নিলামে মানুষ গহনা থেকে শুরু করে খেলোয়াড়দের ব্যাট, বল কিংবা ভয়ঙ্কর সব ছবি, পুতুল- কত কিছুই না কেনে। কিন্তু ভেবে দেখুন তো নিলামে মানুষ তার নিজের তৈরি কিছু বিক্রি না করে বিক্রি করার চেষ্টা করে তারই মতো আরেক মানুষের অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে? বিখ্যাত এবং বিখ্যাত নন, এমন অনেক মানুষের শরীরের অংশই আজ পর্যন্ত উঠেছে নিলামে। সেগুলোকে আবার কিনেও নিয়েছে অন্য উৎসাহী মানুষ। এমন নিলামে বিক্রি হওয়া মানব শরীরের অংশগুলোকেই নিয়েই এই লেখা।
খুলি যখন নিলামে
২০১১ সালের ২৯ মে, এক অ্যাংলো-আইরিশ পরিবার ১৩৭০ সালে মৃত্যুবরণ করা এক সন্ন্যাসী সেইন্ট ভিটালিস অব আসিসির খুলি নিলামে তোলেন। নিজের জীবনের প্রথম দিকে অসৎ পথ অবলম্বন করলেও শেষের দিকে সৎভাবে জীবনযাপন করেন এই সন্ন্যাসী। বেছে নেন তীর্থযাত্রীদের আশ্রয়স্থলে পৌঁছে দেওয়ার কাজ। ইতালিতে জন্ম নেন এই সাধু। তবে পরবর্তীতে নির্বাসন নেন অন্য দেশে। অভাবের তাড়নায় একসময় মৃত্যু হয় তার। জীনগত নানা রোগের সমাধান করতে পারতেন তিনি- এমনটা মনে করা হয়।
আয়ারল্যান্ডের কাউন্টি মীথে নিলাম শুরু করলে ভালো সাড়া মেলে। শুরুতে দাম ৮০০ এবং ১,২০০ ইউরোর মধ্যে রাখা হলেও শেষ পর্যন্ত একজন হলিউড অভিনেত্রী নিজের সংগ্রহের জন্য ৩,৫০০ ইউরোতে কিনে নেনে খুলিটি। নিলামে খুলিটির সর্বোচ্চ দাম উঠেছিল ১০,০০০ ইউরো পর্যন্ত। তবে সেক্ষেত্রে খুলিটিকে আয়ারল্যান্ডের বাইরে নিয়ে যাওয়া হতো। আর তাই বেশি দাম হাঁকা মানুষটিকে না করে দেয় অ্যাংলো-আইরিশ পরিবারটি।
মস্তিষ্ক
জেনে অবাক হবেন যে, এ পর্যন্ত বিখ্যাত অনেকের মস্তিষ্ককই নিলামে ওঠানো হয়েছে। যার মধ্যে প্রথমেই বলতে হয় ফ্রান্সোয়া মারিয়ো রোয়ের কথা, যাকে আমরা সবাই ভলতেয়ার নামেই বেশি চিনি। ফ্রান্সের বিখ্যাত এই লেখকের মস্তিষ্ক এবং হৃদপিণ্ড নিলামে ওঠায়, ফ্রেঞ্চ সরকার সেটা নিয়ে বেশ সমস্যায় জড়িয়ে যায় ভলতেয়ারের সন্তানদের সাথে। পরবর্তীতে এই নিলাম আর সমাপ্ত হয়নি।
অন্যদিকে ইবে নিলামে ইতালির বিখ্যাত একনায়ক বেনিতো মুসোলিনির মস্তিষ্ককেও নিলামে তোলা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিলান হাসপাতালে ময়নাতদন্ত করার সময় এটি চুরি হয় বলে জানান মুসোলিনির নাতনি। ইবে বিখ্যাত এই মানুষের রক্ত এবং মস্তিষ্কের দাম প্রাথমিকভাবে ২২,২৯০ ইউরো ধরলেও পরবর্তীতে সেটি কমে ১৫,০০০ ইউরোতে নামে। আর এরপর কোম্পানির নিয়মের আওতায় না পড়ায় নিলামটিই বন্ধ করে দিতে হয় ইবে-কে।
চুল
মানুষের মৃত্যু হলেও তার চুল অনেকদিন পর্যন্ত ঠিক একইরকম থাকে। আর তাই নিলামের এই তালিকায় চুল যে থাকবে সেটি খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। এ পর্যন্ত নিলামে অনেক বিখ্যাত মানুষের চুলের কেনাবেচা হয়েছে। তবে সবচাইতে বেশি আলোচনা ছড়িয়েছে যে তারকার চুল তিনি আর কেউ নন, বিখ্যাত সংগীতশিল্পী এলভিস প্রিসলি। ২০১২ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার বেভারলি হিলসে জুলিয়েন’স অকশনে বিক্রি হয় এই বিখ্যাত তারকার চুল। মোট ৪,১৬০ ডলারে সেটি কিনে নেন প্রিসলির ব্যক্তিগত হেয়ারস্টাইলিস্ট গিল গিলেলান্দ। এরপর বহু বছর ধরে নিজের বন্ধুদেরকে প্রিসলির চুল সম্বলিত কার্ড পাঠিয়েছেন গিল। তবে এটি একমাত্র নয়, এর আগেও প্রিসলির চুল বিক্রি হয়েছে আরো অনেকগুলো নিলামে।
এছাড়াও ২০০২ সালে প্রিসলির চুল নিলামে বিক্রি হয় প্রায় ১,১৫,০০০ ডলার দামে। প্রিসলির মত এত দামে বিক্রি না হলেও বেসবল তারকা মিকি মেন্টেলের চুল বিক্রি হয় ৬,৯০০ ডলারে। এই তালিকা থেকে বাদ পড়েন নি চে গুয়েভারাও। তবে তার ১,১৯,৫০০ ডলারের নিলামের মধ্যে ছিল গুয়েভারার লাশের ছবি আর হাতের ছাপও।
দাঁত
চুলের মত মানব শরীরের আরেকটি সংরক্ষণযোগ্য অংশ হলো দাঁত। ২০০১ সালে নিলামে উঠেছিল অভিনেতা কোরে হাইমের দাঁত। মজার ব্যাপার হলো, হাইম নিজের দাঁত নিজেই নিলামে তুলেছিলেন। তার একটি পেষক দাঁত পড়ে গেলে এই কাজটি করেন তিনি। তবে কেবল দাঁত নয়, সাথে এক গোছা চুলও জুড়ে দিয়েছিলেন তিনি। প্রথমে ইবে-তে দাঁত আর চুল বিক্রির জন্য তুললেও তাতে করে বেশ ঝামেলায় পড়েন হাইম। ঠিক যেমনটা বলা হয়েছে একটু আগে, ইবে মানব শরীরের কোনো অংশ বিক্রি করে না। তবে তাতে কী? একটুও দমে যাননি হাইম। অন্য আরেকটি ওয়েবসাইটে নিজের দাঁত আর চুল নিলামে তোলেন তিনি।
হাত
২০০৭ সালে আই. এম. চেইট গ্যালারী নিউ ইয়র্ক সিটির ফিফথ এভিনিউয়ে একটি কক্ষ ভাড়া করে নিজেদের ‘ন্যাচারাল হিস্টোরি’ নামক নিলামটি পরিচালনার জন্য। আর সেই প্রদর্শনীতে তারা আরো অনেক কিছুর সাথে রাখে অনেক বছর আগেকার এক মমির হাত। প্রথমে মনে করা হয়েছিল ‘রিপলি’স বিলিভ ইট ওর নট’ এই নিলামে জিতে যাবে আর মমির হাতটি নিজেদের করে নিবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হাতটি সান্তা মনিকার একটি গ্যালারীর মালিক অ্যান্দ্রেস কার্লসন। মোট ৪,৫০০ ডলার খরচ করেন তিনি হাতটি পাওয়ার জন্য। এর আগে ব্রিটিশ জাদুঘরের কাছ থেকে হাতটি কিনে নেন আরেকজন অ্যান্টিক ব্যাবসায়ী।
আঙ্গুল
ইতালিয়ান বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলির নাম তো নিশ্চয়ই শুনেছেন? তিনি মৃত্যুর আগে নিজের আঙ্গুল এবং সেই সাথে দাঁত আর বুড়ো আঙ্গুলও ফেলে গিয়েছিলেন। ২০০৯ সালে এই অংশগুলোকে একজন শিল্প সংগ্রাহক খুঁজে পান। মৃত্যুর প্রায় ৯৫ বছর পর পর্যন্ত ক্যাথেলিক চার্চ গ্যালিলিও গ্যালিলির ধর্মীয় শাস্ত্রানুসারে সৎকার করতে রাজী হয় নি। পরবর্তীতে তারা মন ফেরালেও ১৭৩৭ সালে গ্যালিলির শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে তার দেহের উপরে নজর পড়ে জিওভানি টারজিওনি টোজেটির। মূলত, গ্যালিলির খুলির উপরে নজর ছিল তার। কিন্তু সেটি চুরি করতে না পারলেও আঙ্গুল আর দাঁত সংগ্রহ করেন তিনি। ১৯০৫ সালে হারিয়ে যায় এই দাঁত আর আঙ্গুল। তবে তার আগে নানা হাত ঘোরার সৌভাগ্য হয় এদের। তারপরের গল্পটা তো জানাই আছে। হঠাৎ খুঁজে পেয়ে সাথে সাথে আবার নিলামে উঠিয়ে দেওয়া হয় শরীরের অংশগুলোকে।
পা
২০০৬ সালে এক বিমান ধ্বংস হওয়ার গল্প। সেই দুর্ঘটনায় জন উড তার বাবাকে হারান। সেইসাথে জনের একটি পা কেটে ফেলতে হয় নানা কারণে। তবে বাবার স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য একটি বারবিকিউ স্মোকারের ভেতরে নিজের কাটা পা’টি তিনি যত্ন করে রেখে দেন। সমস্যা শুরু হয় যখন এই স্মোকারটি বিক্রি হয়ে যায় আর স্মোকারের সাথে সাথে পা-টিও হারিয়ে যায়।
পরবর্তীতে শ্যানন হুইশন্যান্ট নিজের কেনা পা-টিকে প্রদর্শন করা শুরু করলে সেটিকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবী জানান উড। টিভি রিয়েলিটি শো-তে আসেন তিনি পা ফিরে পাওয়ার জন্য। বেশ হৈ চৈ হয় ব্যাপারটি নিয়ে। অবশেষে একটা সময় নিজের পা ফিরে পান উড। এরপর নিজের ক্লজিটে রেখে দেন তিনি কেটে ফেলা পা-কে।
কঙ্কাল
২০১২ সালের কথা। এক নারী এবং এক পুরুষের কঙ্কাল তোলা হয় পেন্সিলভেনিয়ার একটি নিলামে। এর আগে আর বেশ কিছু নিলাম এবং মানুষের হাত ঘুরে এসে পৌঁছেছিল প্রায় এক শতক আগের এই কঙ্কাল দুটো। ল্যাঞ্চেস্টারের একজন অ্যান্টিক ব্যবসায়ী কঙ্কাল দুটো কিনে নেন একসাথে। পুরুষ কঙ্কালের জন্য ৯০০ এবং নারী কঙ্কালের জন্য ৯৫০ ডলার খরচ করেন তিনি।
ফিচার ইমেজ: Saga