অক্টোবর ২১, ১৯৬৬।
সময় সকাল ৯:১৫ মিনিট।
অ্যাবাভানবাসীদের জন্য শুক্রবার সকালটা শুরু হয়েছিলো আর দশটা দিনের মতোই।
সকালের নাস্তা সেরে তখন যে যার কর্মস্থলে- কয়লা খনির শ্রমিকরা মাইনে, শিশু-কিশোররা স্কুলে।
গ্রামের প্যান্টগ্লাস জুনিয়র স্কুলের শিশুরা সকালের অ্যাসেম্বলি শেষে সবাই ক্লাসে ঢুকছে।
ক্লাস শেষ হলেই সামনে হাফ টার্মের লম্বা ছুটি- সবাই তাই ভীষণ খুশি।
হঠাৎ করে ভীষণ করে গুড়ুম গুড়ুম শব্দ। সেইসাথে ভূমিকম্প। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ক্লাসরুমের দরজা-জানালা-ছাদ ভেঙে তীব্র স্রোতে ঢুকতে থাকলো কালো থকথকে কী যেন- মুহূর্তেই তছনছ করে ফেললো সবকিছু।
কয়লাখনির বর্জ্যের নিচে চাপা পড়ে সেদিন হারিয়ে গেলো ১৪৪টি তাজা প্রাণ, যার ১১৬ জনই ছিল শিশু।
কী হয়েছিলো সেদিন?
যুক্তরাজ্যের সাউথ ওয়েলসের মেরদের টিডফিল শহর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে মেরদের পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত একটি শান্ত গ্রাম অ্যাবাভান। পাহাড়ে ঘেরা এই গ্রামটির অধিবাসীদের জীবিকা নির্বাহের সবচেয়ে বড় উৎস ছিল কয়লা উত্তোলন। গ্রামের অধিকাংশ ব্যক্তি ছিলেন কয়লা খনির শ্রমিক।
কাছেই অবস্থিত মেরদের ভেইল কয়লা খনিতে কাজ করতো অধিকাংশ শ্রমিক। সে সময় কয়লা উত্তোলনের সময়ে প্রাপ্ত বর্জ্য ও অবশেষ খনির কাছে পাহাড়ের উপর ঢিপি করে রাখা হতো। এগুলোকে বলা হতো টিপ। প্রতিটি টিপের আবার একটা করে নম্বর ছিলো। মেরদের ভেইল কয়লা খনির ৭ নম্বর টিপটা ছিলো অ্যাবাভান গ্রামের ঠিক উপরে।
৭ নম্বর টিপের নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে বেশ কয়েকটি ভূগর্ভস্থ নদী।
১৯৬৬ সালের অক্টোবর মাসে সে সময় প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছিল। ২১ তারিখ সকাল সাতটার সময় যখন কয়লা খনির শ্রমিকরা এসে উপস্থিত হন, তখন তারা দেখতে পান যে ৭ নম্বর টিপটি এক রাতের মধ্যেই প্রায় ১০ মিটার নিচে দেবে গেছে। পাহাড়ের উপর কোনো টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় নিচের গ্রামের অধিবাসীদের সতর্ক করতে পাহাড় থেকে নেমে আসতে আসতে টিপটি আরো দেবে যায়।
এরপর কেউ কিছু করার সুযোগ পাবার আগেই গোটা টিপটি ধ্বসে পড়ে।
প্রায় ১৫০,০০০ টন কয়লা, তরল বর্জ্য, কাদাপানি এবং ধ্বংসাবশেষের স্রোত ধেয়ে আসে ঠিক নিচের অ্যাবাভানের দিকে। আর এর রাস্তার প্রথমেই পড়ে প্যান্টগ্লাস জুনিয়র স্কুল এবং এর ২৪০ জন শিক্ষার্থী-শিক্ষকেরা।
কেউ বুঝে ওঠার আগেই কয়লা খনির বর্জ্যের স্রোতে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় প্যান্টগ্লাস স্কুল এবং তার আশপাশের এলাকা। মুহূর্তের মধ্যে দালান ভেঙেচুরে কুচকুচে কালো তরলের স্রোতে হারিয়ে যায় স্কুল, বসতবাড়ি ও মানুষ।
সকাল সাড়ে ন’টায় যখন মাইনস রেস্কিউ সার্ভিসের কাছে যাওয়া প্রথম ফোনকলটা ধরেছিলেন রয় হ্যামার। তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন যে খুব ভয়ঙ্কর কিছু হয়েছে, তা না হলে কয়লা খনির উদ্ধারকর্মীদের একটা স্কুলে যেতে বলা হচ্ছে কেন?
ঘটনাস্থলে যাবার পর তারা দেখেন, চিরচেনা স্কুলটার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। কোথায় সেই ব্ল্যাকবোর্ড, কোথায় সেই ক্লাসরুমের কলরব? ধ্বংসস্তুপের মাঝে অনেকটা হতবাক হয়েই অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো সমগ্র অ্যাবাভানবাসী। সম্বিত ফিরে আসার পর সবাই একসাথে উদ্ধারকাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নিজ সন্তানের খোঁজে দিশেহারা হয়ে পড়েন মা-বাবারা।
কয়লা খনির শ্রমিক, অগ্নিনির্বাপনকর্মী, সাধারণ গ্রামবাসী- সকলে উদ্ধার কাজে হাত লাগায়। বেঁচে যাওয়া মানুষদের উদ্ধার করায় বাধা দিচ্ছিল তরল বর্জ্যের উপস্থিতি। তাই সকলে মিলে বালতিতে করে বর্জ্য তুলে একটা মানব শিকলের মাধ্যমে তা সাফ করা হচ্ছিলো- একে পরবর্তীতে নাম দেয়া হয় ‘বাকেট চেইন’। ভাঙা দরজা, স্কুলের বেঞ্চ সরিয়ে বহু কষ্টে তারা বের করে এনেছিল একেক জনকে। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা বের হয়ে আসছিল লাশ হয়ে। লাশ বের হচ্ছিল ছোট ছোট শিশুদের। প্ল্যান্টহাউস স্কুলের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর বয়স ছিল ১০ বছরের নিচে। লাশ হয়ে বের হচ্ছিলেন শিক্ষকেরাও। কেউ কেউ শেষ মুহূর্তেও আগলে রাখতে চেয়েছিলেন তার প্রিয় শিক্ষার্থীদের। এমন একজন শিক্ষক ছিলেন ৪৭ বছর বয়সী ডেভিড বেনন। তাকে যখন বের করে আনা হয়, তখনও তার হাত দুটো পরম মমতায় আগলে রেখেছিল পাঁচজন শিক্ষার্থীকে। হয়তো ধেয়ে আসা কালো স্রোত থেকে বাঁচাতেই এমনটি করেছিলেন তিনি।
একই স্কুলে লেখাপড়া করা ভাই হারিয়েছে তার বোনকে। বন্ধু হারিয়েছে বন্ধুকে। শিক্ষার্থী হারিয়েছে শিক্ষককে। মাতা-পিতা হারিয়েছে তাদের সন্তানকে।
উদ্ধারকাজ করতে করতে আবার কারো হাতে এসেছে তার সন্তানের নিষ্প্রাণ দেহ। তাকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে আবার ফিরে গেছেন উদ্ধারকাজে- এমন ঘটনাও ঘটেছে।
সময় যত যাচ্ছিল, বেঁচে যাওয়া মানুষ পাবার সম্ভাবনা ততই ক্ষীণ হয়ে আসছিল। তখন ঘড়ির কাঁটা ১১টা পার হয়ে গিয়েছে, আর মিলছিল শুধুই লাশ।
সবচেয়ে হৃদয়বিদারক দৃশ্যগুলোর অন্যতম ছিল ধ্বসে পড়া ক্লাসরুমগুলোতে শিক্ষার্থীদের তাদের বেঞ্চে বসা অবস্থায় আবিষ্কার করা। ঘটনার সময় ক্লাস চলছিল, তাই সামনে খাতা-কলম রেখে বসা অবস্থাতেই কয়লার নিচে তাদের জীবন্ত সমাধি হয়েছে।
দুপুর হতে হতে উদ্ধারকর্মীরা ধ্বংসস্তুপের ভেতর থেকে উদ্ধার করে ৮ বছর বয়সী জেফ এডওয়ার্ডসকে। ভবিষ্যতের মেয়র জেফ ছিলো এ ট্র্যাজেডিতে উদ্ধারপ্রাপ্ত শেষ জীবিত ব্যক্তি।
লাইব্রেরী থেকে কেবল নতুন একটা বই নিয়ে এসে বেঞ্চে বসেছিল জেফ, এমন সময় গম গম আওয়াজ পায় সে। “ও কিছুনা, মেঘ ডাকছে মনে হয়”, বলেছিলেন তাদের শিক্ষক।
এমন সময় তারা দেখতে পায় যে ভূমিকম্পের মত তাদের বেঞ্চ, ছাদে ঝুলন্ত বাতি- সব একযোগে কাঁপছে।
এর পরের দৃশ্য ছিল নিকষ কালো অন্ধকার আর ক্লাসের সবার আর্তচিৎকার।
জ্ঞান ফেরার পর জেফ আবিষ্কার করে যে সে আটকা পড়ে গেছে। তার বুকের উপর ছিল একটা ডেস্ক, ডেস্কের উপর ছাদের ধ্বসে পড়া অংশ। তার আরেক পাশে ছিল তার এক সহপাঠী, মৃত।
মৃত মেয়েটির সাথে তাকে থাকতে হয়েছিল প্রায় আড়াই ঘণ্টার মতো।
জেফের সাদা চুলের জন্য তাকে খুঁজে পায় উদ্ধারকর্মীরা।
ঘটনার প্রায় ৫২ বছর পরও জেফকে তাড়া করে বেড়ায় এই অভিজ্ঞতা।
“মেয়েটাকে আমি আজও দেখি”, বললেন এই ভদ্রলোক।
স্কুল থেকে একটু দুরেই ছিল বেথানিয়া চ্যাপেল, চার্চটিকে ব্যবহার করা হয়েছিল মৃতদেহ রাখার স্থান হিসেবে। ঈশ্বরের ঘরে মৃতদেহ সনাক্ত করতে এসেছিল সবাই- বাবা তার শিশুকে, বোন তার ভাইকে, বন্ধু তার বন্ধুকে।
অধিকাংশেরই মৃত্যু হয়েছিল দম বন্ধ হয়ে।
দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে আসেন রানী এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। গোটা বিশ্ব থেকে অ্যাবাভানের আর্থিক সহায়তার জন্য ১.৭৫ মিলিয়ন পাউন্ডের তহবিল গঠন করা হয়।
অ্যাবাভান ট্র্যাজেডি কেড়ে নিয়েছিলো ১৪৪ জনের প্রাণ। এর মধ্যে ১১৬ জনই শিশু, প্রায় একটি গোটা প্রজন্ম।
শুধুই কি দুর্ঘটনা?
অ্যাবাভানে যা ঘটেছিল, তা যে একেবারেই আকস্মিক ছিল, তা বললে ভুল বলা হবে। গ্রামের ঠিক উপরে, পাহাড়ের উপর স্থাপিত বর্জ্যের বিশাল ঢিবি, যার নিচ দিয়ে বহমান ভূগর্ভস্থ নদী- ৭ নম্বর টিপটির অবস্থা অনেক আগে থেকেই বেশ নাজুক ছিল। ১৯৬৩ সালে জোন্স নামের একজন পানি বিষয়ক প্রকৌশলী ন্যাশনাল কোল বোর্ডের কাছে বৃষ্টিতে ঝুঁকিপূর্ণ ৭ নম্বর টিপ ধ্বসে পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে একটি চিঠি পাঠান। ঘন বর্ষায় টিপের কিছু হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্যান্টগ্লাস স্কুল- এটাও জানান তিনি। এর পরের বছর গুয়েনেথ উইলিয়ামস নামের একজন কাউন্সিলর এই বর্জ্যের পাহাড় নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
১৯৬৫ সালে দু’জন মায়ের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে টিপ নম্বর ৭ অন্যত্র সরানোর আবেদন করেন প্যান্টগ্লাস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা অ্যান জেনিংস। তার আবেদনের প্রতি কর্ণপাত করেনি প্রশাসন। এর ঠিক এক বছর পরই টিপ ধ্বসে প্রাণ হারান জেনিংস।
দুর্ঘটনার পর ২৫ অক্টোবর ১৯৬৬ তারিখে গঠিত হয় অ্যাবাভান ট্রাইব্যুনাল। প্রায় পাঁচমাস ধরে চলা বিচার প্রক্রিয়ায় প্রায় ১৩৬ জন সাক্ষীর জবানবন্দি নেয়া হয়। ট্রাইব্যুনাল শেষে এ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করা হয় ন্যাশনাল কোল বোর্ডকে, যাদের চূড়ান্ত গাফিলতির কারণে এত বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে। যদিও এর জন্য কেউ তাদের চাকরি হারায়নি।
স্রেফ সাধারণ মানুষের অভিযোগের গুরুত্ব না দেয়া এবং অসচেতনতার দরুন এত বড় ক্ষতি হয়ে যায় অ্যাবাভানের।
এখানেই শেষ নয়, ৭ টিপ নম্বর অপসারণের জন্য অর্থ চাওয়া হয় অ্যাবাভানবাসীর কাছ থেকে।
এই ভয়ংকর ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে সেটা মেনে নেয় তারা।
পুনর্বাসনের জন্য গঠিত ফান্ডের সিংহভাগ, প্রায় ১৫০,০০০ পাউন্ড দিয়ে দিতে হয় তাদেরকেই!
অবশ্য যদিও পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে এ অর্থ ফেরত দেয়া হয়। আবার ওয়েলশ সরকার আরো ১০ বছর ধরে আরো ১.৫ মিলিয়ন পাউন্ড দান করে অ্যাবাভান মেমোরিয়াল ট্রাস্টে।
তারপর?
এই দুর্ঘটনা যেমন বাহ্যিক ক্ষতি করেছিল, তেমনই মানসিকভাবে ভেঙে ফেলেছিল অনেককেই। প্যান্টগ্লাস স্কুলের বহু শিক্ষার্থী তাদের শৈশব-কৈশোর হারিয়েছিল। মানসিক ব্যাধিতে ভুগেছিল অনেকেই।
আবার অনেক শিশুই আর বাইরে খেলতে যেতে পারতো না, পাছে গ্রামের অন্যান্য শোকাহত বাবা-মায়ের হারানো সন্তানের কথা মনে হয়!
অ্যাবাভানবাসীদের জন্য ভয়াবহ এক ক্ষত হয়ে থাকবে এ ট্র্যাজেডি। শান্ত এই গ্রামে গেলে আজও দেখা যাবে সারি সারি সাদা সমাধিস্তম্ভ। অর্ধশতক ধরে এখানে ঘুমিয়ে আছে ১১৬ জন শিশু, ওরা বড় হতে পারেনি।
বছর ঘুরে ২১ অক্টোবর এলে অর্ধনমিত রাখা হয় জাতীয় পতাকা, ব্যথাতুর হৃদয়ে স্মরণ করা হয় অকালে হারিয়ে যাওয়া মানুষদের কথা। স্মরণ করা হয় সাবধানতার মূল্যের কথা, জীবনের মূল্যের কথা।
স্মরণ করা হয় এই দিনকে, যেদিন অ্যাবাভানবাসী তার ভবিষ্যতকে হারিয়েছিল।