ইসলামের অভ্যুদয় পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি। ৬১০ খ্রিস্টাব্দে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর মাধ্যমে মক্কায় ইসলামের প্রচার শুরু হয়। তৎকালীন আরবের পৌত্তলিক ধর্ম ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় তাদের চক্ষুশূলে পরিণত হন রাসুল (সা.)। তিনি মূর্তিপূজার পরিবর্তে এক আল্লাহ্র ইবাদতের প্রচারণা চালান। তাঁর এই নতুন ধর্মের প্রচার মক্কার অধিকাংশ নেতাই ভালোভাবে নেয়নি। ফলশ্রুতিতে মুহাম্মদ (সা.) এর উপর শুরু হয় নির্যাতন-নিপীড়ন। এসব বাধা-বিপত্তি পেরিয়েও ইসলাম তখন ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করছিল। ইসলামের এই সংবাদ মক্কা পেরিয়ে আরবের অন্যান্য অঞ্চলেও পৌঁছে যায়।
মুহাম্মদ (সা.) ও তার মিত্রদের উপর মক্কাবাসীদের নির্যাতন একসময় চরমে পৌঁছে। এ সময় মক্কার উত্তরাঞ্চলের ইয়াসরিব শহর থেকে অনেকেই তাঁকে সেখানে আমন্ত্রণ জানায়। শেষ পর্যন্ত ৬২২ খ্রিস্টাব্দে সময়ের প্রয়োজনে নানা সুবিধা-অসুবিধার হিসেব কষে, এবং আল্লাহর নির্দেশে তিনি ইয়াসরিবে গমন করেন। সাহাবীরাও সেখানে চলে গিয়েছিলেন। ইয়াসরিবে গিয়ে মুহাম্মদ (সা.) সকল ধর্মের সমন্বয়ে এক নতুন রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন। তাঁর সম্মানার্থে ইয়াসরিবের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় মদিনাতুন্নবী, সংক্ষেপে মদিনা।
মদিনা ছিল কৌশলগত ও ভূরাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান। আরবদের ব্যবসা-বাণিজ্যের অধিকাংশই হতো শাম বা সিরিয়ার সঙ্গে। আর মক্কাবাসীর সিরিয়া যেতে হলে পথে মদিনাকে অতিক্রম করতে হতো। তাই মুহাম্মদ (সা.) এর মদিনায় যাওয়া কুরাইশ তথা মক্কাবাসীদের বেশ বিচলিত করে তোলে। আর মদিনায় মুহাম্মদ (সা.)-ও এই ভূরাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করতে থাকেন।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও তার অনুসারীদের মদিনায় নিরাপদে থাকা মক্কাবাসীরা মেনে নিতে পারেনি। ফলে মক্কা ও মদিনার মধ্যে এক যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়। মদিনা তখন অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে দুর্বল একটি এলাকা। সেই মুহূর্তে মদিনার শক্তিশালী হওয়া খুব প্রয়োজন ছিল। সেই সময় সিরিয়া থেকে অস্ত্রশস্ত্র এনে মক্কা আরো শক্তিশালী হচ্ছিল। এই খবর মদিনায় মুহাম্মদ (সা.) জানতে পারেন। তখন তিনি মক্কার এসব বাণিজ্য কাফেলায় অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।
মক্কাবাসীরা বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে সিরিয়া যাওয়ার সময় সঙ্গে করে পাহারাদার নিয়ে যেত। এসব কাফেলা কী ধরনের পাহারাদার নিয়ে যায় সেটা পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন ছিল। তাই মুহাম্মদ (সা.) দ্বিতীয় হিজরির রজব মাসে আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাস (রা.) এর নেতৃত্বে আট সদস্যের একটি পর্যবেক্ষক দল পাঠান। মক্কার নিকটবর্তী নাখলা নামক স্থানে চার সদস্যের এক বাণিজ্য কাফেলার সঙ্গে ঘটনাক্রমে এই পর্যবেক্ষক দলের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে মক্কাবাসীদের একজন নিহত হয়, দুজন বন্দী হয়, এবং একজন পালিয়ে যায়।
নাখলার খন্ডযুদ্ধের পর দুজন বন্দী নিয়ে যখন এই পর্যবেক্ষক দল মদিনায় ফিরে গেল, তখন মুহাম্মদ (সা.) তা দেখে নাখোশ হলেন। কারণ, তৎকালীন আরবের নিয়মানুযায়ী চার মাস যুদ্ধবিগ্রহ নিষিদ্ধ ছিল, তার মধ্যে রজবও একটি। কুরাইশরা খবর ছড়াতে লাগল যে মুসলিমরা নিষিদ্ধ মাসে রক্তপাত ঘটিয়েছে। এই ঘটনার পর মুসলিম ও কুরাইশদের মধ্যে উত্তেজনা চরম আকার ধারণ করে। শেষপর্যন্ত এই বিষয়ে কুরআনের আয়াত নাজিল হয়। আল্লাহ্ বলেন,
“তারা তোমাকে হারাম মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। উত্তরে বলে দাও- এই মাসে লড়াই করা ভীষণ অন্যায়। কিন্তু আল্লাহর কাছে তার চেয়েও বড় অন্যায় হলো আল্লাহর পথে বাধা প্রদান, আল্লাহকে অস্বীকার ও অমান্য করা, বিশ্বাসীদের জন্য কাবা শরীফের পথ বন্ধ করে দেওয়া, এবং সেখানকার অধিবাসীদেরকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া। আর ফিতনা হত্যার চেয়েও জঘন্যতম অন্যায়।”
(সূরা বাকারা, আয়াত: ২১৭)
এই ঘটনার কিছুদিন পর মুসলিমরা তাদের স্পাই এজেন্টদের মাধ্যমে জানতে পারে যে আবু সুফিয়ান ইবনে হারব সিরিয়া থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও মালামালের একটি বিশাল কাফেলা নিয়ে মক্কার দিকে আসছে। সেই কাফেলায় আমর ইবনুল আসসহ কুরাইশ বংশোদ্ভূত ৩০-৪০ জন লোক পাহারা দিচ্ছিল। মুসলিমরা আশঙ্কা করছিল যে এই অস্ত্রশস্ত্র ও ধনসম্পত্তি মক্কার কাছে পৌঁছালে মদিনা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। মদিনার শত্রু মক্কা যেন অধিকতর শক্তিশালী হয়ে উঠতে না পারে, সেজন্য মুহাম্মদ (সা.) এই কাফেলায় অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। আবু সুফিয়ানের কাফেলা অধিকারের উদ্দেশ্যে মদিনা থেকে একটি বাহিনী রওনা হয়।
আবু সুফিয়ানও মদিনা থেকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা করছিলেন। তাই তিনি সিরিয়া থেকে ফেরার সময় পথে কয়েকটি কাফেলার কাছে মদিনার কেউ এসেছিল কিনা জানতে চাইলেন। বিভিন্নভাবে আবু সুফিয়ান খবর পেয়ে যান যে মুসলিমদের একটি দল আসছে তার কাফেলা আক্রমণের জন্য। এমতাবস্থায় আবু সুফিয়ান আরও সৈন্য চেয়ে মক্কায় খবর পাঠান। এ খবর পেয়ে মক্কা থেকে একটি সৈন্যদল আবু সুফিয়ানের কাফেলাকে এগিয়ে আনতে রওনা হয়। কিন্তু আবু সুফিয়ানের কাফেলা মুসলিমদের চোখ এড়িয়ে ভিন্ন পথে লোহিত সাগরের কুল ঘেঁষে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এদিকে মক্কা থেকে যে একটি বাহিনী বাণিজ্য কাফেলাকে পাহারা দেওয়ার জন্য আসছিল, তাদের কাছে আবু সুফিয়ান এই মর্মে খবর পাঠান যে তিনি নিরাপদে মক্কায় পৌঁছেছেন, এবং তারাও যেন মক্কায় ফিরে আসে।
আবু সুফিয়ান নিরাপদে মক্কায় গিয়ে এই সৈন্যবাহিনীকে ফেরত যেতে বললেও আবু জাহেল সেখানে আরও তিনদিন অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিলেন। এ সময় উতবাসহ কুরাইশদের অনেকেই একটি সংঘর্ষ এড়াতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আবু জাহেল তা মানতে নারাজ ছিলেন। যারা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, আবু জাহেল তাদের অপমান করতে থাকেন। এদিকে মুহাম্মদ (সা.) দূতের মাধ্যমে কুরাইশদের যুদ্ধপ্রস্তুতির খবর পেয়ে বুঝতে পারেন যে কোরাইশদের সঙ্গে একটি যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠেছে।
মুসলিম বাহিনী মূলত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল না, কারণ তারা কাফেলা আক্রমণের জন্য এসেছিল। যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে কিনা তা নিয়ে তখন মুহাম্মদ (সা.) দোটানায় পড়ে যান। মুসলিমরা ফিরে গেলে কুরাইশদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ার, এবং তারা আরো অগ্রসর হয়ে মদিনায় আক্রমণের সম্ভাবনা ছিল। অন্যদিকে, মদিনার আনসাররা মদিনার ভেতরে মুহাম্মদ (সা.)-কে রক্ষা করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল, কিন্তু এখন মুসলিম বাহিনী মদিনার বাইরে, তাই তারা যুদ্ধে অংশগ্রহণে বাধ্য ছিল না। তখন মুহাম্মদ (সা.) সবার সঙ্গে পরামর্শে বসেন। আবু বকর (রা.) ও উমর (রা.) বক্তৃতা দিয়ে অন্যদের যুদ্ধে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেন। বৈঠকে আনসার ও মুহাজির সকলেই যুদ্ধে অংশগ্রহণের পক্ষে মত দেন। ফলশ্রুতিতে মুহাম্মদ (সা.) মুসলিম বাহিনী নিয়ে বদরের নিকটে পৌঁছান।
সেদিন কুরাইশ বাহিনী সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য কয়েকজনকে পাঠানো হয়। তারা বদরের প্রান্তরে একটি কুয়ায় দুজন পানি সংগ্রহরত ব্যক্তিকে দেখে বন্দী করেন। তাদের কাছ থেকে মুসলিমরা জানতে পারে যে উপত্যকার শেষ প্রান্তরের টিলার পেছনে কুরাইশরা অবস্থান করছে। তখন তারা কুরাইশদের সংখ্যা জেনে নেয়, সেই সঙ্গে আগত কুরাইশ নেতাদের নামও জেনে নেয়।
কুরাইশদের আগেই বদরের রণক্ষেত্রে পৌঁছে সেখানকার কুয়ার দখল নেওয়ার চেষ্টা করে মুসলিমরা। মুসলিমরা বদরের নিকটে এসে থামে। তখন একজন সাহাবি এখানে না থেমে কুরাইশদের সবচেয়ে নিকটের কুয়ার কাছে অবস্থান নিয়ে বাকি সব কূপ বন্ধ করে দিয়ে নিজেদের কুয়ার উপর চৌবাচ্চা তৈরি করে তাতে পানি জমা করে রাখার পরামর্শ দেন। এর ফলে মুসলিমরা পানি পেলেও কুরাইশরা পানি থেকে বঞ্চিত হবে। মুহাম্মাদ (সা.) এই পরামর্শ মেনে কুরাইশদের সবচেয়ে নিকটের কুয়ার কাছে গিয়ে শিবির স্থাপনের নির্দেশ দেন। এরপর সেখানে পৌঁছে চৌবাচ্চা তৈরি করে অবশিষ্ট সব কূপ বন্ধ করে দেয়া হয়।
মুহাম্মদ (সা.) মাত্র ৩১৩ জন সৈন্য নিয়ে বদরের প্রান্তরে হাজির হন। এই মুসলিম বাহিনীর মধ্যে ৮২ জন ছিলেন মুহাজির, যাঁরা মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেছিলেন, বাকি সবাই ছিলেন মদিনার আনসার। আনসারদের মধ্যে ১৭০ জন ছিলেন খাযরাজ গোত্রের, এবং বাকি ৬১ জন আওস গোত্রের। মুসলিমরা যেখানে শিবির স্থাপন করে, সেখানে একটি পানির কূপ ছিল যা তাদেরকে বাড়তি সুবিধা দিয়েছে, কারণ মরুভূমিতে পানির কূপ পাওয়া অত্যন্ত দুষ্কর। মুসলিম বাহিনীতে উট ছিল ৭০টি, আর ঘোড়া ছিল মাত্র ২টি। অপরদিকে কুরাইশদের সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ১,০০০ জন। তাদের ঘোড়া ছিল প্রায় ১০০টি, এবং উট ছিল প্রায় ১৭০টি। কুরাইশরা সৈন্যসংখ্যায় মুসলিমদের থেকে তিনগুণ শক্তিশালী ছিল, অস্ত্রশস্ত্রে তো আরো বেশি।
মুসলমানরা প্রথমেই বেশ অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়ে। তারা যেখানে অবস্থান নেয়, দিনের বেলায় সূর্য তাদের মুখের উপর পড়ে। তার উপর মুসলিমদের এলাকার মাটি কিছুটা নরম, যা ঘোড়া ও উট দৌড়ানোর জন্য উপযুক্ত নয়। বিপরীতে কুরাইশ বাহিনী যেখানে অবস্থান নেয়, সেখানে সূর্যের আলো তাদের মুখের উপর পড়ে না, এবং সেখানকার মাটিও শক্ত যা ঘোড়া ও উট দৌড়ানোর জন্য বেশ উপযুক্ত।
সেদিন রাতে মুহাম্মদ (সা.) সিজদারত অবস্থায় আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে লাগলেন। সেই রাতে এক আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে। আরবের মরুভূমিতে সাধারণত বৃষ্টি হয় না। কিন্তু সেই রাতে সবাইকে অবাক করে দিয়ে বৃষ্টি হলো। বৃষ্টির ফলে মুসলিমদের অঞ্চলের নরম মাটি শক্ত হয়ে গেল, এবং কুরাইশদের শক্ত মাটি পিচ্ছিল হয়ে গেল। বৃষ্টির ফলে শীতল আবহাওয়ায় ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্থ মুসলিম বাহিনীর খুব ভালো ঘুমও হলো।
পরদিন ১৭ রমজান। ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ১৩ মার্চ। মুসলিম বাহিনী কুরাইশ বাহিনীর মুখোমুখি হয়। মুহাম্মদ (সা.) তার বাহিনীকে তিনটি সারিতে ভাগ করে সাজান। সবার সামনে ছিল বর্শাধারী বাহিনী। তার পেছনে তিরন্দাজি বাহিনী, এবং সবার পেছনে পদাতিক বাহিনী। তৎকালীন আরবের প্রথানুযায়ী দ্বন্দ্বযুদ্ধের মাধ্যমে যুদ্ধের শুরু হলো। মুসলিম ও কুরাইশ বাহিনীর তিনজন করে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করে। কুরাইশদের মধ্য থেকে উতবা ইবনে রাবীয়া, তার ভাই শাইবা, এবং তার ছেলে ওয়ালিদ এগিয়ে এলো। মুসলিমদের মধ্য থেকে মুহাম্মদ (সা.) পাঠালেন হামজা ইবনে আব্দুল মুত্তালিব (রা.), আলী ইবনে আবি তালিব (রা.), এবং উবাইদা ইবনে হারেস (রা.)-কে।
দ্বন্দ্বযুদ্ধে উতবার মুখোমুখি হন উবাইদা, শাইবার বিরুদ্ধে হামজা, এবং ওয়ালিদের বিরুদ্ধে আলী। হামজার তরবারির আঘাতে শাইবা কুপোকাত হন। শাইবা হামজাকে পাল্টা আঘাত করার সুযোগও পেলেন না। একইভাবে আলীও ওয়ালিদকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। ততক্ষণে উতবা ও উবাইদার যুদ্ধ জমে উঠেছে। তারা দুজনই প্রবল যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে আহত হন। পরে হামজা ও আলী উবাইদার সাহায্যে এগিয়ে গেলেন। এরপর তারা উতবাকে হত্যা করে উবাইদাকে নিয়ে মুসলিম শিবিরে আসেন।
এরপর উভয়পক্ষের সৈন্যরা একে অপরের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। মুহাম্মদ (সা.) তার যোদ্ধাদের তিনি নির্দেশ দেওয়ার আগে কুরাইশদের উপর হামলা করতে নিষেধ করলেন। তিনি বললেন, কুরাইশরা তোমাদের কাছাকাছি আসলে তির নিক্ষেপ করে তাদেরকে হটিয়ে দিও। এ সময় তিনি আল্লাহর কাছে সাহায্যের জন্য দোয়া করতে লাগলেন। তখন তিনি কিছুক্ষণের জন্য তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন, অতঃপর উঠে বলতে লাগলেন- আল্লাহর সাহায্য এসে গেছে। এরপর মুহাম্মদ (সা.) যুদ্ধের ময়দানে এগিয়ে গেলেন, এবং মুসলিমদের যুদ্ধে উৎসাহিত করতে করতে বলতে লাগলেন,
সেই মহান সত্তার শপথ যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ। আজ যে ব্যক্তি ধৈর্য ও নিষ্ঠা সহকারে কাফিরদের সাথে যুদ্ধ করবে, এবং শুধু সামনের দিকে এগোতে থাকবে, কোনো অবস্থাতেই পিছু হটবে না, আল্লাহ্ তাকে জান্নাত দান করবেন।
এ কথা শুনে মুসলিমরা আরো উজ্জীবিত হলো, এবং বীরবিক্রমে যুদ্ধ করতে লাগল। এরপর মুহাম্মদ (সা.) একমুঠো ধুলি নিয়ে কুরাইশদের দিকে এগিয়ে গেলেন। সেই ধুলি তিনি কুরাইশদের উদ্দেশ্যে এই বলে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলেন যে, “ওদের মুখ বিকৃত হয়ে যাক।” এরপর তিনি মুসলিম যোদ্ধাদের আরো শক্তিশালী হামলা চালানোর নির্দেশ দিলেন। মুসলিমদের কঠোর আক্রমণের প্রেক্ষিতে কুরাইশরা পর্যুদস্ত হতে লাগল। একপর্যায়ে তাদের নেতা আবু জাহেল নিহত হলে মক্কাবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে রণেভঙ্গ দেয়। কিছুক্ষণ পর কুরাইশদের আরেক নেতা উমাইয়া ইবনে খালাফও নিহত হয়। যুদ্ধে নেতাদের এমন শোচনীয় মৃত্যু দেখে কুরাইশরা পালাতে শুরু করে।
বদরের যুদ্ধে কুরাইশদের ৭০ জন সৈন্য নিহত হয়। অপরদিকে মুসলিমদের ১৪ জন নিহত হন। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর নিহত মুসলিমদের যুদ্ধক্ষেত্রে দাফন করা হয়, এবং নিহত কুরাইশদের লাশ ময়দানের একটি কুয়ায় নিক্ষেপ করা হয়। এই যুদ্ধে কুরাইশদের শীর্ষস্থানীয় অনেক নেতা মৃত্যুবরণ করেন। মুসলিমরা বিশ্বাস করে যে এই যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীকে ফেরেশতারা সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেছিল।
যুদ্ধশেষে প্রায় ৭০ জন কুরাইশকে যুদ্ধবন্দি হিসেবে মদিনায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তীতে তাদেরকে মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্ত করা হয়। প্রতি বন্দীর জন্য এক হাজার থেকে চার হাজার দিরহাম পর্যন্ত মুক্তিপণ ধার্য করা হয়। তবে অর্থবিত্তহীন অনেক বন্দিকে বিনা পণে মুক্তি দেওয়া হয়। যুদ্ধের পর প্রাপ্ত সমস্ত সম্পদ সকল যোদ্ধাদের মধ্যে সমানভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়। বদরের যুদ্ধে অধিকাংশ কুরাইশ নেতার মৃত্যুর ফলে আবু সুফিয়ান কুরাইশদের নতুন নেতায় পরিণত হন। এই যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে পরবর্তী বছরে কুরাইশরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে উহুদের যুদ্ধে মুখোমুখি হয়।
বদরের যুদ্ধ ছিল পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধগুলোর মধ্যে একটি। এটি ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া এক যুদ্ধ। এটি ছিল ইসলামের ইতিহাসে প্রথম যুদ্ধ। এর আগে মুসলিমরা শুধু নির্যাতিতই হয়েছে, এই প্রথম তারা রুখে দাঁড়ায়। এই যুদ্ধের পর ইসলামী রাষ্ট্র আরো বেশি সুসংহত হয়েছে। বদরের যুদ্ধে মুসলিমদের বিজয়ের পর আরবে ইসলামের আবেদন বৃদ্ধি পায়, এবং ইসলামের প্রচার-প্রসারে গতি আসে। যদি মুসলিমরা এই যুদ্ধে হেরে যেত, তবে ইসলাম হয়তো অস্তিত্বের সংকটে পড়ত। মুসলিমরা হেরে গেলে কুরাইশরা ইসলামের উত্থানকে স্তিমিত করে দিত। এ যুদ্ধে মুসলিমদের বিজয়ের ফলে আরবে এক নতুন শক্তির উত্থান ঘটে। পরবর্তীতে বিভিন্ন যুদ্ধে জয়ের মাধ্যমে এই শক্তি একসময় পরাশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। বদরের যুদ্ধজয় ছিল মুসলিমদের বিশ্বজয়ের ভিত্তি।