১
১৫২৬ সালের ২১ এপ্রিল তারিখটি মুঘল ইতিহাসের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। এ দিনটিতেই মুঘল ‘বাঘ’ সম্রাট বাবর পানিপথের প্রান্তরে লোদি সালতানাতের শেষ সুলতান ইব্রাহীম লোদিকে পরাজিত করেন। এর সাথে সাথে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির হিন্দুস্তানে আগমন ঘটে নতুন পরাশক্তি মুঘলদের। যদিও হিন্দুস্তানে মুঘলদের ভিত্তি শক্ত হয় পানিপথের এই বিজয়ের আরও বহু বছর পরে।
সম্রাট বাবরের হিন্দুস্তান বিজয়ের সমসাময়িক হিন্দুস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমের ভূখণ্ডগুলো শাসন করতেন রাজপুত শাসকরা। সামগ্রিকভাবে এ অঞ্চলগুলোকে একত্রে রাজপুতানা বলা হতো। আধুনিক সময়ে এই রাজপুতানা ‘রাজস্থান’ হিসেবে পরিচিত।
রাজপুতানার ওপর তখন পর্যন্ত একক কোনো রাজবংশের অধিকার ছিল না বা এককভাবে কেউই এই এলাকাটি শাসন করতে পারেননি। রাজপুতানার রাজপুত শাসকরা মূলত সংঘবদ্ধ হয়ে একটি কনফেডারেশন গঠন করেছিলেন।
ছোট ছোট অনেকগুলো স্বাধীন রাজপুত রাজ্যের সমন্বয়ে গঠিত এই কনফেডারেশনটির নেতৃত্বে ছিলেন সিসৌদিয়া বংশের রাজপুত রাজা সংগাম সিংহ।
সম্রাট বাবর তখনও হিন্দুস্তান অধিকার করেননি। তার সীমানা বলতে তখন শুধুমাত্র কাবুল।
এদিকে নানা কারণেই সুলতান ইব্রাহিম লোদির ওপর বিরক্ত ছিলেন তার দরবারের অভিজাতরা। এমনই দুইজন অভিজাত ব্যক্তি ছিলেন দৌলত খান লোদি ও আলম খান লোদি। আলম খান লোদি স্বয়ং ইব্রাহিম খান লোদির চাচা ছিলেন।
যা-ই হোক, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে শেষপর্যন্ত তারা ইব্রাহিম লোদিকে মসনদচ্যুত করতে চাইলেন, এবং গিয়ে সাহায্য চাইলেন কাবুলের সুলতান বাবরের কাছে।
হিন্দুস্তান-বিজয়ের প্রস্তুতির প্রাথমিক সময়গুলোতে বাবর হিন্দুস্তানের ভেতর থেকে আরেকজনের আমন্ত্রণও পেয়েছিলেন। তিনি হলেন রাজপুতদের নেতা রানা সংগ্রাম সিংহ।
রানা সংগ্রাম সিংহের হিসাব খুবই সাদাসিধে ছিল। তিনি নিজেও চাইতেন রাজপুতানা ছাড়াও আশেপাশের অন্যান্য ভূখণ্ডের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে; সম্ভব হলে গোটা হিন্দুস্তানই নিজের পদানত করবেন তিনি!
বাবরকে আমন্ত্রণ জানানোর কারণ হলো, তিনি ভেবেছিলেন অন্যান্য আক্রমণকারী শক্তিগুলোর মতো বাবরও কাবুল থেকে অভিযান চালাচ্ছেন শুধুমাত্র কিছু সম্পদের জন্য; যুদ্ধে জিততে পারলে কিছুদিন লুটপাট করে বাবর নিজের আস্তানায় যেয়ে ঢুকে পড়বেন।
স্বপ্নালু রানা সংগ্রাম সিংহের মনে তখন ডালপালা মেলছে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা। ভাবলেন, বাবরের আক্রমণে দিল্লি সালতানাতের বাহিনী যখন দুর্বল হয়ে যাবে, তখন ঝড়ের বেগে আক্রমণ চালিয়ে তিনি দিল্লি সালতানাতসহ অন্যান্য ভূখণ্ড দখলে নেওয়ার চেষ্টা চালাবেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি বাবরকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাবও করেছিলেন।
অবশ্য তার চুপসে যেতেও বেশিদিন সময় লাগেনি, যখন তিনি জানতে পারলেন যে, বাবরের হিন্দুস্তান ছেড়ে যাওয়ার তেমন কোনো ইচ্ছা নেই; তিনি হিন্দুস্তানে আসছেন, হিন্দুস্তান শাসন করতেই!
পরবর্তীতে রানা সংগ্রাম সিংহ আর বাবরকে সামরিক সহায়তা প্রদান করেননি। তিনি বরং ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। তিনি জানতেন বাবরের মুখোমুখি তাকে একদিন না একদিন হতেই হবে।
২
রানা সংগ্রাম সিংহের আশঙ্কা সত্য হলো। কিংবা বলা যায়, তিনি নিজেই এমন কিছু পদক্ষেপ নিলেন, যাতে এই দুই শক্তি একে অপরের মুখোমুখি হতে বাধ্য হয়।
ইব্রাহিম লোদির ইন্তেকালের পর রাজপুতরা তার তৃতীয় পুত্র মাহমুদ লোদিকে স্বীকৃতি দিয়ে লোদি সাম্রাজ্যের সুলতান ঘোষণা দেয়।
এটি ছিল সংগ্রাম সিংহের মারাত্মক দূরদর্শী এক কূটনৈতিক চাল। এই চাল বাস্তবায়িত হতে পারলে মুঘলরা তো হিন্দুস্তান ছাড়তে বাধ্য হতোই, এমনকি লোদিদেরও হয়তো একদিন হিন্দুস্তান ছাড়তে হতো!
যা-ই হোক, মাহমুদ লোদিকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরপরই রাজপুত বাহিনী আগ্রাসী হয়ে বায়ানা আর ফতেহপুরে তাণ্ডব চালায়। বেশ কিছু মুঘল শহর তাদের হাতে বিধ্বস্ত হয়। সমস্যা আরও জটিল হয়, যখন রাজপুতরা হিন্দু জাতীয়তাবাদ সামনে নিয়ে এসে বিপজ্জনক পথে হাঁটতে শুরু করে।
সম্রাট বাবর এবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠলেন। শেষ পর্যন্ত আধিপত্য বিস্তারের এই লড়াই অনেকটা ধর্মীয় আবরণ পেতে শুরু করল। কারণ সম্রাট বাবরও এ সময় ভালো অবস্থানে ছিলেন না। হিন্দুস্তানের নতুন পরিবেশে তিনি বা তার বাহিনী মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। মুঘল সেনাবাহিনী হিন্দুস্তান ত্যাগ করে কাবুলে ফিরে যেতে চাচ্ছিল।
এখন বিরোধটা যেহেতু রাজপুতরা ধর্মীয় দিকে নিয়ে গিয়েছে, বাবরকেও তাই তার বাহিনীর সামনে এই প্রশ্নগুলো রাখতে হলো যে, তারা কি নিজেদের দীর্ঘ সংগ্রামকে পিঠ দেখিয়ে, নিজেদের ধর্মীয় মর্যাদা জলাঞ্জলি দিয়ে কাবুলে গিয়ে আরামে বসবাস করতে চায়, নাকি নতুন এই ভূখণ্ডে মুসলিমদের রাজনৈতিক ঢাল হয়ে অধিকার রক্ষা করতে চায়?
বাবরের হৃদয়স্পর্শী ভাষণ শুনে মুঘল সেনাবাহিনী আরেকবার কঠিন একটি পরীক্ষা দিতে সম্মত হলো।
৩
১৬ মার্চ, ১৫২৭ সাল। রাজপুতদের বাহিনী থেকে পাঁচগুণ ছোট একটি বাহিনী নিয়ে সম্রাট বাবর আগ্রা থেকে ৬০ মাইল পশ্চিমে খানুয়ার প্রান্তরে যুদ্ধের জন্য এসে দাঁড়ালেন।
আম্বার, মারওয়ার, রামপুরা, গড়গাঁও, চান্দেরি, বুন্দি, রায়সিন, সিক্রি, আজমির ও অন্যান্য হিন্দু শাসনাধীন অঞ্চল থেকে বাবরের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য বিপুল অর্থ ও সেনাসাহায্য পাওয়ায় রাজা সংগ্রাম সিংহের বাহিনীর আকার এসময় ১ লাখ ২০ হাজারে গিয়ে পৌছায়। এ বাহিনীতে মাহমুদ লোদির ১০ হাজার সৈন্য আর হাসান খান মেওয়াটির ২০ হাজার সৈন্যও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
অন্যদিকে মুঘল সম্রাট বাবরের অধীনে মাত্র ২৫,০০০ সৈন্য। অবশ্য এটি শুধুমাত্র একটি সংখ্যাই। সম্রাট বাবর এর আগেও নিজের তুলনায় অনেক বড় বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে জয় তুলে নিয়েছিলেন।
সম্রাটের বাহিনীর যোদ্ধারা দক্ষ আর যুদ্ধক্ষেত্রে পরীক্ষিত। সবচেয়ে বড় কথা, মুঘল যোদ্ধারা তাদের সম্রাটকে ভালোবাসতেন আর তারা এই যুদ্ধে জয়ের ব্যাপারেও আত্মবিশ্বাসী ছিলেন।
সকালের দিকে যুদ্ধ শুরু হলো। দিনব্যাপী দুই বাহিনীর মাঝে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হলো। ইস্পাতের মতো দৃঢ় মুঘল সেনাবাহিনীর সামনে রাজপুতরা টিকে থাকতে পারল না। তারা পরাজিত হলো।
রাজা রায়মহল রাঠোর, উদয় সিংহ, রতন সিংহসহ রানা সংগ্রাম সিংহের অনেক ঘনিষ্ঠ মিত্র এ যুদ্ধে মারা গেলেন। মেওয়াটের মুসলিম রাজা হাসান খানও এ যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। স্বয়ং রানা সংগ্রাম সিংহ আহত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
খানুয়ার যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজয়ের পর রাজপুতদের সেই কনফেডারেশনটি ভেঙে পড়ল। ক্ষমতার মাঠের নিয়ন্ত্রণকারী শক্তির আসনটি রাজপুতরা মুঘলদের জন্য ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন।
এই যুদ্ধের পর থেকে যদিও রাজপুতরা আর কখনোই তাদের হারানো অবস্থায় ফিরে যেতে পারেনি, তবে একেবারেই সেই স্বপ্ন যে তারা বাদ দিয়ে দিয়েছিল, তা-ও না।
রাজপুত রানা সংগ্রাম সিংহের উত্তরাধিকারীরাই প্রজন্মান্তরে সেই বিরোধ টেনে নিয়ে এসেছিলেন। উত্তরাধিকার সূত্রে সেই বিরোধের একপক্ষে এখন অবস্থান করছেন সম্রাট বাবরের নাতি জালালুদ্দিন মুহাম্মদ আকবর, অন্যদিকে আছেন রানা সংগ্রাম সিংহের নাতি রানা প্রতাপ সিংহ!
৪
রানা সংগ্রাম সিংহ রাজপুতদের জন্য আজীবন বীরের মতো লড়ে গিয়েছিলেন। অবশ্য তাকে জীবন হারাতেও হয় সেই রাজপুতদের হাতেই। এর কারণ অবশ্য তিনি নিজেই ছিলেন।
খানুয়ার-পরাজয়ের অপমানের শোধ নিতে তিনি আবারও একটি সেনাবাহিনী গঠন করতে চাইছিলেন। কিন্তু রাজপুত অভিজাতরা বুঝতে পেরেছিলেন, মুঘলদের বিরুদ্ধে আবারও যুদ্ধে নামা এখন আত্মহত্যার শামিল! কারণ রাজপুতদের সেই আগের সময় এখন আর নেই। অন্যদিকে আফগান আর রাজপুত দুইদিক থেকেই চাপে থাকলেও মুঘলরাও নিজেদের অবস্থান ইতোমধ্যেই শক্ত করে নিয়েছে; চাইলেই এখন আর তাদের উৎখাত করা সম্ভব না।
কিন্তু বুঝতে চাইলেন না রানা সংগ্রাম। ফলে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে ১৫২৮ সালের ৩০ জানুয়ারি তাকে জীবন দিতে হলো।
রানা সংগ্রাম সিংহের মৃত্যুর পর তার জ্যেষ্ঠ পুত্র রতন সিংহ বসেন মেবারের সিংহাসনে। ১৫৩১ সালে কোনো এক যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি মারা যান। তার মৃত্যুর পর মেবারের ক্ষমতায় আসেন বিক্রমাদিত্য সিংহ। ১৫৩৭ সালে তিনিও বনবীর সিংহ নামে সংগ্রাম সিংহের কোনো এক পুত্রের হাতে নিহত হন।
বনবীর, সংগ্রাম সিংহের আরেক জীবিত পুত্র উদয় সিংহকে হত্যা করতে চাইলে তাকে গোপন স্থানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। প্রায় ৩ বছর পর মেবারের অভিজাতেরা কুম্বলগড়ে তার অভিষেক সম্পন্ন করেন। বনবীরকে পরাজিত করে পরবর্তীকালে তিনি চিতোরে ফিরে এসেছিলেন।
এদিকে যখন উদয় সিংহ মেবারের রানা হিসেবে স্বীকৃতি পেলেন, মুঘলদের তখন ভাগ্য বিপর্যয়ের সময় চলছিল। একে একে চৌসা আর কনৌজে শের শাহের কাছে পরাজয়ের পর সম্রাট বাবরের পুত্র হুমায়ুন তখন রাজ্যছাড়া। হিন্দুস্তানের মসনদে নতুন সম্রাট শের শাহ সুরি।
দুর্ধর্ষ এই সম্রাটের প্রচণ্ড ক্ষমতার সামনে রাজপুতরা মাথা উচু করে দাঁড়াতেই পারলেন না, লড়াই তো দূরের কথা! তবে ১৫৪৫ সালের ২২ মে কালিঞ্জরে একটি দুর্ঘটনায় শের শাহ সুরি মৃত্যুবরণ করলে পরবর্তী কয়েক বছরের মাঝেই সুরিরা গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। এই সুযোগে উদয় সিংহ রাজপুতদের হারানো শক্তির অনেকটাই পুনরোদ্ধার করে ফেলেন।
৫
এদিকে ঘটনা অনেকদূর গড়িয়েছে। সম্রাট হুমায়ুন দীর্ঘ ৫ বছর পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছেন- আজ এ জায়গায় তো কাল অন্য জায়গায়। কেউ দয়া করে সম্রাটকে সাহায্য করতো, তো কেউ আপদ মনে করে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতো।
সম্রাট অবশ্য শুরুতে হাল না ছাড়লেও শেষের দিকে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। পারস্যের মধ্য দিয়ে মক্কায় চলে যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে পারস্যের দরবারে যান। তবে যার ভাগ্যই হলো শাসক হওয়া, তার এত সহজে দমে গেলে চলবে!
পারস্যের শাহের সামরিক সহায়তা নিয়ে ১৫৪৫ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি দখল করেন কান্দাহার। এরপরে একে কাবুল ও এর আশেপাশের এলাকা দখল করে শক্তিবৃদ্ধি করতে থাকেন। নিজের হারানো মসনদ ফিরে পেতে অবশ্য আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হলো সম্রাটকে।
গৃহযুদ্ধে আফগানরা দুর্বল হয়ে যাওয়ার পর তিনি হানলেন মোক্ষম আঘাতটি। মাছিওয়ারা আর সিরহিন্দে আফগানদের পরাজিত করে ১৫৫৫ সালের ২৩ জুলাই দ্বিতীয়বারের মতো মসনদ অধিকার করলেন সম্রাট হুমায়ুন।
রাজনৈতিক এই বিশৃঙ্খলায় রাজপুতরা মোটামুটি নির্ঝঞ্ঝাট সময় কাটাচ্ছিল। যদিও তাদের পুরনো সেই সুসময় আর কখনোই ফিরে আসেনি। এদিকে ১৫৫৬ সালের ২৬ জানুয়ারি সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে ইন্তেকাল করলেন সম্রাট হুমায়ুন।
১৭ দিন পর সম্রাটের মৃত্যুর খবর জনসম্মুখে আনা হলো। সম্রাটের উত্তরাধিকারী ১৩ বছর বয়স্ক বালক আকবর তখন ছিলেন পাঞ্জাবের কালানৌরে। তড়িঘড়ি করে সেখানেই তাকে মুঘল সাম্রাজ্যের সম্রাট হিসেবে অভিষেক করানো হলো।
শাসনের শুরুতে বেশ বড় বড় কয়েকটি হোঁচট খেলেও সম্রাট আকবর ঘুরে দাঁড়ালেন, কঠোর বাস্তবতার মুখে দাঁড়িয়ে সাম্রাজ্য পরিচালনা শিখে ফেললেন। একটা সময়ে এসে তিনি অনুধাবন করলেন সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির বহু ভাষা, বহু সংস্কৃতির এই হিন্দুস্তান শাসন করতে হলে তাকে স্থানীয় রাজ্যগুলোর সাথে সদ্ভাব গড়ে তোলাটাই উচিত। তাতে দু’পক্ষই লাভবান হবে।
৬
আকবর মূলত এমন এক পদ্ধতিতে হিন্দুস্তান শাসন করতে চাইছিলেন, যা এর আগে আর কোনো মুসলিম শাসক চেষ্টা করেননি। মুসলিমদের পাশাপাশি হিন্দুদেরও সমর্থন নিয়ে তিনি হিন্দুস্তানে স্থিতিশীলতা আনতে চাইছিলেন।
হিন্দুদের প্রতি নিজের বিশ্বস্ততা প্রমাণ করতে মুসলিম রাজ্যগুলোর বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করলেও, মৈত্রী চুক্তিতে আসলে হিন্দু রাজ্যগুলোকে সরাসরি দখলে না নিয়ে অনেকটা স্বাধীনভাবেই শাসিত হতে দিয়েছিলেন।
নিজের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আকবর চারটি নীতির উপর অটল থেকেছিলেন।
এক, পারস্পরিক বিবাদমান রাজ্যগুলোর মাঝে শান্তি স্থাপন করা।
দুই, মুঘল সাম্রাজ্যের সর্বত্র ন্যায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত করা। কারণ, ন্যায়বিচার না থাকলে একটি রাষ্ট্র কখনোই স্থায়ী ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারে না।
তিন, ধর্মীয় সহনশীলতা আর হিন্দুস্তানের বহু সংস্কৃতির মাঝে সমন্বয় করা।
চার, মুঘল সাম্রাজ্যের অনুকূলে শক্তিশালী একটি পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করা।
আকবরের এই নীতিতে আকৃষ্ট হলেন রাজপুতগণ। অন্যান্য মুসলিম শাসকদের চেয়ে আকবরকে তাদের কাছে কিছুটা উদার মনে হলো। অন্যদিকে আকবরও রাজপুতদের সাথে মিত্রতা চাইতেন।
আকবর বিশ্বাস করতেন, হিন্দুস্তানের স্থিতিশীলতা চাইলে শত্রুতা ত্যাগ করে হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মের মানুষকে মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ করা উচিত। বিশেষভাবে রাজপুতদের সততা, সামরিক দক্ষতা, আভিজাত্য, বিশ্বাসযোগ্যতা আর তাদের প্রভুভক্তি আকবরের দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছিল।
আকবরের রাজপুত নীতিতে বেশ কয়েকজন রাজপুত রাজা সন্তুষ্ট হয়ে আকবরের আনুগত্য স্বীকার করে নেন। এর মাঝে আম্বার, বিকানির, জয়সালমির, মারাবারের সাথে মুঘলদের বৈবাহিক সম্পর্কও স্থাপিত হয়। একই সাথে হিন্দুদের বিশ্বস্ততা অর্জন করতে জিজিয়া আর তীর্থযাত্রা কর বাতিল করেন। অনেক হিন্দু মতাবলম্বীকে প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর উচ্চপদগুলোতে যাওয়ার সুযোগ করে দেন।
তবে সমস্যা বাঁধে অন্য জায়গায়। মুঘল সাম্রাজ্যের মুসলিম পরিচয়ে ঘৃণা প্রকাশ করে কথিত ‘ভিনদেশি’ শক্তির হাত থেকে দেশের ‘স্বাধীনতা’ রক্ষায় সামরিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে বেশ কয়েকটি রাজপুত রাজ্য। মেবার ছিল এদের মাঝে অন্যতম।
মেবারের এই প্রতিরোধ সামান্য কিছুটা সাফল্য পেলেও দেখা যাবে অনেক রাজপুত রাজ্যই আবারও বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসবে। কাজেই ফলাফল দাঁড়াল, যে লড়াইটি সম্রাট বাবরকে লড়তে হয়েছিল, সেই একই লড়াইটি এখন লড়তে হবে আকবরকেও!
৭
সম্রাট আকবর নিজ হাতে ক্ষমতা নিয়েই সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি গ্রহণ করেছিলেন। সময়টা যখন ‘হয় মারো, নয়তো মরো’ নীতিতে চলছিল, তখন এছাড়া আর উপায়ও ছিল না।
সাম্রাজ্যবিস্তার নীতির আলোকে সম্রাট শুরুতে বিভিন্ন সময়ে হাতছাড়া হয়ে যাওয়া মুঘল ভূখণ্ডগুলো উদ্ধারের চেষ্টা চালাতে লাগলেন। স্বাভাবিকভাবেই এই তালিকায় গুজরাট ছিল। আরব সাগরের উপকূল জুড়ে বিস্তৃত গুজরাট মুঘল সাম্রাজ্যের বহির্বাণিজ্য ও হজ্বযাত্রার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল ছিল।
গুজরাট অধিকার করা ও রাজপুতানায় নিজের নিয়ন্ত্রণ রাখার ক্ষেত্রে প্রধান বাধাও ছিল এই মেবার। কাজেই ১৫৬৮ সালের শুরুর দিকে চিতোর দখল করে নেন। মেবারের রানা দ্বিতীয় উদয় সিংহ দুর্গে আক্রমণের পূর্বেই অনুগত দুই সেনাপতির হাতে দুর্গ রক্ষার দায়িত্ব ন্যস্ত করে গোগুন্দায় পালিয়ে যান।
১৫৬৮ সালের চিতোর দখলের পরপরই আকবর অভিযান চালান রাজপুতদের আরেক দুর্ভেদ্য দুর্গ রণথম্বোরে। পরের বছরের মার্চ মাস নাগাদ রণথম্বোর মুঘল সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
চিতোর আর রণথম্বোরের পতনের পর বিকানির, বুন্দেলখন্ড আর জয়সালমিরসহ অন্যান্য যেসব রাজপুত রাজা মুঘল আনুগত্য স্বীকারে ইতস্তত বোধ করছিলেন তারাও আনুগত্য স্বীকার করলেন। মুঘল আনুগত্য স্বীকার করলেন না কেবল মেবারের রাজা।
এদিকে ১৫৭২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষের মারা যান দ্বিতীয় উদয় সিংহ। মৃত্যুর পূর্বে প্রিয় স্ত্রী ধীর বাঈ-এর প্ররোচনায় জগমল সিংহকে মেবারের উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করে যান।
কিন্তু মেবারের রীতি অনুযায়ী রাজার মৃত্যুর পর বড় ছেলেই তার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার কথা। সেই হিসাবে অভিজাতেরা জগমল সিংহকে বাদ দিয়ে উদয় সিংহের জ্যেষ্ঠ পুত্র প্রতাপ সিংকে ক্ষমতায় বসান।
৩২ বছরে বয়সে মেবারের সিংহাসন পেয়ে প্রতাপ সিংহও তার পূর্বপুরুষের দেখানো পথেই হাঁটলেন। অন্যান্য রাজপুত রাজারা যেখানে নামমাত্র আনুগত্য স্বীকার করে মুঘলদের সাথে সব ঝামেলা মিটিয়ে রাজ্য শাসন করে যাচ্ছিলেন, প্রতাপ সিংহ তখন হাঁটলেন অন্য রাস্তায়।
৮
প্রতাপ সিংহ ক্ষমতাপ্রাপ্তির পর আকবর বেশ কয়েকবার কূটনৈতিক চ্যানেলে তার সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু প্রতাপ সিংহ কোনো শর্তেই আকবরের আনুগত্য স্বীকার না করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি প্রাথমিকভাবে জানালেন, আকবরের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কোনো ইচ্ছা তার নেই। তবে তিনি আকবরের আনুগত্য স্বীকার করতে পারবেন না।
অবশ্য শুধু এটুকু হলেই আকবর আশ্বস্ত হতে পারতেন। কিন্তু প্রতাপ সিংহ সবসময়ই মুঘলদের সাথে রাজপুতদের মিত্রতার সমালোচনা করতেন। তিনি রাজপুতদের হারিয়ে যাওয়া গৌরব ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখতেন। রাজপুতদের জন্য তা স্বাভাবিক স্বপ্ন হলেও তাতে আকবরের চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল।
রাজনৈতিকভাবে যখন কোনো সমস্যার সমাধান হয় না, তখন শক্তি পরীক্ষার জন্য তা গড়ায় যুদ্ধের মাঠে। এক্ষেত্রেও তা-ই হলো। তবে যুদ্ধের আগে শেষবারের মতো আকবর মানসিংহের পিতা ভগবন্ত দাসের নেতৃত্বে আরেকটি কূটনৈতিক মিশন পাঠান। এই মিশনটিও ব্যর্থ হলো।
পরবর্তী কয়েক বছরে এই দুই শক্তির মানসিক দূরত্ব বেড়েই চলল। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল, একটি যুদ্ধ আসন্ন!
[এই সিরিজের পূর্বে প্রকাশিত পর্বটি পড়ুন এখানে। সিরিজের সবগুলো লেখা পড়তে চাইলে ক্লিক করুন এখানে।]