আমেরিকার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষা এবং সারা পৃথিবীতে প্রভাব বিস্তারে এফবিআই, সিআইএ কিংবা সিক্রেট সার্ভিসের ভূমিকা অনেক। সাফল্যের দিক থেকেও পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে এগিয়ে। অবিশ্বাস্য সব কায়দায় অনেক দুর্ধর্ষ ও লোমহর্ষক অপারেশনের নেপথ্যে আছে এসব সংস্থার হাত।
তবে তারপরও তাদের সাফল্যের মুকুটে অসংখ্যবার যুক্ত হয়েছে ব্যর্থতার পালক। তাদের নাকের ডগা দিয়ে সংঘটিত হয়েছে অসংখ্য ভয়াবহ হামলা। এমনই একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো নিউ ইয়র্ক শহরের ওয়ালস্ট্রিট বোমা হামলা। বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে এটি সংঘটিত হয়। পুলিশ কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার শত প্রচেষ্টার পরও আজ পর্যন্ত অজানা রয়ে গেছে এর রহস্য।
ওয়ালস্ট্রিট, আমেরিকার অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক কেন্দ্র। আমেরিকার শীর্ষস্থানীয় স্টক এক্সচেঞ্জসমূহের হেডকোয়ার্টার অবস্থিত এখানে। অর্থনৈতিকভাবে আমেরিকার শক্তিশালী অবস্থান অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত হয় এখান থেকে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে প্রথম ১১টি স্টক নিয়ে ওয়ালস্ট্রিটে শুরু হয় অর্থনৈতিক লেনদেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ধীরে ধীরে জমজমাট হতে থাকে এই অর্থনৈতিক কেন্দ্র।
ওয়ালস্ট্রিটের দক্ষিণদিকের অংশটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তৎকালীন প্রভাবশালী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান জে পি মর্গান অ্যান্ড কো.-এর সদরদপ্তর ছিল এখানে। এছাড়াও ছিল আমেরিকার সাব-ট্রেজারি অফিস, নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জসহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। আমেরিকার বাড়তে থাকা অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র হয়ে ওঠে এই ওয়ালস্ট্রিট। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই নৈরাজ্যবাদী এবং বিপ্লবীদের কুদৃষ্টি পড়ে এর উপর।
তাদের মতে, সারা পৃথিবীতে ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে ওঠা পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রতিনিধিত্ব করছে এখানকার প্রতিষ্ঠানগুলো। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে হুমকি দেওয়া হলেও নিউ ইয়র্কের পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন ব্যাপারটিকে ততটা পাত্তা দেয়নি।
১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯২০; দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। বৃষ্টির পূর্বাভাস ছিল আগে থেকেই। ওয়ালস্ট্রিটে যথারীতি কর্মব্যস্ত আরেকটি দিন। সকাল থেকেই সেখানকার রাস্তা জনাকীর্ণ ছিল বার্তাবাহক, ব্যবসায়ী আর মালবাহী গাড়ি দ্বারা। সকাল গড়িয়ে দুপুর। ঠিক এমন সময় জে পি মর্গান অ্যান্ড কো. সদর দপ্তরের অদূরে একটি ঘোড়াসহ মালবাহী গাড়ি এসে দাঁড়ায়। কেউ ধারণা করতে পারেনি, এর ভেতরে ছিল ১০০ পাউন্ডের ডিনামাইট, যা ৫০০ পাউন্ড লোহার টুকরা দিয়ে পূর্ণ ছিল।
নিকটবর্তী চার্চে দুপুর বারোটার ঘণ্টা বাজার সাথে সাথেই ওয়ালস্ট্রিটের রাস্তায় মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে মধ্যাহ্নভোজ গ্রহণের জন্য। হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয় সেই গাড়ি। কয়েক মাইল দূর থেকেও শোনা যায় সেই বিস্ফোরণের শব্দ। মুহূর্তের মধ্যে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে লোহার টুকরো, ভাঙা কাঁচ আর আগুনের কুণ্ডলী। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে মানুষের লাশ। বাতাস ভারী হয়ে ওঠে ধোঁয়ার কুণ্ডলী, লাশের গন্ধ আর আহতদের আর্তনাদে। বিভীষিকাময় এই হামলায় তৎক্ষণাৎ ৩৮ জন নিহত হয়, আহত হয় ৩০০ জন। ক্ষতি হয় সব মিলিয়ে ২ মিলিয়ন ডলারের।
বিস্ফোরণের কিছুক্ষণের মধ্যেই নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেন বন্ধ ঘোষণা করা হয়। পুলিশ এবং স্বেচ্ছাসেবী দল দ্রুত ছুটে যায় ঘটনাস্থলে। যথাসম্ভব দ্রুততার সাথে আহতদের উদ্ধার করে পাঠানো হয় হাসপাতালে। বিকেল নাগাদ স্টক এক্সচেঞ্জে পরিচালকদের গুরুত্বপূর্ণ সভা বসে। সভায় সিদ্ধান্ত হয়- সকল প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে পরের দিনই প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করা হবে। কর্মরত নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা সারারাত পরিশ্রম করে বিস্ফোরণস্থল এবং আশেপাশের ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করে ফেলে।
দুর্ভাগ্যবশত, এ সময় বেশ কিছু আলামত নষ্ট হয়ে যায়, যা পরবর্তীতে তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হতে পারতো। ১৭ সেপ্টেম্বর, সকালে নতুনভাবে আবারও শুরু হয় এখানকার ব্যস্ততা। হামলায় বেঁচে যাওয়া এবং আহত কর্মীরা বিকেলে নিহতদের স্মরণে আর নতুনভাবে শুরু করার স্বপ্নে সমস্বরে গেয়ে উঠে আমেরিকার জাতীয় সংগীত।
হামলার পরপরই নিউ ইয়র্ক পুলিশ, সিক্রেট সার্ভিস এবং ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পরবর্তীতে এফবিআই) তদন্তে নেমে পড়ে। প্রাথমিক পর্যায়ে, একে নিছক একটি দুর্ঘটনা হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু, ঘটনার আলামত বিশ্লেষণ করে পুলিশ এবং গোয়েন্দারা বুঝতে পারেন, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পিত হামলা।
পরবর্তীতে টানা তিন বছর ধরে পুলিশ এবং গোয়েন্দা কর্মকর্তারা অবিরাম চেষ্টা করে গেছেন রহস্য উদঘাটনে। বিভিন্ন সময় সন্দেহভাজনদের গ্রেফতার এবং জিজ্ঞাসাবাদের পরও কোনো গুরুত্বপূর্ণ সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। পুলিশের পক্ষ থেকে বিস্ফোরিত গাড়ির চালকের সম্ভাব্য একটি ছবি প্রকাশ করা হয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত অধরাই থেকে যায় রহস্যময় সেই চালক।
ঘটনার পেছনে জে পি মর্গান অ্যান্ড কো. এর চেয়ারম্যান প্রভাবশালী জে পি মরগ্যান জুনিয়রকে হত্যার কোনো উদ্দেশ্য ছিল কি না তা খতিয়ে দেখতে শুরু করে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। কিন্তু, বিস্ফোরণের সময় মরগ্যান জুনিয়র ইউরোপে অবস্থান করছিলেন। ফলে, শুরুতেই এ ধারণাকে নাকচ করে দেওয়া হয়।
বোমা বিস্ফোরণের ঠিক পরদিন ওয়ালস্ট্রিটের ডাকবক্সে একটি চিঠি পাওয়া যায়, যা বিস্ফোরণের আগমুহূর্তে বক্সে ফেলা হয়েছিল। চিঠিতে লেখা ছিল, “মনে রেখো, আমরা আর সহ্য করবো না। সকল বন্দীকে মুক্তি দাও অথবা সবাই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও। -আমেরিকান নৈরাজ্যবাদী সৈনিক।”
চিঠির ধরন দেখে গোয়েন্দাদের সন্দেহের তীর চলে যায় ইতালীয় নৈরাজ্যবাদীদের দিকে, যারা পরিচিত ছিল ‘গ্যালিয়ানিস্টস’ নামে। গ্যালিয়ানিস্টস, মূলত আমেরিকায় অভিবাসী ইতালীয়দের একটি চরমপন্থী সংগঠন, যারা নৈরাজ্যবাদে বিশ্বাসী ছিল। আমেরিকার শক্তিশালী হয়ে ওঠা পুঁজিবাদী অর্থনীতির ঘোর বিরোধী ছিল গ্যালিয়ানিস্টসরা। সংগঠনটির তৎকালীন আদর্শিক গুরু ছিলেন লুইগি গ্যালিয়ানি।
এই সংগঠন বিগত কয়েক বছরে বেশ কয়েকবার আমেরিকার বিভিন্ন শহরে ছোট ছোট বোমা হামলা চালিয়েছিল। এসব হামলায় ব্যবহৃত বোমা তৈরির কৌশলের সাথে ওয়ালস্ট্রিটের বিস্ফোরিত বোমার সাদৃশ্য খুঁজে পায় তদন্তকারী দল। ফলে গোয়েন্দাদের সন্দেহের মাত্রা আরো তীব্র হয়। কিন্তু, লুইগি গ্যালিয়ানি সে সময় ইতালিতে থাকায় গোয়েন্দারা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে ব্যর্থ হয়। ফলে, শক্তিশালী প্রমাণের অভাবে তদন্তকারী দল তাদের এই ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হয়।
ঘটনার আরেক সন্দেহভাজন ছিলেন মার্কিন টেনিস খেলোয়াড় এডউইন ফিশ্চার। তিনি ঘটনার বেশ কয়েকমাস আগে থেকে তার পরিচিত এক ব্যক্তিকে পোস্ট কার্ড পাঠিয়ে ১৬ সেপ্টেম্বরের আগেই ওয়ালস্ট্রিট ছেড়ে চলে যাবার পরামর্শ দিচ্ছিলেন। তাকে গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে ফিশ্চার বলেন, তিনি ঈশ্বরের নিকট থেকে সম্ভাব্য বিপদের বিষয়ে বার্তা পেয়েছিলেন। তার আচরণে পুলিশ বুঝতে পারে, তিনি মানসিক ব্যধিতে আক্রান্ত। ফলে, তাকে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।
বছরজুড়ে একের পর এক গ্রেফতার এবং জিজ্ঞাসাবাদের পরেও শেষপর্যন্ত তদন্তকারী দল কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেনি। সময়ের সাথে সাথে ঝিমিয়ে পড়তে থাকে হামলার তদন্ত কাজ। ওয়ালস্ট্রিটও ফিরে পেতে থাকে তার পুরনো জৌলুশ। কোনো বড় সাফল্য ছাড়াই একসময় বন্ধ হয়ে যায় গোয়েন্দাদের অনুসন্ধান কাজ।
পরবর্তীতে, বেশ কয়েকজন ইতিহাসবিদ এই হামলার পেছনে আরেকজনের নাম যুক্ত করেন। তিনি গ্যালিয়ানিস্ট মারিও বুদা। ধারণা করা হয়, মারিও বুদা তার ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধাদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে এই হামলায় ইন্ধন জুগিয়েছিল। তাদের এই ধারণার পেছনে যুক্তি ছিল, হামলায় ব্যবহৃত বোমা তৈরিতে বুদার পূর্বাভিজ্ঞতা।
এছাড়া, পরবর্তীতে তার বেশ কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী এই হামলায় তার জড়িত থাকার বিষয়টি প্রকাশ্যে স্বীকার করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, হামলার পরবর্তী সময়ে গোয়েন্দাদের সন্দেহের তালিকায় তার নাম ছিল না। ফলে সে সময় নিউ ইয়র্কে অবস্থান করলেও তাকে কোনোপ্রকার জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়নি। পরবর্তীতে, নভেম্বর মাসে, স্থায়ীভাবে মারিও বুদা আমেরিকা ছেড়ে ইতালি চলে যান।
১৯৪৪ সালে তৎকালীন এফবিআই ওয়ালস্ট্রিট হামলার পুনঃতদন্ত শুরু করে। ঘটনার বিভিন্ন দিক গভীর পর্যালোচনার পর গোয়েন্দারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, হামলার সন্দেহভাজনদের বিষয়ে তাদের পূর্বসূরিদের (ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন) ধারণাই সঠিক। অর্থাৎ ইতালীয় নৈরাজ্যবাদীদের একটি ক্ষুদ্র দল এই হামলার পেছনে দায়ী থাকার সম্ভাবনাই প্রবল। এটি সত্য হয়ে থাকলে পর্যাপ্ত আলামতের অপ্রতুলতার কারণে সে সময় এই রহস্যের কোনো সুরাহা করা সম্ভব হয়নি। পরিশেষে, এফবিআই এই বিভীষিকাময় হামলাকে একটি ‘অমীমাংসিত রহস্য’ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে এর তদন্ত বন্ধ করে।
আর দুই বছর পর ওয়ালস্ট্রিট হামলার এক শতক পূর্ণ হবে। মার্কিন অর্থনীতির অন্যতম সূতিকাগার এই স্ট্রিটের সুউচ্চ ভবন আর কর্মব্যস্ততার ভিড়ে চাপা পড়ে গেছে শতাব্দীর অন্যতম ভয়াবহ এই হামলার স্মৃতি। এই ঘটনাকে উপজীব্য করে রচিত হয়েছে বেশ কয়েকটি বই, নির্মিত হয়েছে টেলিভিশন সিরিজ। আজও ২৩ ওয়ালস্ট্রিটের মরগ্যান বিল্ডিংয়ের দেয়ালে চোখে পড়ে বিস্ফোরণের চিহ্ন, শতাব্দী ধরে যা সাক্ষী হয়ে আছে এই রহস্যের।