ ১৯২৪ এর গ্রীষ্মে রাজধানী জুনোতে (Juneau) হেল্থ কমিশনারকে নতুন ব্যাচের জন্য চিঠি পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বরফের কারণে নোমের একমাত্র বন্দর বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে তা আর পৌঁছতে পারেনি। উপায় না পেয়ে ডক্টর ওয়েলচ একুশে জানুয়ারি সাত বছরের বেসি স্ট্যানলিকে মেয়াদ উত্তীর্ণ টক্সিন প্রয়োগ করলেও কোনো কাজ হলো না। বেচারি বেসি দিন শেষ হওয়ার আগেই মারা গেলো। সেদিনই সন্ধ্যায় ডক্টর ওয়েলচের আবেদনের প্রেক্ষিতে মেয়র মেইনার্ড টাউন কাউন্সিলের জরুরি সভা আহবান করে পুরো শহর কোয়ার্যান্টিনের নির্দেশ জারি করেন। সমস্ত স্কুল ও জনসমাবেশের জায়গা অবিলম্বে বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং শহরবাসীকে অতি প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া ঘর থেকে না বের হতে অনুরোধ করা হয়। ডক্টর ওয়েলচের সহযোগী হিসেবে চারজন নার্সের মধ্য থেকে মিস এমিলি মর্গানকে নিযুক্ত করা হয় কোয়ার্যান্টিন নার্স হিসেবে।
সাহায্যের আবেদন
জানুয়ারি ২৫, ১৯২৫। ইউ এস আর্মির সিগন্যাল কর্পসের মাধ্যমে ডক্টর ওয়েলচ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে জরুরি ভিত্তিতে এক মিলিয়ন ইউনিট ভ্যাক্সিনের আবেদন জানিয়ে তৎকালীন গভর্নর স্কট বুন ও আলাস্কার প্রধান সহরগুলোতে টেলিগ্রাম করেন। একই রকম আরেকটি টেলিগ্রাম পাঠান হয় ওয়াশিংটনে ইউ এস পাবলিক হেল্থ সার্ভিসের কাছে। সবচেয়ে কাছাকাছি ভ্যাক্সিনের মজুত ছিল নোম থেকে ১০০০ মাইল দূরে (১৬০০ কিলোমিটার), অ্যাঙ্করেজ রেলরোড হাসপাতালে। ৩০০,০০০ ইউনিটের পরিমাণ ডক্টর ওয়েলচের চাহিদার চেয়ে কম হলেও পরবর্তী চালান না পৌঁছানো পর্যন্ত পরিস্থিতির তাগিদ মেটাতে যথেষ্ট ছিল।
সমস্যা ও সমাধান
প্রশ্ন হলো, কিভাবে এই চালান নোমে পৌঁছানো হবে? অ্যাঙ্করেজ থেকে রেলগাড়ির সাহায্যে ভ্যাক্সিন নিয়ে যাওয়া যাবে ৩০০ মাইল দূরের শহর নেনানা পর্যন্ত। তারপর?
বেরিং সাগরের সুয়ার্ড পেনিনসুলার প্রান্তে নোমের একমাত্র বন্দর নভেম্বর থেকে জুলাই পর্যন্ত বরফে ঢাকা পড়ে থাকে বলে বাষ্পচালিত জাহাজ সেখানে ঢুকতে পারে না। নোমের মেয়র উড়োজাহাজে করে ভ্যাক্সিন পাঠানোর প্রস্তাব করেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে সালটা ছিল ১৯২৫, মাত্র ২২ বছর আগে রাইট ভ্রাতৃদ্বয় উড়োজাহাজের সূচনা করেছেন। সেই সময় পরিচালিত প্লেনগুলিতে ছিল খোলা ককপিট, যা আলাস্কার শীতকালের তীব্র ঠাণ্ডায় ব্যবহার উপযোগী নয়। সুতরাং শীতকালে নোমের মত দূর প্রান্তের শহরগুলিতে ডাক পৌঁছে দিতে ইউ এস পোস্টাল সার্ভিসের ভরসা ছিল ইডিটারড ট্রেইল। ৯৩৮ মাইলের মত (১৫০০ কিলোমিটার) দীর্ঘ এই ট্রেইল নোমকে যুক্ত করেছিল সুয়ার্ড শহরের সাথে। কুকুরের টানা স্লেজে করে শীতকালে ইডিটারড ট্রেইল ধরে ডাক ও অন্যান্য মালপত্র পরিবহন করা হতো। সেই কথা ভেবে ২৪ জানুয়ারি বোর্ড অফ হেলথের সভায় মার্ক সামার্স নামে স্বর্ণখনির এক সুপারিন্টেনডেন্ট ডগ স্লেজ ব্যবহার করে ভ্যাক্সিনে পৌঁছে দেয়ার প্রস্তাব করেন।
সামার্সের পরামর্শ ছিল একটি টিম নেনানা থেকে যাত্রা শুরু করে নুলাটো, যা নেনানা আর নোমের মোটামুটি মাঝামাঝি পৌঁছবে। একই সময় নোম থেকে যাত্রা শুরু করা আরেকটি টিম সেখানে উপস্থিত থাকবে, যারা ভ্যাক্সিনের চালান গ্রহণ করে নোমে ফিরে যাবে। অনেকটা রিলে রেসের মত। শুনতে সহজ মনে হলেও আসল কাজটা ছিল ভীষণ কঠিন। আলাস্কার ক্ষমাহীন বরফের মধ্যে দিয়ে ৬৭৪ মাইল (১০৮৪ কিলোমিটার) রাস্তা, যার একটা বড় অংশ বরফে আচ্ছাদিত বেরিং সাগরের উপর দিয়ে। তাপমাত্রা বিগত বিশ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। সাথে উপরি হিসেবে ছিল হারিকেনের মত তীব্র বাতাস। সবকিছু উপেক্ষা করে নোমে ভ্যাক্সিন নিয়ে যেতে হবে ছয় দিনের মধ্যে, কারণ ডক্টর ওয়েলচের হিসাব মতে এর থেকে বেশি সময় নিলে ভ্যাক্সিন আর ব্যবহার উপযোগী থাকবে না। তখন পর্যন্ত এই রাস্তা অতিক্রমের অফিশিয়াল রেকর্ড ছিল নয় দিনের। কিন্তু স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা লিওনহার্ড সেপালার কথায় প্রভাবিত হয়েছিলেন। লিওনহার্ড সেপালাকে মনে করা হত তৎকালীন আলাস্কার শ্রেষ্ঠ স্লেজ ডগ ব্রিডার ও ড্রাইভার হিসেবে, যারা সাধারণভাবে মাশার নামে পরিচিত।এই ঐতিহাসিক যাত্রার জন্য তারা বিশজন মাশার ও তাদের কুকুরদের নিযুক্ত করেন।
যাত্রাপথ
নেনানা থেকে নোম যাওয়ার রাস্তা নির্ধারণ করা হয় ইউ এস পোস্টাল সার্ভিসের ম্যাপ অনুসারে। টানানা নদীর তীর ধরে ১৩৭ মাইল ইউকন নদীর সাথে মোহনা পর্যন্ত গিয়ে ইউকন নদী ধরে ২৩০ মাইল রাস্তা চলে গেছে ক্যালটাগ। সেখান থেকে পশ্চিমে ৯০ মাইল ভ্রমণ করে বেরিং সাগরের অংশ নরটন সাউন্ডের তীরে উনালাক্লিত পৌঁছতে হবে। উনালাক্লিত থেকে যেতে হবে উত্তর-পশ্চিমে, সুয়ার্ড পেনিনসুলার দক্ষিণ তীর ধরে ২০৮ মাইল, তারপর অপেক্ষা করছে চলমান বরফে আচ্ছাদিত বেরিং সাগরের উপর দিয়ে ৪২ মাইলের ঝুঁকিপূর্ণ পথ।
দ্য সিরাম রানের সূচনা
২৬ জানুয়ারি অ্যাঙ্করেজ রেলরোড হাসপাতালের চিকিৎসকেরা খুব সাবধানে ভ্যাক্সিনের চালান প্যাক করে দেন। এর ওজন দাঁড়ায় ২০ পাউন্ডের (৯ কেজি) মত। সেই চালান নিয়ে রেলগাড়ি নেনানা পৌঁছে ২৭ জানুয়ারি সন্ধ্যার দিকে। সেখান থেকে চালান বুঝে নিয়ে বিল শ্যানন তার নয়টি কুকুরে টানা স্লেজ নিয়ে চলা শুরু করেন পরবর্তী পয়েন্ট টলোভানা রোডহাউসের দিকে। শুরু হয় “দ্য সিরাম রান”, যা “গ্রেট রেস অফ মার্সি” নামেও পরিচিত। পুরো আমেরিকা তখন উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছিল তাদের সাফল্যের জন্য।
২৭-২৮ জানুয়ারি
শ্যাননের লিড স্লেজ ডগ ছিল পাঁচ বছর বয়সী ব্ল্যাকি। নিজেকে গরম রাখার স্বার্থে শ্যানন নিজেও স্লেজের পাশাপাশি অনেকটা পথ দৌড়ে চলেন। -৬২ ° F (-৫২° C) তাপমাত্রায় প্রচণ্ড বাতাসের ঝাপটা উপেক্ষা করে ক্ষয়ে যাওয়া ট্রেইল ধরে শ্যানন পরবর্তী ড্রাইভার এডগার ক্যালান্ডসের কাছে পৌঁছান পরদিন সকাল ১১ টার দিকে। এই যাত্রায় তিনি তিনটি কুকুর হারান, এবং নিজেও ফ্রস্টবাইটে আক্রান্ত হন। ক্যালান্ডস ৩১ মাইল দূরে ম্যানলি হট স্প্রিংসে ভ্যাক্সিনে নিয়ে যান বিকেল ৪ টার সময়। তার হাত স্লেজের হ্যান্ডলবারে এমনভাবে আটকে ছিল যে গরম পানি ঢেলে তার হাত ছাড়াতে হয়।এখান থেকে ড্যান গ্রিন ও জনি ফোলজার দিন ও রাতের পরবর্তী সময়টা ভ্যাক্সিনে বহন করে টানানা নদী ধরে এগিয়ে যান।
২৯-৩০ জানুয়ারি
ছয়জন মাশার (স্যাম জোসেফ, টাইটাস নিকোলাই, ডেভ করনিং, হ্যারি পিটকা, বিল ম্যাককারথি ও এডগার নোলনার) ১৭০ মাইল (২৭৩ কিলোমিটার) এগিয়ে যান। সর্বশেষ ড্রাইভার ভ্যাক্সিনে হস্তান্তর করেন জর্জ নোলনারের হাতে। ৩০ জানুয়ারি ভোর তিনটায় জর্জ নোলনার বিশপ মাউন্টেনে এসে চার্লি এভান্সকে চালান বুঝিয়ে দেন। কুয়াশার মধ্যে আসতে আসতে এভান্স তার দুই লিড স্লেজ ডগকে হারান। সকাল দশটার দিকে এভান্স পরের ধাপের জন্য টমি প্যাটসির কাছে আসতে সক্ষম হন। প্যাটসির তার স্লেজ নিয়ে ৩৬ মাইল এগিয়ে গিয়ে ক্যালটাগে ড্রাইভার জ্যাকস্ক্রুর কাছে আসতে সক্ষম হন।
এদিকে ডিপথেরিয়া আক্রান্তদের সংখ্যা ক্রমে ক্রমে বেড়ে যেতে থাকায় প্লেন ব্যবহারের জন্য গভর্নরের উপর চাপ বাড়তে থাকে, যদিও স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও অভিজ্ঞ পাইলটেরা এককথায় তা নাকচ করে দেন। এজন্য সংবাদপত্রে গভর্নরের বিরুদ্ধে করা ভাষায় লেখা ছাপা হয়। এমন অবস্থায় গভর্নর সময় কমানোর জন্য আরও মাশারকে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী সেপালার দায়িত্ব ছিল ভ্যাক্সিনে নুলাটো থেকে নোমে নিয়ে যাওয়া, যার জন্য তিনি ইতোমধ্যে নুলাটোর দিকে রওনা হয়েছিলেন। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই ধাপে চার্লি অলসেন এবং সেপালারই ছাত্র গুনার কাসেনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
৩১ জানুয়ারি – ১ ফেব্রুয়ারি
জ্যাকস্ক্রুর কাছ থেকে ভ্যাক্সিন বুঝে পেয়ে ভিক্টর অ্যানাজিক ৩৪ মাইল স্লেজে করে অগ্রসর হয়ে উনালাক্লিতে মাইলস গনাঘানের কাছে পৌঁছে দেন, যিনি আরও ৪০ মাইল তা বহন করে নিয়ে যান শাকটুলিকে। সেপালা এখানে থাকার কথা থাকলেও তিনি তখনো পৌঁছেননি। তবে এরকম হতে পারে ধরে নিয়ে আগে থেকেই সেখানে হেনরি ইভানফ অপেক্ষা করছিলেন। -৭০° F (-৫৭° C) তাপমাত্রায় অবিরাম বরফপাত আর ঝড়ো বাতাস মাথায় নিয়ে হেনরি বের হলেন সেপালার উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে সেপালার সাথে দেখা হয়, যিনি এরি মধ্যে নোম থেকে ১৭০ মাইল (২৭৩ কিলোমিটার) রাস্তা পাড়ি দিয়ে এসেছেন। তিনি ভ্যাক্সিন সেপালার হাতে তুলে দেন। শুরু হয় “দ্য সেরাম রানে”র সবথেকে দীর্ঘ আর বিপদসংকুল রাস্তা।
সেপালার লিড ডগ ছিল টোগো। সাইবেরিয়ান হাস্কি প্রজাতির এই কুকুর বিগত প্রায় সাত বছর সেপালার লিড ডগের দায়িত্ব পালন করে আসছিল। ১২ বছর বয়সী টোগো বয়সের বিচারে কুকুরদের মধ্যে বুড়ো বিবেচিত হলেও মাশারদের কাছে সেপালা ও টোগোর এই জুটি ছিল কিংবদন্তির মত। দ্রুত কমে যেতে থাকা তাপমাত্রা, তুষারপাত, তীব্র বাতাস আর আলাস্কার তুষারাবৃত প্রান্তরের মধ্যে দিয়ে শুধুমাত্র নিজের অনুভূতির উপর বিশ্বাস রেখে টোগো তার সহযোগী কুকুরদের নিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি দেন নরটন সাউন্ডের বিপদজনক পথ। রাত ৮ টার দিকে সেপালা ও তার কুকুরদল আইজাক’স পয়েন্ট রোডহাউসে যাত্রাবিরতি নেন। এর মধ্যে তারা অতিক্রম করেছেন ৮৪ মাইল (১৩৫ কিলোমিটার), তার মানে ঘণ্টায় ৮ মাইল (১৩ কিলোমিটার) প্রায়।
রাত দুইটা। ঝড় তখন তার সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে আছড়ে পড়ছে। বাতাসের গতি কম করে হলেও ঘণ্টায় ৬৫ মাইল (১০৫ কিলোমিটার)। কিন্তু নষ্ট করার মত সময় হাতে নেই। সেপালা আর তার বিশ্বস্ত টোগোর নেতৃত্বে কুকুরদল আবার পথচলা শুরু করলেন বেরিং সাগরের চলমান বরফের উপর দিয়ে। তাদের লক্ষ্য লিটল ম্যাককিনলি মাউন্টেইন অতিক্রম করা। ঝুঁকি আছে জেনেও পরিস্থিতির ভয়াবহতা চিন্তা করে সেপালা এই সিদ্ধান্ত নেন। ম্যাককিনলি মাউন্টেইন রাস্তার দূরত্ব কমিয়ে দেবে যার ফলে পরের ড্রাইভাররা স্বল্প সময়ের মধ্যে ভাক্সিনে পৌঁছে দিতে পারবে। ৫০০০ ফুট (১৫০০ মিটার) পাহাড় পার হয়ে সেপালা ১ ফেব্রুয়ারি সকালে চার্লি অলসেনের সাথে মিলিত হন। নোম থেকে শুরু করে ভ্যাক্সিন হাতে পাওয়া এবং তার পরের পুরো রাস্তা মিলিয়ে টোগো ও তার দল দৌড়ে গেছে ২৬১ মাইল (৪২০ কিলোমিটার) পথ।
তীব্র ঠাণ্ডা আর ঝড় উপেক্ষা করে অলসেন যখন পরবর্তী স্লেজ ড্রাইভার গুনার কাসেনের কাছে পৌঁছান তখন বাজে সন্ধ্যা সাতটা। এরই মধ্যে অলসেনের হাতে ফ্রস্টবাইট হয়ে গেছে। কাসেন তার কাছ থেকে চালান নিয়ে রাত দশটার দিকে চলতে শুরু করেন। তার লিড ডগ ছিল সেপালার কাছ থেকে পাওয়া বাল্টো। চারিদিক এমন অন্ধকার যে কাসেন অনেক সময় তার স্লেজ টানা কুকুরগুলিও দেখতে পাচ্ছিলেন না। এর মধ্য দিয়ে বাল্টো ও অন্যান্য কুকুর মিলে তুষারের ড্রিফট আর টপকক পাহাড় পাড় হয়ে আসে।
২ ফেব্রুয়ারি-সমাপ্তি
রাত তিনটায় কাসেন পয়েন্ট সেইফটিতে পৌঁছে পরবর্তী ড্রাইভার এড রোনকে ঘুমন্ত দেখতে পান। তার কারণ ছিল রোন তাকে এতো তাড়াতাড়ি আসা করেননি। সময় বাঁচাতে কাসেন তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি না থেমে এগিয়ে যাবেন। সেই মোতাবেক চলা শুরু করে ভোর পাঁচটার কিছু পরে তিনি শেষ পর্যন্ত ভ্যাক্সিন নিয়ে নোম শহরে প্রবেশ করেন। শেষ হয় “দ্য সেরাম রান”। বিশ জন মাশার ও তাদের ১৫০ টি স্লেজ ডগ মিলে ১২৭ ঘণ্টায় পাড়ি দিয়েছে ৬৭৪ মাইল (১০৮৪ কিলোমিটার), যা সেই সময়ে ছিল রেকর্ড। সব থেকে বড় কথা, তারা সময়ের মধ্যে ভ্যাক্সিন নিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছে। এর ১৩ দিন পর একইভাবে আরও ভ্যাক্সিন শহরে এসে পৌঁছে।
পরবর্তী ঘটনা
লাইমলাইটের সব আলো এসে পরে কুকুর বাল্টোর উপর, যদিও সে পাড়ি দিয়েছিলেন ৫৫ মাইল পথ, যেখান তার থেকে দ্বিগুণেরও বেশি পথ ও রেসের সবথেকে দুর্গম রাস্তা পাড়ি দিয়েছিল টোগো। সংবাদপত্রগুলিতে বাল্টো আর কাসেনের উপর বড় বড় ফিচার লেখা হয়, এমনকি নিউ ইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কে বাল্টোর ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। সেপালা কঠিনভাবে এর সমালোচনা করেন, তার দৃষ্টিতে আসল নায়ক ছিল টোগো।
শেষ কথা
সেরাম রানের উপর লেখা হয়েছে বই, তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্র। ২০০৩ সালে প্রকাশিত বেস্টসেলিং বই “দ্য ক্রুয়েলেস্ট মাইল” সিরাম রানের বিশদ ইতিহাস বর্ণনা করছে। তারও অনেক আগে ১৯৩০ সালে এলিজাবেথ রাইকারের লেখা “সেপালা: আলাস্কান ডগ ড্রাইভার” বইতে সেপালার নিজের বয়ানে সেরাম রানের বৃত্তান্ত পাওয়া যায়। এছাড়া ১৯৯৫ সালে ডিজনি বাল্টোকে নিয়ে একটি অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র নির্মাণ করে। তবে ২০১৯ সালে তারা “টোগো” নামে আরেকটি চলচ্চিত্র ডিজনি প্লাসে প্রদর্শন করে, যেখানে সেরাম রানের ইতিহাস মোটামুটি সঠিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে। আগ্রহীরা চাইলে তা দেখতে পারেন। তবে সবকিছুর পরে বলতে হয় এটা ছিল ক্ষমাহীন প্রকৃতির কঠোর বাধাকে তুচ্ছ করে মানব সংকল্পের বিজয়ের এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ, যেখানে মানুষ কৃতজ্ঞ থাকবে জীবনের ঝুঁকি নেয়া অদম্য একপাল কুকুরের কাছে।