মার্চ ১৯৪৫, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির তখন টালমাটাল অবস্থা। নাৎসি জার্মানির রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়ছে রাশিয়ার লালফৌজ আর আমেরিকান সেনারা। বিশ্বযুদ্ধের কুখ্যাত খলনায়কেরা তখন তাদের অপকর্মের প্রমাণ সরাতে ব্যস্ত। ৩০ এপ্রিল রেড আর্মি বার্লিনের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। জার্মানির মিলিটারি রিসার্চ এসোসিয়েশনের প্রধান ওয়ার্নার ওসেনবার্গ রেডিওতে শুনতে পেলেন হিটলারের আত্মহত্যার সংবাদ। দ্রুত তিনি সামরিক গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ কাগজগুলো টয়লেটে ফ্ল্যাশ করে দিয়ে পালিয়ে গেলেন। কাগজগুলো বেশীরভাগ চলে গেল ভূগর্ভস্থ নর্দমায়। কিন্তু সম্ভবত পানি শেষ হয়ে যাওয়ায়, ফ্ল্যাশ হওয়া থেকে বেঁচে যাওয়া কিছু কাগজ উদ্ধার হবার পর চলে গেল ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এম আই-৬ (MI6) এর কাছে। হাতবদল হয়ে সেই কাগজ আবার পৌঁছে গেল আমেরিকান গোয়েন্দাদের কাছে। এই কাগজে থাকা তথ্যগুলোই হন্য হয়ে খুঁজছে তখন মার্কিন গোয়েন্দারা। আর সেসব কাগজ থেকেই শুরু হয়েছিলো গোপন এক মিশন, যার নাম ‘অপারেশন পেপারক্লিপ‘। কী লেখা ছিল সেই কাগজে? কী ছিল সে মিশনে?
ওসেনবার্গ লিস্ট
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের অধীনে নাৎসি জার্মানির উত্থানের পিছনে অনেক বড় ভূমিকা ছিলো বিজ্ঞানীদের। তাই যুদ্ধকালীন জার্মানিতে থাকা খ্যাতিমান সব বিজ্ঞানী আর গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে এক ছাতার নিচে আনতেই গঠন করা হয় মিলিটারি রিসার্চ এসোসিয়েশন। এর প্রধান করা হয় ওয়ার্নার ওসেনবার্গকে। ওসেনবার্গ সেসময় হ্যানোভার টেকনিকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ছিলেন। নাৎসিবাদের ভক্ত হিসাবে তার বেশ খ্যাতি ছিলো। তার কাঁধে দায়িত্ব ছিলো সামরিক অস্ত্র তৈরিতে সহায়তা করতে সক্ষম এমন বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ আর প্রকৌশলীদের এই সংগঠনে নিয়োগ দেয়া। তিনি তার কাজে সফল ছিলেন বটে। এখানে তিনি কম করে হলেও প্রায় ৫,০০০ এর মতো বিখ্যাত বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ আর প্রকৌশলী নিয়োগ দেন। নিয়োগপ্রাপ্তদের নামের তালিকার একটি কপিই টয়লেটে ফ্ল্যাশ হওয়া থেকে বেঁচে গিয়েছিলো সেদিন। পরবর্তীতে এই তালিকা মার্কিন গোয়েন্দাদের হাতে গিয়ে পড়ে। এই তালিকার ঐতিহাসিক নাম ‘ওসেনবার্গ লিস্ট’। আর এই লিস্ট ধরে জার্মানিতে থাকা মার্কিন সেনাবাহিনীর গোয়েন্দারা শুরু করেন বিজ্ঞানীদের খুঁজে বের করার কাজ।
খ্যাতিমান এই বিজ্ঞানীদের যুদ্ধবন্দী হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাবার গোপন মিশন শুরু করে তারা। তাদের লক্ষ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলো রকেট, ক্ষেপনাস্ত্র, রাডার সহ সামরিক যন্ত্রপাতিতে দক্ষ প্রকৌশলীরা। পারমাণবিক খাতের বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে সামরিক ডাক্তার, জৈব প্রযুক্তিবিদ থেকে শুরু করে সব খাতের মোড়লদের ধরে ধরে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাবার গোপন এই পরিকল্পনাই করা হয়েছিল ‘অপারেশন পেপারক্লিপ’ এর অধীনে।
অপারেশন পেপারক্লিপের যাত্রা শুরু
মার্কিন গোয়েন্দারা অপারেশন পেপারক্লিপের কাজ শুরু করেন অনেক আগেই। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের সেক্রেটারী হেনরি ওয়ালেস নিয়মিত খবরাখবর রাখতেন জার্মানির দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের সামরিক গবেষণাগুলোর উপরে। বিশ্বযুদ্ধ যখন শেষের দিকে তখন এই ওয়ালেস আঁচ করতে পেরেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যবর্তী সম্ভাব্য এক স্নায়ুযুদ্ধের কথা। আর কঠিন এই যুদ্ধে জিতে পরাশক্তি হয়ে উঠতে হলে বিজ্ঞানীদের যে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করতে হবে, তা ভালোই বুঝতেন দক্ষ অর্থনীতিবিদ আর পরবর্তীতে আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া হেনরি ওয়ালেস।
তাই যুদ্ধের হাওয়া যখন মিত্রশক্তির দিকে বইছে, তখন প্রায় ১,৮০০ জার্মান বিজ্ঞানীর তালিকা করা হয়। তারা সবাই যুদ্ধকালীন রকেট, ক্ষেপনাস্ত্র, পারমাণবিক বোমা, সামরিক ওষুধদ্রব্য, রাসায়নিক আর জৈব অস্ত্র নিয়ে কাজ করছিলেন। এই ক্ষেত্রগুলোতে নাৎসি জার্মানির বিজ্ঞানীরা অভূতপুর্ব সাফল্য পেয়েছে- এমন খবরের নিশ্চয়তাও ছিলো যুদ্ধকালীন গোয়েন্দাদের কাছে। আর তাই এদের সবাইকে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আমেরিকায় নিয়ে আসার জন্যে ওয়ালেসের খসড়া তালিকাটি পৌঁছে দেয়া হয় আমেরিকান সেনা, নৌ আর বিমান বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ একদল গোয়েন্দার কাছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে গঠিত এই গোয়েন্দা দলের কেতাবি নাম ‘United States Joint Intelligence Objectives Agency (JIOA)’। এই দলটিই মূলত ওসেনবার্গ লিস্টের সাথে ওয়ালেসের খসড়াটির সমন্বয় করে চুড়ান্ত তালিকা তৈরির কাজ শুরু করে। এ তালিকাটি ১৯৪৫ সালের মে মাস নাগাদ জার্মানিতে থাকা মার্কিন গোয়েন্দাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্বেও ছিলো দলটির। এই গোপন অপারেশনের নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন ওভারক্যাস্ট’। পরবর্তীতে মার্কিন সামরিক বাহিনী এর নামকরণ করে ‘অপারেশন পেপারক্লিপ’।
নাম কেন পেপারক্লিপ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন জার্মান বিজ্ঞানীরা যে দুরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, বিশেষত রকেট নির্মাণে সফলতা অর্জন করেছিলেন, তা কারো অজানা ছিলো না। নাৎসি বিজ্ঞানীদের নির্মিত ২,০০০ পাউন্ড ওজনের গোলাবারুদ বহনে সক্ষম V-2 rocket মিত্র বাহিনীর জন্যে ছিলো সাক্ষাৎ ত্রাস। আর তাই এই গোপন অপারেশনের অন্যতম লক্ষ্য ছিলো, এই রকেট নির্মাতা বিজ্ঞানীদের খুঁজে বের করা। আর এই তালিকায় থাকা প্রকৌশলী আর বিজ্ঞানী, যাদেরকে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে, তাদের কাগজপত্রগুলোকে ‘পেপারক্লিপ’ দিয়ে আলাদা করে রাখতেন গোয়েন্দারা। আর তাই ১৯৪৫ এর নভেম্বরে আমেরিকার সামরিকদপ্তর থেকে এই মিশনের নাম রাখা হয় ‘অপারেশন পেপারক্লিপ’।
অপারেশন পেপারক্লিপ কতটুকু সফল ছিলো?
ওসেনবার্গ লিস্টের এক নম্বরে ছিলেন রকেট সাইন্টিস্ট ওয়ার্নার ভন ব্রাউন। যুদ্ধ শুরুর আগে প্রতিভাবান এই বিজ্ঞানীর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিলো মহাকাশে মনুষ্যবাহী রকেট প্রেরণ। কিন্তু অভিজাত এই জার্মান বিজ্ঞানী শুরু থেকেই ছিলেন হিটলারের নাৎসি বাহিনীর সমর্থক। হিটলার তাকে মিলিটারি স্পেস রিসার্চের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেবার পর তার হাতেই তৈরি হয় ইংল্যান্ডে আঘাত হানা সেই কুখ্যাত V-2 rocket।
অপারেশন পেপারক্লিপের মাধ্যমে আমেরিকায় নিয়ে আসা হয় বিজ্ঞানী ব্রাউন আর দলের সব ইঞ্জিনিয়ারকে। ১০৪ জন রকেট সায়েন্টিস্টের পুরো দলকে মার্কিন সেনাবাহিনী নিয়োজিত করে মহাকাশ গবেষণার কাজে। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার এবং সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তাদেরকে নিশ্চিত করা হয় কড়া নিরাপত্তা। মহাকাশে মার্কিনীদের পাঠানো প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘এক্সপ্লোরার-১’ উৎক্ষেপণ থেকে শুরু করে এপোলো মিশনে অনেক বড় ভূমিকা রাখেন এই দলের সদস্যরা। এপোলো-১১ মিশনের সহকারী পরিচালকের দায়িত্বও পালন করেছিলেন ওয়ার্নার ভন ব্রাউন।
তবে সে তালিকায় আরো ছিলেন অটো এমব্রোস-এর মতো খ্যাতিমান রসায়নবিদরাও। অটো এমব্রোস ছিলেন ‘সারিন’, ‘ট্যাবুন’ সহ বেশ কয়েকটি নার্ভ গ্যাসের উদ্ভাবক। যুদ্ধকালীন ট্যাংক সহ যুদ্ধযানের টায়ার নির্মাণে এমব্রোস গবেষণাগারে তৈরি করেন কৃত্রিম রাবার। ১৯৪৪ সালে হিটলার তাকে এক ভোজসভায় ডেকে ১ মিলিয়ন রাইখমার্ক দিয়ে পুরষ্কৃত করেন। কিন্তু পেপারক্লিপের খপ্পরে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানো এই বিজ্ঞানী পরবর্তীতে কাজ করেন মার্কিন সামরিক বাহিনীর জন্য।
ভন ব্রাউন আর অটো এমব্রোস এর মতো আরও প্রায় ১,৬০০ জার্মান বিজ্ঞানী এই অপারেশনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে বাধ্য হয়েছিলো। তাদের সবাই যুক্তরাষ্ট্রেে সামরিক বাহিনীর গবেষণা ক্ষেত্রে সাফল্যের স্বীকৃতি রেখেছেন। তাই অপারেশন পেপারক্লিপ যে মার্কিন শিবিরে অনেকগুণ সফল ছিলো তা বলাই বাহুল্য।
সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিক্রিয়া
যুক্তরাষ্ট্রের এই তৎপরতার খবর পেয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন হাত গুটিয়ে বসে থাকবে এমন ভাবা দুষ্কর। সোভিয়েত গোয়েন্দা আর সামরিক বাহিনীও শুরু করে অপারেশন ওসোভিয়াখিম (Operation Osoaviakhim)। যার মাধ্যমে যুদ্ধকালীন ২,০০০ জার্মান বিজ্ঞানীকে যুদ্ধবন্দী হিসাবে নিয়ে আসা হয় সোভিয়েত ইউনিয়নে। সোভিয়েত ইউনিয়ন আর যুক্তরাষ্ট্রের এই পাল্টাপাল্টি অপারেশনে জার্মান বিজ্ঞানীরাও নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন যে, তাদের জন্মভূমি ছেড়ে পাড়ি জমাতে হবে এই দুই দেশের যেকোনো একটিতে।
অপারেশন পেপারক্লিপের স্বীকৃতি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান ১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বরে গোপন এই মিশনকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেন। যদিও এখন পর্যন্ত এই মিশনের বেশিরভাগই গোপন করে রেখেছে মার্কিন সামরিক বাহিনী আর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।
‘Operation Paperclip: The Secret Intelligence Program That Brought Nazi Scientists to America’ নামে ২০১৪ সালে লেখা এক বইয়ে মার্কিন অনুসন্ধানী সাংবাদিক এনি জ্যাকবসেন এই অপারশনের পিছনের ঘটনাগুলোকে তুলে ধরেছেন।
Featured image source: http://nypost.com