ট্রাফালগারের যুদ্ধে অ্যাডমিরাল হোরাশিও নেলসনের আততায়ী থেকে শুরু করে ইরাক যুদ্ধে জুবা নামের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ইরাকিদের নায়ক, যে নিজের শিকার করার দৃশ্য ভিডিওটেপে ঢুকিয়ে রেখেছিল, যুদ্ধক্ষেত্রে স্নাইপারদেরকে সবসময়েই শ্রদ্ধা আর ভয়ের চোখে দেখা হয়। তাকে দেখা যাবে না, ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বেশ দূরে থেকেই সে পাল্টিয়ে দিতে পারে যুদ্ধের মোড়। মাত্র একটি গুলি দিয়েই শত্রুর বুক ফুটো করে দিতে পারে তারা, কখনো কখনো থামিয়ে দেয় পুরো শত্রুদলটিকেই!
ইতিহাসের সেরা এই মার্কসম্যানদের শুধু অসাধারণ লক্ষ্যভেদ করার ক্ষমতাই নেই, বরং পরিবেশের সাথে নিজেদেরকে আড়াল করে নেওয়ার দক্ষতাও অসাধারণ। ফিনিশীয় যুদ্ধের সাদা তুষার কিংবা ভিয়েতনামের সবুজ জঙ্গলের মধ্যে নিজের ক্যামোফ্লেজ আড়াল করে শত্রুদের আতঙ্ক হিসেবে পরিচিতি পাওয়া সেরা ৫ স্নাইপারের উপাখ্যানই শোনা যাক।
লুডমিলা পাভলিচেংকো
ইউক্রেনে জন্ম নেওয়া পাভলিচেংকো রেড আর্মির স্নাইপার হিসেবে যোগদান করে ১৯৪১ সালে, যখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করছে। সেনাবাহিনীর রিক্রুটার তাকে মেডিকেল নার্স হিসেবে আহত সৈন্যদের সেবা শুশ্রূষা করার পরামর্শ দিয়েছিল, কিন্তু পাভলিচেংকো চেয়েছিলেন স্নাইপার হতে। অবশেষে ট্রেনিংয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার পর তার নামের পাশে যুক্ত হয় শার্পশ্যুটার ব্যাজ, এবং তাকে স্নাইপার রাইফেল নিয়ে রণাঙ্গনে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।
রেড আর্মিতে মাত্র দুই হাজার মহিলা স্নাইপার ছিল। সেনাবাহিনীর অন্যান্য বাহিনীর তুলনায় স্নাইপার হিসেবে মহিলাদেরকে অনেক কম সুযোগই দেওয়া হয়েছিল। যুদ্ধক্ষেত্রের সাধারণ সৈনিক হিসেবে মহিলারা তো ছিলই, এমনকি ট্যাংক চালক, বোম্বার পাইলট হিসেবেও অনেক মহিলাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তবে লুডমিলা পাভলিচেংকোর মতো সফল হতে পারেনি কেউই, এমনকি পুরুষ সহযোদ্ধাদেরকেও ছাড়িয়ে গিয়েছেন ২৫ বছর বয়সী এই তরুণী।
পাভলিচেংকো নাৎসিনিধন শুরু করে ওডেসার যুদ্ধে। তবে যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছেই তা শুরু করেনি সে, বরং তার এক সহযোদ্ধাকে মারা যেতে দেখার পর সে স্নাইপার নিয়ে শুরু করে তার দক্ষযজ্ঞ। প্রায় দুই মাস ধরে যুদ্ধ করার পর সোভিয়েতে ফিরে যায়, ততদিনে পাভলিচেংকোর হিটলিস্টে যোগ হয়েছে ২৫৭ জন নাৎসি, অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন ৫ জন করে! তার কাজের এই স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে ‘অর্ডার অফ লেনিন’ পদকে ভূষিত করা হয়।
পাভলিচেংকোর পরবর্তী গন্তব্য সেভাস্টোপোল, এবং ১৯৪২ এর মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই তার ট্যালিতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩০৯ জন, যার মধ্যে রয়েছে ৩৬ জন জার্মান স্নাইপার! এরপর রেড আর্মি তাকে প্রোপাগান্ডার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে, তাকে পাঠানো হয় যুক্তরাষ্ট্রে। প্রথম সোভিয়েত নাগরিক হিসেবে হোয়াইট হাউজে ঢোকে পাভলিচেংকো, যুক্তরাষ্ট্রে এই স্নাইপার এতটাই জনপ্রিয়তা পায় যে তাকে নিয়ে একটি সিনেমাও বানানো হয়।
সোভিয়েত ইউনিয়নে ফিরে আসার পর তাকে ‘হিরো অফ দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন’ পদকে ভূষিত করা হয়। পরবর্তীতে তাকে স্নাইপার প্রশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। মেজর পদে পদোন্নতি হয় লুডমিলা পাভলিচেংকোর, এবং সামরিক বাহিনীতেই নিজের ক্যারিয়ার শেষ করেন তিনি।
নিকোলাস ইরভিং
বর্ণান্ধ হওয়ার কারণে নেভি সীল থেকে বাদ যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের রেঞ্জার বাহিনীর সদস্য হিসেবে ইরাক আর আফগানিস্তানে সাড়ে ৩ বছর ধরে স্নাইপার দলের নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন নিকোলাস ইরভিং। সহযোদ্ধাদের কাছে ‘দ্য রিপার’ হিসেবে পরিচিত এই স্নাইপারের সর্বোচ্চ দূরত্বের রেকর্ড হলো ৮০৭ মিটার, এক রেঞ্জার প্লাটুনের উপর অ্যামবুশ করতে উদ্যত হওয়া এক তালেবান মেশিনগানারকে এক গুলিতেই শুইয়ে দেন ইরভিং।
কম করে ৩৩টি নিশ্চিত হিটশট করা এই স্নাইপার পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে নিজের স্নাইপিং স্কুল চালু করেন, এবং ‘দ্য রিপার’ গ্রন্থে তুলে ধরেন ইরাক এবং আফগানিস্তানে তার অভিজ্ঞতার গল্প।
চাক ম্যাহুইনি
চার্লস ‘চাক’ ম্যাহুইনি, অসাধারণ শিকারী এই ব্যক্তি প্রথমে চেয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীতে যোগ দিতে, যদিও পরবর্তীতে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয় মেরিন কর্পসে। নিখুঁত লক্ষ্যভেদের কারণে তাকে স্কাউট স্নাইপার স্কুলে ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হয়, আর শেষমেশ পাঠানো হয় ভিয়েতনামে।
ম্যাহুইনির জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় মিশনের তারিখটি ছিল ১৯৬৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। ম্যাহুইনির মেরিন দলের দিকে এগিয়ে আসা ভিয়েতনামী এনভিএ প্লাটুনকে মুহূর্তের মধ্যে শেষ করে দেন তিনি। দল থেকে কিছুটা দূরে থাকা ম্যাহুইনি মাত্র ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই ১৬টি হেডশট করে মার্কিন দলটিকে রক্ষা করেন, পরবর্তীতে এই মিশনের নাম রাখা হয় ‘সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে ম্যাসাকার’।
ভিয়েতনাম যুদ্ধে স্নাইপার হিসেবে সবচেয়ে বেশি হিটশটের রেকর্ডটি রয়েছে তার দখলে। মাত্র ১৩ মাস ছিলেন তিনি, এই ক’দিনেই ১০৩টি নিশ্চিত হিটশটসহ আরো ২১৬টি অনিশ্চিত ‘কিল’ রয়েছে তার ট্যালিতে। পরবর্তীতে আরো ছয় মাস করে দুইবার ভলান্টিয়ার হিসেবে ভিয়েতনামে আসলেও কর্তৃপক্ষ ‘কমব্যাট স্ট্রেস’-এর কারণে তাকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে দেয়। তার প্রিয় স্নাইপারটি বর্তমানে মেরিন কর্পস জাদুঘরে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে।
ক্রিস কাইল
ঘোড়সওয়ার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে ওঠা ক্রিস কাইলের নিয়তি ছিল নেভি সীল মিশন। দুঃসাধ্য নেভি সীল ট্রেনিংয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার পর স্পেশাল ট্রেনিং হিসেবে স্নাইপার কোর্সে ভর্তি হন কাইল। তার প্রথম হিটশট হলো একজন ইরাকি মহিলা, যে ইউএস মেরিনের এক বহরের উপর অ্যান্টি-ট্যাংক গ্রেনেড ছুঁড়ে মারতে যাচ্ছিলো। মহিলা গ্রেনেড পিন খোলার আগেই তাকে পরপারে পাঠিয়ে দেন কাইল। এরপরে আরো অনেক হিটশট যুক্ত হয় কাইলের নামের পাশে, যার মধ্যে একটি ছিল ফালুজাতে, প্রায় দেড় কিলোমিটার (১৪৬০ মিটার) দূর থেকে নিখুঁত লক্ষ্যভেদে ইরাকি এক সেনাকে মেরে ফেলেন তিনি।
কাইলের বেশিরভাগ হিটশটই হলো ২০০৫ সালের ‘ব্যাটল অফ রামাদি’তে, যেখানে প্রথম ১২ ঘণ্টাতেই এক ডজন ইরাকি সৈন্য কাইলের গুলিতে লুটিয়ে পড়ে। কাইল এতটাই বিখ্যাত হয়ে পড়েছিলেন যে বিদ্রোহীরাও তাকে ‘শাইতান-আর-রামাদি’ অর্থাৎ রামাদির শয়তান উপাধি দিয়েছিলো, অন্যদিকে মার্কিন বাহিনীর কাছে তিনি পরিচিতি পেয়েছিলেন ‘দ্য লিজেন্ড’ হিসেবে।
২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসার ৩ বছরের মাথায় নিজের আত্মজীবনী ‘আমেরিকান স্নাইপার’ প্রকাশ করেন কাইল। আশ্চর্য হলেও সত্যি, ইরাক যুদ্ধের বিভীষিকাময় যুদ্ধক্ষেত্রে কিছু না হলেও, কাইল মারা গিয়েছেন নিজের টেক্সাসের বাড়িতে! নৌবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে কাইল নিজের বাড়িতেই স্নাইপিং স্কুল খোলেন। ঐ সময়েই পিটিএসডি (পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার)-তে ভোগা ২৫ বছর বয়সী এক মেরিন ক্রিস কাইল এবং তার এক বন্ধুকে স্নাইপার দিয়েই মেরে ফেলেন! পরবর্তীতে ২০১৫ সালে তার আত্মজীবনীর উপর ভিত্তি করে নির্মাণ করা হয় ‘আমেরিকান স্নাইপার’ মুভিটি।
সিমো হায়হা
১৯৩৯ এর শীতকাল, রেড আর্মিরা হানা দিয়েছে ফিনল্যান্ডে ফিনল্যান্ড দখলে নেয়ার জন্য। কিন্তু ফিনিশরা তাদের ছোটখাট বাহিনী নিয়েই বনের মধ্যে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে পর্যুদস্ত করে রেখেছে রাশিয়ানদেরকে। আর স্নাইপাররা হলো এই বাহিনীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, আর এদের মধ্যেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সিমো হায়হা, যিনি পরিচিতি পেয়েছিলেন ‘হোয়াইট ডেথ’ অর্থাৎ সাদা মৃত্যু হিসেবে।
হায়হা, ২য় বিশ্বযুদ্ধের আগে অন্যান্য অনেক সৈন্যের মতোই একজন শিকারি ছিলেন। হেলসিংকির উত্তরের বনে হরিণ শিকার করে অভিজ্ঞ হওয়া এই শিকারি খুব ভালো করে জানতেন ক্যামোফ্লেজের ব্যবহার। আপাদমস্তক সাদা কাপড়ে মোড়া দেহ নিয়ে তিনি তার শিকারের আরো কাছে চলে যেতেন। সাদা তুষারের সাথে মিশে যাওয়া সিমো হায়হাকে আর আলাদা করে চেনার উপায় ছিল না।
সিমো হায়হা বরফের মধ্যে স্কি ব্যবহার করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে গিয়ে রেড আর্মিকে বিভ্রান্ত করে রাখতেন। প্রথমে এক জায়গা থেকে গুলি করে দিক পরিবর্তন করে অন্য জায়গা থেকে গুলি করে সোভিয়েত বাহিনীকে চমকে দিতেন তিনি।
স্নাইপার হিসেবে হায়হার হিটশট আহামরি কিছু ছিল না, অন্যান্য সাধারণ স্নাইপারদের মতোই তার গড় হিট ছিল দিনে ৫ জন। তবে এই ফিনিশ স্নাইপারের ধৈর্য ছিল অসীম। ঘন্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে সোভিয়েত স্নাইপাররা যখন অধৈর্য হয়ে আদের অস্তিত্ব ফাঁস করে দিতো, ঠিক তখনই সিমো হায়হা তার বুলেট ঢুকিয়ে দিতেন প্রতিপক্ষের শরীরে।
সিমো হায়হা তার শেষ যুদ্ধে প্রায় মারাই যেতে বসেছিলেন। প্রতিপক্ষের স্নাইপারের বুলেট তার মুখে আঘাত করে তার বামপাশের অধিকাংশ উড়িয়ে দিয়েছিল, সাথে চোয়ালের হাড়ও ভেঙে গিয়েছিলো। সহযোদ্ধারা তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে সেবা শুশ্রূষা করে এবং প্রায় নয় দিন কোমায় থাকার পর অবশেষে তার জ্ঞান ফেরে। তবে ততদিনে শীতকালীন যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছে। ২০০২ সালে ৯৬ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন ‘সাদা মৃত্যু’।