বিশ্বের ইতিহাসে সামরিক অভ্যুত্থান নতুন কিছু নয়। কোনো দেশে সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হলে মুহূর্তের মধ্যে সেই খবর রটে যায় সারাবিশ্বে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাস এমন এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছিল যা ছিল সম্পূর্ণ গোপন। এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়নের সাধারণ মানুষ তো দূরে থাক, অনেক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং প্রশাসনের অনেকেই এ ঘটনা জানত না। ঘটনাটি জানাজানি হয় দীর্ঘদিন পরে। ইতিহাসের এই অভূতপূর্ব ঘটনা নিয়েই হলিউডের বিখ্যাত ‘দ্য হান্ট ফর রেড অক্টোবর’ নামের মুভিটি নির্মিত হয়।
১৯৭৫ সালের ৯ নভেম্বর। ভোরের আলো তখনও ভালোভাবে ফোটেনি। বাল্টিক সাগরে সোভিয়েত এন্টি সাবমেরিন ফ্রিগেট স্টোরজহেভয়কে খুঁজে বেড়াচ্ছে সেদেশরই একটি নিজস্ব বাহিনী। সোভিয়েত নৌ ও বিমান বাহিনী যৌথভাবে এই জাহাজের অনুসন্ধানে নেমেছে। তাদের উপর নির্দেশ আছে- হয় এই যুদ্ধজাহাজকে থামাতে হবে, নয়তো সাগরেই ডুবিয়ে দিতে হবে। খোদ সোভিয়েত প্রতিরক্ষা দপ্তর থেকেই এই নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
গত রাতে সেই জাহাজে সোভিয়েত ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। ১৯১৭ সালের বিপ্লবের বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে জাহাজটি তখন নোঙর করা ছিল লাটভিয়ার রিগা নৌঘাঁটিতে। জাহাজের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কমান্ডার সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি ভ্যালেরি সাবলিন সেই রাতে জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন।
১৯০৫ সালে রুশ নৌবাহিনীর একটি যুদ্ধজাহাজ পটেমকিনে এক নৌ বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। ভ্যালেরি সাবলিন ঠিক ঐ ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই একটি নতুন এবং প্রকৃত কমিউনিস্ট বিপ্লব শুরু করতে চেয়েছিলেন। তার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে ইতিমধ্যেই নিয়োগ করা হয়েছে একজন নাবিককে। সেই নাবিকের সহায়তায় জাহাজের ক্যাপ্টেনকে তার কক্ষে তালাবদ্ধ করে আটকে রাখেন ভ্যালেরি সাবলিন। এরপর জাহাজের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ক্রুদের নিয়ে এক জরুরি বৈঠক শুরু করেন।
এদিকে জাহাজের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মিটিংয়ে উপস্থিত হয়ে যখন দেখতে পেলেন ক্যাপ্টেন নেই, তখন সবাই জানতে চাইলেন তাদের ক্যাপ্টেন কোথায়। কথা এড়িয়ে গিয়ে ভ্যালেরি বললেন, ক্যাপ্টেন কাজে ব্যস্ত রয়েছে। সবাইকে জানিয়ে দিলেন, এই বৈঠক ক্যাপ্টেনকে ছাড়াই অনুষ্ঠিত হবে। এরপর তিনি কথার সুর পাল্টে রাশিয়ার সরকার এবং কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করতে লাগলেন। উপস্থিত সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে বোঝাতে লাগলেন তাদের সরকার কতটা দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে এবং রাশিয়ার সাধারণ জনগণ কতটা কঠিন সময় পার করছে। পররাষ্ট্রনীতি এবং অর্থনীতি কতটা হুমকির মুখে রয়েছে। এরপর তিনি বললেন, এখন একটা পরিবর্তনের সময় এসেছে। সবাইকে জানিয়ে দিলেন, তিনি এই জাহাজ নিয়ে সেন্ট পিটার্সবার্গে যেতে চান। সেখান থেকে রেডিওতে তিনি রুশ জনগণকে উদ্দেশ্য করে একটি ভাষণ দেবেন। তিনি ভেবেছিলেন, তিনি একটি বিপ্লব ঘটাতে যাচ্ছেন, যার মাধ্যমে সোভিয়েত সরকারের পরিবর্তন ঘটবে।
জাহাজের অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী ভ্যালেরি সাবলিনের সাথে একমত হতে পারছিলেন না। কিন্তু তারপরও ভয়ে কেউ মুখ খোলেনি। কেননা ইতিমধ্যে ভ্যালেরি হাতে তুলে নিয়েছেন একটি অ্যাসল্ট রাইফেল। স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, যে তার মতের বিরোধিতা করবে তাকে তার প্রয়োজন নেই। জাহাজের প্রায় অর্ধেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিয়ে তিনি নিচের ডেকে চলে গেলেন। এরপর বন্দুকের নলের মুখে জিম্মি করে লোহার দরজাটা বাইরে থেকে শক্তভাবে আটকে দিলেন।
এদিকে জাহাজের প্রায় অর্ধেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আটকাতে পারলেও বাকি অর্ধেককে নিয়ে তিনি তার পরিকল্পনার কথা জানাতে উদ্বুদ্ধ হলেন। বোঝাতে লাগলেন এই পরিকল্পনার সুফল। এরপর তিনি তাদের বড় পর্দায় সের্গেই আইজেনস্টাইনের বিখ্যাত রুশ বিপ্লবী চলচ্চিত্র ‘ব্যাটেলশিপ পটেমকিন’ দেখতে বাধ্য করলেন। অবশেষে অনেক চেষ্টা-তদবির করে ঐ জাহাজের প্রায় ২০০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রায় সবাই ঐতিহাসিক এই বিপ্লবে যোগদান করলেন।
‘ব্যাটলশিপ পটেমকিন’ মুভিটি ১৯০৫ সালে সোভিয়েত নৌ বিপ্লবের ঘটনাকে কেন্দ্র করে নির্মিত। এটি তাদেরকে দেখানো হয় যাতে করে তারা বিপ্লবের গুরুত্ব বুঝতে পারে এবং বিপ্লবে যোগদানের জন্য উদ্বুদ্ধ হয়। ভ্যালেরির এই কৌশল সত্যিই কাজে লাগে। জাহাজের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকেই এই মুভিটি দেখার পর ভ্যালেরির মতের সাথে একমত পোষণ করলেন এবং নৌ বিপ্লবে উৎসাহী হয়ে উঠলেন, কারণ তারা অধিকাংশই ছিল বয়সে তরুণ, তাদের তেমন শিক্ষা-দীক্ষাও ছিল না। কিন্তু এর পরিণতি কী হতে পারে এ কথা তারা মোটেও চিন্তা করেনি।
ভ্যালেরি সাবরিনের স্ত্রী-সন্তান ছিল। উজ্জ্বল রঙিন ক্যারিয়ারের সবরকম সম্ভাবনা তার ছিল। কিন্তু তিনি কঠোর সোভিয়েত আমলাতান্ত্রিক বেড়াজাল এবং বয়স্ক নেতৃত্ব মেনে নেওয়ার মানসিকতা ও ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি কোনোভাবেই সোভিয়েত শাসনব্যবস্থা এবং নেতৃত্ব মেনে নিতে পারছিলেন না। এজন্য বিপ্লবের আদর্শকে সামনে রেখে বিদ্রোহ ঘোষণার আগেই তিনি তার স্ত্রীকে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিটির কিছু কথা ছিল এমন,
জীবনের প্রতি ভালোবাসাই আমাকে এই পথ গ্রহণে বাধ্য করেছে। কোনো আত্মতুষ্ট বড়ুয়ার জীবন নয়, বরং একটি সৎ ও উজ্জ্বল জীবন যা সব নাগরিকের মনে আনন্দের সঞ্চার করবে। ৫৮ বছর আগে ১৯১৭ সালের বিপ্লবের সময় মানুষের মনে যে বিপ্লবী চেতনা জেগে ছিল, আমার দৃঢ় বিশ্বাস সেই চেতনা এখনও মানুষ লালন করছে। তা আবার উৎসারিত হবে এবং আমাদের দেশে একদিন প্রকৃত কমিউনিজম আসবে।
এদিকে দ্রুত ভ্যালেরির পরিকল্পনার কথা জানাজানি হতে শুরু করল। একজন জুনিয়র অফিসার, যিনি বিদ্রোহকে সমর্থন করেছিলেন, রিগা বন্দরে জাহাজ থেকে নেমে কর্তৃপক্ষকে বিদ্রোহের খবর দিয়ে দেন। ভ্যালেরি এ কথা জানতে পেরে রাত প্রায় ১টার দিকে জাহাজ নিয়ে বন্দর ছেড়ে গেলেন। বিদ্রোহের খবর যখন মস্কোতে গিয়ে পৌঁছল, তখন কর্তৃপক্ষের কর্তাব্যক্তিদের মাঝে একদিকে অবিশ্বাস ও অন্যদিকে ক্রোধ দেখা দিল। তাদের আশঙ্কা ছিল জাহাজটি নিয়ে সাবলিন হয়তো দেশ ছেড়ে পালাবে। এজন্য নৌবাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হলো যেকোনো মূল্যে, যেকোনোভাবে জাহাজটিকে খুঁজে বের করতে এবং এর যাত্রা থামিয়ে দিতে। এরপর খবর এলো জাহাজটি বন্দর থেকে সমুদ্রর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সোভিয়েত নৌবাহিনীর বিমান বিদ্রোহী সেই জাহাজের হদিস পেয়ে গেল। কিন্তু তারা কোনোভাবেই বোমাবর্ষণের মাধ্যমে জাহাজটি সাগরে ডুবিয়ে দিতে রাজি ছিল না। বিমান বহরের সেই কমান্ডার স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন, আমাদের নৌবাহিনীর সহকর্মীদের আমরা এভাবে সাগরে ডুবিয়ে দিতে পারব না। এ কথা শুনে ক্রোধে ফেটে পড়লেন তৎকালীন সোভিয়েত প্রতিরক্ষামন্ত্রী। তিনি এবার সরাসরি নির্দেশ দিলেন বিমানবাহিনীকে, যেন হামলা চালিয়ে ওই জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া হয়।
ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই সোভিয়েত বিমানবহর বাল্টিক সাগরের আকাশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল। এদিকে সোভিয়েত নৌ-বহর ঐ বিদ্রোহী জাহাজকে চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলল। এমন সময় বিদ্রোহী কয়েকজন নৌ-কর্মকর্তা জাহাজের ইঞ্জিনিয়ার বরিস কিনডেন ও আরো কয়েকজন অফিসারকে দরজার তালা খুলে মুক্ত করে দিলেন। মুক্তি পাওয়া জাহাজের ক্যাপ্টেন সঙ্গে সঙ্গে বরিসকে নির্দেশ দিলেন একটা বন্দুক নিয়ে ইঞ্জিন রুমে যেতে এবং যেকোনো মূল্যে জাহাজকে থামাতে। এমতাবস্থায় জাহাজের মধ্যে শুরু হয়ে গেল হট্টগোল। বোঝাই যাচ্ছিল না কে সাবলিনের বিদ্রোহের পক্ষে আর কে বিপক্ষে।
জাহাজের ইঞ্জিন রুমে তখন প্রায় ২০ জন নাবিক ছিল। বরিস হন্তদন্ত হয়ে ইঞ্জিন রুমে ঢুকে বন্দুকের নল তাক করলেন নাবিকদের দিকে। এ ঘটনায় নাবিকরা সবাই হতবাক হয়ে গেল। এদিকে সোভিয়েত বিমান বহর থেকে একজন দূত জাহাজে নেমে এসেছিলেন। ইতিমধ্যে জাহাজকে থামানোর জন্য বিমান থেকে কয়েকটি আক্রমণ চালানো হয়েছে। সব মিলিয়ে নাবিকরা তখন প্রচন্ড ভয়ের মধ্যে রয়েছে। জাহাজ থামানোর নির্দেশ দেওয়ার পর যখন জাহাজের গতি কমে আসে তখন বিমানবাহিনী তাদের আক্রমণ থামিয়ে দেয়।
বরিস যখন ইঞ্জিন থামানোর চেষ্টা করছিলেন তখন জাহাজের ক্যাপ্টেন চলে গেলেন নিয়ন্ত্রণ কক্ষে। সেখানে প্রবেশ করেই ভ্যালেরির হাঁটু লক্ষ্য করে গুলি চালান। এরপর জাহাজের নিয়ন্ত্রণ পুনরায় নিজের হাতে তুলে নেন। তিনি রেডিও বার্তা পাঠিয়ে বিমানবাহিনীর কাছে অনুরোধ জানান যেন জাহাজটিতে আর কোনো হামলা চালানো না হয়। এভাবেই সমাপ্তি ঘটে ঐতিহাসিক সেই বিদ্রোহের।
জাহাজটিকে পুনরায় লাটভিয়ার রিগা বন্দরে নিয়ে আসা হলো। এদিকে সোভিয়েত শীর্ষ নেতারাও তখন বিমানযোগে রিগা বন্দরে এসে পৌঁছেছেন। জাহাজের প্রত্যেক অফিসারকে আলাদাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। সোভিয়েত নৌ ও সেনাবাহিনীর শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রধান অ্যালেক্সেই ইয়েপেশেপ কথা বললেন বরিস কিনডেনের সাথে। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, “এই বিদ্রোহে তুমি কীভাবে বেঁচে রয়েছ? এই বিদ্রোহ ঠেকাতে তুমি কোনো পদক্ষেপ নাওনি কেন?” পরবর্তীতে তাকে সোভিয়েত নৌবাহিনী থেকে বরখাস্ত করা হয়।
জাহাজে যতজন কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিল, তাদের সবাইকে পরের কয়েক মাস যাবত সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি জিজ্ঞাসাবাদ করে। এরপর এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ভ্যালেরি সাবলিনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড। বরিসসহ যে সমস্ত অফিসার ভ্যালেরি সাবলিনকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেন তাদেরকে চাকরিচ্যুত করা হলেও আইনানুগ কোনো সাজা প্রদান করা হয়নি। এ সমস্ত অফিসারকে আর কখনোই নৌবাহিনীর জাহাজে পাঠানো হয়নি। সকল অফিসারকে এই বিদ্রোহের গোপনীয়তার ব্যাপারে কঠোরভাবে শপথ নেওয়ানো হয়।
এর বহু বছর পর স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটলে বরিস কিনডেন এই বিদ্রোহ সম্পর্কে প্রথম লেখেন ‘মিউটিনি‘ নামক এক বইয়ে। বরিস রুশ নাগরিকত্ব হারিয়ে বর্তমানে বসবাস করছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এভাবেই ওই ঐতিহাসিক নৌ-অভ্যুত্থানকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ। অবশেষে তা প্রকাশিত হয়ে যায় এবং সোভিয়েত ইতিহাসে টিকে থাকে এক অভূতপূর্ব ঘটনা হিসেবেই।