কে ভেবেছিল যে একদিন একজন মানুষের জীবনের দাম তার ওজনের সমান সামুদ্রিক শামুকের পরিমাণের সমান হবে? প্রশান্ত আর ভারত মহাসাগরের অগভীর পানিতে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় ‘সাইপ্রিয়া’ জাতের সামুদ্রিক শামুক বা ‘কড়ি’ একসময় হয়ে ওঠে বাংলার দাস ব্যবসার মূল হাতিয়ার।
কেবল যে ক্রীতদাসদেরকেই কড়ি দিয়ে মাপা হতো এমন নয়। বলিউডের হিন্দি ফিল্মের খলনায়করাও নায়কদের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, “তুম দো কৌড়ি কে আদমি কি আওকাত হি কেয়া হ্যায় জো হাম সে সাওয়াল পুঁছা? (যখন তোমার মূল্য দুই কড়ি, তখন আমার কর্তৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলার কী অধিকার আছে তোমার?)” বাংলাতেও কড়ির আরেক নাম টাকা-পয়সা, “অর্থকড়ি হাতে আছে তো?”
শক্ত, বহনযোগ্য, অনেকাংশে অভিন্ন এবং নকল করা কঠিন হওয়ার ফলে প্রাচীনকাল থেকেই পূর্ব আফ্রিকা এবং ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে মুদ্রা হিসেবে কড়ি ব্যবহৃত হতো। ধাতব মুদ্রার প্রচলন হওয়ার আগের যুগ ছিল কড়ির যুগ। ‘সাইপ্রিমোনেটা’ বা ‘অর্থকড়ি’, ধাতব মুদ্রা প্রচলনের পরও বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার হতো এবং ধাতব মুদ্রার পাশাপাশি একটি সমান্তরাল মুদ্রা ব্যবস্থা গঠন করেছিল। প্রকৃতপক্ষে, উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে কেউ যদি ভারতের একজন ব্যবসায়ী হতো, বিশেষ করে তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি এবং মালাবার উপকূলীয় অঞ্চলে, তাহলে এই চকচকে শামুকের খোল দিয়ে বিলাসী পণ্য কিনতে খুব একটা ঝামেলা করতে হতো না।
প্রাচীনকালে ভারত, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ওশেনিয়ায় গহনা ও অন্যান্য ধরনের ব্যক্তিগত অলঙ্করণ হিসেবে কড়ি ব্যবহৃত হত ব্যাপকভাবে। সরল হওয়া সত্ত্বেও তারা সবসময় বিভিন্ন সংস্কৃতি এমনকি পুরাণেও বিশেষ স্থান পেয়েছে।
সংস্কৃত ভাষায় কড়ি পরিচিত কপর্দক নামে। অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, সনাতন ধর্মের দেবতা শিবের চুল সুতোয় বাঁধা কড়ির লম্বা সারির মতো হওয়ার কারণে সেটিকে কপর্দক বলা হয়। সম্ভবত এ কারণেই শিবকে ‘কপর্দী’ এবং পার্বতীকে ‘কপর্দিনী’ নামেও ডাকা হয়।
পূর্ব ও মধ্য ভারতের কিছু সম্প্রদায়ের মধ্যেও কড়ির নাম চোখে পড়ে। সেখানকার পুরুষ শিশুদের নাম কড়ির সাথে সম্পর্কিত। যেমন: তিনকড়ি, ছকারি এবং নওকারি নামগুলোর আক্ষরিক অর্থ হলো তিনটি কড়ি, ছয়টি কড়ি এবং নয়টি কড়ি। এই নামকরণের ঐতিহ্য এসেছিল হিন্দুদের একটি ধর্মীয় আচার থেকে। দেবতার কাছে পুরুষ উত্তরাধিকারী পাওয়ার জন্য দেবতাকে প্রণাম করার চিহ্ন হিসেবে নির্দিষ্ট সংখ্যক কড়ির প্রতিশ্রুতি দেয় অনেকে। সেখান থেকেই চলে আসে এই নামের প্রচলন। কড়িকে এখনও অনেক জায়গায় সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেমন: সম্পদের দেবী লক্ষ্মীর প্রতীক এই কড়ি।
পারস্য থেকে আসা পর্যটক সুলায়মান আল তাজির, তারপর আল মাসুদি (৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ) এবং পরবর্তীতে একাদশ শতাব্দীর পলিম্যাথ আল বিরুনি (১০২০ খ্রিস্টাব্দ) ভারতের মুদ্রা হিসেবে কড়ির উল্লেখ করেছিলেন। আল বিরুনি আরও উল্লেখ করেন যে, ভারতের উপকূলীয় অঞ্চলগুলো এই কড়ির ব্যবসার সাথে জড়িত। ১২৪০ সালে তাবাকাত-ত-নাসিরিও মালদ্বীপ, বাংলা এবং উড়িষ্যার মধ্যে কড়ির বাণিজ্য লক্ষ্য করেন। ইবনে বতুতাও ১৩৪৩ সালের দিকে যখন মালদ্বীপে পৌঁছান এবং ১৮ মাস দ্বীপপুঞ্জে থাকেন, তখনও কড়ির ব্যবহার ও ব্যবসা প্রত্যক্ষ করেন।
ভারতের পূর্ব উপকূলে ছড়িয়ে থাকা বাণিজ্য বন্দরগুলোতে কড়িই ছিল প্রধান মুদ্রা, অন্তত ১৮০৫ সাল পর্যন্ত, যখন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একে বিলুপ্ত ঘোষণা করে। এর অন্যতম ফলাফল ছিল ১৮১৭ সালে উড়িষ্যার পাইকা বিদ্রোহ। ব্রিটিশদের কড়ি মুদ্রা বিলুপ্তকরণ এবং রৌপ্যে কর প্রদানের জন্য জোর দেওয়ার ফলে এই বিদ্রোহ শুরু হয়।
কেবল উড়িষ্যাতেই নয়, বাংলাতেও মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হতো কড়ি। ৯৪৩ থেকে ১৮৩৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ৯০০ বছর ধরে বাংলা মালদ্বীপের সাথে বাণিজ্য করতো কেবল কড়ি সংগ্রহের জন্য। মালদ্বীপ ছিল এই অঞ্চলের কড়ি উৎপাদনের বৃহত্তম কেন্দ্র এবং বাংলাসহ ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা এই কড়ি পাওয়ার বিনিময়ে তাদের কাছে চাল, মশলা এবং রেশম বিনিময় করতো।
দাসবাণিজ্যের মুদ্রা
ষোড়শ শতকে ইউরোপীয়রা যখন ভারতীয় উপকূলে দাস ব্যবসা শুরু করে তখন কড়ির চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ফরাসি এবং ইংরেজদের আফ্রিকার দালালদের কাছ থেকে থেকে ক্রীতদাস কেনার জন্য মালদ্বীপের কড়ির প্রয়োজন ছিল। লাভজনক সুযোগ খুঁজে পেয়ে বাংলার ব্যবসায়ীরা ইউরোপীয়দের কাছে বিক্রির জন্য মালদ্বীপের কাছ থেকে কড়ি সংগ্রহ করতে শুরু করে। ফলে কলকাতা হয়ে ওঠে এক গুরুত্বপূর্ণ দাস বাণিজ্য বন্দর।
১৮২৩ সালে ক্যালকাটা জার্নালের সম্পাদক কলকাতার দাসবাণিজ্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে লিখেছিলেন, “এই মহান রাজধানী, যেটি প্রাচ্যের বাণিজ্য ও ধন-সম্পদের আধার, সেখানে পশুর মতো আফ্রিকান মানুষ বিক্রি করা হয়, সর্বোচ্চ দাম হাঁকানো ক্রেতার মাঠে কাজ করানোর জন্য।”
অনলাইনভিত্তিক মুদ্রা ক্যাটালগ নুমিস্তার মতে, ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে ১ রুপির সমান ছিল ২,৫৬০টি কড়ি। অর্থনৈতিক ইতিহাসের একটি আকর্ষণীয় অধ্যায় হিসেবে মালদ্বীপের কড়িশিল্পের নাম জোরেশোরেই উচ্চারিত হবে, যেটি পশ্চিম আফ্রিকা এবং বাংলার প্রধান মুদ্রা হয়ে উঠেছিল। উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে প্রতি বছর ৩০ হাজার রুপির সমান কড়ি আমদানি করা হতো।
তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো: এই কড়ির মূল্যায়ন কীভাবে হতো? অর্থনীতির যোগান এবং চাহিদার মৌলিক আইন এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলা থেকে বহুদূরে, ভারতে কয়েকটি কড়ি দিয়েই একটি গরু কেনা যেত, অন্যদিকে কড়ি উৎপাদনের কেন্দ্রস্থল মালদ্বীপে কয়েক লক্ষ কড়ির দাম ছিল মাত্র একটি সোনার দিনারের সমান। ক্রীতদাস ব্যবসায়ীরা একজন আফ্রিকান ক্রীতদাস কেনার জন্য প্রায় ২৫ হাজার কড়ি প্রদান করতো।
উনবিংশ শতাব্দীর গড়ার দিকে কলকাতার চিৎপুর রোড আর চব্বিশ পরগণার বাজবাজে ‘দাসবাজার’ ছিল। চিৎপুরের নদীর তীর জুড়ে ক্রীতদাস ক্রয়-বিক্রয় করা। পর্তুগিজ ক্রীতদাস জাহাজগুলো কলকাতার ঠিক দক্ষিণের বাজবাজে ভিড়তো। সেখান থেকে ক্রীতদাসদেরকে নিয়ে যাওয়া হতো সড়কপথে অথবা নদীপথে ছোট নৌকায় করে। তারপর, তারা দিল্লীসহ ভারতের অন্যান্য জায়গায় চলে যেত।
কলকাতায় আনা ক্রীতদাসদেরকে ধরে আনা হতো জলদস্যুতার মাধ্যমে। বঙ্গোপসাগর একসময় ছিল বিভিন্ন জাতিসত্তার জলদস্যুদের কেন্দ্রস্থল। এদের মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত ছিল মগ (বর্মী), পর্তুগিজ এবং ওলন্দাজরা, যারা বঙ্গোপসাগরের বাণিজ্যিক জাহাজগুলো লুট করে বেঁচে থাকা লোকদেরকে দাস হিসেবে বিক্রি করে দিত। জলদস্যু জাহাজ ছাড়াও, ওলন্দাজ, ইংরেজ এবং ফরাসি বাণিজ্যিক জাহাজগুলো প্রায়ই উপকূলীয় গ্রামগুলোতে লুটপাট চালিয়ে পুরুষ এবং নারীদেরকে বন্দী করতো। এরপর এই বন্দীদেরকে ক্রীতদাস হিসেবে বিভিন্ন বন্দরে বিক্রি করা হতো, যাদের জায়গা হতো গৃহকর্মী, বাবুর্চি, নাপিত, কোচ ড্রাইভার, বিনোদনকারী হিসেবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পতিতাবৃত্তি করতেও বাধ্য করা হতো তাদের। বঙ্গোপসাগরের বন্দর নগরী হিসেবে কলকাতার ভৌগলিক অবস্থান দাস ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে একে নিউ অরলিন্স, লন্ডন এবং ব্রিস্টলের মতো গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছিল। ফারসি এবং আরব ভ্রমণকারীদের ভ্রমণ বিবরণীসহ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেকর্ডেও কলকাতার ক্রীতদাস বাজারের উল্লেখ পাওয়া যায়। তাছাড়া ১৭৮০ এবং ১৭৯০-এর দশকে কলকাতার পত্রিকাগুলোতেও ক্রীতদাস বাণিজ্য-সম্পর্কিত প্রচুর ইংরেজি বিজ্ঞাপন পাওয়া যায়।
ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো এশিয়া জুড়েই অভিজাত এবং রাজপরিবারগুলোতে কাফ্রি নামে পরিচিত আফ্রিকান ক্রীতদাস, বিশেষ করে ‘হাবশি’ নামে পরিচিত ইথিওপীয় বা আবিসিনীয় ক্রীতদাসদের এর প্রচুর চাহিদা ছিল। এই ক্রীতদাসরা সেনাবাহিনীতে সৈনিকের পাশাপাশি রাজকীয় হারেম এবং অভিজাত নারীদের প্রহরী হিসেবে কাজ করত।
কলকাতা ছাড়াও তৎকালীন বাংলার অন্যান্য বন্দর, যেমন- চট্টগ্রাম এবং উড়িষ্যার বালাসোরও ছিল দাসব্যবসার আঞ্চলিক কেন্দ্র।
বাংলা অঞ্চলে পুরুষ ক্রীতদাসদেরকে দিয়ে জমিতে কৃষক হিসেবে আর গৃহস্থালির কাজ করানো হতো। অন্যদিকে, নারী ক্রীতদাসদেরকে প্রায়ই তাদের মালিকদের সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য বাধ্য করা হত। ক্রীতদাসরা মালিকের সামাজিক মর্যাদারও একটি চিহ্ন ছিল। যত বেশি দাস, তত বেশি সম্পদ এবং সমৃদ্ধির চিহ্ন।
ক্রীতদাস বা ক্রীতদাস মালিকদের মধ্যে ধর্ম নিয়ে তেমন চিন্তা করতে দেখা যেত না। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়কেই সমানতালে ক্রীতদাসে রূপান্তরিত করা হয়েছিল। হিন্দু মালিকরা তাদের দাসদের ডাকতো ‘দাস’ বা ‘ক্রীতদাস’ নামে, অন্যদিকে মুসলমান মালিকরা তাদের দাসদেরকে ডাকতো ‘গোলাম’ বা ‘নফর’ নামে। ধনী এবং প্রভাবশালী অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের উইলেও দাসদের উল্লেখ পাওয়া যায়, যা প্রমাণ করে বাংলায় দাসত্ব ছিল সর্বব্যাপী।
দাস ব্যবসার সমস্ত বেচাকেনা হতো মূলত কড়ির মাধ্যমেই। ১৮৩৪ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট থেকে ব্রিটেন এবং তাদের সবগুলো উপনিবেশে দাসপ্রথা বিলুপ্ত করার ঘোষণা দেয়। এর ফলে বাংলার দাস ব্যবসা মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তাছাড়া ১৮৩০ সাল নাগাদ ধাতব মুদ্রা বাংলায় ভালোভাবে প্রচলন শুরু হওয়ার পর থেকে অর্থ হিসেবে কড়িকে প্রতিস্থাপন করতে শুরু করে।
যা-ই হোক, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অনেকেই, যারা দাস ব্যবসাকে প্রথম থেকেই বৈধতা দিয়ে আসছিল এবং সরাসরি অংশ নিয়েছিল, তারা তাদের স্বার্থে আঘাত লাগায় এই আইনের বিরোধিতা করে। যেমন: গভর্নর-জেনারেল লর্ড অকল্যান্ড যুক্তি দেখায়, “দাস ব্যবসা দাস এবং প্রভু উভয়ের জন্যই ‘পারস্পরিক সুবিধা’ প্রদান করে।”
এসব কারণেই আইন প্রণয়নের পরেও বাংলায় দাসপ্রথা বিলোপ হতে বহু দশক সময় লেগে যায়। তবে, দাসপ্রথার চূড়ান্ত বিলুপ্তির ভিত্তি স্থাপন করে এই আইন। ক্রীতদাসদের আমদানি ও রপ্তানি অবৈধ করা ছিল এই সামাজিক ও মানবিক অপরাধ নির্মূলের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ এবং শেষ পর্যন্ত তা সফল হয়।
আর এর ফলে কড়ি পুরো ইতিহাসের গতিপথ একবার ভ্রমণ করে আসে। একটি সাধারণ সামুদ্রিক শামুক থেকে মানুষের জীবনের মূল্যের ভিত্তি হয়ে ওঠে, আবার আধুনিক বিশ্বের সাথে পাল্লা না দিতে না পেরে আবারও হয়ে পড়ে সাধারণ শামুক।