স্বর্ণ, নিঃসন্দেহে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ধাতব পদার্থ, বিশেষত নারীদের কাছে। তবে স্বর্ণের এই জনপ্রিয়তা আজকের নয়, চলে আসছে অনাগত কাল থেকেই।
সেই অনাগত কাল সম্পর্কে আরো জানার উদ্দেশ্যে প্রতিনিয়ত গবেষণা করে যাচ্ছেন প্রত্নতাত্ত্বিকগণ। সেই গবেষণাকার্যের অংশ হিসেবেই বিভিন্ন সময় মাটির নিচ থেকে তাদের হাতে এসেছে স্বর্ণনির্মিত নানা ধরনের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন। সেগুলোর অনেকগুলোর রহস্য উন্মোচন করা গেলেও কোনো কোনোটির পেছনের কাহিনী আজও রহস্যাবৃত।
তেমনই কিছু প্রাচীন স্বর্ণনির্মিত নিদর্শনের কাহিনী জানাতেই আজকের এই লেখা।
১) অভিশাপযুক্ত স্বর্ণফলক
অভিশাপযুক্ত ফলক, তথা ট্যাবেলা ডেফিক্সিওনিস (Tabella Defixionis) ছিলো প্রাচীন রোমের বেশ পরিচিত একটি জিনিস। কারো উপর প্রতিহিংসাবশত প্রতিশোধ নিতে চাইলে সেই ব্যাপারে বিভিন্ন মন্ত্র লিখে এসব ফলকে খোদাই করা হতো।
দু’বছর আগে আগস্ট মাসে সার্বিয়ার পূর্বাঞ্চলে প্রত্নতত্ত্ববিদগণ এমনই বেশ কিছু ফলক খুঁজে পান, যেগুলো তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছিল সোনা। কিছু কিছু ট্যাবলেটে গ্রিক ভাষা ব্যবহৃত হলেও অন্যগুলোতে অজানা এক ভাষার পাশাপাশি ব্যবহার করা হয়েছিল বিভিন্ন প্রতীক, যেগুলোর মর্মোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি আজও। কিছু কিছু ফলকে শয়তানকে আহবান করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রতীকগুলো মানুষ ও অপদেবতার যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত গোপন কোড।
নতুন আবিষ্কৃত এই ফলকগুলো প্রায় ১,৬০০ বছরের পুরনো। এর আগে সীসার তৈরি ফলক খুঁজে পাওয়া গেলেও স্বর্ণের ফলকগুলো একেবারেই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।
২) ধাম্মাজেইয়ের বৃহদাকার স্বর্ণালী ঘণ্টা
এবার আমাদের প্রতিবেশি দেশ মায়ানমারের দিকে তাকানো যাক। প্রতিটি দেশের ইতিহাসেই অমীমাংসিত কিছু রহস্যের সন্ধান পাওয়া যায়, যেগুলো শত-সহস্র বছরের পুরনো। ধাম্মাজেইয়ের স্বর্ণনির্মিত এ ঘণ্টাটি তেমনই মায়ানমারেরও এক অমীমাংসিত রহস্য।
পনের শতকে নির্মিত এ ঘণ্টা তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছিল সোনা, রুপা ও তামা একত্রিত করে প্রস্তুতকৃত সংকর ধাতু। আনুমানিক ৩০০ টন ওজনের ঘণ্টাটি শেডাগোন প্যাগোডার সামনে স্থাপন করা হয়েছিল। ১৬০৮ সালে পর্তুগিজ ভাড়াটে সৈনিক ফিলিপ ডি ব্রিটো ঘণ্টাটি দখল করে নেন। এরপর সেটা নিয়ে তিনি চলে যান বাগো নদীর তীরে। তবে, দুর্ভাগবশত নদী পার হবার সময় সেটি নদীর বুকে চিরতরে হারিয়ে যায়।
এরপর থেকে আর কখনোই ঘণ্টাটির সন্ধান পাওয়া যায়নি। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারও শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে। গত ৪০০ বছরে বাগো নদীও তার গতিপথ পরিবর্তন করেছে, ফলে সঠিক জায়গা খুঁজে পাওয়াটা বেশ দুঃসাধ্যই হয়ে গিয়েছে।
কেউ কেউ তো আবার এর অস্তিত্ব আদৌ কোনোকালে ছিলো কি না তা নিয়েই সন্দিহান। কারণ ঘণ্টাটি তৈরির আনুমানিক ২০০ বছর পর লিখিত ইতিহাস বিষয়ক ৩টি লেখনীতে এর কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না।
৩) সৌরপূজারীদের সর্পিলাকার অলঙ্কার
২০১৫ সালে ডেনমার্কের জিল্যান্ডে আনুমানিক ২,০০০ স্বর্ণনির্মিত বস্তুর সন্ধান পাওয়া যায়। খাটি সোনার তৈরি প্রায় ৩ সেন্টিমিটার লম্বা এ বস্তুগুলো খ্রিস্টপূর্ব ৯ম থেকে ৭ম শতকের মধ্যবর্তী সময়ে নির্মিত।
প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা মতে, ব্রোঞ্জ যুগে সেখানে বসবাসরত সৌরপূজারীরা উৎসবের অনুষঙ্গ হিসেবে এসব ব্যবহার করতেন। সেগুলো সম্ভবত তারা ধর্মীয় পোশাক, চুল ও পাগড়িতে পরিধান করতেন।
উত্তর ইউরোপে সবচেয়ে বেশি স্বর্ণের সন্ধান পাওয়া গেছে এই অঞ্চলেই। এর আগে চারটি স্বর্ণের ব্রেসলেট পাওয়া গিয়েছিল। উনিশ শতকে স্থানীয় কৃষকেরা নিকটবর্তী একটি মাঠে ছয়টি স্বর্ণনির্মিত গামলা খুঁজে পেয়েছিলেন। এ জায়গায় এত মূল্যবান জিনিসপত্র বিভিন্ন সময় পাওয়া গিয়েছিল বলে প্রত্নতাত্ত্বিকগণ মনে করেন, ব্রোঞ্জ যুগের অধিবাসীদের কাছে এই স্থানটি সম্ভবত বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিলো।
৪) মাপুঙ্গুবের সোনালী গণ্ডার
দক্ষিণ আফ্রিকায় খুঁজে পাওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর মাঝে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি হলো এই গণ্ডার। কাঠের তৈরি কাঠামোর উপর স্বর্ণের কয়েকটি পাত হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে, মাটির নিচ থেকে কেবল গণ্ডারই নয়, এর সাথে ৯ কেজি ওজনের স্বর্ণের অলঙ্কার, পুতি এবং আরো বেশ কিছু প্রাণীর মূর্তির সন্ধানও পাওয়া গিয়েছিল।
ত্রয়োদশ শতাব্দীতে সাব-সাহারান আফ্রিকার সবচেয়ে বড় রাজ্য ছিলো এই মাপুঙ্গুবে। এর অবস্থান ছিল আজকের দিনে দক্ষিণ আফ্রিকা ও বতসোয়ানার সীমান্ত বরাবর। এশিয়া ও মিশরের সাথে রাজ্যটির বহুবিধ বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল।
৫) গ্রিফিন যোদ্ধার স্বর্ণের আংটি
২০১৫ সালে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা দক্ষিণ-পশ্চিম গ্রিসে প্রাচীন এক যোদ্ধার কবরের সন্ধান পান। প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছরের পুরনো এ কবরে শুয়ে আছেন ত্রিশ বছর বয়সী এক যোদ্ধা, যার নাম দেয়া হয়েছে গ্রিফিন।
গ্রিফিনের কবরে বিভিন্ন রকম প্রাচীন নিদর্শনেরই সন্ধান পাওয়া গেছে, যেগুলোর মাঝে আছে ৪টি অদ্ভুত আংটিও। কয়েক প্রস্থ স্বর্ণের পাত দিয়ে বানানো এ আংটির নকশায় ফুটে উঠেছে মাইনোয়ান উপকথার নানা চিত্র। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই আংটিগুলো বানানো হয়েছিলো ক্রিটে, যেগুলো বিভিন্ন রকম প্রশাসনিক কাজে সিল হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
ক্রিটের মাইনোয়ান সভ্যতা আজ থেকে আনুমানিক ৩,২০০ বছর আগে হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যায়। ধারণা করা হয়, মাইসিনীয় গ্রিকদের কাছে পরাজয় ঘটেছিল তাদের। এর ফলে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায় মাইনোয়ান সংস্কৃতিও। কেউ কেউ আবার মনে করেন, এই আংটিগুলো দুই সভ্যতার মাঝে সংস্কৃতি ও বিভিন্ন আইডিয়ার আদান-প্রদানের দিকেই ইঙ্গিত করে।
৬) আফ্রোদিতির স্বর্ণের মুকুট
এই ঘটনাটি বেশ বিচিত্রই বটে, যা ঘটেছিলো ব্রিটেনের এক লোকের সাথে। লোকটির দাদা মৃত্যুর আগে তাকে একটি কার্ডবোর্ডের বাক্স দিয়ে যান, যা তিনি কখনো খুলে দেখেননি। একদিন হঠাৎ কী মনে করে যেন খুললেন। কিন্তু খুলেই তার চোখ কপালে উঠবার জোগাড়। কারণ এর ভেতরে সুরক্ষিতভাবে রাখা ছিলো প্রায় ২,৩০০ বছরের পুরনো একটি স্বর্ণের মুকুট!
বিশেষজ্ঞগণ এই মুকুটটি আসল বলেই মত দিয়েছেন। আনুমানিক ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের এই মুকুটটি দৈর্ঘ্যে ৮ ইঞ্চি এবং ওজন ১০০ গ্রামের মতো। এর গঠনশৈলী নির্দেশ করে, উত্তর গ্রিসের কোনো এক দক্ষ কারিগরের হাতেই এর জন্ম হয়েছে। ওদিকে এর গায়ে লেগে থাকা ময়লা থেকে বোঝা যায়, এককালে মুকুটটির স্থান হয়েছিল মাটির তলদেশে।
প্রাচীন গ্রিকরা ধর্মীয় উৎসব এবং বিভিন্ন অ্যাথলেটিক প্রতিযোগিতায় এ ধরনের মুকুট ব্যবহার করতো। দেবী আফ্রোদিতির মাথার মুকুটটি মেদিগাছের পাতা দিয়ে বানানো হতো। কারণ, মনে করা হতো, এটি দেবীর কাছে খুব পবিত্র একটি জিনিস। সেই সাথে এ ধরনের মুকুটগুলো ছিলো ভালোবাসার শক্তির পরিচায়ক।
তবে ব্রিটিশ সেই লোকটির দাদা কীভাবে এই মুকুটটি খুঁজে পেয়েছিলেন সেই কথা অবশ্য জানা যায় না। গত শতকের চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে তিনি পৃথিবীব্যাপী প্রচুর ঘুরে বেড়াতেন। তার সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ছিলো আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের মেসিডোনীয় আবাস নিয়ে।
৭) বিশ্বের সবচেয়ে পুরাতন প্রক্রিয়াজাত স্বর্ণ
বছরখানেক আগে বুলগেরিয়াতে প্রত্নতাত্ত্বিকগণ বিশ্বের সবচেয়ে পুরাতন প্রক্রিয়াজাত স্বর্ণের সন্ধান পেয়েছেন। টেল ইয়ুনাটসাইটে প্রাপ্ত ৩ মিলিমিটারের সেই স্বর্ণনির্মিত পুতিটি খ্রিস্টপূর্ব ৪,৫০০ অব্দের দিকে তৈরি করা হয়েছিল। এর আগে পাওয়া সবচেয়ে পুরাতন স্বর্ণের রেকর্ডটিও ছিলো বুলগেরিয়ার, যা এখনের খণ্ডটি থেকে বয়সে ২০০ বছরের ছোট।
ব্রোঞ্জ যুগের বলকান এ স্থাপত্যটি ঘিরে আছে ৯ ফুট পুরু দেয়াল, যা থেকে বোঝা যায় এককালে জায়গাটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিকগণ মনে করেন, টেল ইয়ুনাটসাইটের অধিবাসীরা আনাতোলিয়া থেকে সেখানে এসেছিলেন। তারা কীভাবে ধাতুবিদ্যায় এতটা পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন, সেটা আজও এক রহস্য হয়ে আছে।