‘জাস্তাভা, রাইট ড্রেস! জাস্তাভা, রেডি! আইজ ফ্রন্ট! ১২ নম্বর জাস্তাভার জীবিত সৈনিকরা আপনাদের সামনে উপস্থিত!’ ১৯৯৩ সালের ১৩ জুলাই তাজিকিস্তান–আফগানিস্তান সীমান্তে তাজিক মিলিট্যান্টদের সঙ্গে রক্তাক্ত যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর যখন রুশ সীমান্তরক্ষীদের জন্য সহায়তাকারী একটি বাহিনী এসে পৌঁছায়, তখন যুদ্ধটিতে বেঁচে যাওয়া সৈনিকরা ঠিক এভাবেই তাদের অভিবাদন জানায়।
১৯৯১ সালে প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত ৫টি মুসলিম–অধ্যুষিত প্রাক্তন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়। এই রাষ্ট্রগুলো হলো– কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান এবং তুর্কমেনিস্তান। এই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে তাজিকিস্তান ছিল আয়তনের দিক থেকে ক্ষুদ্রতম এবং অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে পশ্চাৎপদ। স্বাধীনতা লাভের পরপরই রাষ্ট্রটিতে একটি রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, যেটি ১৯৯২ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
সোভিয়েত শাসনামলে তাজিকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রজাতন্ত্রটির বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে সমানভাবে বণ্টিত ছিল না। সোভিয়েত তাজিকিস্তানের শাসকশ্রেণির সিংহভাগ সদস্য আসত প্রজাতন্ত্রটির খুজান্দ (প্রাক্তন লেনিনাবাদ) অঞ্চল থেকে। আর প্রজাতন্ত্রটির অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তারক্ষী বাহিনীর সদস্যদের অধিকাংশ আসত কুলোব অঞ্চল থেকে। তাজিকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পরও সোভিয়েত আমলের খুজান্দ ও কুলোবভিত্তিক ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ এবং ‘কমিউনিস্ট’ ভাবধারার অনুসারী অভিজাতশ্রেণিই রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল।
কিন্তু তাজিকিস্তানের গার্ম ও গর্নো–বাদাখশান অঞ্চলের অধিবাসীরা এবং তাজিকিস্তানি সরকারের অন্যান্য বিরোধীরা এই ব্যবস্থার প্রতিবাদ জানায় এবং সেটি ১৯৯২ সালে রূপ নেয় একটি রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে। ১৯৯৩ সালে তাজিকিস্তানের সরকারবিরোধী দলগুলো ‘সম্মিলিত তাজিক বিরোধীদল’ (Оппозицияи муттаҳидаи тоҷик) নামে একটি জোট গঠন করে এবং তাজিকিস্তানের ‘খুজান্দি–কুলোবি’–নিয়ন্ত্রিত সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখে। এই জোটটিতে একদিকে যেমন ইসলামপন্থী, গণতন্ত্রকামী এবং তাজিক জাতীয়তাবাদীরা অন্তর্ভুক্ত ছিল, তেমনই গার্ম ও গর্নো–বাদাখশানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিদাররাও এই জোটে যোগদান করেছিল। এই জোটের যোদ্ধারা নিজেদের ‘মুজাহিদিন’ হিসেবে অভিহিত করত, কিন্তু তাদের প্রতিপক্ষ তাদেরকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ (terrorist) বা ‘দস্যু’ (bandit) নামে অভিহিত করত। এই লেখায় এই যোদ্ধাদের ‘মিলিট্যান্ট’ (militant) হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ‘মিলিট্যান্ট’ শব্দটির অর্থ ‘যে ব্যক্তি নিজ মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সহিংসতা অবলম্বন করে’। এক্ষেত্রে, যে কোনো রাজনৈতিক মতবাদের অনুসারী (ধর্মনিরপেক্ষ, ইসলামপন্থী, হিন্দুত্ববাদী বা অন্যান্য) তার মতবাদ প্রতিষ্ঠায় সহিংস পন্থা অবলম্বন করলে তাকে ‘মিলিট্যান্ট’ হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে।
‘সম্মিলিত তাজিক বিরোধীদলে’ ইসলামপন্থীদের বেশ প্রভাব ছিল এবং এজন্য পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র আফগানিস্তান ও আফগানিস্তানের বিভিন্ন ইসলামপন্থী দল তাজিক মিলিট্যান্টদের নানাভাবে সহায়তা প্রদান করছিল। অন্যদিকে, রাশিয়া, উজবেকিস্তান, কিরগিজস্তান ও কাজাখস্তান সমর্থন প্রদান করছিল তাজিকিস্তানি সরকারকে। এসব রাষ্ট্রের সরকারগুলোর আশঙ্কা ছিল যে, তাজিকিস্তানে ইসলামপন্থী সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে এই রাষ্ট্রগুলোর ইসলামপন্থী মিলিট্যান্টরা তাজিকিস্তানকে একটি ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করবে এবং আফগানিস্তান থেকে তাজিকিস্তানের মধ্য দিয়ে আফগান ও অন্যান্য দেশি মিলিট্যান্টরা মধ্য এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোতে ও রাশিয়ায় অনুপ্রবেশ করবে।
তাজিকিস্তানের সঙ্গে আফগানিস্তানের ১,৩৫৭ কি.মি. দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে এবং এই সীমান্ত দিয়েই আফগানিস্তানে অবস্থিত ঘাঁটিগুলো থেকে তাজিক মিলিট্যান্টরা তাজিকিস্তানে প্রবেশ করে তাজিকিস্তানি সরকারি বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালাত। এই সীমান্ত প্রহরা দেয়ার মতো পর্যাপ্ত পরিমাণ সৈন্য তাজিকিস্তানি সরকারের হাতে ছিল না, কারণ সে সময় তাদের সামরিক সামর্থ্য ছিল অত্যন্ত সীমিত এবং তাদের সীমিত সংখ্যক সৈন্য তাজিকিস্তানের অভ্যন্তরে বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। এজন্য রাশিয়া তাজিক–আফগান সীমান্ত সুরক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং রুশ সীমান্তরক্ষীদের এই সীমান্ত বরাবর মোতায়েন করে। তাজিকিস্তানের গৃহযুদ্ধ চলাকালে মস্কো রাষ্ট্রটিতে ৫,০০০ থেকে ২৫,০০০ সৈন্য (বিভিন্ন সূত্রের হিসাব অনুযায়ী) মোতায়েন করেছিল এবং এদের বড় একটি অংশই ছিল সীমান্তরক্ষী।
বস্তুত, রুশ সীমান্তরক্ষীদের জন্য তাজিক যুদ্ধ ছিল ১৯৭৯–১৯৮৯ সালে সংঘটিত আফগান যুদ্ধেরই চলমান বর্ধিতাংশ। আফগানিস্তানে সোভিয়েত সৈন্যরা ইসলামপন্থী আফগান মিলিট্যান্টদের (বা মিলিট্যান্টদের দৃষ্টিকোণ থেকে, ‘মুজাহিদিন’) বিরুদ্ধে প্রায় ৯ বছর যুদ্ধে লিপ্ত ছিল এবং এই মিলিট্যান্টদের একটি অংশ এসেছিল জাতিগত আফগান তাজিকদের মধ্য থেকে। একইভাবে, ১৯৯২–১৯৯৭ সালে সংঘটিত তাজিক যুদ্ধে রুশ সৈন্যরা ইসলামপন্থী (ও অন্যান্য মতাবলম্বী) তাজিক মিলিট্যান্টদের সঙ্গে প্রায় ৫ বছর যুদ্ধে লিপ্ত ছিল।
রুশ সীমান্তরক্ষীরা তাজিক–আফগান সীমান্তে বেশ কয়েকটি ‘জাস্তাভা’ (застава) বা সীমান্ত ফাঁড়ি গড়ে তুলেছিল। রুশ ভাষায় ‘জাস্তাভা’ শব্দটির অর্থ ‘দূরবর্তী ঘাঁটি’। এই ‘জাস্তাভা’গুলোর উদ্দেশ্য ছিল তাজিক–আফগান সীমান্ত দিয়ে তাজিক ও আফগান মিলিট্যান্টদের অনুপ্রবেশ রোধ করা, উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে অস্ত্রশস্ত্র ও মাদকদ্রব্য চোরাচালান নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং সময়ে সময়ে সীমান্ত অঞ্চলে সক্রিয় তাজিক মিলিট্যান্ট দলগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা। উল্লেখ্য, আফগান যুদ্ধের সময়ও আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে সোভিয়েত সৈন্যরা অনুরূপ বহুসংখ্যক ‘জাস্তাভা’ স্থাপন করেছিল এবংং এগুলোর ওপরে আফগান মিলিট্যান্টরা প্রায়ই আক্রমণ চালাত।
তাজিক–আফগান সীমান্তের রুশ ‘জাস্তাভা’গুলোর ওপরেও তাজিক এবং কখনো কখনো আফগান মিলিট্যান্টরা আক্রমণ চালাত এবং ১৯৯৩ সালের ১৩ জুলাইয়ের আগ পর্যন্ত রুশ সীমান্তরক্ষীরা মিলিট্যান্টদের প্রতিটি আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। একই কথা প্রযোজ্য ছিল তাজিক–আফগান সীমান্তবর্তী ‘জাস্তাভা–১২’ এর ক্ষেত্রে।
‘জাস্তাভা–১২’তে মোতায়েনকৃত ছিল ৪৭ জন রুশ সীমান্তরক্ষী এবং একজন বেসামরিক বিশেষজ্ঞ। ঘাঁটিটিতে কোনো ভারী সামরিক সরঞ্জাম (যেমন: ট্যাঙ্ক বা কামান) ছিল না, কেবল একটি হালকা অস্ত্রে সজ্জিত ‘আইএফভি’ (ইনফ্যান্ট্রি ফাইটিং ভেহিকল) ছিল। এছাড়া, ঘাঁটিটির সৈনিকদের কাছে কিছু অ্যাসল্ট রাইফেল, কয়েকটি মেশিনগান এবং ১টি এজিএস–১৭ গ্রেনেড লঞ্চার ছাড়া আর কিছু ছিল না। এর ফলে বড় ধরনের কোনো আক্রমণ প্রতিহত করার মতো সামর্থ্য ঘাঁটিটির ছিল না।
১৯৯৩ সালের জুলাইয়ের প্রথম দিক থেকে তাজিক মিলিট্যান্টরা পার্শ্ববর্তী পাহাড়গুলো থেকে ঘাঁটিটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিল এবং রুশ সীমান্তরক্ষীরা চাইলেই তাদের ওপর গুলি চালাতে পারত, কিন্তু গ্যারিসন সদর দপ্তর থেকে তাদেরকে কড়া নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, কোনোরকম উস্কানি ছাড়া যাতে সীমান্তরক্ষীরা গুলি না ছোঁড়ে। তদুপরি, আফগানদের একটি প্রতিনিধি দল ঘাঁটিটিতে এসেছিল এবং রুশ সীমান্তরক্ষীদের আশ্বস্ত করেছিল যে, তাদের ওপর কোনো আক্রমণ চালানো হবে না। ১৯৯৩ সালের ১২ জুলাই গ্যারিসন সদর দপ্তর থেকে সীমান্তরক্ষীদের নির্দেশ দেয়া হয় যে, ঘাঁটির সীমানার বাইরে যে ফায়ারিং পয়েন্টগুলো তারা স্থাপন করেছে, সেগুলো যেন সরিয়ে নেয়া হয়। এই সিদ্ধান্তের ফলে ঘাঁটিটির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে।
১৯৯৩ সালের ১৩ জুলাই ঠিক ভোর ৪টায় তাজিক মিলিট্যান্ট ও আফগান সৈন্যরা জাস্তাভা–১২ এর ওপর আক্রমণ চালায়। আক্রমণকারী দলটিতে প্রায় ৪০০ জন যোদ্ধা ছিল, যাদের মধ্যে প্রায় ২৫০ জন তাজিক মিলিট্যান্ট এবং প্রায় ১৫০ জন আফগান সৈন্য। এই আফগান সৈন্যরা ছিল আফগান সেনাবাহিনীর ৫৫তম পদাতিক ডিভিশনের অংশ। তাজিক মিলিট্যান্টদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন কোরি হামিদুল্লো নামক একজন মিলিট্যান্ট কমান্ডার। তাজিক ও আফগান যোদ্ধারা মর্টার, মেশিনগান, গ্রেনেড লঞ্চার ও স্নাইপার রাইফেলে সুসজ্জিত ছিল। তারা পার্শ্ববর্তী পাহাড়গুলো থেকে ঘাঁটিটির ওপর আক্রমণ চালায়। রুশ সীমান্তরক্ষীরা এই আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না, ফলে তাজিক–আফগান যোদ্ধারা আরো সুবিধা লাভ করে।
আক্রমণের প্রথম পর্যায়েই তাজিক ও আফগান যোদ্ধারা মর্টার ব্যবহার করে ঘাঁটিতে থাকা একমাত্র সাঁজোয়া যানটিকে অকেজো করে দেয়। তদুপরি, সীমান্তরক্ষীদের কাছে থাকা একমাত্র গ্রেনেড লঞ্চারটিও যুদ্ধের সময় অকার্যকর হয়ে পড়ে। তাজিক ও আফগান যোদ্ধারা দ্রুত ঘাঁটিটিকে ঘিরে ফেলে এবং এর ফলে সীমান্তরক্ষীরা তাদের ব্যারাকের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে সেখান থেকে যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়। ঘাঁটিটির ওপরে প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু হয়, কিন্তু এর জবাব দেয়ার মতো কোনো ভারী অস্ত্র সীমান্তরক্ষীদের কাছে ছিল না। এর মধ্যে একজন সীমান্তরক্ষী তাদের সদর দপ্তরের কাছে সাহায্য চেয়ে বার্তা পাঠাতে সক্ষম হয়।
কয়েক ঘণ্টা পর গোলাবর্ষণ স্তিমিত হয়ে আসে এবং সংঘর্ষটি প্রলম্বিত গোলাগুলিতে রূপ নেয়। সীমান্তরক্ষীরা তাদের ব্যারাকের মধ্যে থেকে যুদ্ধ করছিল এবং তাদের গোলাবারুদের ডিপোটি ছিল বাইরে। তাদের গুলি ক্রমশ ফুরিয়ে আসছিল, কিন্তু অ্যামিউনিশন ডিপো থেকে গুলি সংগ্রহ করার জন্য তাদের কয়েকটি মরিয়া প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ঘাঁটিটির অফিসারদের ব্যারাকে ২০০ রাউন্ড গুলিসহ একটি বাক্স ছিল। একজন সৈনিক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাক্সটি সেখান থেকে নিয়ে আসে এবং এর ফলে তারা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
এরপরও ঘাঁটিটির ২৫ বছর বয়সী অধিনায়ক ঘাঁটি ছেড়ে পশ্চাৎপসরণ করতে ইচ্ছুক ছিলেন না। কারণ ইতোমধ্যে তাদের সদর দপ্তরে সাহায্য চেয়ে বার্তা প্রেরণ করা হয়েছিল এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সহায়তা এসে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছিল। এজন্য গুলি প্রায় শেষ হয়ে আসার পরও তারা ঘাঁটি আঁকড়ে ধরে ছিল।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রায় ৭ ঘণ্টা পর সকাল ১১টায় অবরুদ্ধ সীমান্তরক্ষীদের সহায়তা করার উদ্দেশ্যে ২টি রুশ হেলিকপ্টার গানশিপ ঘাঁটিটির ওপরে এসে উপস্থিত হয়। হেলিকপ্টার দুইটি থেকে ঘাঁটিটির আশেপাশের পাহাড়গুলোতে তাজিক মিলিট্যান্ট ও আফগান সৈন্যদের অবস্থান লক্ষ্য করে রকেট নিক্ষেপ করা হয় এবং এর ফলে তাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। কিন্তু হেলিকপ্টার দুইটির পাইলটরা নিচে অবতরণ করে অবরুদ্ধ সীমান্তরক্ষীদের উদ্ধার করার সাহস পায়নি, কারণ কয়েক মাস আগে ঐ অঞ্চলে তাজিক মিলিট্যান্টরা কাঁধ থেকে নিক্ষেপযোগ্য সারফেস-টু-এয়ার মিসাইলের সাহায্যে নিচু দিয়ে ওড়া অবস্থায় একটি যুদ্ধবিমান ধ্বংস করেছিল। এজন্য রকেট হামলার পর হেলিকপ্টার দুটো ফিরে যায়।
হেলিকপ্টারগুলো ফিরে যাওয়ার পর তাজিক ও আফগান যোদ্ধারা কিছুটা বিশৃঙ্খলভাবেই তাদের আক্রমণ আবার শুরু করে এবং গোলাগুলিতে জাস্তাভা–১২ এর অধিনায়ক নিহত হন। ঘাঁটির উপ–অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট আন্দ্রেই মের্জলিকিন পশ্চাৎপসরণের সিদ্ধান্ত নেন এবং তাজিক ও আফগান যোদ্ধাদের গোলাগুলির মধ্য দিয়েই জীবিত সৈন্যদের নিয়ে নিকটবর্তী সারি–গোর গ্রামের দিকে রওনা হন। এই যুদ্ধে ২৫ জন রুশ সৈন্য নিহত হয় এবং মাত্র ২৩ জন রুশ সৈন্য প্রাণ বাঁচিয়ে পশ্চাৎপসরণ করতে সক্ষম হয়। রুশ সৈন্যদের পশ্চাৎপসরণের পর তাজিক ও আফগান যোদ্ধারা পরিত্যক্ত ‘জাস্তাভা’টি দখল করে নেয় এবং নিহত রুশ সৈন্যদের লাশগুলোকে বিকৃত করে।
এই যুদ্ধে প্রায় ৭০ জন তাজিক ও আফগান যোদ্ধাও নিহত হয়েছিল। কিন্তু এই যুদ্ধে তাদের অর্জন ছিল অভূতপূর্ব। তারা একটি রুশ ঘাঁটি দখল করতে সক্ষম হয়েছে, যেটা ৯ বছরব্যাপী আফগান যুদ্ধেও আফগান মিলিট্যান্টদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। আফগানিস্তান জুড়ে ৮৬২টি সোভিয়েত ‘জাস্তাভা’ ছিল এবং এগুলোর কোনো কোনোটিতে এক ডজনের বেশি সৈন্য ছিল না। এরপরেও আফগান মিলিট্যান্টরা একটিও সোভিয়েত ‘জাস্তাভা’ দখল করতে পারেনি। কিন্তু ১৯৯৩ সালের এই যুদ্ধে তাজিক ও আফগান যোদ্ধারা ‘জাস্তাভা–১২’ দখল করতে সক্ষম হয়।
জাস্তাভা–১২ এর জীবিত সীমান্তরক্ষীরা সারি–গোর গ্রামে পৌঁছে নিকটবর্তী ‘জাস্তাভা–১৩’ এর সীমান্তরক্ষীদের দেখা পায়। তারা ট্যাঙ্ক ও ভারী কামান নিয়ে জাস্তাভা–১২ কে সহায়তা করার জন্য অগ্রসর হচ্ছিল। জাস্তাভা–১৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ভাসিলি মাসিউক তাদেরকে জানান যে, জাস্তাভা–১২ থেকে সাহায্যের আবেদন আসার সঙ্গে সঙ্গেই তারা এবং তাজিক সেনাবাহিনীর একটি সৈন্যদল ২টি হেলিকপ্টারসহ তাদেরকে সহায়তা করার জন্য রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু জাস্তাভা–১২ তে পৌঁছানোর একমাত্র পাকা রাস্তাটিতে তাজিক মিলিট্যান্টরা অসংখ্য মাইন পুঁতে রেখেছিল, এবং তারা মাইন সরানোর চেষ্টা করলে মিলিট্যান্টরা তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এমতাবস্থায় তাজিক সৈন্যরা পশ্চাৎপসরণ করে এবং তারা ঘুরপথে জাস্তাভা–১২ এর দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন, এজন্য তাদের এত দেরি হয়েছে।
ঐদিন বিকেলেই এই জাস্তাভা–১২ এর অবশিষ্ট সৈন্যরা এবং জাস্তাভা–১৩ এর সহায়তাকারী বাহিনী তাজিক ও আফগানদের দখলকৃত জাস্তাভা–১২ এর ওপর আক্রমণ চালায়। রুশদের প্রচণ্ড গোলাবর্ষণে ঘাঁটিটি প্রায় ধ্বংস হয়ে যায় এবং তাজিক ও আফগান যোদ্ধারা আশেপাশের পাহাড়গুলোর দিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এই সংঘর্ষে আরো ৩৫ জন তাজিক ও আফগান যোদ্ধা নিহত হয়, কিন্তু রুশদের মধ্যে নতুন কোনো হতাহত হয়নি, কারণ তারা সম্মুখযুদ্ধের পরিবর্তে নিরাপদ দূরত্বে থেকে গোলাবর্ষণ করেছিল।
জাস্তাভা–১২ এর যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত রুশদের বিজয় হয়, কিন্তু এটি ছিল তাদের জন্য একটি তুলনামূলক রক্তাক্ত বিজয়। ২৫ জন রুশ সীমান্তরক্ষী এই যুদ্ধে নিহত হয়, এবং এই দিনটিকে রুশ সীমান্তরক্ষীদের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তাক্ত দিনগুলোর একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ঐ দিনটি ছিল মঙ্গলবার, এজন্য রুশ সীমান্তরক্ষীরা দিনটিকে ‘কালো মঙ্গলবার’ হিসেবে অভিহিত করে।
রুশ সরকার ও জনসাধারণ ঘটনাটিকে ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। এই ঘটনার পর রুশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর তদানীন্তন কমান্ডার পদত্যাগ করেন এবং সীমান্তরক্ষীদের কাছে সঠিক সময়ে কেন সহায়তা পৌঁছানো হয়নি, রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কতিপয় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়। অন্যদিকে, জাস্তাভা–১২ এর যুদ্ধে জড়িত সৈন্যদের বিভিন্ন সম্মাননা প্রদান করা হয়। এদের মধ্যে জাস্তাভা–১২ এর উপ–অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট মের্জলিকিন–সহ ৬ জনকে রাশিয়ার সর্বোচ্চ সামরিক পদক ‘রুশ ফেডারেশনের বীর’ (Герой Российской Федерации) প্রদান করা হয়। এদের মধ্যে ৪ জন মরণোত্তর এই সম্মানে ভূষিত হন।
জাস্তাভা–১২ এর যুদ্ধের পরও তাজিক মিলিট্যান্টরা রুশ সীমান্তরক্ষীদের ওপরে আক্রমণ অব্যাহত রাখে, এবং ১৯৯৪ সালে একই ঘাঁটিতে মিলিট্যান্টদের আক্রমণে ৭ জন রুশ সীমান্তরক্ষী নিহত হয়। কিন্তু এই ঘটনার পর তাজিক–আফগান সীমান্তবর্তী ‘জাস্তাভা’গুলোর নিরাপত্তা বহুলাংশে বৃদ্ধি করা হয়, ফলে তাজিকিস্তানের গৃহযুদ্ধ চলাকালে মিলিট্যান্টরা আর কোনো রুশ ঘাঁটি দখল করতে সক্ষম হয়নি। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় তাজিকিস্তানি সরকার ও ‘সম্মিলিত তাজিক বিরোধীদলে’র মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, এবং এর মধ্য দিয়ে তাজিকিস্তানের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে।