দুর্ঘটনা, রোগব্যাধি সহ নানাবিধ বিপদের ভয় আমাদের মাথায় সর্বদাই কাজ করে। আর সেসব বিপদের কথা মাথায় রেখেই একে একে কেটে যায় আমাদের জীবনের প্রতিটি দিন। আচ্ছা, আজকে আমাদের কাছে যেসব জিনিসকে বিপদ বলে মনে হচ্ছে, যেসব বিপদের ঝুঁকি নিয়ে আমরা গড়ে চলেছি আমাদের স্বপ্নের তাজমহল, মধ্যযুগের মানুষরাও কি ঠিক একই জিনিসকে তাদের বিপদ বলে মনে করতো? নাকি তাদের কাছে বিপদের সংজ্ঞা ছিলো অন্যরকম? ঠিক কোন কোন জিনিসকে বিপদ মনে করে এর থেকে দূরে থাকতে চাইতো তারা? আর সেসব বিপদের পেছনের কারণ হিসেবে তারা কোন জিনিসগুলোকেই বা চিহ্নিত করেছিলো?
মধ্যযুগীয় মানুষগুলোকে সর্বদা ভীতসন্ত্রস্ত করে রাখা হরেক জাতের বিপদের কাহিনী নিয়েই আমাদের আজকের এ আয়োজন।
প্লেগ
মধ্যযুগের মানুষদের কাছে অন্যতম বড় এক আতঙ্কের নাম ছিলো প্লেগ। Yersinia pestis ব্যাকটেরিয়ামের প্রভাবে সৃষ্ট এই সংক্রামক রোগটি চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকে ইউরোপের জনসংখ্যা হ্রাসে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে গেছে। ধারণা করা হয় যে, আনুমানিক ১৩৪৮ সালের দিকে ইউরোপে এর আগমন ঘটে। এরপরই একে একে জার্মানি, স্পেন, ইতালি, স্ক্যান্ডিনেভিয়া, রাশিয়া, ব্রিটেন, ওয়েলস ও স্পেনে হাজার হাজার লোক মৃত্যুমুখে পতিত হতে থাকে।
বিউবোনিক প্লেগের প্রভাবে লোকজনের শরীরের নানা জায়গায় ফোলা ফোলা অংশ দেখা দিতো। সেপ্টিসেমিক প্লেগের প্রভাবে শরীরের বিভিন্ন জায়গা কালো বর্ণ ধারণ করতো। অনেকে এজন্যই একে ব্ল্যাক ডেথও বলে থাকেন। সবচেয়ে সংক্রামক নিউমোনিক প্লেগের প্রভাবে আক্রান্ত ব্যক্তির জ্বর, মাথাব্যথা, নিউমোনিয়া, বুকে ব্যথা, শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হতো।
ব্ল্যাক ডেথের কবলে পড়ে মধ্যযুগে ভূমধ্যসাগর ও ইউরোপীয় অঞ্চলের ৩০-৬০ ভাগ লোক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলো। চতুর্দশ শতকে শুধুমাত্র এর প্রভাবেই সেখানকার জনসংখ্যা আনুমানিক ৪৫ কোটি থেকে ৩৫-৩৭.৫ কোটির ঘরে নেমে এসেছিলো।
তখনকার লোকে জানতো না যে, কেন এমন অদ্ভুত রোগ হচ্ছে আর এর প্রতিকারের উপায়ই বা কী। সৃষ্টিকর্তার ক্রোধ, মানুষের পাপ, এমনকি ইহুদিদেরও দায়ী মনে করা হতো প্লেগের জন্য।
ভ্রমণ
তৎকালে ভ্রমণ করার বিষয়টি ছিলো বেশ আতঙ্কের এক নাম। বিশ্রাম, ঘুমের মতো বিষয়গুলোর জন্য নিরাপদ ও পরিষ্কার জায়গা ছিলো অপ্রতুল। প্রায়শই খোলা আকাশের নিচে ঘুমোনো লাগতো তাদের। তবে শীতকালে ঠান্ডা আবহাওয়া তাদের জন্য বয়ে আনতো মৃত্যুর শীতল বার্তা। দলবদ্ধভাবে কোথাও যাত্রা হয়তো কিছুটা নিরাপত্তা দিতে পারতো, কিন্তু তারপরেও থেকে যেত ডাকাতদলের হাতে আক্রান্ত হবার ভয়। এমনকি কখনো কখনো স্বীয় দলের সদস্যরাই একে অপরকে আক্রমণ করে বসতো।
খাদ্য ও পানীয় নিয়ে সংকটও ছিলো বেশ চিন্তার বিষয়। প্রায়ই ফুড পয়জনিংয়ের কবলে পড়তে হতো তাদের। খাবার শেষ হয়ে গেলে খাদ্য অন্বেষণ, চুরি করার মতো কাজে জড়াতে হতো তাদের, নাহলে থাকতে হতো অনাহারে। কখনো কখনো আবার দুটি দেশের মধ্যকার বিবাদে দুর্ভাগ্যক্রমে জড়িয়ে পড়ে জেলের ভাতও খেতে হতো একজন ভ্রমণকারীকে। ভ্রমণকালীন অসুস্থতাও ছিলো ভাবিয়ে তোলার মতো একটি বিষয়। চলার পথে কেউ অসুস্থ হয়ে গেলে সে যে চিকিৎসা সুবিধা পাবে এমনটার কোনো নিশ্চয়তা এখনকার মতো দেয়া সম্ভবপর ছিলো না।
দুর্ভিক্ষ
মধ্যযুগীয় নারী-পুরুষদের কাছে দুর্ভিক্ষ ছিলো এক ভয়াবহ আতঙ্কের নাম। খারাপ আবহাওয়া কিংবা ফলনে মন্দা দেখা দিলে এ ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব হতো। তখন অনেককেই না খেয়ে দিনাতিপাত করতে হতো। যদি বা ভাগ্যে সামান্য কিছু খাবার জুটত, তবে তার মাঝে থাকতো গাছের বাকল, ছোট ছোট ফল, নিম্নমানের ভুট্টা ও ছত্রাকের প্রভাবে নষ্ট যব।
অনাহার-অর্ধাহারে থাকা এসব মানুষ এরপর আক্রান্ত হতো অপুষ্টিতে। যদি তারা দুর্ভিক্ষের ধাক্কা সামলাতে পারতো, তবে এরপর তাদের সামনে যমরুপে আসতো নানাবিধ রোগ। যক্ষা, স্মলপক্স, আমাশয়, টাইফয়েড, ইনফ্লুয়েঞ্জা, হাম, গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টাইনাল ইনফেকশনে ভুগেও অনেকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো।
সন্তান জন্মদান
চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্রমোন্নতির ফলে আজকের দিনে সন্তান জন্মদানের বিষয়টি আগের চেয়ে বেশ নিরাপদ। মধ্যযুগে এ আনন্দদায়ক মুহুর্তটি প্রায় সময়ই রুপ নিতো শোকসভার।
জন্মের সময় সন্তানের অবস্থান প্রায় সময়ই মা ও সন্তানের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতো। কখনো কখনো প্রসব বেদনায় ভুগতে ভুগতেই মারা যেত একজন গর্ভধারিণী মা। আজকের দিনের মতো সিজারিয়ান অপারেশনের এত চল তখন ছিলো না। যদি মা মারা যেত কিংবা মারা যাওয়ার মতো অবস্থায় চলে যেত, তবেই কেবলমাত্র সিজারিয়ান অপারেশনের দ্বারস্থ হতো লোকেরা। তবে সেক্ষেত্রেও সফলতার কোনো নিশ্চয়তা ছিলো না।
আজকের দিনে মানুষজন সন্তান জন্মের জন্য ডাক্তারের দ্বারস্থ হলেও তখনকার দিনে তারা যেত ধাত্রীদের কাছে। অনেক সময়ই দেখা যেত সেসব ধাত্রীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নেই। এছাড়া সন্তান জন্মদানের পরবর্তী সময়ে মায়েদের বিভিন্ন ইনফেকশনে আক্রান্ত হবার ঘটনাও তো ছিলো বেশ কমন।
শিশুকাল
বর্তমানে আমাদের দেশে শিশুমৃত্যুহার কমে গেছে অনেক। সেই সাথে আধুনিক নানা টিকা ও চিকিৎসাপদ্ধতিও শিশুদেরকে অনাকাঙ্ক্ষিত রোগব্যাধি থেকে সুরক্ষা দিয়ে চলেছে। তবে আজ থেকে পাঁচ-ছয়শ বছর আগেকার পরিস্থিতি কিন্তু এমন ছিলো না। তখনকার সময়ে শিশুমৃত্যুর হারটা ছিলো সত্যিই চোখে পড়ার মতো। মধ্যযুগের বিভিন্ন নথিপত্র ঘাটিয়ে গবেষকরা জানিয়েছেন যে, সাত বছরের কম বয়সী প্রতি একশজন শিশুর মাঝে বিশ থেকে ত্রিশজনই মারা যেত নানাবিধ রোগের কবলে পড়ে। তবে প্রকৃত সংখ্যাটা আরো বেশি বলেই অনুমান করেন অনেকে।
অপুষ্টি, বিভিন্ন রোগ ও ইনফেকশন ছিলো শিশুদের প্রধান শত্রু। স্মলপক্স, হুপিং কফ, হাম, বিভিন্ন দুর্ঘটনা, যক্ষা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, পাকস্থলিতে ইনফেকশন ইত্যাদি নানা রোগে ভুগে মারা যেত শিশুরা। প্লেগে মারা যাওয়া জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ ছিলো এ শিশুরাই।
আবহাওয়া
নানাবিধ রোগশোকের পর এবার তাহলে একটু আবহাওয়ার দিকেও নজর বুলানো যাক। তৎকালীন জনগণের উপর বিপদ যে সবদিক থেকেই আসতো, আবহাওয়ার কথাগুলো বললে এ ধারণাটা স্পষ্ট হবে। আমাদের বর্তমান যুগেও যে আমরা আবহাওয়া দ্বারা প্রভাবিত হই না এমনটা বলা না গেলেও জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনগ্রসর মধ্যযুগীয় মানুষগুলোর জীবনে আবহাওয়ার প্রভাব ছিলো এখনকার চেয়ে শতগুণ বেশি।
আবহাওয়ার পরিবর্তনে মাঝে মাঝে সময়ের ফসল সময়ে ফলতো না। তখন দেশজুড়ে দেখা দিতো খাদ্যের তীব্র সংকট। অনাহার-অর্ধাহার-অপুষ্টিতে ভোগা মানুষগুলো তখন মৃত্যুহার বাড়াতে অনিচ্ছাকৃত অবদান রাখতো। এছাড়া ফসল নষ্ট হবার মতো দুর্যোগ তো ছিলোই।
যে আবহাওয়া নিয়ে এত সমস্যা, তাহলে সেই আবহাওয়াকেই আগে স্থিতিশীল করা দরকার। এজন্য তৎকালীন মানুষেরা জমি চাষ, বীজ বপন ও ফসল কাটানো উপলক্ষ্যে নানাবিধ ধর্মীয় আচার-প্রথার উদ্ভব ঘটিয়েছিলো। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মুক্তি পেতে তারা বিভিন্ন সেইন্টের দ্বারস্থও হতো। এর মাঝে তুষারপাত থেকে মুক্তি পেতে সেইন্ট সার্ভেইস, বায়ুপ্রবাহ কিংবা বৃষ্টিপাতের উপর ক্ষমতা লাভে সেইন্ট ক্লেমেন্ট এবং খরার নিয়ন্ত্রণে সেইন্ট এলিজাহের কাছে সাহায্য চাইতো তারা। এছাড়া মাদার মেরী (বিবি মরিয়ম) ও অন্যান্য সেইন্টরা তাদেরকে ঝড়ঝঞ্চা ও বজ্রপাতের কবল থেকে রক্ষা করবে বলেও বিশ্বাস ছিলো তাদের।
দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার পেছনের কারণ সম্পর্কে তাদের ভাবনাও আজকের দিনের মানুষজনকে বিস্মিত না করে পারবে না। তারা মনে করতো নানাবিধ অপরাধ, খুন, ইনসেস্ট, পারিবারিক কলহের মতো বিষয়গুলো আবহাওয়ার বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। এছাড়া তারা মনে করতো যে, জাদুকর ও ডাইনিরাও আবহাওয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ধ্বংস করে দিতো তাদের খাদ্যশস্য!
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি
আজকের দিনে পেপার খুললে কিংবা টিভি চালু করলে যেমন আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতির নানাবিধ খবর পাওয়া যায়, মধ্যযুগটাও এর থেকে কোনো অংশে ব্যতিক্রম ছিলো না।
রাস্তাঘাটে মারামারি, খুনোখুনি, ধর্ষণ, লুটতরাজ ছিলো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সামন্তরাজরা মাঝে মাঝেই তাদের প্রভুদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসতো। বিভিন্ন পরিবারের সদস্যদের মাঝে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলতো রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। এছাড়া জমিজমা, টাকা-পয়সা কিংবা অন্যান্য বিষয়াদি নিয়ে আজকের দিনের মতো তখনকার সময়েও আত্মীয়দের মাঝে ঝামেলা বাধতো।
শিকার
আজকের দিনে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে আমাদের আমোদ-প্রমোদের উৎসের সংখ্যা অনেক। তবে আগেকার দিনে পরিস্থিতি এমন ছিলো না। এই যেমন শিকারের কথাই ধরা যাক। তখনকার দিনের ধনী ও অভিজাত সমাজের অবসর বিনোদনের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপায় ছিলো শিকার করা। এ জিনিসটিকে বেশ সম্মানের চোখেও দেখতো তারা। তবে এ শিকার থেকেও প্রায় সময়ই তাদেরকে নানাবিধ দুর্ঘটনার শিকার হতে হতো।
ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে, তীরবিদ্ধ হয়ে, হরিণের শিং কিংবা বুনো শূকরের দীর্ঘ দাঁতের আঘাত পেয়ে, বাঘ-ভাল্লুক-সিংহ ইত্যাদি প্রাণীর আক্রমণ মাঝে মাঝেই শৌখিন ধনীক শ্রেণীর মানুষগুলোর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াতো।
উদাহরণস্বরুপ বলা যায় বাইজান্টাইন সম্রাট প্রথম বাসিলের কথা। ৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে তার বেল্ট একটি হরিণের শিংয়ে আটকে গেলে তা তাকে প্রায় ১৫ মাইল দূর পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়। এতেই মৃত্যু ঘটে রাজার।