ব্যস্ত বাজার, এক গল্পকার তার স্মৃতি থেকে গল্প বলে যাচ্ছেন। সামনে জমা হয়েছে সম্মোহিত জনতার ভিড়। ক্রেতা আর বিক্রতা উভয়েই মুগ্ধ চোখে চেয়ে আছেন গল্পকারের দিকে। বাইরের দুনিয়ার এক অপরিচিত খবর নিয়ে এসেছে এই গল্পকার, নানা জনপদের গল্প শুনতে শুনতে শ্রোতা কল্পনায় ছবি আঁকে মনের ভেতর। পৃথিবীর ইতিহাসজুড়ে আছে এমন গল্পকারেরা, এদের খুঁজে পাওয়া যাবে নানা সংস্কৃতিতে। খাতা কলম বা পুঁথি ছাড়াই এক এলাকার গল্পকে এরা নিয়ে গেছেন অন্য জায়গায়, মুখে মুখে কাহিনী, উপাখ্যান ছড়িয়ে গেছে এদের কাছ থেকে।
মধ্য এশিয়া, পারস্য, খাইবার পাস পেরিয়ে ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় যাযাবর একদল মানুষ এসেছিলেন যারা ‘কিসসা’ বা ‘দাস্তান’ বলে বেড়াতেন। এই ‘কিসসা’ কিংবা ‘দাস্তান’ যারা এর বাংলা কী হবে তা নিয়ে একটু বিতর্কও আছে। এটি বৃহত্তর বাংলার পুঁথি থেকে আলাদা, কারণ সুর করে বলা হয় না। ব্যবহার হয় না বাদ্যযন্ত্র। হাত পা, মৌখিক অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে এই দীর্ঘ কাহিনী বলে যাওয়া হয়। এমনও শোনা যায় দিল্লী, লখনৌ, লাহোর কিংবা আগ্রার পথে প্রান্তরে, মসজিদের সিড়িতে, বাজারে, সরাইখানায় সপ্তাহের পর সপ্তাহ কাহিনী বলে যায় এরা। ধর্ম থেকে উপাদান নিয়ে, ইতিহাসের মালমশলায় নির্মিত হয় এই মহাআখ্যান। মধ্যযুগে ভারতের পথে প্রান্তরে এক জনপ্রিয় দাস্তান ছিল আমির হামজাকে নিয়ে, ইসলামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র এই আমির হামজা। তার জীবনের বীরত্বের বাস্তব উপাদান যেমন ছিল ঠিক তেমনি কল্পনার অদ্ভুত মিশেল ছিল দীর্ঘকায় এই দাস্তানে।
যাযাবর এই মানুষেরা মূলত দাস্তান শুনিয়েই দু’পয়সা রোজগার করতেন, এদের পরিচয় ছিল দাস্তানগোয়ি। ‘দাস্তান’ শব্দটি মূলত ফারসি, এর অর্থ আখ্যান। যারা পথে পথে ঘুরে দেশবিদেশ থেকে এই আখ্যান সংগ্রহ করতেন, নতুন নতুন মানুষের সামনে গিয়ে বলতেন তারাই দাস্তানগোয়ি নামে পরিচিত। মধ্য এশিয়া, সমরখন্দ কিংবা পারস্য থেকে কাফেলারা যখন ভারতের দিকে কাফেলা নিয়ে যাত্রা করতো এদের দলে ভীড়ে যেত দাস্তানগোয়িরা।
খাইবার হিন্দুকুশের দুর্গমপথ, দীর্ঘ বিনোদনশূন্য এক রুক্ষ পথ, প্রতি পদে এখানে মৃত্যু, ব্যবসায়ী মালামাল কিংবা পয়সা লুট করার জন্য পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকে পাহাড়ি ডাকাত। সবকিছু ভুলে ব্যবসায়ীদের কাফেলাগুলোকে রাস্তায় একটুকু বিনোদনের খোঁড়াক দিয়েছিল এই দাস্তানগোয়িরা। দাস্তান শোনানোর পাশাপাশি কেউ কেউ কবিরাজী ওষুধ বিক্রি করে দুই পয়সা কামিয়ে নিতেন। অবসরে কেউ ভাগ্য গণনা করতেন, কেউ হাত সাফাই করে টুকটাক জাদু দেখাতেন। আবার কোনো দাস্তানগোয়ি দলের পাগড়ি কিংবা জোব্বার ভাঁজে খোঁজ করলে আফিমের মতো নেশাবস্তু পাওয়াও অসম্ভব ছিলো না। একই দেহের মাঝে নানা সংস্কৃতি, নানান দেশের ভাষা, চিকিৎসাপ্রণালী, ইতিহাস আর আখ্যান নিয়ে বেড়াতেন এরা। শ্রোতা বুঝে কোথাও লাইলি মজনুর প্রেমের আখ্যান বলতেন, কোথাও আমির হামজার বীরত্ব, কোথাও কারবালার হৃদয়বিদারক কাহিনী।
ভারতীয় নৃত্বাত্তিকদের অনেকের ধারণা মুখে মুখে এই দাস্তান বলার প্রথার একটি প্রাচীন ধারা চালু ছিল আরবের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। ব্যবসার কাজে পথ পাড়ি দেওয়ার পথে বিশ্রামের জন্য গড়ে উঠা উন্মুক্ত সরাইখানাগুলোতে রূপ নিতে শুরু করে দাস্তান বা কিসসা। এই গল্প শুনে বাড়ি ফিরতে ফিরতে আর মুখে মুখে বলতে বলতে আরব্য উপদ্বীপের গল্পগুলোতে ব্যবসায়ী, বণিক, সওদাগর নিজেরাই নায়ক হয়ে যান কোথাও। আরবভূমিতে ইসলামের প্রসার এবং পারস্যে নতুন সাহিত্য কেন্দ্র গড়ে উঠার পাশাপাশি বণিকদের যাত্রার পরিধি বাড়তে থাকে। পারস্যে এই দাস্তান একদম দানা বাঁধতে থাকে।
ধারণা করা হয়ে থাকে, বাণ্যিজ্যিক কর্মকাণ্ড বাড়তে থাকায় এখানের সরাইখানাগুলোতে কাহিনী শুনিয়ে পয়সা উপার্জন করাকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন অনেকেই। দাস্তানের শুরু থেকেই এর পুরোটা ছিল মুখ আর অঙ্গভঙ্গির কাজ, এতে আবহ সংগীত, বাদ্যযন্ত্র কিংবা সুরের ব্যাপার ছিল না। তাই শহরকেন্দ্রিক ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের ধর্মবিশ্বাসে সংঘাত না থাকায় অনেক ধনী মুসলিম একে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। এতে দাস্তানগোয়িদের নানা শাখা প্রশাখা মেলতে শুরু করে, কেউ তরুণদের মাঝে জনপ্রিয়, কেউ মধ্যবয়সী ব্যবসায়ীদের মাঝে, কারো জনপ্রিয়তা শরাবখানায়, কারো জনপ্রিয়তা মসজিদের চত্ত্বরে, কারো জনপ্রিয়তা বাজারে।
কোনো কোনো দস্তানগোয়ি বাঁধতে থাকেন দল, শহর থেকে শহরে কেউ বেরিয়ে পড়েন গল্পের খোঁজে। কোথাও কোনো বাদশাহ, আমির কিংবা মন্ত্রী, সওদাগরের সত্য কাহিনী শুনে তা প্রচার করতে শুরু করেন দাস্তানগোয়িরা, আর এরপর প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এই গল্প কালক্রমে বিস্তৃত এবং বিকৃত হয়ে সৃষ্টি করে উপাখ্যানের।
শের শাহের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মুঘল বাদশাহ হুমায়ূন আশ্রয় নিয়েছিলেন পারস্যে। ধারণা করা হয়ে থাকে সেখানে দাস্তানের সাথে তার পরিচয় এবং তার ভারতে ফিরে আসার পর মুঘল দরবারে দস্তানগোয়িরা খাতির পেয়েছিলেন। দাস্তানের ভাষা ছিল মূলত প্রথমে ফারসি, এতে প্রচুর আরবি আখ্যানের সংমিশ্রণ ছিল। ভারতে এসে তা উর্দু বা খাড়িবুলিতেও এর চর্চা শুরু হয়। তবে আমির উমরাহদের মাঝে ফারসিতেই চর্চা হলেও দস্তানগোয়িদের কাজ ছিল সাধারণ শহুরে জনতাকে নিয়ে, যারা কাজের ফাঁকে থমকে দাঁড়িয়ে গল্প শুনেন, তাদের জন্য উর্দুতেই দাস্তান শোনাতেন দাস্তানগোয়িরা।
রাজদরবারে দস্তানগোয়িদের সর্বদাই দ্বন্দ্ব বাঁধে ইতিহাসবিদ আর লেখকদের সাথে, কারণ দাস্তানের মৌখিক ইতিহাসের রীতির সাথে লিখিত ইতিহাস আর বর্ণনার ফারাক আছে। তবে আকবরের শাসনামলে রাজদরবারে ডাক পড়ে দাস্তানগোয়িদের। দাস্তান-এ-আমির হামজার উপর ভিত্তি করে আকবরের নির্দেশে তৈরি হয় ‘হামজানামা’ নামের এক সমৃদ্ধ চিত্রকর্ম। দাস্তানের মৌখিক গল্পের প্রতিটি বীরত্ব, ভালোবাসা, বিরহের কাহিনীর সাথে সংযোগ ঘটে চিত্রকলার, প্রায় বারোশত ছবি আঁকা হয় এই দাস্তানকে কেন্দ্র করে। কোনো কোনো বিশ্লেষক হামজানামাকে মুঘল চিত্রকলার ইতিহাসে সবচেয়ে অসাধারণ কাজ হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন।
১৭৩৯ সালে নাদির শাহর ভারত আক্রমণের সময়ে ময়ুর সিংহাসন, মুঘল কোষাগার আর রাজভাণ্ডারের পাশাপাশি লুট হয় বিশাল ‘মুঘল তসবিরখানা’ যেখানে সংরক্ষিত ছিল হামজানামা।
হামজানামা হারিয়ে গেলেও ভারতের বুকে দীর্ঘদিন বেঁচে ছিল দাস্তান-এ-আমির হামজা। আকবরের সময় আগ্রা, এরপর মুঘল রাজধানীর পরিধিজুড়ে ছড়িয়ে গেছে ভারতীয় দস্তানগোয়িরা। নাদির শাহের আক্রমণের পর দিল্লী থেকে যাযাবর, ব্যবসায়ী, কবি, শায়েরদের মতো দস্তানগোয়িরাও ছড়িয়ে পড়েন ছোটছোট সমৃদ্ধশালী রাজ্যে। মুঘল কর্তৃত্ব যখন আলগা হয়ে যাচ্ছে তখন স্বাধীন নবাবদের আধিপত্য বাড়তে থাকে।
হারিয়ে গেলেন দাস্তানগোয়িরা
দাস্তানগোয়িরাও লখনৌ, লাহোর, অমৃতসর, পেশওয়ারের দিকে চলে আসতে থাকেন। নাদির শাহ থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত দিল্লীতে আবার দস্তানগোয়িরা জমা হয়েছিলেন, দিল্লীতে জামা মসজিদ, চক, আফিমখানা, শরাবখানাগুলোতে দস্তানগোয়িরা আঁকড়ে ছিলেন। গল্প শুনিয়ে দিন গুজরান তখনো করা যেত দিল্লীতে, যদিও ব্রিটিশ ভারতবর্ষের রাজপাট চলে যাচ্ছে তখন কলকাতাতে। উর্দুভাষী দস্তানগোয়িরা দিল্লীতেই পড়ে ছিলেন, আমির হামজা, লাইলি মজনু, শাহবাজ কলন্দর, রুমী, তৈমুর, চেঙ্গিসের সাথে উর্দু দস্তানের কোথাও আকবর, হুমায়ূন, বাবর, শাহজাহানের অন্দরের কথা, হারেমের কথাও কিসসা-দাস্তানে যুক্ত হতে থাকে। কারণ মুঘলদের সোনালী দিন শুধু দাস্তানেই ছিল, বাস্তবে তো ক্ষমতা ইংরেজ বণিকদের হাতে।
সিপাহী বিদ্রোহের পর দিল্লী শহর একদম প্রাণশূন্য হয়ে যায়। দাস্তানগোয়িদের আবার পাড়ি জমাতে হয় লখনৌ, আগ্রা, লাহোর, অমৃতসরের মতো শহরের দিকে। তবে চারদিকেই আকাশ ভেঙে পড়ছিল দাস্তানগোয়িদের মাথায়, পশ্চিমা সাহিত্যের উপাদানের ঝড়ে খড়কুটোর মতো ভেসে যেতে শুরু করে দাস্তান। ১৮৫৮ সালে মুন্সি নাভাল কিশোর চালু করেন তার ‘লখনৌ প্রেস’। আমির হামজার দাস্তানগুলোকে সংগ্রহ করে প্রকাশ করেন বই আকারে। মুন্সি নাভাল কিশোরের এই উদ্যোগ বেশ সাড়া জাগায় পাঠকদের মাঝে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের উদ্যোগেও আমির হামজার দাস্তান সংকলন করে বের হয়। এরপর হাতে লিখে কিংবা ছাপাখানায় আমির হামজার দাস্তান সহ দাস্তানগোয়িদের মুখে প্রচলিত গল্পগুলো ছাপা হতে থাকে। সবার অলক্ষ্যে গল্প বলে পেট চালানো দাস্তানগোয়িরাই হারিয়ে যান।
দাস্তানের পুনর্জন্ম
১৯৮০ সালে ভারতে শামসুর রহমান ফারুকীর উদ্যোগে একদল ব্যক্তি উদ্যোগ নেন এই দাস্তানকে আমার ফিরিয়ে আনা যায় কিনা। মরক্কো, ইন্দোনেশিয়া, বসনিয়া এ ধরনের মৌখিক আখ্যান বলার চল আছে তবে সেখানে আবহ সংগীতের ব্যবহার করা হয়, কোথাও আবার বায়োস্কোপের মতো চিত্রকলা দেখিয়ে তার সাথে সাথে গল্প বলা হয়। তবে ইতিহাস থেকে দেখা যায় ভারতীয় দাস্তান ছিল এদিক থেকে আলাদা, এখানে আখ্যানই প্রধান আর মুখের কথা আর শারীরিক অঙ্গভঙ্গি। এখানে সংগীত, বাদ্যের ব্যবহার নেই। এরপর থেকে ভারতে জোরেশোরে চেষ্টা হয়েছে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে তোলার, ঘটা করে আয়োজন করা হয়েছে দাস্তান শোনার পরিবেশ করে। তবে চলতি পথে থমকে দাঁড়িয়ে, কাফেলা থামিয়ে সরাইখানায় দাস্তান শোনার দিন তো চলে গেছে। তাই পাঠকের জন্য বৃহদাকার আমির হামজার দাস্তান না হোক একটা সুফী কিসসার সারাংশ তুলে ধরেই লেখা শেষ করা যাক,
“এক সুফী তার শিষ্যদের বললেন, যত সাহায্যই করো না কেন যদি ঐ সাহায্য তার নসীবে না থাকে তবে তার কাজে আসবে না, তার হাতে তুলে দিলেও না, সে তার লক্ষ্য চিনতেই পারবে না।
কয়েকজন শিষ্য তার এই কথা মেনে নিতে রাজী না হওয়ায় সুফী দুই শিষ্যকে ডাকলেন। একজনকে বললেন শহর থেকে বের হতে যে সেতু পড়বে, সেখানে একটি সোনারূপার থলি রেখে আসতে। আর আরেক শিষ্যকে বললেন, শহর ঘুরে খুঁজে সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিটিকে বের করতে আর অনুরোধ করতে সেতুটা যাতে সে পার হয়। গুরুর কথা অনুযায়ী দুই শিষ্য কাজ করলো। সেতু পেরিয়ে আসলে গুরু সেই ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলেন, সেতুর মাঝে কিছু দেখতে পেয়েছিলে?
সে উত্তর দিলো, কিছুই দেখতে পাইনি। শিষ্যরা অবাক হয়ে হয়ে জিজ্ঞেস করলো সেতু পাড় হলে আর কিছুই দেখতে পারলে না, চোখ ঠিক আছে তোমার? ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি বললো, জীবনে এতবার এই সেতু পার হয়েছি, একে আমি হাতের তালুর মতো চিনি, তাই ভাবলাম আজ একবার চোখ বন্ধ করে পার হয়ে যাই, দেখিতো পারি কিনা।
গুরু তার শিষ্যদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন!”