[১ম পর্ব পড়ুন]
১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই মিত্রশক্তি ও কেন্দ্রীয় শক্তির মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়, এবং মিত্রশক্তির সদস্য রাশিয়ার বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় শক্তির সদস্য জার্মানি ও অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি যুদ্ধ ঘোষণা করে। বর্তমান ইউক্রেনের ভূখণ্ড (যেটি সেসময় রুশ–নিয়ন্ত্রিত ‘ক্ষুদ্র রাশিয়া’ এবং অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় নিয়ন্ত্রণাধীন ‘পশ্চিম ইউক্রেনে’ বিভক্ত ছিল) এই যুদ্ধের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও রক্তক্ষয়ী রণাঙ্গনে পরিণত হয়। রাশিয়া ও অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরিতে পুরুষদের জন্য সশস্ত্রবাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামূলক ছিল, সুতরাং উভয় রাষ্ট্রের সশস্ত্রবাহিনীতেই বিপুল সংখ্যক ‘ইউক্রেনীয়’ (অর্থাৎ ইউক্রেন থেকে আগত) সৈন্য ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে অন্তত ৩৫ লক্ষ ‘ইউক্রেনীয়’ সৈন্য রুশ সশস্ত্রবাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করে, এবং অন্তত আড়াই লক্ষ ‘ইউক্রেনীয়’ সৈন্য অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় সশস্ত্রবাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করে।
উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী বছরগুলোতে বর্তমান ইউক্রেনের ভূখণ্ডে (বিশেষত পশ্চিম ইউক্রেনে) ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা বিস্তার লাভ করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেসময় ইউক্রেন কেবল একটি ভৌগোলিক অঞ্চলের নাম ছিল, এবং ‘ইউক্রেনীয়’ বলতে কেবল জাতিগত ইউক্রেনীয়দেরকে নয়, বরং ইউক্রেন অঞ্চলে বসবাসরত সকল জাতিসত্তার মানুষকেই বোঝানো হতো। অর্থাৎ, এসময় ‘ইউক্রেনীয়’ শব্দটি জাতীয় পরিচিতি নির্দেশ করত না, কেবল আঞ্চলিক পরিচিতি নির্দেশ করত। বস্তুত তখন পর্যন্ত রুশ–নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেনের সিংহভাগ জনসাধারণ এবং অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় নিয়ন্ত্রণাধীন পশ্চিম ইউক্রেনের জনসাধারণের বৃহদাংশ নিজেদেরকে ‘ইউক্রেনীয়’ জাতিভুক্ত নয়, বরং রুশ জাতির অন্তর্ভুক্ত হিসেবে বিবেচনা করত।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ইউক্রেন সম্পর্কে রাশিয়া, অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি ও জার্মানি প্রত্যেকের নিজস্ব পরিকল্পনা ছিল। রাশিয়ার উদ্দেশ্য ছিল অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় নিয়ন্ত্রণাধীন পশ্চিম ইউক্রেন দখল করে সেটিকে রুশ–নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেনের সঙ্গে যুক্ত করা এবং এর মধ্য দিয়ে ‘প্রাচীন রুশ’ রাষ্ট্রের ভূখণ্ডগুলোর একত্রীকরণ সম্পন্ন করা। অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির উদ্দেশ্য ছিল রুশ–নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেনের সম্পূর্ণ অংশ বা অংশবিশেষ দখল করে নিজস্ব রাষ্ট্রসীমা সম্প্রসারিত করা। জার্মানির উদ্দেশ্য ছিল ‘রাশিয়ার শস্যভাণ্ডার’ হিসেবে পরিচিত রুশ–নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেন দখল করে সেটিকে একটি জার্মান উপনিবেশে পরিণত করা এবং জার্মানির খাদ্য ও ভূমি সঙ্কটের সমাধান করা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইউক্রেন: রাশিয়া, অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি ও জার্মানির শক্তি পরীক্ষা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর ১৯১৪ সালে রাশিয়া গালিৎসিয়ার যুদ্ধে অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরিকে পরাজিত করে এবং এর ফলে অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় নিয়ন্ত্রণাধীন পশ্চিম ইউক্রেনের বৃহদাংশ রাশিয়ার হস্তগত হয়। কিন্তু ১৯১৫ সালে গরলিৎসে–তারনভ আক্রমণাভিযানে জার্মানি ও অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির নিকট রাশিয়া পরাজিত হয় এবং রুশ সৈন্যরা পশ্চিম ইউক্রেন থেকে পশ্চাৎপসরণে বাধ্য হয়। ১৯১৬ সালে ব্রুসিলভ আক্রমণাভিযানে রাশিয়া জার্মানি ও অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরিকে পরাজিত করে এবং আবার পশ্চিম ইউক্রেনের অংশবিশেষ দখল করে নেয়। কিন্তু ১৯১৭ সালের মার্চে রাশিয়ায় সংঘটিত একটি বিপ্লব/অভ্যুত্থানের ফলে রোমানভ রাজবংশ ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং একটি ‘অস্থায়ী সরকার’ রাশিয়ার শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়।
একই সময়ে রুশ–নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেনে ‘ইউক্রেনীয় কেন্দ্রীয় পরিষদ’ বা ‘উক্রাইনস্কা ৎসেন্ত্রালনা রাদা’ (ইউক্রেনীয়: Українська Центральна Рада) গঠিত হয় এবং ১৯১৭ সালের এপ্রিল নাগাদ উক্ত প্রতিষ্ঠানটি রুশ–নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেনের প্রকৃত শাসকে পরিণত হয়। ১৯১৭ সালের জুনে ৎসেন্ত্রালনা রাদা রাশিয়ার অভ্যন্তরে ইউক্রেনকে একটি স্বায়ত্তশাসিত ভূখণ্ড হিসেবে ঘোষণা করে। এদিকে রুশ ‘অস্থায়ী সরকারে’র গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে রুশ সশস্ত্রবাহিনীতে তীব্র বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং এর ফলে ১৯১৭ সালের জুলাইয়ে কেরেনস্কি আক্রমণাভিযানে জার্মানি ও অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির নিকট রাশিয়া পরাজিত হয়। ফলশ্রুতিতে রুশ সৈন্যরা পশ্চিম ইউক্রেন থেকে বিতাড়িত হয় এবং জার্মান ও অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় সৈন্যরা রুশ–নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেনে প্রবেশ করে।
স্বাধীন ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রের সৃষ্টি: বলশেভিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং কেন্দ্রীয় শক্তির দখলদারিত্ব
১৯১৭ সালের নভেম্বরে রাশিয়ায় সংঘটিত আরেকটি বিপ্লব/অভ্যুত্থানের ফলে রুশ ‘অস্থায়ী সরকার’ ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং বলশেভিকরা (‘রুশ সামাজিক–গণতন্ত্রী শ্রম দল’–এর উগ্রপন্থী শাখা) রাশিয়ার শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। বলশেভিকদের উত্থানের ফলে রাশিয়ায় বিরাজমান রাজনৈতিক সঙ্কট পূর্ণ গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। বলশেভিকদের উত্থানের পরপরই ৎসেন্ত্রালনা রাদা ইউক্রেনকে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী ইউক্রেন’ (ইউক্রেনীয়: Українська Народня Республіка, ‘উক্রাইনস্কা নারোদনিয়া রেসপুবলিকা’) নামে রাশিয়ার অধীনস্থ একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু তারা বলশেভিক সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করেনি এবং এর ফলে শীঘ্রই বলশেভিক–নিয়ন্ত্রিত রাশিয়া ও ‘গণপ্রজাতন্ত্রী ইউক্রেনে’র মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সশস্ত্র সংঘাত আরম্ভ হয়। অন্যদিকে, বলশেভিক–শাসিত রাশিয়া ও ‘গণপ্রজাতন্ত্রী ইউক্রেন’ উভয়েই পৃথকভাবে কেন্দ্রীয় শক্তির সঙ্গে সাময়িক যুদ্ধবিরতি স্থাপন করে এবং শান্তি আলোচনায় লিপ্ত হয়। একই সময়ে মিত্রশক্তির সদস্য ফ্রান্স ইউক্রেনে আক্রমণ চালায় এবং সেখানে বলশেভিক–নিয়ন্ত্রিত রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
এদিকে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের পর ১৯১৭ সালের ডিসেম্বরে বলশেভিক–নিয়ন্ত্রিত রাশিয়া ‘গণপ্রজাতন্ত্রী ইউক্রেন’–এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এর এক সপ্তাহের মধ্যে খারকভে (বর্তমান ইউক্রেনের খারকিভ শহর) ইউক্রেনীয় বলশেভিকরা বলশেভিক–নিয়ন্ত্রিত রাশিয়ার সমর্থনে ‘সোভিয়েত গণপ্রজাতন্ত্রী ইউক্রেন’ (রুশ: Украинская Народная Республика Советов, ‘উক্রাইনস্কায়া নারোদনায়া রেসপুবলিকা সোভিয়েতভ’; ইউক্রেনীয়: Українська Народна Республіка Рад, ‘উক্রাইনস্কা নারোদনা রেসপুবলিকা রাদ’) নামক একটি বলশেভিক রাষ্ট্র স্থাপন করে এবং ১৯১৮ সালের জানুয়ারিতে উক্ত রাষ্ট্রটিও ‘গণপ্রজাতন্ত্রী ইউক্রেন’–এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এরপর ‘গণপ্রজাতন্ত্রী ইউক্রেন’ আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে।
১৯১৮ সালের ফেব্রুয়ারি নাগাদ বলশেভিক–নিয়ন্ত্রিত রাশিয়া ও সোভিয়েত গণপ্রজাতন্ত্রী ইউক্রেনের সৈন্যরা গণপ্রজাতন্ত্রী ইউক্রেনের বৃহদাংশ দখল করে নেয় এবং গণপ্রজাতন্ত্রী ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভও তাদের হস্তগত হয়। এমতাবস্থায় ‘গণপ্রজাতন্ত্রী ইউক্রেন’–এর সরকার ঝিতোমিরের দিকে পশ্চাৎপসরণ করে এবং কেন্দ্রীয় শক্তির সঙ্গে পৃথকভাবে ‘ব্রেস্ত–লিতোভস্ক চুক্তি’তে স্বাক্ষর করে। এই চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী ইউক্রেন কার্যত কেন্দ্রীয় শক্তির একটি ‘আশ্রিত রাষ্ট্রে’ পরিণত হয় এবং তারা বলশেভিক–নিয়ন্ত্রিত রাশিয়া ও সোভিয়েত গণপ্রজাতন্ত্রী ইউক্রেনের সৈন্যদের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করার জন্য কেন্দ্রীয় শক্তির সহায়তা প্রার্থনা করে। এদিকে বলশেভিক–নিয়ন্ত্রিত রাশিয়া শান্তি স্থাপনের জন্য কেন্দ্রীয় শক্তির প্রদত্ত শর্তাবলি প্রত্যাখ্যান করেছিল, ফলে তাদেরকে উক্ত শর্তাবলি গ্রহণে বাধ্য করার জন্য জার্মানি ও অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি ১৯১৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার ওপর আক্রমণ চালায় এবং এই ‘১১ দিনের যুদ্ধে‘ বলশেভিক–নিয়ন্ত্রিত রাশিয়া সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয়।
পরাজিত বলশেভিক–নিয়ন্ত্রিত রাশিয়া কেন্দ্রীয় শক্তির সঙ্গে ১৯১৮ সালের ৩ মার্চ ‘ব্রেস্ত–লিতোভস্ক চুক্তি’তে স্বাক্ষর করে এবং উক্ত চুক্তির শর্তানুযায়ী বলশেভিক–শাসিত রাশিয়া গণপ্রজাতন্ত্রী ইউক্রেনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করতে বাধ্য হয়। কিন্তু এই চুক্তিতে বলশেভিক–নিয়ন্ত্রিত রাশিয়া ও গণপ্রজাতন্ত্রী ইউক্রেনের মধ্যবর্তী সীমান্ত নির্ধারণ করা হয়নি। ফলে ইউক্রেনীয় বলশেভিকদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূখণ্ড যাতে হাতছাড়া না হয় সেজন্য বলশেভিক–নিয়ন্ত্রিত রাশিয়ার ইঙ্গিতে ইউক্রেনের ভূখণ্ডে স্থাপিত অন্যান্য বলশেভিক প্রজাতন্ত্রগুলো সোভিয়েত গণপ্রজাতন্ত্রী ইউক্রেনের সঙ্গে অঙ্গীভূত হয় এবং সোভিয়েত গণপ্রজাতন্ত্রী ইউক্রেন স্বাধীনতা ঘোষণা করে। কিন্তু ১৯১৮ সালের এপ্রিল নাগাদ জার্মানি, অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি ও কেন্দ্রীয় শক্তি–নিয়ন্ত্রিত গণপ্রজাতন্ত্রী ইউক্রেনের সম্মিলিত সৈন্যদল সোভিয়েত গণপ্রজাতন্ত্রী ইউক্রেন দখল করে নেয় এবং রাষ্ট্রটির বিলুপ্তি ঘটায়।
১৯১৮ সালের ২৮ এপ্রিল জার্মান ও অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় সৈন্যদের দ্বারা সমর্থিত একটি অভ্যুত্থানের ফলে ৎসেন্ত্রালনা রাদা ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং ২৯ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী ইউক্রেনের নাম পরিবর্তন করে ‘ইউক্রেনীয় রাষ্ট্র’ (ইউক্রেনীয়: Українська Держава, ‘উক্রাইনস্কা দেরঝাভা’) রাখা হয়। ‘হেৎমান’–শাসিত একনায়কতান্ত্রিক ইউক্রেনীয় রাষ্ট্র ছিল মূলত কেন্দ্রীয় শক্তির একটি আশ্রিত রাষ্ট্র। রাষ্ট্রটিতে ব্যাপক অরাজকতা দেখা দেয় ও অন্তর্ঘাতমূলক কার্যক্রম পরিচালিত হতে থাকে। এদিকে এসময় অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির নিয়ন্ত্রণাধীন জাতিগত সংখ্যালঘুরা ক্রমশ ভিয়েনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে শুরু করে এবং রাষ্ট্রটি ভেঙে পড়তে শুরু করে। ১৯১৮ সালের ১ নভেম্বর ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদীরা পশ্চিম ইউক্রেনে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী পশ্চিম ইউক্রেন’ (ইউক্রেনীয়: Західно-Українська Народна Республіка, ‘জাহিদনো–উক্রাইনস্কা নারোদনা রেসপুবলিকা’) নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে, কিন্তু একই দিনে পোলিশ জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ শুরু হয়।
১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর নাগাদ কেন্দ্রীয় শক্তি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হয়। এ সময় কার্যত দুটি স্বাধীন ইউক্রেন ছিল — প্রাক্তন রুশ–নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেনভিত্তিক ‘ইউক্রেনীয় রাষ্ট্র’ এবং প্রাক্তন অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় নিয়ন্ত্রণাধীন পশ্চিম ইউক্রেনভিত্তিক ‘গণপ্রজাতন্ত্রী পশ্চিম ইউক্রেন’। কিন্তু প্রথম রাষ্ট্রটি কার্যত কেন্দ্রীয় শক্তির আশ্রিত রাষ্ট্র ছিল এবং বিশ্বযুদ্ধে কেন্দ্রীয় শক্তির পরাজয় সেটির অবস্থানকে ব্যাপকভাবে দুর্বল করে ফেলে। বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর কেন্দ্রীয় শক্তি ‘ইউক্রেনীয় রাষ্ট্র’ থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে শুরু করে। অন্যদিকে, দ্বিতীয় রাষ্ট্রটি শুরু থেকেই পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল এবং পার্শ্ববর্তী পোল্যান্ড, রুমানিয়া ও চেকোস্লোভাকিয়া রাষ্ট্রটির দাবিকৃত ভূখণ্ডের অংশবিশেষ দখল করে নেয়।
ইউক্রেনে বহুমুখী যুদ্ধ এবং পশ্চিম ইউক্রেনের বিভাজন
১৯১৮ সালের ১৩ নভেম্বর সোভিয়েত রাশিয়া ব্রেস্ত–লিতোভস্ক চুক্তিকে বাতিল ঘোষণা করে এবং এর মধ্য দিয়ে ইউক্রেনে পুনরায় সোভিয়েত হস্তক্ষেপের পথ উন্মুক্ত হয়ে যায়। ১৬ নভেম্বর ‘গণপ্রজাতন্ত্রী ইউক্রেন’–এর ‘ডিরেক্টরি’ (বিলুপ্ত গণপ্রজাতন্ত্রী ইউক্রেনের ‘ৎসেন্ত্রালনা রাদা’র নতুন সংস্করণ) ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। ২৮ নভেম্বর সোভিয়েত রাশিয়ার সমর্থনে ইউক্রেনীয় বলশেভিকরা কুরস্কে (বর্তমান রাশিয়ার একটি শহর) ‘ইউক্রেনের শ্রমিক ও কৃষকদের অস্থায়ী সরকার’ প্রতিষ্ঠা করে এবং তাদের সৈন্যদের সঙ্গে ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রের সংঘর্ষ শুরু হয়। ১৪ ডিসেম্বর নাগাদ ডিরেক্টরির সৈন্যরা কিয়েভ দখল করে ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রের পতন ঘটায় এবং ‘গণপ্রজাতন্ত্রী ইউক্রেন’ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে, কিন্তু বলশেভিকদের সঙ্গে তাদের সংঘাত অব্যাহত থাকে।
১৯১৯ সালের ১৬ জানুয়ারি গণপ্রজাতন্ত্রী ইউক্রেন সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ২২ জানুয়ারি গণপ্রজাতন্ত্রী ইউক্রেন ও গণপ্রজাতন্ত্রী পশ্চিম ইউক্রেন পরস্পরের সঙ্গে একত্রিত হয়, কিন্তু পশ্চিম ইউক্রেন ‘গণপ্রজাতন্ত্রী ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ’ নাম ধারণ করে বহুলাংশে স্বায়ত্তশাসিত থেকে যায়। এসময় গণপ্রজাতন্ত্রী ইউক্রেন সোভিয়েত রাশিয়া ও সোভিয়েত রুশ–সমর্থিত ইউক্রেনীয় সোভিয়েত সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, আর পশ্চিম ইউক্রেন পোল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়া ও রুমানিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ছিল। ১৯১৯ সালের ফেব্রুয়ারি নাগাদ বলশেভিকরা কিয়েভ দখল করে নেয় এবং ১০ মার্চ ইউক্রেনীয় বলশেভিকরা ‘ইউক্রেনীয় সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র’ (রুশ: Украинская Социалистическая Советская Республика, ‘উক্রাইনস্কায়া সোৎসিয়ালিস্তিচেস্কাউয়া সোভিয়েতস্কায়া রেসপুবলিকা’; ইউক্রেনীয়: Українська Соціалістична Радянська Республіка, ‘উক্রাইনস্কা সোৎসিয়ালিস্তিচনা রাদিয়ানস্কা রেসপুবলিকা’) নামক একটি স্বাধীন বলশেভিক রাষ্ট্র গঠন করে।
১৯১৯ সালের মার্চ নাগাদ প্রাক্তন রুশ–নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেনের ভূখণ্ডের ক্ষুদ্র একটি অংশ গণপ্রজাতন্ত্রী ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল, এবং বাকি অংশ সোভিয়েত ইউক্রেনের কর্তৃত্বাধীনে চলে গিয়েছিল। এমতাবস্থায় ১৯১৯ সালের এপ্রিল নাগাদ ফ্রান্সও ইউক্রেন থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। অন্যদিকে, ১৯১৯ সালের জুলাই নাগাদ প্রাক্তন অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় নিয়ন্ত্রণাধীন পশ্চিম ইউক্রেনের সম্পূর্ণ অংশ পোল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়া ও রুমানিয়ার দখলদারিত্বের অধীনে চলে যায় এবং ১৯১৯ সালের শেষভাগ নাগাদ ‘গণপ্রজাতন্ত্রী ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশে’র আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তি ঘটে।
এদিকে ১৯১৯ সালের মাঝামাঝি নাগাদ মিত্রশক্তি–সমর্থিত ‘শ্বেত ফৌজ’ প্রাক্তন রুশ–নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেনে আক্রমণ চালায় এবং ১৯১৯ সালের নভেম্বর নাগাদ উক্ত রাষ্ট্রদ্বয় কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত প্রায় সমস্ত ভূখণ্ড দখল করে নেয়। কিন্তু ১৯১৯ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত রাশিয়া ও সোভিয়েত ইউক্রেন পূর্ণ মাত্রায় পাল্টা আক্রমণ চালায় এবং ১৯২০ সালের ফেব্রুয়ারি নাগাদ শ্বেত ফৌজ ইউক্রেন থেকে পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হয়। এই পর্যায়ে এসে প্রাক্তন রুশ–নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেনের প্রায় সম্পূর্ণ অংশ সোভিয়েত ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণাধীনে চলে আসে। অন্যদিকে, গণপ্রজাতন্ত্রী ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে কোনো ভূখণ্ড ছিল না এবং ১৯২০ সাল নাগাদ রাষ্ট্রটির সরকার কার্যত পোল্যান্ডের ‘আশ্রিত সরকারে’ পরিণত হয়।
পোলিশ–সোভিয়েত যুদ্ধ এবং সোভিয়েত ইউক্রেনের বিভাজন
বিভিন্ন কারণে ১৯১৯ সালের শুরু থেকেই সোভিয়েত রাশিয়া ও তাদের মিত্র রাষ্ট্রগুলো সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। ১৯২০ সালের এপ্রিলে পোল্যান্ড সোভিয়েত ইউক্রেনের ওপর আক্রমণ চালায় এবং মে মাস নাগাদ কিয়েভ দখল করে নেয়, কিন্তু সোভিয়েত প্রতি–আক্রমণের ফলে তারা কিয়েভ থেকে পশ্চাৎপসরণে বাধ্য হয় এবং পশ্চিম ইউক্রেনে অবস্থান গ্রহণ করে। কিন্তু অন্যান্য রণাঙ্গনে সোভিয়েত রাশিয়া ও তাদের মিত্ররা পোলিশদের হাতে পর্যুদস্ত হয় এবং অবশেষে ১৯২১ সালের ১৮ মার্চ সম্পাদিত ‘রিগা শান্তিচুক্তি’র মধ্য দিয়ে পোলিশ–সোভিয়েত যুদ্ধের অবসান ঘটে। এই চুক্তির মধ্যে দিয়ে সোভিয়েত ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলের অংশবিশেষ পোল্যান্ডের হস্তগত হয়।
এর মধ্য দিয়ে বর্তমান ইউক্রেনের ভূখণ্ডে তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর থেকে পোলিশ–সোভিয়েত যুদ্ধের অবসান পর্যন্ত বর্তমান ইউক্রেনের ভূখণ্ড একটি বৃহৎ রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল এবং বলশেভিকদের উত্থানের পর উক্ত ভূখণ্ডে ব্যাপক অরাজকতা দেখা দিয়েছিল। এসময় বিভিন্ন পক্ষের সৈন্যরা ইউক্রেনের ভূখণ্ডে একে অপরের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত সংঘর্ষে লিপ্ত হয় এবং যুদ্ধের পাশাপাশি ইউক্রেন জুড়ে ব্যাপক রাজনৈতিক নিষ্পেষণ, জাতিগত নিধন, ধর্মভিত্তিক দাঙ্গা ও গণহত্যা পরিচালিত হয়। পোলিশ–সোভিয়েত যুদ্ধের সমাপ্তির পর ইউক্রেনের ভূখণ্ডে অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয় বটে, কিন্তু পূর্ববর্তী বছরগুলোর ঘটনাবলি সেখানকার জনসাধারণের মধ্যে গভীর প্রভাব রেখে যায়।
এই পর্যায়ে এসে বর্তমান ইউক্রেনের ভূখণ্ড কার্যত ৪টি রাষ্ট্রের মধ্যে বিভক্ত ছিল। সোভিয়েত ইউক্রেন ছিল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এবং প্রাক্তন রুশ–নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেনের বৃহদাংশ সোভিয়েত ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে এটি ‘পূর্ব ইউক্রেন’ নামে পরিচিত ছিল। অন্যদিকে, প্রাক্তন অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় নিয়ন্ত্রণাধীন পশ্চিম ইউক্রেনের বৃহদাংশ (প্রধানত গালিৎসিয়া) এবং প্রাক্তন রুশ–নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেনের পশ্চিমাংশের অংশবিশেষ (প্রধানত ভোলিন) পোল্যান্ডের অন্তর্ভুক্ত হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে পোলিশ–নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড ‘পশ্চিম ইউক্রেন’ নামে পরিচিত ছিল। তদুপরি, প্রাক্তন অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় নিয়ন্ত্রণাধীন ইউক্রেনীয়–অধ্যুষিত উত্তর বুকোভিনা রুমানিয়ার হস্তগত হয় এবং ট্রান্সকার্পেথিয়া (ইংরেজি: Transcarpathia) বা জাকারপাত্তিয়া (ইউক্রেনীয়: Закарпаття) তদানীন্তন চেকোস্লোভাকিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়।
সোভিয়েত ইউক্রেন: কোরেনিজাৎসিয়া, ইউক্রেনীয়করণ এবং পূর্বদিকে ইউক্রেনের ভৌগোলিক সম্প্রসারণ
১৯২২ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়নে যোগদান করে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি ইউনিয়ন প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। বলশেভিকরা সোভিয়েত ইউনিয়নের জাতিগত সংখ্যালঘু–অধ্যুষিত প্রজাতন্ত্রগুলোতে ‘স্থানীয়করণ’ (রুশ: коренизация, ‘কোরেনিজাৎসিয়া’) নীতির প্রবর্তন করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা ও মার্ক্সবাদ–লেনিনবাদের প্রবর্তক ভ্লাদিমির লেনিন বিশ্বাস করতেন যে, প্রতিটি জাতির নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশ লাভের সুযোগ এবং সমঅধিকার থাকা উচিত। তদুপরি, সোভিয়েত ইউনিয়নের সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি রুশরা যেন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যান্য জাতির ওপর জাতিগত, ভাষাগত, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক বা অন্য কোনো প্রকার আধিপত্য বিস্তার করতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করাও ছিল লেনিনের অন্যতম লক্ষ্য। এই আদর্শিক চিন্তাধারা থেকেই ‘স্থানীয়করণ’ নীতির উৎপত্তি।
স্থানীয়করণ নীতির সারমর্ম ছিল: সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিটি জাতিকে তাদের নিজস্ব ভূখণ্ডে সর্বোচ্চ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব প্রদান করা হবে; প্রতিটি জাতির নিজস্ব স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে প্রশাসনসহ অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে উক্ত জাতির মানুষদের অগ্রাধিকার প্রদান করা হবে; প্রতিটি জাতির নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে এবং কোনো সংখ্যালঘু জাতির সদস্যরা যেন সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতির (অর্থাৎ রুশ জাতির) সঙ্গে পুরোপুরি অঙ্গীভূত হয়ে না যায়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। কেবল তা-ই নয়, লেনিনের নীতি অনুসারে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিটি ইউনিয়ন প্রজাতন্ত্রকে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণার অধিকার প্রদান করা হয় এবং উক্ত অধিকারকে সোভিয়েত সংবিধানে স্পষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
অবশ্য কার্যত সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিটি ইউনিয়ন প্রজাতন্ত্রে স্থানীয় বলশেভিকরা/কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল এবং ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিস্ট পার্টি’র মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। সুতরাং কার্যত ইউনিয়ন প্রজাতন্ত্রগুলো সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাইবে, এরকম সম্ভাবনা সেসময় ছিল না। তদুপরি, কমিউনিস্ট তাত্ত্বিকদের বিশ্বাস ছিল, প্রজাতন্ত্রগুলোর ‘মেহনতি জনসাধারণ’ (অর্থাৎ শ্রমিক, কৃষক ও অন্যান্য শ্রমজীবী শ্রেণি) কমিউনিজমের সুফল পেতে শুরু করলে তাদের মধ্যে কখনো বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তাধারার উন্মেষ ঘটবে না।
সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যান্য প্রজাতন্ত্রের মতো সোভিয়েত ইউক্রেনেও স্থানীয় বলশেভিকরা ‘স্থানীয়করণ’ নীতিকে অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে প্রয়োগ করে এবং সোভিয়েত ইউক্রেনকে ‘ইউক্রেনীয়করণ’ (Ukrainization) করার প্রক্রিয়া শুরু করে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সোভিয়েত ইউক্রেনের প্রশাসন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ইউক্রেনীয়দের অগ্রাধিকার প্রদান শুরু হয়, শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রায় সম্পূর্ণরূপে ইউক্রেনীয়কৃত করা হয় (অর্থাৎ, সর্বস্তরে ইউক্রেনীয় ভাষায় শিক্ষাদান কার্যক্রম প্রবর্তিত হয় এবং সোভিয়েত ইউক্রেনে বসবাসকারী সকল শিক্ষার্থীর জন্য ইউক্রেনীয় ভাষা শেখা বাধ্যতামূলক করা হয়) এবং ইউক্রেনীয় সংস্কৃতির বিকাশের জন্য বিস্তৃত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। কেবল তাই নয়, রুশ ও ইউক্রেনীয়রা একই জাতির অংশ, কেউ এরকম মতবাদ প্রচার করলে সোভিয়েত সরকার তাদেরকে ‘বৃহৎ রুশ উগ্র জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা’ পোষণের দায়ে অভিযুক্ত করতে শুরু করে।
কেবল তা-ই নয়, সোভিয়েত কেন্দ্রীয় সরকার ১৯২০–এর দশকে দনেৎস্ক, লুহানস্ক, খেরসন, মিকোলাইভ, ওদেসা প্রভৃতি অঞ্চলকে সোভিয়েত ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত করে। এই অঞ্চলগুলো ঐতিহাসিকভাবে প্রাক্তন রুশ–নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেনের অংশ ছিল না, বরং ‘নতুন রাশিয়া’ বা ‘নভোরোসিয়া’ (রুশ: Новороссия) নামক আরেকটি ঐতিহাসিক অঞ্চলের অংশ ছিল এবং বর্তমান দক্ষিণ রাশিয়ার অঞ্চলগুলোর সঙ্গে অধিকতর সম্পৃক্ত ছিল। কিন্তু সোভিয়েত কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন কারণে এই অঞ্চলগুলোকে সোভিয়েত রাশিয়ার কাছ থেকে সোভিয়েত ইউক্রেনের কাছে হস্তান্তর করে। সেসময় এই সিদ্ধান্তের সেরকম কোনো বিরূপ প্রভাব লক্ষ করা যায়নি, কারণ কার্যত সোভিয়েত রাশিয়া ও সোভিয়েত ইউক্রেন উভয়ে একই রাষ্ট্রের অংশ ছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়া ও ইউক্রেন দুইটি পৃথক রাষ্ট্রে পরিণত হয় এবং এর ফলে উক্ত অঞ্চলগুলো নিয়ে রাষ্ট্র দুটির মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়।
সামগ্রিকভাবে, সোভিয়েত ইউক্রেনের ভূখণ্ড দীর্ঘদিন পোলিশ–লিথুয়ানীয় শাসনের অধীনে থাকায় সেখানকার রুশদের মধ্যে রুশ জাতির অন্যান্য অংশের তুলনায় একটি স্বতন্ত্র সত্তা গড়ে উঠেছিল, কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত সেই স্বতন্ত্র সত্তা পূর্ণাঙ্গ জাতীয় পরিচিতিতে রূপান্তরিত হয়নি। ১৯১৭ সালে রুশ সাম্রাজ্যের পতন এবং বর্তমান ইউক্রেনের ভূখণ্ডে সংঘটিত রক্তাক্ত রাজনৈতিক পরিবর্তন এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। পরবর্তী সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক গৃহীত ‘স্থানীয়করণ’ নীতির ফলে এই প্রক্রিয়া পরিপূর্ণ রূপ লাভ করে এবং সোভিয়েত ইউক্রেনে ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদ ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করে।
সোভিয়েত ইউক্রেনে দুর্ভিক্ষ এবং শুদ্ধি অভিযান
১৯৩০–এর দশক নাগাদ সোভিয়েত ইউনিয়নে ব্যাপক শিল্পায়ন এবং কৃষিব্যবস্থার ‘যৌথীকরণ’ (collectivization) আরম্ভ হয়। ‘যৌথীকরণ’ প্রক্রিয়ার লক্ষ্য ছিল কৃষকদের ভূমির ব্যক্তিগত মালিকানা রদ করে সেগুলোকে সমন্বিত করে বৃহদাকৃতির ‘যৌথ খামার’ এবং ‘রাষ্ট্র–নিয়ন্ত্রিত খামারে’র সৃষ্টি করা। সোভিয়েত কেন্দ্রীয় সরকারের ধারণা ছিল, এর ফলে খাদ্য ও অন্যান্য কৃষিপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন জুড়ে (সোভিয়েত ইউক্রেন–সহ) কৃষকদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ যৌথীকরণের বিরোধিতা করে এবং তীব্রভাবে এর প্রতিরোধ করতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে সোভিয়েত সরকার কর্তৃক বলপূর্বক যৌথীকরণের প্রচেষ্টা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অন্যান্য কারণে ১৯৩০–১৯৩৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন জুড়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এই দুর্ভিক্ষের ফলে মৃত ব্যক্তির প্রকৃত সংখ্যা কখনো হিসেব করা হয়নি, কিন্তু বর্তমানে প্রচলিত তথ্য অনুসারে, উক্ত দুর্ভিক্ষের ফলে সমগ্র সোভিয়েত ইউনিয়নে ৩৫ লক্ষ থেকে ৮০ লক্ষ লোকের মৃত্যু হয়।
উক্ত দুর্ভিক্ষ ইউক্রেনেও আঘাত হানে এবং ইউক্রেনের অন্তত ১০ লক্ষ থেকে ৩০ লক্ষ অধিবাসী এই দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারায়। অবশ্য ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদীদের দাবি অনুসারে, এই দুর্ভিক্ষের ফলে ৬০ লক্ষ থেকে ১ কোটি ইউক্রেনীয় প্রাণ হারিয়েছিল। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, উক্ত দুর্ভিক্ষ চলাকালে কেউ দুর্ভিক্ষের ভুক্তভোগীর সংখ্যা গণনা করেনি, এজন্য উক্ত দুর্ভিক্ষের প্রকৃত ভুক্তভোগীর সংখ্যা কখনোই সঠিকভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। এজন্য উক্ত দুর্ভিক্ষে মৃতের যেসব সংখ্যা প্রচারিত হয়েছে, সবই অনুমাননির্ভর এবং কোনোটিই পুরোপুরিভাবে নির্ভরযোগ্য নয়। স্বাভাবিকভাবেই, সোভিয়েত সরকারের সমর্থকরা উক্ত দুর্ভিক্ষে মৃত ব্যক্তির সংখ্যা কমিয়ে দেখিয়েছে। অন্যদিকে, সোভিয়েত সরকারের বিরোধীরা এবং ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদীরা এই সংখ্যাকে অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দেখিয়েছে।
তদুপরি, ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদীরা ও সোভিয়েতবিরোধীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দাবি করে যে, সোভিয়েত সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে ইউক্রেনীয় জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে কৃত্রিমভাবে এই দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি করেছিল এবং এজন্য এই দুর্ভিক্ষকে ইউক্রেনীয় জাতির বিরুদ্ধে পরিচালিত ‘গণহত্যা’ (genocide) হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। কিন্তু কার্যত এই দুর্ভিক্ষে ইউক্রেনীয়দের পাশাপাশি রুশ, বেলারুশীয়, কাজাখ ও অন্যান্য জাতিরও লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল, সুতরাং এই দুর্ভিক্ষকে ইউক্রেনীয় জাতির বিরুদ্ধে পূর্বপরিকল্পিত গণহত্যা হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না। তদুপরি, যে ‘যৌথীকরণ’ নীতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে উক্ত দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়েছিল, সেই নীতির প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে ইউক্রেনীয় জাতির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নিজেরাও জড়িত ছিল।
কিন্তু এই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ এবং দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় সোভিয়েত সরকারের প্রাথমিক ব্যর্থতা যে ইউক্রেনীয় জনসাধারণের একাংশের মধ্যে তীব্র সোভিয়েতবিরোধী মনোভাবের সৃষ্টি করেছিল, সেটি বলাই বাহুল্য। তদুপরি, ১৯৩৭–৩৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন জুড়ে একটি রক্তক্ষয়ী শুদ্ধি অভিযান আরম্ভ হয়, যার ফলে অন্তত ৮ লক্ষ মানুষ নিহত হয়। স্বাভাবিকভাবেই সোভিয়েত ইউক্রেনেও এই শুদ্ধি অভিযানের আঁচ লাগে এবং হাজার হাজার ইউক্রেনীয় ‘গণশত্রু’ (enemy of the people) হিসেবে অভিযুক্ত হয়ে প্রাণ হারায়। ইউক্রেনীয় জনমানসের ওপর উক্ত দুর্ভিক্ষ এবং শুদ্ধি অভিযানের ফলাফল ও প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।
পোলিশ ইউক্রেন: পোলীয়করণের প্রচেষ্টা এবং ‘ওইউএনে’র সৃষ্টি
পোল্যান্ডের শাসনাধীন পশ্চিম ইউক্রেনের মূলত দুটি অংশ ছিল — গালিৎসিয়া এবং ভোলিন। গালিৎসিয়া ইতিপূর্বে অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির অধীনে ছিল, সেখানকার ‘ইউক্রেনীয়’দের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ ছিল গ্রিক ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মের অনুসারী এবং সেখানে অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের ফলে ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদের বিস্তার ঘটেছিল। অন্যদিকে, ভোলিন ইতিপূর্বে রাশিয়ার অধীনে ছিল, সেখানকার ইউক্রেনীয়দের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ ছিল অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্মের অনুসারী এবং সেখানে তখনো ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদ তেমন বিস্তৃতি লাভ করেনি। এমতাবস্থায় পোল্যান্ডের জাতীয়তাবাদী সরকার গালিৎসিয়া ও ভোলিনের ইউক্রেনীয়দের পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে, ইউক্রেনীয় ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদকে কঠোরভাবে দমন করে এবং তাদেরকে কোনো ধরনের স্বায়ত্তশাসন প্রদান থেকে বিরত থাকে। তদুপরি, তারা ইউক্রেনীয়দের জোরপূর্বক ‘পোলীয়করণ’ (Polonization) করার, অর্থাৎ তাদের ওপর পোলিশ ভাষা ও সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়ার, চেষ্টা করে এবং অর্থোডক্স ইউক্রেনীয়দের ওপর জোরপূর্বক রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্ম চাপিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা চালায়, কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা বহুলাংশে ব্যর্থ হয়।
পোলিশ সরকারের কার্যক্রমের প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিম ইউক্রেনে, বিশেষত গালিৎসিয়ায়, ইউক্রেনীয়দের মধ্যে উগ্র জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯২৯ সালে সেখানে ‘ওইউএন’ (OUN) বা ‘ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদীদের সংগঠন’ (ইউক্রেনীয়: Організація Українських Націоналістів, ‘অর্হানিজাৎসিয়া উক্রায়নস্কিখ নাৎসিওনালিস্তিভ’) নামক একটি উগ্র ডানপন্থী, জাতীয়তাবাদী ও বর্ণবাদী একটি সংগঠনের সৃষ্টি হয় এবং তারা পোল্যান্ড, সোভিয়েত ইউনিয়ন, রুমানিয়া ও চেকোস্লোভাকিয়াকে নিজেদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে। ১৯৩০–এর দশক জুড়ে তারা পোল্যান্ডে বিস্তৃত সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম পরিচালনা করে।
রুমানীয়, চেকোস্লোভাক ও হাঙ্গেরীয় শাসনাধীন ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড
রুমানিয়ার শাসনাধীন বুকোভিনা ইতিপূর্বে অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির অধীনস্থ ছিল। বুকোভিনার দক্ষিণাংশে জাতিগত রুমানীয়রা এবং উত্তরাংশে জাতিগত ইউক্রেনীয়রা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। রুমানীয় সরকার উত্তর বুকোভিনায় ইউক্রেনীয় ভাষা ও সংস্কৃতিকে কঠোরভাবে দমন করে, ইউক্রেনীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেয় এবং ইউক্রেনীয়দের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন বাতিল করে দেয়। তদুপরি, তারা উত্তর বুকোভিনার ইউক্রেনীয়দের বলপূর্বক ‘রুমানীয়করণে’র (Romanianization) প্রচেষ্টা চালায়।
অন্যদিকে, চেকোস্লোভাকিয়ার শাসনাধীন জাকারপাত্তিয়ায় জাতিগত ইউক্রেনীয়রা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। চেকোস্লোভাক সরকার সাধারণভাবে জাকারপাত্তিয়াকে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন প্রদান থেকে বিরত ছিল, কিন্তু পোল্যান্ড বা রুমানিয়ার মতো তারা সেখানকার অধিবাসীদের জোরপূর্বক অঙ্গীভূতকরণের প্রচেষ্টা করেনি। জাকারপাত্তিয়ার রাজনৈতিক শ্রেণি প্রধানত তিন ভাগে বিভক্ত ছিল। তাদের একাংশ নিজেদেরকে বৃহত্তর রুশ জাতির অংশ হিসেবে বিবেচনা করত, আরেক অংশ নিজেদেরকে ইউক্রেনীয় জাতির অংশ হিসেবে বিবেচনা করত এবং অপর একটি অংশ স্থানীয় ও স্বতন্ত্র একটি জাতিসত্তার বিস্তার ঘটাতে আগ্রহী ছিল।
১৯৩৮ সালে জার্মানি, ইতালি, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে সম্পাদিত ‘মিউনিখ চুক্তি’র ফলে চেকোস্লোভাকিয়া জার্মান–অধ্যুষিত সুডেটেনল্যান্ড বা সুদেতি অঞ্চল জার্মানির নিকট হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৩৮ সালের অক্টোবরে জাকারপাত্তিয়া স্বায়ত্তশাসন লাভ করে, কিন্তু ১৯৩৮ সালের নভেম্বরে সম্পাদিত ভিয়েনা চুক্তি অনুযায়ী জাকারপাত্তিয়ার রাজধানী উঝহরোদসহ অঞ্চলটির অংশবিশেষ হাঙ্গেরির হস্তগত হয়। ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বরে জাকারপাত্তিয়াকে ‘কার্পেথিয়ান ইউক্রেন’ বা ‘কার্পাৎস্কা উক্রাইনা’ (ইউক্রেনীয়: Карпа́тська Украї́на) নামকরণ করা হয়। ১৯৩৯ সালের মার্চে জার্মান কূটকৌশলের ফলে স্লোভাকিয়া চেকোস্লোভাকিয়া থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং জার্মানি বিনা যুদ্ধে চেকোস্লোভাকিয়ার অবশিষ্টাংশ দখল করে নেয়। এমতাবস্থায় ‘কার্পেথিয়ান ইউক্রেন’ও চেকোস্লোভাকিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে, কিন্তু হাঙ্গেরি সদ্য গঠিত রাষ্ট্রটির ওপর আক্রমণ চালায় এবং একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর রাষ্ট্রটিকে দখল করে নেয়। তারা উক্ত ভূখণ্ডটিকে ‘হাঙ্গেরীয়করণে’র (Hungarianization) প্রচেষ্টা শুরু করে।
অবশ্য শীঘ্রই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যায় এবং ইউক্রেন আবারো একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও ইউক্রেন সংক্রান্ত সকল সমীকরণকে স্থায়ীভাবে পাল্টে দেয়।