স্পাই বা গুপ্তচর শুনলেই আমাদের কল্পনার দৃষ্টিতে ভেসে ওঠে মাসুদ রানা অথবা জেমস বন্ডের মতো কারো চেহারার বর্ণনা। আমাদের অনেকেরই ধারণা, স্পাই হবে সুদর্শন, ছয় ফিট লম্বা, সুঠাম দেহের অধিকারী ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী কোনো যুবক। সে শুধুমাত্র কারাতে এবং জুজুৎসুতেই অসম্ভব দক্ষ হবে না, বরং একই সাথে তার থাকবে কয়েক ডজন ভাষার উপর অগাধ জ্ঞান, এবং সে হবে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ও বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র থেকে শুরু করে গাড়ি, প্লেন, হেলিকপ্টার সহ সব ধরনের যানবাহন চালানোয় অসম্ভব রকমের পারদর্শী।
কিন্তু হুয়ান পুহোল গার্সিয়ার মধ্যে এ ধরনের কোনো গুণাবলিই ছিল না। তিনি ছিলেন মাঝারি উচ্চতার, অনাকর্ষণীয় চেহারার এবং মাথায় আংশিক টাক বিশিষ্ট খুবই সাধারণ একজন ব্যক্তি। গোয়েন্দাগিরি বিষয়ে তার কোনো অভিজ্ঞতা বা প্রশিক্ষণ ছিল না। কোনো ধরনের বিশেষ দক্ষতাও তার ছিল না। এমনকি তিনি তার মাতৃভাষা স্প্যানিশের বাইরে ইংরেজিটাও ভালো করে জানতেন না। কিন্তু শুধুমাত্র অসম্ভব বুদ্ধিমত্তা এবং লাগামহীন কল্পনাশক্তির সাহায্যে বিশ্বের অন্যতম সেরা ডাবল এজেন্ট হিসেবে তিনি ঠাঁই করে নিয়েছিলেন ইতিহাসের পাতায়।
পুহোলের তৈরি করা অবিশ্বাস্য রকমের জটিল এবং বিস্তৃত কাল্পনিক গোয়েন্দা জগতের রিপোর্টগুলো ধোঁকা দিতে সক্ষম হয় স্বয়ং হিটলারকেও। তার অপারেশন ফোর্টিচিউড এর ধোঁকায় পড়ে হিটলারের কমান্ডার ইন চিফ, ফিল্ড মার্শাল রান্ডস্টেড জার্মান বাহিনীর ২১ ডিভিশন সৈন্যকে নিযুক্ত করে রাখেন অন্য জায়গায়। আর এর ফলেই মিত্র বাহিনীর পক্ষে বিখ্যাত ডি-ডে‘র অপারেশনে নরম্যান্ডি বিচে জার্মানদের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করা সম্ভব হয়। লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন রক্ষা পায় তার কূট কৌশলের কারণে। আর এসবই তিনি করেন শত্রু পক্ষের মনে কোনো রকম সন্দেহের উদ্রেক না ঘটিয়েই। তিনি ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের খুবই স্বল্পসংখ্যক গুপ্তচরের মধ্যে একজন, যিনি একই সাথে ব্রিটিশ এবং জার্মান, দুই পক্ষের কাছ থেকেই বিশেষ অবদানের জন্য পুরস্কার পেয়েছিলেন।
কে ছিলেন এই হুয়ান পুহোল গার্সিয়া?
হুয়ান পুহোল গার্সিয়া ছিলেন স্পেনের কাতালুনিয়ার বার্সেলোনার অধিবাসী। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন নির্ঝঞ্ঝাট, নিরুপদ্রব ধরনের মানুষ। ত্রিশের দশকে যখন স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, তখন তিনি যুদ্ধে যোগ দেওয়ার ভয়ে দীর্ঘদিন পর্যন্ত তার প্রেমিকার বাসায় আত্মগোপন করে ছিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত রিপাবলিকান পক্ষের হাতে ধরা খেয়ে তাকে যুদ্ধে যোগ দিতে হয়েছিল। রিপাবলিকান দলের প্রতি পুহোলের আগে থেকেই বিতৃষ্ণা ছিল, কারণ তাদের হাতে তার মা, বোন এবং বোনের প্রেমিক হয়রানির শিকার হয়েছিল। তাই বাধ্য হয়ে তাদের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দিলেও তিনি সবসময় পালানোর সুযোগ খুঁজছিলেন।
১৯৩৮ সালে রিপাবলিকানদের পক্ষ হয়ে যুদ্ধের ময়দানে টেলিগ্রোফের তার বসানোর সময় সুযোগ বুঝে পুহোল পালিয়ে গিয়ে ন্যাশনালিস্টদের পক্ষে যোগদান করেন। কিন্তু ন্যাশনালিস্টদের হাতেও তিনি একই রকম নিগৃহীত হন। তাদের ফ্যাসিস্ট মনোভাবও পুহোলের পছন্দ হচ্ছিল না। নিজের মতামত প্রকাশ করায় তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে তিনি গ্রেপ্তার বরণ করেন। ফলে পুহোলের মধ্যে একই সাথে কমিউনিজম এবং ফ্যাসিজম- উভয় মতাদর্শের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়, যে বিদ্বেষ পরবর্তীতে যথাক্রমে বৃহত্তর সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং নাৎসি জার্মানী পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। তার এ ধরনের মনোভাবই তাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জার্মানীর বিপক্ষে গোয়েন্দাগিরি করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
জার্মান গোয়েন্দা হিসেবে যোগদান
স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের পর পুহোল যখন সবেমাত্র তার পুরানো মুরগির খামারটি বন্ধ করে মাদ্রিদে একটি নিম্নমানের একতারকা হোটেলের ব্যবসা চালু করে কোনো রকমে দিন অতিবাহিত করার চেষ্টা করছিলেন, ঠিক তখনই শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। হিটলারের সেনাবাহিনী একের পর এক ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো দখল করে নিতে থাকে, আর জেনারেল ফ্রাঙ্কোর সম্মতিতে স্পেন হয়ে উঠতে থাকে নাৎসি বাহিনীর গুপ্তচরদের অন্যতম প্রধান অভয়ারণ্য। সে সময় ব্রিটেন ছিল জার্মানীর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো ইউরোপের একমাত্র সম্ভাবনাময় রাষ্ট্র। পুহোল সিদ্ধান্ত নেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও মানবতার বৃহত্তর কল্যাণে তাকে হিটলারের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কিছু একটা করতে হবে।
১৯৪১ সালে পুহোল মাদ্রিদে অবস্থিত ব্রিটিশ দূতাবাসে যান এবং ব্রিটিশদের হয়ে জার্মান গোয়েন্দাদের উপর পাল্টা গোয়েন্দাগিরি করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু পুহোলের চেহারা, শারীরিক গঠন, শিক্ষা কিংবা অভিজ্ঞতা, কোনো কিছুই গোয়েন্দা হওয়ার উপযুক্ত ছিল না। ফলে ব্রিটিশ কর্মকর্তারা হাসতে হাসতেই তাকে দূতাবাস থেকে বের করে দেন। তাদের জানার কথা ছিল না, মাত্র এক বছরের মধ্যেই এই আপাত অযোগ্য লোকটিই হয়ে উঠবে হিটলারকে বিভ্রান্ত করার জন্য ব্রিটেনের সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র। তার শত্রুকে ধোঁকা দেওয়ার অবিশ্বাস্য সব কৌশল এবং শত্রুর বিশ্বাস অর্জন করার অসাধারণ দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে অভিনেত্রী গ্রেটা গার্বোর নামানুসারে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা তার ছদ্মনাম দিবে এজেন্ট গার্বো!
পরপর তিনবার চেষ্টা করেও ব্রিটিশদের কাছ থেকে পাত্তা না পেয়ে পুহোল সিদ্ধান্ত নেন, তিনি জার্মান গোয়েন্দা বাহিনীতে যোগ দিবেন। এরপর তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য দিয়ে সাহায্য করবেন ব্রিটিশদেরকে। তিনি যেচে পড়ে এক স্প্যানিশ কূটনীতিবিদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। এরপর একদিন সুযোগ বুঝে তাকে পানীয় এবং চিপস খেতে দিয়ে তার রুমে গিয়ে তার পাসপোর্ট এবং কূটনৈতিক কাগজপত্রগুলো ফটোকপি করে ফেলেন। পরে সেগুলো দেখিয়ে ভুয়া পরিচয় দিয়ে কূটনৈতিক পাসপোর্ট এবং ভিসার অনুলিপি সংগ্রহ করে ফেলেন। স্প্যানিশ কূটনীতিবিদের ছদ্মবেশ ধরে পুহোল মাদ্রিদের জার্মান দূতাবাসে যান এবং নিজেকে নাৎসি ভক্ত হিসেবে পরিচয় দেন। সেখানে তিনি ফ্রেডেরিকো নামে এক জার্মান গোয়েন্দার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন।
পুহোল তার কূটনৈতিক পাসপোর্ট-ভিসা দেখিয়ে এবং উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের সাথে তার বন্ধুত্বের কাল্পনিক গল্প শুনিয়ে ফ্রেডেরিকোকে এমনভাবে মুগ্ধ করে ফেলেন যে, ফ্রেডেরিকো তাকে গুপ্তচর হিসেবে নিয়োগ দেন। তিনি পুহোলকে গুপ্তচরবৃত্তির উপর একটি সংক্ষিপ্ত কোর্স করান, যার মধ্যে সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার সহ বিভিন্ন মৌলিক দক্ষতা অন্তর্ভুক্ত ছিল। কোর্স সমাপ্তির পর ফ্রেডেরিকো পুহোলকে সাংকেতিক ভাষার একটি কোড বই, গোপন বার্তা লেখার জন্য এক বোতল অদৃশ্য কালি ও নগদ ৬০০ পাউন্ড দেন এবং ইংল্যান্ডে গিয়ে তার বিশ্বস্ত ব্যক্তিদেরকে নিয়ে গুপ্তচরদের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করে নিয়মিত রিপোর্ট পাঠানোর নির্দেশ দেন। জার্মান গোয়েন্দাবাহিনীতে পুহোলের ছদ্মনাম দেওয়া হয় অ্যালারিক অ্যারাবেল (Alaric Arabel)।
ডাবল এজেন্ট হিসেবে পুহোলের তৎপরতা
ভুয়া পরিচয়ের কারণে পুহোল ইংল্যান্ডে না গিয়ে পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে গিয়ে স্থায়ী হন। সেখানে পাবলিক লাইব্রেরি থেকে ব্রিটিশ মিলিটারির উপর লেখা বিভিন্ন বইপত্র ও ম্যাগাজিন সংগ্রহ করে এবং ব্রিটিশ ফোন বুক, প্রচারণামূলক চলচ্চিত্র, সামরিক বিজ্ঞাপন প্রভৃতি থেকে তথ্য নিয়ে তার সাথে নিজের কল্পনাশক্তির মিশ্রণ ঘটিয়ে নিজের হোটেল রুমে বসেই তিনি জার্মানদের কাছে একের পর এক এমন বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠাতে থাকেন যে, জার্মানরা সেগুলোকে সত্যি বলে বিশ্বাস করতে থাকে। গুপ্তচরের নেটওয়ার্ক তৈরি করার পরিবর্তে তিনি নিজের কল্পনার জগতেই এক এক করে অন্তত ২৭ জন গুপ্তচর বানিয়ে নেন। তাদের পাঠানো কাল্পনিক রিপোর্টের সাথে সাথে তিনি ব্রিটিশ ট্যুরিস্ট গাইড ও রেলওয়ের ভ্রমণ গাইড ব্যবহার করে তথ্য সংগ্রহের কাজে তাদের ইংল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে যাতায়াতের খরচের বিবরণও জার্মানদের কাছে পাঠাতে থাকেন এবং সে বাবদ প্রয়োজনীয় অর্থও আদায় করে নিতে থাকেন।
পুহোলের পাঠানো রিপোর্টগুলো ছিল শতভাগ ভুয়া। কিন্তু সেগুলো এত বিস্তারিত এবং বিশ্বাসযোগ্য ছিল যে, জার্মান বাহিনী তার পাঠানো তথ্যগুলো নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা, বিশ্লেষণ এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে শুরু করে। জার্মানদের রেডিওতে আড়ি পেতে ব্রিটিশরা যখন জানতে পারে যে, কোনো এক গুপ্তচর ইংল্যান্ডে বসে তাদের সামরিক স্থাপনা, সৈন্যসংখ্যা, অস্ত্রশস্ত্র সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য জার্মানদের কাছে পাচার করছে, তখন তারা সেই গুপ্তচরকে খুঁজে বের করার জন্য বিশাল অভিযান শুরু করে। কিন্তু পরবর্তীতে পুহোল যখন মাল্টাতে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য অভিযান সংক্রান্ত একটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক রিপোর্ট জার্মানদের কাছে পাঠায় এবং জার্মানরাও সে তথ্যের ভিত্তিতে তাদের বিশাল বাহিনী পাঠায় পাল্টা অভিযান চালানোর জন্য, তখনই ব্রিটিশরা বুঝতে পারে যে, এই গুপ্তচর তাদের শুভাকাঙ্ক্ষী, যে ইচ্ছাকৃতভাবে জার্মানদেরকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করছে।
অবেশেষে ১৯৪২ সালে ব্রিটেনের এমআইসিক্স (MI6) গোয়েন্দারা পুহোলকে খুঁজে বের করে এবং তাকে ইংল্যান্ডে নিয়ে আসে। পুহোলের স্থান হয় টমাস হ্যারিস নামে এমআইফাইভ (MI5) এর স্প্যানিশ ভাষা জানা এক কর্মকর্তার অধীনে। তার নতুন ছদ্মনাম হয় এজেন্ট গার্বো। ইংল্যান্ডে আসার পর পুহোল তথা গার্বোর কাজ অনেকটা সহজ হয়ে যায়। কাল্পনিক তথ্যের পরিবর্তে এবার ব্রিটিশরাই তাকে তাদের পরিকল্পনা সম্পর্কিত বিভিন্ন গোপনীয় তথ্য দিতে শুরু করে, যেগুলো সত্য কিন্তু কম গুরুত্বপূর্ণ। গার্বো এবং হ্যারিস মিলে যুদ্ধের তিন বছর সময়ব্যাপী জার্মানদের কাছে মোট ৩১৫টি রিপোর্ট পাঠান, যার প্রতিটিতে মোটামুটি ২,০০০ করে শব্দ ছিল। গার্বোর কাল্পনিক এজেন্টদের নেটওয়ার্ক এবং তাদের পাঠানো রিপোর্টগুলো জার্মানদের কাছে এতটাই সন্তোষজনক ছিল যে, তারা ইংল্যান্ডে নতুন কোনো এজেন্ট পাঠানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি।
ব্রিটিশদের সামরিক অভিযান সম্পর্কে গার্বোর পাঠানো অগ্রীম রিপোর্টগুলো কেন কখনো কাজে লাগে না, সেজন্য অবশ্য গার্বোকে প্রায়ই জার্মানদের কাছে জবাবদিহিতা করতে হতো। তাদেরকে বিশ্বাস করানোর জন্য গার্বো একেক সময় একেক কাহিনী রচনা করতেন। একবার গুরুত্বপূর্ণ একটি অভিযানের তথ্য পাঠাতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য গার্বো তার এক কাল্পনিক এজেন্টের অসুস্থতাকে দায়ী করেন। কিন্তু জার্মানরা হয়তো তাকে বিশ্বাস না-ও করতে পারে এরকম আশঙ্কায় তিনি কিছুদিন পর সংবাদ পাঠান যে, অসুস্থতার কারণে ঐ এজেন্ট মৃত্যুবরণ করেছে। তার বক্তব্যকে বিশ্বাসযোগ্য করানোর জন্য এমআইফাইভের উদ্যোগে স্থানীয় একটি পত্রিকায় ঐ কাল্পনিক এজেন্টের মৃত্যুসংবাদও ছাপানো হয়। জার্মানরা শেষপর্যন্ত তাকে বিশ্বাস করে এবং ঐ কাল্পনিক এজেন্টের কাল্পনিক বিধবা স্ত্রীর ভরণ পোষণের জন্য পেনশনও দিতে রাজি হয়।
গার্বোর গুরুত্ব অনুধাবন করে জার্মানরা তাকে একটি মূল্যবান রেডিও প্রদান করে, যেন তার সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হয়। রেডিওর মাধ্যমে গার্বো বার্তাগুলো সাংকেতিক ভাষায় মাদ্রিদে পাঠাতেন। এরপর সেখান থেকে জার্মান গোয়েন্দারা বার্তার মর্ম উদ্ধার করে সেটিকে পুনরায় এনিগমা মেশিনের মাধ্যমে কোড করে পাঠিয়ে দিত বার্লিনে নাৎসি বাহিনীর হেড কোয়ার্টারে। এনিগমা মেশিন ছিল যেকোনো বার্তাকে সাংকেতিক ভাষায় রূপান্তরিত করার সবচেয়ে জটিল যন্ত্র।
ব্রিটিশরা দীর্ঘদিন ধরে জার্মানদের আবিষ্কৃত এ যন্ত্রটি দ্বারা কোড করা তথ্যকে ডিকোড করার কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিল না, কারণ প্রতিদিনই এতে নতুন পদ্ধতিতে বার্তা কোড করা হতো। গার্বোর পাঠানো বার্তাগুলো এনিগমা মেশিনের মাধ্যমে প্রেরণ করা হতো বলে যেদিন গার্বো বার্তা পাঠাতেন, ব্রিটিশ গোয়েন্দার সেই বার্তার সূত্র ধরে কখনো কখনো সেদিনের বার্তা ডিকোড করার পদ্ধতি বের করে ফেলতে পারত। যদিও এই সমাধান ছিল সাময়িক, তারপরেও এর মাধ্যমে ব্রিটিশরা মাঝে মাঝে জার্মান বাহিনীর গোপন তথ্য জানতে পারত।
অপারেশন ফোর্টিচিউড এবং হিটলারের সাথে প্রতারণা
এজেন্ট গার্বোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন ছিল অপারেশন ফোর্টিচিউড, যার মাধ্যমে গার্বো স্বয়ং হিটলারকে ধোঁকা দিয়ে জার্মান বাহিনীর পরাজয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯৪৪ সালের জানুয়ারিতে জার্মানরা গার্বোকে জানায়, তারা আশঙ্কা করছে মিত্রবাহিনী ইউরোপে বড় ধরনের আক্রমণ করবে। তারা গার্বোকে এ সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে এবং রিপোর্ট পাঠাতে নির্দেশ দেয়। জার্মানদের ধারণা ভুল ছিল না। মিত্রবাহিনী সত্যি সত্যিই সে সময় অপারেশন ওভারলর্ডের অধীনে ফ্রান্সে জার্মানদের উপর আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পরবর্তীতে ১৯৪৪ সালের ৬ জুন ফ্রান্সের নরম্যান্ডি বিচ আক্রমণের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল সে অভিযানটি। ইতিহাসে এই দিনটি ডি-ডে নামেই বেশি পরিচিত।
ব্রিটিশ গোয়েন্দা বাহিনী বুঝতে পেরেছিল, এত বড় আক্রমণের সংবাদ জার্মানদের কাছ থেকে গোপন রাখা কঠিন হবে। তাই তারা গার্বোর মাধ্যমে জার্মানদের কাছে আক্রমণটির অগ্রীম সংবাদ পাঠাতে শুরু করেন। ১৯৪৪ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু করে ডি-ডে পর্যন্ত গার্বো জার্মানদের কাছে পাঁচশটিরও বেশি রেডিও বার্তা পাঠান, যার মধ্যে অন্তত ৬২টি বার্তা জার্মান হাই কমান্ড পর্যন্ত পৌঁছেছিল। এসব বার্তায় গার্বো জার্মানদেরকে মিত্রবাহিনীর গোপন প্রস্তুতি, সৈন্যসংখ্যা, আক্রমণের সম্ভাব্য তারিখ প্রভৃতি সম্পর্কে অবহিত করতে থাকেন।
কিন্তু অপারেশন ফোর্টিচিউডের আওতায় গার্বো জার্মানদেরকে সত্য তথ্যের পাশাপাশি আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মিথ্যা তথ্য দিতে থাকেন। তিনি জার্মানদেরকে জানাতে থাকেন, মিত্রবাহিনীর মূল আক্রমণটি হবে নরম্যান্ডিতে না, বরং পা-দে-কালেতে। তার পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, বিখ্যাত মার্কিন জেনারেল জর্জ প্যাটনের অধীনে ১,৫০,০০০ সৈন্য পা-দে-কালে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। গার্বোর পাঠানো তথ্যকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের উদ্যোগে গার্বোর বর্ণিত এলাকায় লোক দেখানো এয়ারফিল্ড তৈরি করা হয় এবং যুদ্ধজাহাজ, প্লেন ও ট্যাংকের যাতায়াত বৃদ্ধি করা হয়। সেখান থেকে তারা রেডিওতে নিজেদের মধ্যে এমন সব তথ্য আদান-প্রদান করতে থাকে, যা শুনে জার্মান বাহিনী গার্বোর রিপোর্টটিকেই নিশ্চিত সত্য ভেবে বসে।
জার্মান বাহিনীর কাছে গার্বো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাসেজটি পাঠান ডি-ডে’র তিন দিন পর, জুনের ৯ তারিখে। বিশাল সে রিপোর্টে একাধিক এজেন্টের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে তিনি উল্লেখ করেন, নরম্যান্ডিতে আক্রমণ ছিল জার্মান বাহিনীকে পা-দে-কালে থেকে সরিয়ে আনার জন্য মিত্র বাহিনীর একটি প্রচেষ্টা। তিনি দাবি করেন, জেনারেল প্যাটনের নেতৃত্বে মিত্র বাহিনীর মূল সৈন্যদল তখনও ইংল্যান্ডেই রয়ে গিয়েছিল পা-দে-কালেতে আক্রমণ করার জন্য।
গার্বোর পাঠানো এ রিপোর্ট স্বয়ং হিটলারের কাছে পাঠানো হয় এবং হিটলারও তা বিশ্বাস করেন এবং তার হাইকমান্ডকে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। বিখ্যাত জেনারেল রোমেলের আপত্তি সত্ত্বেও গার্বোর বার্তা দ্বারা প্রভাবিত জার্মান বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ জার্ড ফন রান্ডস্টেড পরবর্তী দুমাস পর্যন্ত প্রায় আড়াই লাখ সৈন্যকে পা-দে-কালেতে বসিয়ে রাখেন সম্ভাব্য পরবর্তী আক্রমণ মোকাবেলা করার জন্য। আর এ সুযোগে নরম্যান্ডির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় মিত্র বাহিনী, যা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাদের বিজয়ের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
পুরস্কার এবং স্বীকৃতি
যদিও গার্বোর দেওয়া তথ্যের কারণেই নরম্যান্ডিতে জার্মানদের পরাজয় ঘটেছিল, কিন্তু জার্মানরা শেষপর্যন্তও তা বুঝতে পারেনি। ১৯৪৪ সালের ২৯ জুন তাকে জানানো হয়, জার্মানীর জন্য বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ হিটলারের পক্ষ থেকে তাকে আয়রন ক্রস পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। আয়রন ক্রস সাধারণত সম্মুখ সমরে বীরত্বের জন্য হিটলার সশরীরে উপস্থিত হয়ে প্রদান করতেন। কিন্তু গার্বোর বিশেষ অবদানের জন্য সম্মুখ সমরের যোদ্ধা না হওয়া সত্ত্বেও রেডিও বার্তার মাধ্যমে তাকে পুরস্কার প্রদানের ঘোষণা দেওয়া হয় এবং পরবর্তীতে যুদ্ধ শেষে পদকটি তার হাতে পৌঁছে।
অন্যদিকে একই বছরের নভেম্বরে তাকে ইংল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ জর্জের পক্ষ থেকে এমবিই (MBE: Order of the British Empire) পুরস্কার প্রদান করা হয়। একইসাথে যুদ্ধের দুই বিপরীত পক্ষের কাছ থেকে পুরষ্কার নজির ইতিহাসে অত্যন্ত বিরল। যুদ্ধের পর এজেন্ট টমাস হ্যারিস যখন মার্কিন প্রেসিেন্ট জেনারেল আইজেনহাওয়ারের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন, তখন তিনি হ্যারিসকে বলেছিলেন, তার এবং গার্বোর কাজ যুদ্ধে এক ডিভিশন (১০-১৫ হাজার) সৈন্যের চেয়েও বেশি অবদান রেখেছে। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ রজার ফ্লিটউড হেসকেথের মতে, গার্বোর মেসেজই নরম্যান্ডি যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি বদলে দিয়েছিল। ডি-ডে’র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে হুয়ান পুহোল তথা গার্বো নিজেকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ডাবল এজেন্ট হিসেবে প্রমাণ করতে পেরেছিল।
যুদ্ধের পর দীর্ঘদিন পর্যন্ত এজেন্ট পুহোল আলোচনার বাইরে ছিলেন। তিনি এমআইফাইভের পরামর্শে নিজের মৃত্যুর কাহিনী সাজিয়ে প্রথমে অ্যাঙ্গোলা এবং পরবর্তীতে ভেনেজুয়ালাতে গিয়ে ভিন্ন পরিচয়ে বসবাস শুরু করেন। ১৯৭১ সালে ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ রুপার্ট অ্যালাসন, যিনি নাইজেল ওয়েস্ট ছদ্মনামে গুপ্তচরবৃত্তির উপর লেখালেখি করতেন, তিনি গার্বোর ব্যাপারে আগ্রহী হন। দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর তিনি গার্বোকে খুঁজে বের করেন এবং ১৯৮৪ সালে তার সাথে সাক্ষাৎ করেন। ১৯৮৫ সালে তারা দুজন মিলে Operation GARBO: The Personal Story of the Most Successful Double Agent of World War II শিরোনামে একটি বই প্রকাশ করেন, যেখানে এজেন্ট গার্বোর জীবনবৃত্তান্ত উঠে আসে। পরবর্তীতে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআইফাইভ তার অপারেশনের তথ্য উন্মুক্ত করে দেয়।
এই আর্টিকেলটি ভালো লাগলে পড়তে পারেন একই বিষয়ের উপর এই লেখকের লেখা বই “স্পাই স্টোরিজ: এসপিওনাজ জগতের অবিশ্বাস্য কিছু সত্য কাহিনি“।
বইটি সংগ্রহ করতে পারেন এখান থেকে: roar.cm/spy-stories