১ জুন, ২০০১। নেপালের কাঠমুন্ডুতে অবস্থিত রাজপ্রাসাদে চলছিল রাজপরিবারের সদস্যদের পুনর্মিলনী পার্টি। পার্টিতে উপস্থিত ছিলেন নেপালের রাজা বীরেন্দ্র, রানী ঐশ্বরিয়াসহ রাজ পরিবারের বিশ জনের মতো সদস্য। প্রায় প্রতি মাসেই রাজপরিবারের সদস্যদের পুনর্মিলনী পার্টি হয়। রাজা, রানী সহ রাজপুত্র, রাজকন্যা, রাজার ভাই, তাদের ছেলেমেয়েসহ অনেকেই উপস্থিত থাকেন সেসব পার্টিতে। কিন্তু নতুন শতাব্দীর জুন মাসের প্রথম দিনের পার্টিটি পরিণত হয়েছিল রক্তের বন্যায়। আর রক্তের বন্যা যার হাত ধরে বয়েছিল তিনি বাইরের কেউ ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন রাজা বীরেন্দ্রর বড় ছেলে ক্রাউন প্রিন্স দীপেন্দ্র!
পার্টির শুরু থেকেই দীপেন্দ্র অতিরিক্ত মদ পান শুরু করেন। মদের পাশাপাশি সিগারেটের সাথে হাসিসও নেয়া শুরু করেন পার্টিতে থাকা অবস্থাতেই। ফলে দ্রুতই মাতাল হয়ে অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে দেন দীপেন্দ্র। অবস্থা বেগতিক হতে যাচ্ছে দেখে দীপেন্দ্রর ভাই নিরঞ্জন ও চাচাতো ভাই পরশ তাকে রাজপ্রাসাদের নিজের ঘরে রেখে আসে। এরপর সবাই নিজেদের মতো করে পার্টি উপভোগ করতে থাকে। প্রায় ঘন্টাখানেক পর তারা আবারো দীপেন্দ্রকে পার্টিতে দেখতে পায়। তবে এবার ভিন্ন রূপে, আর্মি ফ্যাটিগ পরিহিত ও হাতে অস্ত্র!
কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই দীপেন্দ্র সরাসরি চলে যান তার বাবা রাজা বীরেন্দ্রর কাছে। কোনো কথা ছাড়াই SPAS-12 শটগান দিয়ে গুলি করেন রাজাকে। হঠাৎ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে হতভম্ব হয়ে পড়েন উপস্থিত সবাই। কাউকে কিছু বলার কিংবা করার সুযোগ না দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসেন দীপেন্দ্র। বুকে গুলি লাগলেও রাজা তখনও জীবিতই ছিলেন। তাঁকে সাহায্যের জন্য ছুটে আসে সবাই। দীপেন্দ্রকে আটকানোর কথা কারো মাথাতেই আসেনি সে মুহুর্তে। আর সবাই হয়তো ভেবেছিল একমাত্র রাজাই ছিল দীপেন্দ্রর শিকার, সেটি যে কারণেই হোক না কেন।
কিন্তু সবাইকে ভুল প্রমাণ করতেই আবারো ঘরে প্রবেশ করে দীপেন্দ্র, এবার হাতে আরো ভয়ানক মারণাস্ত্র, এম-১৬ অটোমেটিক রাইফেল। মেঝেতে পড়ে থাকা আহত বাবাকে আবারো গুলি করতে গেলে দীপেন্দ্রকে বাঁধা দেন চাচা ধীরেন্দ্র। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে এম-১৬ দিয়ে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে দীপেন্দ্র। চাচাকে হত্যার পর শুরু হয় দীপেন্দ্রর নির্বিচার গুলি চালানো। দীপেন্দ্রর পরের শিকার হয় প্রিন্সেস শারাদার স্বামী কুমার খাদজা। স্বামীকে গুলি করতে দেখে ছুটে যান প্রিন্সেস শারাদা, যিনি ছিলেন দীপেন্দ্রর পরবর্তী শিকার। একাধিক গুলির আঘাতে সাথে সাথেই মারা যান তিনি।
দীপেন্দ্রর পরবর্তী শিকার তার ছোট বোন শ্রুতির স্বামী কুমার গোরাখা। মেঝেতে কাতরাতে থাকা স্বামীর দিকে ছুটে গেলে শ্রুতিকে গুলি করেন দীপেন্দ্র। আহত স্বামীর উপরে পড়ে থাকে ভাইয়ের গুলিতে নিহত প্রিন্সেস শ্রুতির লাশ। দীপেন্দ্রর হত্যাকাণ্ড হয়তো তার বোনের মাধ্যমেই শেষ হতো। কিন্তু আহত রাজা মেঝেতে পড়ে থাকা একটি অস্ত্র তুলে ছেলেকে গুলি করতে গেলে রাজার বোন শোভা শাহী তার ভাইকে আটকান ও রাজার কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নেন। তিনি ভেবেছিলেন দীপেন্দ্রর হত্যাকাণ্ড শেষ হয়েছে, আর রক্ত বন্যার কোনো মানে হয় না। কিন্তু সেটি বাস্তবে হীতে বিপরীতে হয়ে যায়। ফুপুর কাছে অস্ত্র দেখে নয়টি গুলি করেন দীপেন্দ্র। তবে ভাগ্যক্রমে সেই ভয়ংকর রাত্রির বিভীষিকা থেকে বেঁচে যান তিনি।
দীপেন্দ্রর আক্রোশের শিকার হতে থাকে তার চাচা, ফুপু, ভাই, বোন সবাই। ঘর থেকে বের হবার পর আগে দীপেন্দ্র মুখোমুখি হন চাচাতো ভাই পরশের। তার দিকে অস্ত্র তাক করলেও একপর্যায়ে কোনো কথা না বলে ঘর থেকে বের যান দীপেন্দ্র। তার পেছন পেছন যান দীপেন্দ্রর মা রানী ঐশ্বরিয়া ও ছোট ভাই নিরঞ্জন। তারা দুজন আরো কয়েকজনসহ পাশের কক্ষে লুকিয়ে ছিলেন। ঘর ছেড়ে যাবার আগে দীপেন্দ্র মেঝে কিংবা সোফায় পড়ে থাকা দেহগুলো মৃত কিনা নিশ্চিত হবার জন্য পা দিয়ে লাথি মেরে নিশ্চিত হয়েছিল। তবে গুলিতে আহত হয়ে অজ্ঞান অনেককেই মৃত মনে করায় সে রাতে বেঁচে যান বেশ কজন।
রানী ঐশ্বরিয়া ও প্রিন্স নিরঞ্জন দীপেন্দ্রর পেছন পেছন গিয়েছিলেন তাঁকে থামানোর জন্য। কিন্তু দীপেন্দ্রর আক্রোশের হাত থেকে বাঁচেনি তার ছোট ভাই আর মা-ও। প্রথমে ভাইয়ের বুকে একাধিক গুলি চালিয়ে প্রাসাদের বাগানে হত্যা করেন দীপেন্দ্র। পরবর্তীতে রানী যখন দীপেন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করেন তার উদ্দেশ্য কি তখন কোনো কথা না বলেই তাঁর উপরেও গুলি চালিয়ে দেন দীপেন্দ্র। রাজপ্রাসাদের ভয়ংকর সেই রাতে দীপেন্দ্রর শেষ শিকার ছিল তাঁর মা। তবে শেষ গুলিটি চালিয়েছিলেন নিজের উপরেই। নিজেকেই গুলি করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন তিনি। তবে মাথার বাম দিকে গুলি লাগার পরেও বেঁচে ছিলেন। এর মধ্যে রাজা বীরেন্দ্র মারা গেলে দীপেন্দ্রকেই রাজা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু দীপেন্দ্রর রাজত্ব ছিল মাত্র তিন দিনের, হাসপাতালে কোমায়।
রাজপ্রাসাদ ক্রাউন প্রিন্সের এই হত্যাকাণ্ড নেপালসহ পুরো বিশ্বকেই অবাক করে দেয়। রাজা হিসেবে বীরেন্দ্র জনগণের বেশ পছন্দের ছিল। ক্রাউন প্রিন্স দীপেন্দ্র নিজেও জনগণের পছন্দের ছিল। কিন্তু এই হত্যাকান্ডের পর রাজা হওয়া জ্ঞানেন্দ্র মোটেও জনগণের পছন্দের কেউ ছিল না। সেই সাথে পরিবারের প্রায় সব সদস্য উপস্থিত থাকলেও সেই রাতে প্রাসাদের জ্ঞানেন্দ্রর অনুপস্থিতি ও জ্ঞানেন্দ্রর স্ত্রী বা সন্তানের কারোরই নিহত না হওয়া প্রশ্ন তোলে হাজারটা। তবে জ্ঞানেন্দ্রর দিকে আঙ্গুল তোলার আগে একটু পেছনে ফিরে দেখা যাক দীপেন্দ্রর জীবনের ইতিহাস।
১৯৭১ সালে জন্ম নেয়া দীপেন্দ্রর পড়াশোনা শুরু হয় নেপালেই। পরবর্তীতে ইংল্যান্ডের ইটন কলেজ থেকে পড়াশোনা করেন তিনি। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে নেপালের ত্রিভূবন বিশ্ববিদ্যালয় ও নেপালের সামরিক অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণ নেন তিনি। ত্রিভূবন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোলে মাস্টার্স ও পিএইচডি করেন তিনি। সামরিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি সিভিল এভিয়েশন থেকে বিমান চালনার প্রশিক্ষণও নেন। সামরিক একাডেমিতেই তিনি অস্ত্র চালনায় নিজের পারদর্শীতা দেখান। আর অস্ত্রের প্রতি তার বেশ আগ্রহও ছিল। প্রায়ই রাতে প্রাসাদে পাখি মারার জন্য বের হতেন বন্দুক নিয়ে। এ কারণেই সে রাতে তিনি যখন অস্ত্র নিয়ে বের হয়েছিলেন তখন নিরাপত্তাকর্মী কিংবা প্রাসাদের অন্য কেউ সন্দেহ করেনি তাঁকে।
এ ঘটনার বেশ আগে থেকেই গুজব ছিল দীপেন্দ্রর বিয়ে নিয়ে পরিবারের সাথে তার ঝামেলা চলছিল। দীপেন্দ্রর সাথে দেভয়ানি রানার বেশ কয়েক বছর ধরেই সম্পর্ক ছিল। কিন্তু তাদের দুই পরিবারের সম্পর্ক বেশ আগে থেকেই খারাপ ছিল। এছাড়াও দেভয়ানি ছিল ভারতের এক রাজ পরিবারের সদস্য। এসব কারণে দীপেন্দ্রর পরিবারের কেউই তাদের বিয়ের ব্যাপারে রাজি ছিল না। বিশেষ করে দীপেন্দ্রর মা রানী ঐশ্বরিয়া ও দীপেন্দ্রর বোনেরা এই বিয়ের বিপক্ষে ছিল। এ ব্যাপারে ভাই-বোনদের সাথে দীপেন্দ্রর একবার বেশ বড় ঝগড়াও হয়েছিল। কাউকে রাজি করাতে না পেরে রাগে গিয়ে দীপেন্দ্র সবাইকে খুন করার হুমকি দিয়েছিল। কিন্তু সেই হুমকিকে রাগের মাথায় বলা কথা হিসেবেই নিয়েছিল সবাই। সে রাতে দীপেন্দ্র সেই রাগেই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল কি না সেটা নিশ্চিতভাবে বলা না গেলেও পরিবারের সদস্যদের উপর তার রাগ ছিল সেটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
প্রশ্ন উঠতে পারে গোলাগুলি শুরু হবার পরেও কেন প্রাসাদের নিরাপত্তাকর্মীরা কিছু করেনি। যেহেতু দীপেন্দ্র রাতে শিকার করত তাই তার সাথে অস্ত্র দেখে কেউ সন্দেহ করেনি, তেমনি প্রথমদিকে গুলির আওয়াজেও কেউ সন্দেহ করেনি। এমনকি যে ঘরে হত্যাকাণ্ড হয়েছিল তার পাশের ঘরে যারা ছিলেন তারাও ভেবেছিলেন দীপেন্দ্র বাইরে শিকার করছে! কিন্তু গুলির ধরণ আর প্রাসাদ থেকে আসা চিৎকারে নিরাপত্তাকর্মীরা বুঝতে পারেন কিছু একটা গন্ডগোল আছে। গন্ডগোলটা কী সেটা বুঝে উঠে কোনো অ্যাকশন নেবার আগেই দীপেন্দ্র সব শেষ করে দেয়।
তবে পুরো হত্যাকাণ্ড ও এর কারণ নিয়ে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ওঠে দুটি। প্রথমত রাজা বীরেন্দ্রর ভাই জ্ঞানেন্দ্রর সেদিন পার্টিতে অনুপস্থিত থাকা। জ্ঞানেন্দ্রর রাজ সিংহাসনে বসার একটি মাত্র উপায় ছিল। রাজা বীরেন্দ্র ও তার দুই ছেলে দীপেন্দ্র ও নিরঞ্জনের মৃত্যু। সেদিন দীপেন্দ্র বাবা, ভাইদের সাথে বোন ও তাদের স্বামীদেরও হত্যা করার চেষ্টা করে। সবাইকে হত্যা করতে না পারলেও অন্তত আহত করে। কিন্তু জ্ঞানেন্দ্র নিজে ছিলেন অনুপস্থিত, তার স্ত্রীর হাতে গুলি লাগলেও অন্যদের তুলনায় তার আঘাত ছিল খুবই সামান্য। এমনকি জ্ঞানেন্দ্রর ছেলে পরশ কোনো প্রকার আঘাত ছাড়াই বেঁচে যান! জ্ঞানেন্দ্র ও পরশ দুজনই জনগণের কাছে খুব একটা জনপ্রিয় ছিলেন না। ফলে দীপেন্দ্রকে মাদক দিয়ে পুরো পরিবারকে হত্যা করিয়ে নিয়েছে এমন প্রশ্ন ওঠাটা খুবই স্বাভাবিক ছিল। অনেকে দাবী করে জ্ঞানেন্দ্র এ কাজ করেছে ভারতের র কিংবা আমেরিকার সিআইএর সহায়তায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত জ্ঞানেন্দ্রর বিরুদ্ধে সব কিছুই দাবী হিসেবেই রয়ে গিয়েছে, কোনোটাই প্রমাণ করা সম্ভব হয় নি।
দ্বিতীয় প্রশ্ন ওঠে সে রাতের ঘটনা ধামাচাপা দিতে রাজ পরিবারের আগ্রহ। প্রথমত রাজপ্রাসাদ থেকে জানানো হয় পুরো ঘটনা ঘটেছে ‘দুর্ঘটনাক্রমে একটি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের কারণে’! এটি মূলত ছিল দীপেন্দ্রকে বাঁচানোর একটি প্রচেষ্টা। নেপালের তখনকার সংবিধান অনুযায়ী রাজপরিবারের কাউকে হত্যাকান্ডের দায়ে দোষী করা যাবে না! কিন্তু জনগণের চাপের মুখে তদন্ত করতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ এবং দীপেন্দ্রকেই দায়ী করা হয়। কিন্তু সে তদন্তেও রয়ে গিয়েছে ফাঁক।
দীপেন্দ্র আত্মহত্যা করেছে দাবী করা হলে দীপেন্দ্রর মাথার খুলিতে পাওয়া গিয়েছিল দুইটি গুলি। সব থেকে বড় কথা দীপেন্দ্র ডান হাতি হওয়া সত্ত্বেও গুলি দুইটি ছিল তার মাথার বাম দিকে। এক জন ডানহাতি বাম হাত দিয়ে গুলি করবে এমনটা খুবই অস্বাভাবিক। কিন্তু এ ব্যাপারে কখনোই পরিপূর্ণ তদন্ত হয় নি। এমনকি দীপেন্দ্রর মৃতদেহের কোনো প্রকার ফরেনসিক পরীক্ষাও করানো হয়নি। ফলে অনেক কিছুই ধোঁয়াশার মধ্যেই থেকে গেছে। সেদিন পার্টিতে উপস্থিত থাকা রাজা বীরেন্দ্রর বোন বলেন, দীপেন্দ্র শুরুতে মাতালের অভিনয় করেছিল। কারণ তাকে যখন বের করে নিয়ে যাওয়া হয় তখন তার যে অবস্থা ছিল তাতে এক ঘন্টা পর ফিরে এসে ঠান্ডা মাথায় হত্যাকাণ্ড চালানো সম্ভব ছিল না।
মধ্যযুগে রাজপরিবারের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করত সিংহাসনের লড়াই নিয়ে। মুঘল আমলে বাবা-ছেলে, ভাই-ভাই যুদ্ধ নিয়মিত হয়েছে। কিন্তু এক বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই একজন ক্রাউন প্রিন্স স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে বাবা- ভাই, বোনদের হত্যা করেছে শুধুমাত্র সিংহাসনের জন্য এটি একটু বেশিই অস্বাভাবিক। প্রায় দেড় যুগ পার হয়ে গেলেও এখনও রয়ে গিয়েছে অসংখ্য প্রশ্ন। কিন্তু সেসব প্রশ্নের উত্তর যিনি দিতে পারতেন তিনিই আর বেঁচে নেই। অসংখ্য অজানার মাঝেও নেপালের রাজপ্রাসাদের সেদিনের হত্যাকান্ডের কারণও হয়ত চিরদিনই অজানাই থেকে যাবে।
ফিচার ইমেজ- Pinterest
তথ্যসূত্র
১. Zero Hour, Season 3 Episode 3