ঘুড়ি যেভাবে আকাশে উড়লো

পেটকাটি চাঁদিয়াল মোমবাতি বগ্গা
আকাশে ঘুড়ির ঝাঁক, মাটিতে অবজ্ঞা।।
বয়স বারো কি তেরো ।।
রিকশা চালাচ্ছে,
আকাশে ঘুড়ির ঝাঁক ছেলেটাকে ডাকছে।
-[কবির সুমন]

নির্মল নীল আকাশে রঙিন ঘুড়ি আকাশে উড়তে দেখলে কার না মন আনচান করে ওঠে! কৈশোরের কোনো স্মৃতি কি তখন মনের কোণায় উঁকি ‍দিয়ে ফিরে না! কিন্তু এই ঘুড়ি কিভাবে এলো, কিভাবে নানা বৈচিত্রময় ঘুড়ি আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে উঠলো সেই জানা-অজানা ইতিহাসের কাহিনীই জানার চেষ্টা করবো আজ।

কিভাবে ঘুড়ি আকশে উড়লো?

ঘুড়ির আবিষ্কার হয়েছিলো কোথায়? কে-ই বা তা আবিষ্কার করেন? এ সম্পর্কে কোনো সঠিক তথ্য উপাত্ত তেমন একটা পাওয়া যায় না। তবে ধারণা করা হয়,২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে হান সিন নামে চীন দেশের এক সেনাপতিই প্রথম ঘুড়ি তৈরী করেন। তবে এর বিপরীতে অন্য একটি মতও প্রচলিত।

চীনা সেনাপতি হান সিন

সেটি হচ্ছে, ৪০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে গ্রীসের ট্যারাস্টাস শহরের আর্কিটাস নামে এক ভদ্রলোক প্রথম ঘুড়ি তৈরী করেন। আবার কারো কারো মতে,  প্রাচীনকালের ছুনছিউ আমলে প্রায় ২,৮০০ বছর আগে একজন দার্শনিক মুওছু ৩ বছর সময় ধরে কাঠ দিয়ে একটি ঘুড়ি তৈরি করেছিলেন। আর সে ঘুড়িই হলো বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো ঘুড়ি।

চীনে প্রথম ঘুড়ি ওড়ানো শুরু হয় বলে মনে করেন অনেক গবেষক

সেসময় বাঁশের কাঠামোর সঙ্গে সিল্ক কাপড় দিয়ে ঘুড়ি বানানো হতো। কাগজ আবিস্কার করার পর থেকেই ঘুড়িতে কাগজ ব্যবহার শুরু হয়। পরবর্তীকালে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ইটালির বিখ্যাত পর্যটক মার্কো পোলোর  মাধ্যমে ঘুড়ির কথা সারা ইউরোপের মানুষের কাছে পরিচিতি লাভ করতে থাকে। তবে ঘুড়ির স্বর্ণযুগ বলা হয় ১৮৬০ সাল থেকে ১৯১০ পর্যন্ত সময়কে।

ঘুড়ির যত ব্যবহার

যুদ্ধের নানা কাজে ঘুড়ি ব্যবহার করা হয়েছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। প্রায় হাজার বছর আগে চীন দেশের এক সেনাপতি হানসিন শত্রু পক্ষের কেল্লার দূরত্ব মাপার কাজে ঘুড়ি ব্যবহার করেছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুপক্ষের চোখ এড়িয়ে নিজের লোকদের কাছে সংবাদ প্রেরণের কাজেও ব্যবহৃত হয়েছিল ঘুড়ি। এছাড়া ঘুড়িতে ক্যামেরা বেঁধে শত্রুপক্ষের ছবি তোলা, ঘুড়িতে বিস্ফোরক বেঁধে শত্রুপক্ষের জাহাজ ধ্বংস করা থেকে শুরু করে নানা কাজে ব্যবহৃত হতো এই ঘুড়ি।

বিজ্ঞানীদের নানা কর্মকান্ডে ঘুড়ির ব্যাপক ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। ১৭৪৯ সালে আলেকজান্ডার উইলসন ঘুড়িতে থার্মোমিটার লাগিয়ে উর্ধ্বাকাশের তাপমাত্রা নির্ণয়ের চেষ্টা করেন। ১২ ডিসেম্বর ১৯০১ সালে ঘুড়ির মধ্যে অ্যান্টেনা লাগিয়ে বৈজ্ঞানিক মার্কনি আকাশের ইলেকট্রোম্যাগনেটিভ ওয়েভ ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৭৫২ সালে বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্র্যাংকলিন ঘুড়ির সাহায্যে কৃত্রিমভাবে প্রস্তুত বিদ্যুৎ ও আকাশের বিদ্যুৎ যে এক তা প্রমাণ করেন।

 ঘুড়ির হরেক নাম

ঘুড়ি এক প্রকারের হালকা খেলনা যা সুতা টেনে আকাশে উড়ানো হয়। ইংরেজি KITE শব্দের অর্থ চিল বা বাজ পাখি। চিল উর্ধ্বাকাশে মনের সুখে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ঘুড়িতে চিলের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় বলে ইংরেজী শব্দ KITE  রাখা হয়। আর বাংলা ঘুড়ি শব্দটি সংস্কৃত ‘ঘূর্ণ’ শব্দ থেকে এসেছে। বাংলায় এটি গুড্ডি বা ঘুড্ডি নামেও পরিচিত। ঘুড়ির এ নামটিও হিন্দি ‘গুড্ডী’ শব্দ থেকে এসেছে। জাপানে একে ‘তাকো’, ফ্রান্সে ‘সেফ ভোলেন্ট’, চায়নায় ‘ফুঙ জুঙ’, মেক্সিকোতে ‘পাপালোতে’ নামে ডাকা হয়। যে নামেই তাকে ডাকা হোক না কেন, সব দেশেই এটি সার্বজনীন খেলা হিসেবে পরিচিত।

বৈচিত্রময় ঘুড়ির দুনিয়া

বৈচিত্র রঙের ঘুড়ি

ঘুড়ি বলতেই এক সময় মনে করা হতো চৌকোণা উড়ন্ত খেলনা। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে ঘুড়ির আকার আকৃতিতে এসেছে নানা পরিবর্তন। মাছ, পাখি, ফুল, বাঘ, সিংহ, ড্রাগন, ব্যাঙ, সাপ-কতো আকৃতিরই না ঘুড়ি তৈরি হচ্ছে এখন। নানা দেশের মানুষ ঘুড়ির মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করতে চেয়েছে নিজেদের সংস্কৃতি, মিথ, এমনকি ধর্মও।

বৈচিত্রময় আকৃতির ঘুড়ি

চীনা আর জাপানিরা ড্রাগনসহ নানা প্রাগৈতিহাসিক জীবজন্তুর মুখের আদলে রঙ-বেরঙের ঘুড়ি ওড়ায়। মুসলমান আমলে বিভিন্ন সময়ে নানা রকমের ঘুড়ি দেখা গেছে। যেমন নকাওয়া, চংগ, তুলকল, পতংগ, গুডডি প্রভৃতি। আমাদের দেশের ঘুড়ির সাথে মালয়েশিয়ার ঘুড়ির কিছু মিল পাওয়া যায়। কেবল নানা রঙের কাগজ দিয়ে বিভিন্ন ডিজাইনের তৈরি ঘুড়িকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়; যেমনঃ চাঁদিয়াল, ঢুপিয়াল, ঘয়লা, চৌরঙ্গী ইত্যাদি। ভারতবর্ষসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নেতা বা সিনেমার নায়কদের ছবি ঘুড়িতে লাগিয়ে ওড়ানো হয়ে থাকে।

 ঘুড়ি উৎসব

১৯৮৪ সাল থেকে জানুয়ারি ৮ থেকে ১৪ তারিখের মধ্যে আন্তর্জাতিক ঘুড়ি উৎসবের আয়োজন করা হয়। আর ঘুড়ি খেলার আন্তর্জাতিক সংগঠন বিশ্ব ঘুড়ি ফেডারেশনের প্রধান কার্যালয় চীনের ওয়ে ফ্যাং শহরে অবস্থিত। পৃথিবীর অনেক দেশেই ঘুড়ি উড়ানো জাতীয় উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে থাকে। চীন, জাপান, তাইওয়ানে তো ঘুড়ি উড়ানোকে কেন্দ্র করে সরকারি ছুটির ঘোষণা করা হয়। অনেক দেশে ঘুড়ি উড়ানো ধর্মীয় সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে পালন করা হয়।

ঘুড়ি উৎসবকে কেন্দ্র চীনের ওয়ে ফ্যাং শহরে আয়োজিত অনুষ্ঠান

ভারতের গুজরাট প্রদেশের লোকেরা সুন্দর সুন্দর ঘুড়ি উড়িয়ে সূর্য দেবতাকে খুশি করে মনের আকুতি, অভিলাষ প্রকাশ করে। বাংলার হিন্দুরা পৌষ সংক্রান্তিতে ঘুড়ি উৎসব পালন করে। মালয়েশিয়ায় ঘুড়িকে পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে মানা হয়। তারা ঘুড়িকে জি্বন বা ভূতের ওঝা হিসেবে বাড়ির আশপাশ থেকে ভূত তাড়াতে ঘুড়ি উড়ায়।

পৌষ সঙক্রান্তিতে আয়োজিত ঘুড়ি উৎসব

নেপালে ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসবকে মাঘি নামে ডাকা হয়। থাইল্যান্ডে সংক্রান, লাওসে পিমালাও, মিয়ানমারে থিং ইয়ান হিসেবে এই উৎসব পালন করা হয়। গায়ানায় ধর্মীয় ঐতিহ্য হিসেবে ঘুড়ি উৎসব হয় ইস্টারের সময়। কলম্বিয়াতে আগস্ট জুড়ে চলে এই উৎসব।

গুজরাতের উত্তরায়নের দিনে আয়োজিত হয় ঘুড়ি উৎসব

চিলির স্বাধীনতা দিবসকে উপলক্ষ করে পালিত হয় ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব। কানাডা আর যুক্তরাষ্ট্রের নানা রাজ্যজুড়ে ঘুড়ির নানা উৎসব পালিত হয়।

কানাডায় আয়োজিত ঘুড়ি উৎসব

২০০১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা প্রদেশে ‘কালার দ্য উইন্ড’ নামে ঘুড়ি উৎসব ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের শীতকালীন ঘুড়ি উৎসবগুলোর মধ্যে এটিই সবচেয়ে বড়।

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে আয়োজিত ঘুড়ি উৎসব

ভোকাট্টা

ঘুড়ির লড়াইয়ে সাধারণত মাঞ্জা দেওয়া সুতা দিয়ে ঘুড়ি উড়িয়ে একজন আরেকজনের ঘুড়িকে কাটার চেষ্টা করেন। বিজয়ী ঘুড়ি আকাশে উড়তে থাকে আর হেরে যাওয়া, কেটে যাওয়া ঘুড়ি ভোকাট্টা হয়ে বাতাসে দুলতে দুলতে ভুপাতিত হয়। ঘুড়ির এই লড়াই প্রায় সব দেশেই  হয়ে থাকে। তবে থাইল্যান্ডে এই লড়াই নিয়ে মাতামাতি হয় খুব বেশি। সেখানে ঘুড়ির লীগ প্রতিযোগিতা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়।

মাঞ্জা দেয়া ঘুড়ির অন্যতম উপকরন সুতোসহ লাটাই

ঘুড়ি কাটাকাটির লড়াই বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান প্রভৃতি অঞ্চলগুলোতে প্রায় সারা বছর ধরেই চলে। এখানকার নবাব আমলে নবাব বাড়িকে কেন্দ্র করে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা হতো। প্রতিযোগিতার মাসখানেক আগেই শুরু হতো প্রস্তুতি; ঘুড়ি ও নাটাই তৈরি, সুতায় মাঞ্জা দেয়া, সব মিলিয়ে বিশাল কর্মযজ্ঞ। দুই বাড়ির ছাদে অথবা কোনো মাঠে দুই দল সামনাসামনি দাঁড়িয়ে ঘুড়ি-কাটাকাটির প্রতিযোগিতা হতো।

 এই বাংলায় ঘুড়ির প্রচলন

ঘুড়ি উৎসবকে কেন্দ্র করে পুরনো ঢাকার জমজমাট ঘুড়ির বাজার

বাংলাদেশের ঘুড়ি উৎসবের ইতিহাস অনেক পুরোনো। বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো ঘুড়ি উৎসব হলো পুরোনো ঢাকার পৌষ সংক্রান্তির ঘুড়ি উৎসব। তবে মোঘল আমল থেকেই বাংলাদেশের মানুষ ঘুড়ি নিয়ে উৎসব করে আসছে। নবাবরাই প্রথম শুরু করে এই ঘুড়ি উৎসব। ধীরে ধীরে এই উৎসব পুরোনো ঢাকার মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে।

পুরনো ঢাকার ঘুড়ি উৎসব

ঘুড়ি ওড়ানোর মধ্য দিয়ে আকাশে ওড়ার সুপ্ত বাসনাই হয়তো মানুষের মনে প্রতিনিয়ত খেলা করে বলে ঘুড়ি ওড়ানোর খেলা এখনও দেশ-বিদেশের মানুষদের মাঝে সমান জনপ্রিয়। ছোটদের মতো বড়রাও ঘুড়ি ওড়ানোর এই খেলায় নিজেদের হারিয়ে যাওয়া অতীতে ফিরে যেতে চান। তাই ঘুড়ি কাহিনী বলতে গিয়ে সকলের  শৈশবকে উসকে দেওয়ার ছোট্ট এক প্রয়াস।

তথ্যসূত্র

১) en.wikipedia.org/wiki/Kite

২) kites.com/history-of-kites

৩) chinahighlights.com/travelguide/culture/kites.htm

৪) sites.google.com/site/stanfordkfs/the-kite/uses-of-kites

৫) asahi-net.or.jp/~et3m-tkkw/history-table.html

৬) pictureprettykites.com/kite-history/

Related Articles

Exit mobile version