ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান এক অনন্য নাম। তিনিই শেষ রাজপুত রাজা যিনি দিল্লি শাসন করেছিলেন। তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে তার পরাজয়ের মাধ্যমেই দিল্লিতে মুসলিম শাসন শুরু হয়। বিজয়ী বীর মুহাম্মদ ঘুরী দিল্লিতে সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন আর পরাজিত বীর যোদ্ধা রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহানের মৃত্যু হয়। ইতিহাসের নিষ্পৃহ শীতল দৃষ্টিতে এটাই হয়তো রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহানের পরিচয়। কিন্তু স্বাধীনচেতা, রাজপুত রাজা, বীর যোদ্ধা, করুণ মৃত্যু- এসব ছাপিয়েও পৃথ্বীরাজের রয়েছে আরেকটি পরিচয়। আর সেই পরিচয়টি ইতিহাসের পাতায় নয়, কাব্য-কথায় পাওয়া যায়। আর সেই পৃথ্বীরাজ কোনো যোদ্ধা নন, নন কোনো রাজা-মহারাজা। তিনি শুধুই একজন প্রেমিক, যার প্রেমকাহিনী আজও লোককথার অংশ হয়ে মানুষের মুখে মুখে ফেরে ভারতবর্ষের বহু অঞ্চলে।
প্রেমিক পৃথ্বীরাজ চৌহানের পরিচয় মেলে মূলত তারই সভাকবি চান্দ বারদাই রচিত ‘পৃথ্বীরাজ রাসো’ নামক কাব্যে। আর এই প্রেমকাহিনী এতটাই রোমাঞ্চকর যে এটা নিয়ে অনায়াসেই একটি বলিউডি রোমান্টিক সিনেমা বানিয়ে ফেলা যায়।
কী নেই এই প্রেম কাহিনীতে? অজানা-অদেখা মানব-মানবীর প্রেম, তারপর দূত মারফত দেখা, নায়িকার বাবার সঙ্গে নায়কের শত্রুতা, নায়িকার বাবার কূটচাল এবং নায়কের পাল্টা কৌশল আর বীরোচিত ভূমিকায় নায়িকাকে আপন করে কাছে টেনে নেয়া, সবই আছে এই প্রেমের গল্পে। গল্পের নায়ক হচ্ছেন দ্বাদশ শতাব্দীর চৌহান বংশের রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান। চৌহান বংশের এই রাজপুত রাজা ছিলেন দিল্লি এবং আজমীরের শাসক। বীর যোদ্ধা হিসেবে বেশ সুনাম ছিল রাজা পৃথ্বিরাজের। আর গল্পের নায়িকা হচ্ছেন কনৌজের রাজা জয়চাঁদ এর কন্যা সংযুক্তা। রূপকথার রাজকন্যাদের মতোই তার রূপ-সৌষ্ঠবের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল আশেপাশের বিভিন্ন রাজ্যে। এবং যথারীতি এই গল্পে ভিলেন ছিলেন সংযুক্তার বাবা অর্থাৎ রাজা জয়চাঁদ।
কবি চান্দ বারদাই এর বর্ণনা অনুযায়ী, দিল্লি ও আজমীরের রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহানের তলোয়ার চালনা এবং তীরন্দাজির সুনাম ছিল ভারতবর্ষ জুড়ে, এমনকি ভারতবর্ষের বাইরেও সবাই তার প্রশংসা করত। কনৌজের রাজা জয়চাঁদ পৃথ্বীরাজ চৌহানের প্রশংসা একদমই সহ্য করতে পারতেন না। যেন-তেন প্রকারে পৃথ্বীরাজের ক্ষতি সাধনই তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। পারিবারিকভাবেও পৃথ্বীরাজ এবং জয়চাঁদ পরস্পরের আত্মীয় ছিলেন। কনৌজ রাজকন্যা সংযুক্তা অত্যন্ত রূপবতী ছিলেন। তার রূপের খ্যাতিও ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা ভারতবর্ষে। রাজকবি চান্দ বারদাই পৃথ্বীরাজের সুহৃদ ও বন্ধু ছিলেন। ইতিহাস বলে পৃথ্বীরাজ এবং চান্দ বারদাই এর জন্ম এবং মৃত্যুর লগ্ন একই। পারিবারিক দিক দিয়েও চান্দ বারদাই পৃথ্বীরাজের আত্মীয় ছিলেন।
একইভাবে সংযুক্তারও একজন সখী ছিল। তার নাম চাকোরী, কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে তার নাম ছিল মদনা। মদনা একদিকে সখী, সেবিকা আবার প্রয়োজনে অসিচালনা ও অশ্বারোহণেও পটু ছিল। মদনার মুখেই রাজকুমারী সংযুক্তা মহারাজ পৃথ্বীরাজ চৌহানের রূপ, গুণ, যৌবন এবং বীরত্বের কথা শোনেন। দিনের পর দিন পৃথ্বীরাজের নানান বীরত্বব্যঞ্জক কাহিনী শুনে রাজকন্যার মনে পৃথ্বীরাজকে দেখার এক প্রবল বাসনা জাগরিত হয়। উল্টোদিকে পৃথ্বীরাজও লোকমুখে সংযুক্তার রূপ-লাবণ্যের প্রশংসা শুনতে থাকেন। তার মনেও সংযুক্তাকে দেখার ইচ্ছে জেগে ওঠে। দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ হয় কোটেশ্বর মন্দিরে। পৃথ্বীরাজ ও সংযুক্তা দুজনেই ছদ্মবেশে একে অপরের সামনে এসেছিলেন। ধীরে ধীরে দুজনের সম্পর্ক আরও নিবিড় হতে থাকে। বিনিময় হয় একাধিক প্রেমপত্রও। পৃথ্বীরাজের হয়ে ব্রজবুলি ভাষায় প্রেমপত্রগুলো লিখতেন খোদ চান্দ বারদাই। পায়রার মাধ্যমে সেই পত্র পৌঁছে যেত কনৌজ রাজকন্যার হাতে। আবার সংযুক্তার প্রেমপত্রও পৌঁছে যেত দিল্লির দরবারে।
এভাবেই চলছিল পৃথ্বীরাজ এবং সংযুক্তার প্রেম। কিন্তু পৃথ্বীরাজ এবং সংযুক্তার গোপন প্রেমকাহিনীর ব্যাপারে রাজা জয়চাঁদ জানতে পারলে তড়িঘড়ি রাজকন্যার স্বয়ংবর সভার আয়োজন করেন। স্বয়ংবর সভার আগে এক বিশাল রাজকীয় যজ্ঞের আয়োজন করেন। যজ্ঞের আগে পৃথ্বীরাজ চৌহানের কাছে এক অপমানজনক পত্র পাঠান। পৃথ্বীরাজ যোগ্য জবাব দেবার জন্য রাতারাতি পরিকল্পনা করে ফেলেন।
রাজকবি চন্দ্রবরদৈয়ের পদসেবক গনপথডাঙ্গির ছদ্মবেশে পৃথ্বীরাজ কনৌজের দরবারে পৌঁছান। সেকালে রাজকবিদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। শত্রুদেশের রাজাদের কাছেও বিদ্বান রাজকবিরা সমাদর পেতেন। চান্দ বারদাই, গনপথডাঙ্গি আর গুটি কয়েক চৌহানসেনা কনৌজের অতিথিশালায় স্থান পেলেন। কবিদের আলাপচারিতার সময় গনপথডাঙ্গি কনৌজের পণ্ডিতদের কিছু কাব্যরস সংক্রান্ত প্রশ্ন করেন কিন্তু কনৌজদেশীয় পণ্ডিতগণ তার উত্তর দিতে অক্ষম হলে গনপথডাঙ্গি নিজেই সেই উত্তর বলে দেন। এতে কনৌজদেশীয় রাজসভায় চান্দ বারদাই এর খ্যাতি আরও বেড়ে যায়। রাতের অন্ধকারে পৃথ্বীরাজ চৌহান যজ্ঞস্থলের কাছে পৌঁছে দেখলেন কয়েক শত সেনা বিনিদ্র রজনী যাপন করে যজ্ঞস্থল পাহারা দিচ্ছে। যজ্ঞ শুরুর আগের দিনই পৃথ্বীরাজ প্রহরারত সমস্ত সেনাদের মেরে ফেলেন এবং যজ্ঞবেদীতে একটি পত্র রেখে দেন যার দ্বারা সহজেই বোঝা যায় কাজটা আর কারো নয়, পৃথ্বীরাজ চৌহানের।
পরদিন সবকিছু জানতে পেরে জয়চাঁদ ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। রাজকন্যার স্বয়ংবর সভার অয়োজন শুরু করলেন কিন্তু পৃথ্বীরাজকে কোনো আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হোল না। তার পরিবর্তে রাজসভার প্রবেশদ্বারের পাশে পৃথ্বীরাজের একটা মূর্তি বানিয়ে রাখা হলো। উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়, তাকে অপমান করা।
চিন্তামগ্না সংযুক্তা তার স্বয়ংবর সভার কথা জানিয়ে পৃথ্বীরাজকে পত্র পাঠালো। পৃথ্বীরাজ উত্তরে জানান যে তিনি স্বয়ংবরে উপস্থিত থাকবেন। স্বয়ংবর সভায় রাজকন্যা সংযুক্তা পৃথ্বীরাজের মূর্তির গলায় মালা দিলেন। আসলে পৃথ্বীরাজ ওই মুর্তির আড়ালেই লুকিয়ে ছিলেন। এই ঘটনা দেখে উপস্থিত রাজারা হকচকিয়ে গেলেন। পৃথ্বীরাজ সংযুক্তাকে ঘোড়ায় চাপিয়ে স্বয়ংবর সভা ত্যাগ করলেন। কনৌজ সেনারা তাদের ধাওয়া করল। মাঝপথে চাকোরী এসে পৃথ্বীরাজকে সহায়তা করলেন। কনৌজ থেকে বেরিয়ে যাবার গোপন পথ দেখিয়ে দিলেন। কিছু দূরেই চৌহান বাহিনী পৃথ্বীরাজের জন্য অপেক্ষা করছিল। চৌহান ও কনৌজ বাহিনীর তুমুল যুদ্ধ হলো। ফের জয়চাঁদের পরাজয় ঘটল। উভয় পক্ষেরই প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হল। তবে সংযুক্তা এবং পৃথ্বীরাজের বিবাহ হল োখুব ধুমধাম করে। পৃথ্বীরাজের ঘর আলো করলো কনৌজ রাজকন্যা সংযুক্তা।
প্রেমের এই গল্পটা এভাবেই শেষ হতে পারত। অতঃপর তারা সুখে শান্তিতে ঘর করতে লাগলো। তবে এ যে সাধারন কোনো প্রেমকাহিনী নয়! তাই তো আবারও নাটকীয় এক মোড় নিল এই প্রেমের গল্প। এবার ভিলেন শ্বশুর জয়চাঁদ পরাজয় আর অপমানের বদলা নিতে হাত মেলালেন শত্রুপক্ষের সঙ্গে। এখানেই এসে পড়ে ঐতিহাসিক ঘটনা। এর আগে তরাইনের প্রথম যুদ্ধে ১১৯১ সালে পরাজিত হয়ে আফগানিস্তানে ফিরে গিয়েছিলেন মুহাম্মদ ঘুরী। প্রতিশোধ নেয়ার স্পৃহা তার মনে তো আগে থেকেই ছিল। সেই প্রতিশোধের আগুনে ঘি ঢেলে দিলেন পৃথ্বীরাজের শ্বশুর জয়চাঁদ। তিনি ঘুরীকে দিল্লি দখলের আহ্বান জানালেন। সঙ্গে দিলেন সহায়তার আশ্বাস। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুহাম্মদ ঘুরীও আবার ভারত আক্রমণে আসেন। মুহাম্মদ ঘুরীর ভারত আক্রমণের খবর শুনে অন্তঃপুর ছেড়ে আবারো পৃথ্বীরাজকে আসতে হলো যুদ্ধের ময়দানে। দেশপ্রেমিক রাজা পৃথ্বীরাজ আঞ্চলিক সব রাজ্যকে আহ্বান জানালেন তাকে সহায়তা করতে। কিন্তু তার শ্বশুর জয়চাঁদ যে আগেই সবাইকে সহায়তা থেকে বিরত থাকতে রাজি করিয়ে ফেলেছেন। ফলে একা নিজের বাহিনী নিয়েই তরাইনের যুদ্ধের মাঠে নামতে হলো বীর যোদ্ধা পৃথ্বীরাজকে।
কিন্তু এবার আর তিনি পারলেন না। অন্য রাজপুত রাজাদের অসহযোগীতার কারণে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে পরাজয় বরণ করতে হয় রাজা পৃথ্বীরাজকে। এরপর তাকে হত্যা করা হয়। আর স্বামীর মৃত্যুর খবর শুনে রানী সংযুক্তাও অন্তঃপুরে আত্মাহুতি দেন। এভাবেই শ্বশুরের খলনায়কোচিত ভূমিকার কারণে করুণ এক ট্র্যাজেডিতে পরিণত হয় অসামান্য একটি প্রেমকাহিনী। প্রায় এক হাজার বছর হয়ে গেলেও ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে গ্রামীণ রূপকথা এবং লোককথায় এই প্রেমকাহিনী, বিশেষত স্বয়ংবর সভা থেকে সংযুক্তাকে ছিনিয়ে আনার ঘটনাটি আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে।