মুণ্ডু শিকারী নাগারা

মারামারি-দাঙ্গা-ফ্যসাদে পড়ে আপনার মুণ্ডুটা কাটা যেতেই পারে। মারামারির সময় এমন ঘটনা তো ঘটবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এমন যদি হয় আপনার প্রতিপক্ষের মূল উদ্দেশ্যই হল আপনার মাথাখানা কেটে নিয়ে ঘরের শোভা বর্ধন করা কিংবা স্বজাতির কোনো তরুণীর হৃদয় হরণ করা; তখন ব্যাপারটা রীতিমত বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যায়।

এই মুণ্ডু কেটে নেওয়া বা কেতাবী ভাষায় ‘হেডহান্টিং’ কোনো নতুন ঘটনা না। বস্তুত আমেরিকা, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলো, ইউরোপ আর এশিয়ার অনেক অঞ্চলেই এহেন মুণ্ডু কাটার সংস্কৃতি ছিল। এই আমাদের উপমহাদেশেই, আসামের ব্রক্ষপুত্র নদের দক্ষিণে বহু আদিবাসী এই মুণ্ডু কাটার নেশায় জড়িয়ে পড়েছিল একটা সময়ে। এমনই একটি দুর্ধর্ষ জাতি, নাগাদের নিয়ে আলোচনা হবে আজ।

বেশিরভাগ নাগাদের বসবাস ভারতের নাগাল্যান্ডে; ছবিসূত্র: Encyclopedia Brittannica

জাতি পরিচয়

নাগারা বাস করে মূলত আসাম, অরুণাচল, মনিপুর এবং নাগাল্যাণ্ডে। এর বাইরেও মায়ানমারে লাখখানেক নাগা আছে। নাগাল্যান্ড সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ১৭টি নাগা জাতির অস্তিত্ব স্বীকার করে। প্রত্যেকটা জাতি নিজস্ব ভাষায় কথা বলে। ভাষাগুলোর মধ্যে অবশ্য প্রকট সামঞ্জস্য আছে এবং উৎপত্তিগত দিক দিয়ে সবগুলো ভাষাই তিব্বতী-বর্মী ভাষা থেকে এসেছে। তবে এতগুলো ভিন্ন ভাষা দিয়েও নাগাদের পোষায়নি, নাগারা গ্রামভিত্তিক সমাজে বাস করে এবং প্রত্যেকটি গ্রামের আবার নিজস্ব উচ্চারণ রীতি আছে।

এতগুলো ভাষা এবং উচ্চারণরীতির কারণে বাতচিত আদান প্রদান কষ্টকর হতে বাধ্য। বিশেষ করে এ যুগের সমাজে যখন কিনা নাগারা আর গ্রামে গ্রামে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাস করে না, শহর বন্দরে হরদম অন্যান্য জাতির নাগাদের সাথে কথা বলতে হয়। কাজেই নাগারা ‘নাগামিজ ক্রেওল’ নামের একটা নতুন ভাষা উদ্ভাবন করেছে। সব নাগাই কমবেশী এই ভাষায় কথা বলতে পারে। এর পাশাপাশি ইংরেজি ভাষাতেও নাগারা বেশ সড়গড়।

নাগারা বরাবরই স্বাধীন জাতি ছিল। আসামের জাতিগুলোর সাথে কিঞ্চিত যোগাযোগ ছাড়া বহির্বিশ্বে তাদের কারো সাথে কোনো সংযোগ ছিল না। তবে ব্রিটিশরা ভারত দখল করে নিলে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। ১৮৩০-৮০ সাল পর্যন্ত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে ব্রিটিশ সেনা আর নাগা যোদ্ধাদের মধ্যে প্রকাশ্য আর গেরিলা যুদ্ধ চলেছে। শেষমেশ আধুনিক অস্ত্রের কাছে নাগারা হার মানে আর নাগাল্যান্ডে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়

দুর্ধর্ষ যোদ্ধা হিসেবে নাগাদের কদর আছে; ছবিসূত্র: North East today

স্বাধীনচেতা নাগারা ভারত স্বাধীন হওয়ার ঠিক আগের দিন, ১৪ আগস্টে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। উদ্দেশ্য, নাগা ন্যাশনাল কাউন্সিলের শাসনে একটি স্বাধীন রাজ্য গঠন করা। ভারত এই দাবি না মেনে নিলে শুরু হয় গেরিলা যুদ্ধ। স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা যাপু ফিজো পরে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। ১৯৬৩ সালে নাগাল্যান্ডকে ভারতের প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করা হলেও নাগারা স্বাধীনতার দাবিতে যুদ্ধ চালাতে থাকে। পরে নানা শান্তিযুক্তির মাধ্যমে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়ে এলেও কয়েকটি নাগা বিদ্রোহী দল এখনো যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।

মুণ্ডু শিকার

নাগারা জাত মুণ্ডু শিকারী ছিল। ব্রিটিশ মিশনারী আর সেনাবাহিনীর যন্ত্রণায় মুণ্ডু শিকারের প্রথা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। তবে দুর্গম পাহাড়-পর্বতের আনাচে কানাচে কোথায় কী হচ্ছে তা তো সরকার বাহাদুরের সার্বক্ষণিক নজরে থাকার কথা নয়। কাজেই এই পঞ্চাশ আর ষাটের দশকেও ভারত সরকারকে নাগাদের মুণ্ডু কেটে নেওয়ার অভ্যাসটাকে দূর করবার প্রচুর চেষ্টা করতে হয়েছে। নাগাদের মধ্যে, বিশেষ করে কোনিয়াক জাতির লোকেরা, খুব দুর্ধর্ষ মুণ্ডু শিকারী বলে কুখ্যাত ছিল। সারা গায়ে উল্কি আঁকা এই যোদ্ধারা পাহাড়ের চূড়ায় দেওয়াল ঘেরা দুর্গ সদৃশ গ্রামে থাকতো।

সুন্দর করে ঘর সাজায় নাগারা; ছবিসূত্র: mapsofindia

এখন আমাদের কাছে হয়তো প্রতিপক্ষের মুন্ডূ কেটে নেওয়া হয়তো অমানবিক, কিন্তু বাস্তবতা হল নাগা যোদ্ধাদের কাছে এটা ছিল এক বীরত্বের নিদর্শণ। কাটা মাথা বাসার দেওয়াল বা আঙ্গিনায় শুকিয়ে, সুন্দর করে সাজিয়ে রেখে দেওয়া হত। আর যা-ই হোক, বিয়ের কনের মন পেতে হলে অন্তত একটা মুন্ডূ কেটে আনা ছিল নাগা সমাজের দস্তুর। বহু বছর ধরে ক্রমাগত শিক্ষা আর আইন কানুনের যৌথ উদ্যোগে এই রীতি বিলুপ্ত হয়েছে বলা চলে। প্রখ্যাত বাঙ্গালী লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী পঞ্চাশের দশকে এই নাগা সমস্যা নিয়ে কিছু লেখালেখি করে গিয়েছেন।

ধর্ম ও সমাজব্যবস্থা

নাগারা দোনি পোলো নামের আদিম ধর্মে বিশ্বাস করতো। সূর্য ও চাঁদ নির্ভর এই ধর্মের অনেক অনুসারী অরুণাচলে আছে। বর্তমান নাগারা অবশ্য প্রায় সবাই ধর্মে খ্রিস্টান। ব্রিটিশ আর আমেরিকান মিশনারীদের ক্রমাগত চেষ্টায় নাগারা নিজেদের প্রাচীন ধর্ম আর রীতিনীতি অনেকাংশে ভুলে গিয়েছে।

নাগারা মূলত গ্রামে থাকে। প্রত্যেক গ্রামের নিজস্ব সীমানা রয়েছে। নাগা গ্রামগুলো আবার কয়েকটা গোত্র বা খেল এ বিভক্ত থাকে। একই গোত্রে বিয়ে দেওয়াটাকে নাগারা খুব খারাপ নজরে দেখে থাকে। নাগারা যেহেতু যোদ্ধা জাতি ছিল, সমাজে ছেলে শিশুদের কদর বেশি। তবে মেয়েদেরকেও যথেষ্ঠ সম্মান করা হয়। নাগা মেয়েরা মূলত কাপড় বোনে আর কৃষিকাজে সাহায্য করে থাকে। গ্রামের মোড়লকে আংঘ বলা হয়।

দুর্গম পাহাড়ে একটি নাগা গ্রাম; ছবিসূত্র: frontiermyanmar

নাগাদের গ্রামে একটি আলাদা করে বড় ঘর বানানো হয়, এটাকে বলে মোরাং। নাগা শিশু-কিশোরেরা তাদের জীবনের বেশ কিছুটা সময় এই মোরাং এ থাকে, আর বয়স্কদের কাছ থেকে নাগা রীতিনীতি শিখে নেয়। বর্তমানে অবশ্য অনেক গ্রামেই আর মোরাং বানানো হয় না। রঙ-বেরং এর শাল এবং অলংকার প্রস্তুত করবার ব্যাপারে নাগারে খুব দক্ষ। শুধু তা-ই নয়, প্রত্যেকটি বাড়ির দরজার দু’পাশে নানা কারুকাজ করে থাকে তারা। নাগা সাজসজ্জায় গয়ালের খুলি খুব গুরুত্বপূর্ণ। গয়াল হচ্ছে ভারতীয় বন্য গরু বা গৌরের সাথে গৃহপালিত গরুর সংমিশ্রণ। নাগাল্যান্ডের প্রাদেশিক সিলেও গয়ালের মাথা ব্যবহার করা হয়।

একটি নাগা মোরাং; ছবিসূত্র: antiquemapsandprints

প্রতিবছর নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমাতে ১-৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ধনেশ উৎসব পালন করা হয়। মূলত নাগা সমাজকে তুলে ধরবার জন্য ২০০০ সাল থেকে এই উৎসব পালন করা হয়ে আসছে। নাগাদের গল্পকথায় ধনেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ পাখি, নাগা নেতাদের মুকুট প্রস্তুতের কাজে শূকরের দাঁতের পাশাপাশি ধনেশের পালক আর ঠোটঁ দারুণ প্রয়োজনীয় অনুসঙ্গ। নাচ, গান, সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা এবং নানা কুটির পণ্যের সমাহার ঘটে এই উৎসবে। এই ধনেশ উৎসব ছাড়াও বছরব্যাপী নাগা জাতিগুলি নানা আনন্দ উৎসবের আয়োজন করে থাকে খুব ধুমধাম সহকারে।

নাগাদের ধনেশ উৎসব খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে; ছবিসূত্র: ftd travel

নাগা সমাজে মুখে মুখে চলা আসা প্রাচীন গল্পকথা প্রচলিত আছে। বিশেষ করে কোনিয়াক গোত্রের নাগাদের মধ্যে রাজা গদাধরের কাহিনী খুব জনপ্রিয়। অহোম রাজা গদাধর বার শতাব্দীর দিকে নিজ রাজ্য ছেড়ে নাগাল্যান্ডে পালিয়ে এসেছিলেন। এখানেই নাগা রাজকন্যা ওয়াতলং এর সাথে তার প্রণয় ও বিবাহ হয়। চৌদ্দ এবং পনেরো শতক থেকেই অহোমদের সাথে নাগাদের সাংস্কৃতিক আদান প্রদান হতে থাকে।

বর্তমান

দীর্ঘদিনের বৈরী পরিবেশ কাটিয়ে উঠে নাগারা এখন পর্যটকদের সানন্দে বরণ করে নিচ্ছে। নাগাল্যান্ডের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য, বিশেষ করে ফ্যালকন নামক শিকারী পাখির সমারোহ নাগাদের বাসভূমিকে ক্রমেই আকর্ষণীয় করে তুলছে। প্রদেশটির ঐতিহাসিক গুরুত্বও কম নয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমাতেই জাপানী সেনাবাহিনী এবং সুভাষ চন্দ্র বোসের ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়েছিল।

বর্ণিল জীবনধারা নাগাদেরকে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে; ছবিসূত্র: Pinterest

ফিচার ইমেজ: BBC

Related Articles

Exit mobile version