পৃথিবীর মানুষ আতঙ্কে ছুটাছুটি করছে, এক-দু’শ তলা বিল্ডিং ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে, পায়ের নিচের মাটি দু’ভাগ হয়ে গলিত লাভা বেরিয়ে আসছে… ব্যাপারগুলো কি খানিকটা পরিচিত লাগছে? প্রায় সব ধর্মেই উল্লেখ আছে পৃথিবীর চূড়ান্ত পরিণতির দিনের কথা। ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা যাকে কেয়ামত বলে জানেন। ধর্মগ্রন্থের হিসেবে এই শেষ দিনে সমস্ত পৃথিবী এভাবেই ধ্বংস হয়ে যাবে। তবে কাছাকাছি ঘটনা নিয়ে ২০০৯ সালে মুক্তি পাওয়া 2012 সিনেমার নাম নিশ্চয়ই কারো অজানা নয়। কিন্তু ক’জন জানেন যে এই সিনেমার সঙ্গে জড়িয়ে আছে রহস্যময় মায়া জাতির এক ভবিষ্যদ্বাণী?
‘মায়া সভ্যতা’- কথাটা শুনলেই কেমন একটা রহস্যের কুয়াশাঘেরা শিরশিরে অনুভূতি হয়, তাই না? এই মায়া জাতি আসলে কারা? তাদের পরিচয় কী? কোথায় থাকে তারা? এখনও কি আছে? তারা কি আধুনিক আর উন্নত, নাকি অসভ্য ও বর্বর? চলুন জেনে নেয়া যাক মায়ানদের পরিচয়।
মায়ান সভ্যতার আবিষ্কার
খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালের কথা। অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৪০০০ বছর আগের কথা আর কী। এই সময়কার অদ্ভুত কিছু পান্ডুলিপি আর ফলক আবিষ্কৃত হলো আধুনিক পৃথিবীতে, চারিদিকে হৈ চৈ পড়ে গেলো। কোনো অক্ষর-বর্ণের বালাই নেই, কেবল কিছু ছোট ছোট ছবি পাশাপাশি এঁকে যেন কিছু একটা লেখার চেষ্টা। আস্তে আস্তে নৃতত্ত্ববিদদের গবেষণায় পৃথিবীর এক অন্যতম প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস আলোর মুখ দেখতে পেল, যা এই মায়ান সভ্যতা।
শুনলে অবাক বনে যেতে হয় এমন সব ইতিহাস মায়ানদের। ৪০০০ বছর আগে যখন পৃথিবীর অনেক প্রান্তে মানুষ সভ্যও হতে শেখেনি, স্থায়ী কোনো আবাস গড়তে জানেনি, সেই সময়ে মায়ানরা কী করে ২৫-৩০ তলার সমান উঁচু স্থাপনা তৈরি করেছিল? জ্যোতির্বিদ্যা আর ভাষা নিয়ে রেখেছিল অগাধ জ্ঞান? কেমন করে তারা সবার চাইতে উন্নত হয়ে গিয়েছিল?
মায়া জাতির খোঁজে
মেসো আমেরিকা, বা বর্তমান মধ্য আমেরিকার সবচেয়ে পরাক্রমশালী প্রাচীনতম জাতি ছিল মায়ারা। অন্যান্যদের মত মায়া জনবসতি খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে ছড়িয়ে ছিল না, তাদের লোকালয় মোটামুটি ভৌগলিক একটি নির্দিষ্ট সীমারেখার মাঝেই ছিল বলা যায়। তারা প্রধানত হন্ডুরাস, গুয়াতেমালা, এল সালভেদরের উত্তরাংশ, কেন্দ্রীয় মেক্সিকোর তাবাস্কো আর চিয়াপাস সহ আরো প্রায় ১ হাজার কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বসতি স্থাপন করেছিল। একসঙ্গে থাকার কারণেই হয়তো অন্য অনেক শক্তিশালী জাতি মায়ানদের লোকালয় আক্রমণ করে খুব একটা সুবিধা করতে পারতো না।
মায়ান ভাষার একটা রূপ পাওয়া গেছে যার বয়স ৪০০০ বছর। তার মানে আসলে মায়ারা এসব এলাকায় কিন্তু বসবাস করে আসছিলো আরো অনেক আগে থেকেই। এর আগে তারা কীভাবে জীবনযাপন করত তা আসলে খুব বেশি স্পষ্ট না, তবে ধারণা করা হয় মায়ানরা শুরুর দিকে যাযাবর ছিল। একেবারে আদিম মানুষের মতো খাবার আর আশ্রয়ের খোঁজে তারা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরে বেড়াতো। একসময় হয়তবা তারা বাসস্থানের উপযোগী হিসেবে এ জায়গাটা বেছে নেয়, শুরু করে পশুপালন। ধীরে ধীরে তারা গড়ে তোলে স্থায়ী আবাস আর ত্যাগ করে যাযাবরের জীবন।
মায়ান ভাষা
মায়ানদের তৈরি পাণ্ডুলিপি থেকে জানা গেছে যে, ভাবের আদান-প্রদানের জন্যে তারা একটি ভাষার ব্যবহার অবশ্যই করত। সেই ভাষার লিখিত রূপটি বেশ মজার। কোনো বর্ণমালা তাদের ছিল না, লেখার জন্যে ব্যবহার করত ছবি বা চিহ্ন। এক হিসেবে বলা যায়, খানিকটা হায়ারোগ্লিফিক লেখা। প্রায় ৮০০টির বেশি ছবি তারা ব্যবহার করেছিল তাদের লেখায়। এসব লেখা থেকে তাদের সভ্যতা আর সংস্কৃতি সম্পর্কে বেশ ধারণা পাওয়া যায়। এছাড়া তারা গাছের বাকল দিয়ে তৈরি কাগজ দিয়ে বই বানাতো, সেগুলোকে বলা হয়ে থাকে কোডেক্স। মায়ান সভ্যতার মাত্র ৪টি কোডেক্স উদ্ধার করা হয়েছে অক্ষতভাবে।
মায়ানরা লেখার কাজ চালাত তুলি দিয়ে, কলম তখনও আবিষ্কৃত হয়নি। এই তুলিগুলো তারা বানাতো পশুর লোম অথবা লেজের সাহায্যে।
মায়াদের ধর্মবিশ্বাস
মায়াদের ধর্ম নিয়ে বলতে গেলে আসলে শেষ হবে না, কারণ তাদের ধর্ম ছিল প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। সভ্যতার একেক পর্যায়ে তাদের ধর্মীয় আচার-বিধি ছিল একেকরকম। তবে ধর্ম পালন করতে গিয়ে শেষ দিকে তারা হয়ে উঠেছিল ভয়ংকর নিষ্ঠুর।
তাদের ধর্মবিশ্বাস বেশ খানিকটা গোপনীয় ও রহস্যময়। কেউ কেউ বলেন, মায়ানরা বিশ্বাস করতো ঈশ্বরই সকল প্রাণ ও শক্তির উৎস, কেবল ঈশ্বরই পারেন জাগতিক সকল বিষয়ের সঙ্গে পরজাগতিক যোগাযোগ ঘটাতে। তারা আরও বিশ্বাস করত, ঈশ্বর মিশে আছেন চন্দ্র, সূর্য আর বৃষ্টির সঙ্গে, মানুষের সকল প্রার্থনা শোনেন তিনি। তাদের ধারণা ছিল, ঈশ্বরের নৈকট্য পাওয়ার একমাত্র মাধ্যম ছিল নিজ দেহের রক্ত। আর তাই তারা বিশেষ কিছু অনুষ্ঠানে ঈশ্বরের নামে রক্ত বিসর্জন দিত। সবচাইতে গুরুত্ববাহী অনুষ্ঠানে রক্ত দিতেন মায়ানদের রাজা স্বয়ং! তবে এই আচারটি পালিত হত অত্যন্ত গোপনে, কেননা এর মধ্য দিয়ে তারা পেত ঈশ্বরের দর্শন।
তবে মতান্তরে, মায়ানরা বেশিরভাগই নাকি প্রকৃতির পূজারী ছিল। বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তিকে তারা উপাসনা করত। পৃথিবীর সকল মানুষের জন্ম ছোট ছোট শস্যদানা থেকে- এই ছিল মানবজাতির উৎপত্তি নিয়ে তাদের বিশ্বাস!
এখন মায়াদের ধর্মবিশ্বাসের যে অংশটুকু নিয়ে বলা হবে, তা শুনে অনেকেরই গা শিউরে উঠবে। হ্যাঁ, মায়ান নরবলি! কেমন লাগছে?
নরবলি নিয়ে বলতে গেলে মায়া ধর্মের এক নতুন পর্বে এসে পড়তে হবে। কেননা যখন তারা ঈশ্বরের সন্তুষ্টির জন্যে নরবলি দিচ্ছে, তখন কিন্তু তারা আর প্রকৃতির উপাসক নয়। তারা ততদিনে বহু দেবদেবীর পূজারি। আরও ভয়ের কথা হলো, এই নরবলিগুলো কিন্তু তারা নিজেদের মানুষ থেকে দিত না। ভিন্ন সমাজের কেউ যদি মায়া রাজ্যে প্রবেশ করত, তারা হতো নরবলির শিকার।
মায়া সভ্যতার অন্যতম নগরীর নাম চিচেন ইতজা। এই শহরকে বলা হত নরবলির শহর। এই শহরে ছিল দুটো প্রাকৃতিক কুয়া, দুই কুয়ার মাঝেই ছিল শহরটি। আর এই কুয়াকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল মায়ান সভ্যতা আর সংস্কৃতি। এই শহরে গড়ে উঠেছিল মায়াদের পিরামিড, ধর্মীয় মঠ, টেম্পল অফ দি ওয়ারিয়র্স, কারাকোল (গোল স্তম্ভ) ইত্যাদি। ধর্মীয় প্রধান আচার অনুষ্ঠান পালিত হতো এই শহরেই।
মায়ানদের দুই প্রধান অমর দেবতার একজন হলো ইতজামনা। তাদের মতে, ইতজামনা মহাপরাক্রমশালী আকাশচারী দেবতা। এই দেবতাকে খুশি করতে মায়ান যাজকরা পবিত্র পিরামিডের ওপর নরবলি দিত। তবে এই বলিদান আর উৎসর্গের জন্যে বিশেষ সময় বেছে নিত, আর এই পুরো প্রক্রিয়াটি হতো মায়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী। বলিদানের সময় খানিকটা অ্যাজটেক রীতি অনুযায়ী মায়ানরা বিশেষ আচার হিসেবে মানুষের বুক চিরে হৃৎপিণ্ড বের করে দেবতার সামনে উৎসর্গ করত। এছাড়া তারা মৃত মানুষের হাত, পা ও অন্যান্য অঙ্গ রেখে দিত নিজেদের কাছে।
আরেকজন প্রধান মায়া দেবতার নাম কুকুলকান। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সর্পদেবী মনসার সঙ্গে এই দেবতার বেশ মিল রয়েছে। কুকুলকান হলো মায়ানদের সর্পদেবতা, তার বাবা হলেন সর্পদের রাজা। কুকুলকান মূলত ডানাওয়ালা এক সরীসৃপ, যাকে মায়ারা শ্রদ্ধাভরে পূজা করতো। এই পূজার জন্য নবম ও দশম শতকের মাঝামাঝিতে তারা তৈরি করেছিল ১০০ ফুট উচ্চতার একটি পিরামিডসদৃশ উপাসনালয়। চারদিকে ৯১টি করে সিঁড়ির ধাপ, আর একেবারে ওপরে উঠার জন্যে একটি ধাপ, সব মিলিয়ে ৩৬৫টি ধাপ ছিল এই উপাসনালয়ে।
কুকুলকানের উপাসনা (ইটজা) ছিল মায়ান রাষ্ট্রধর্ম। রাজনৈতিক ও কিছুটা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে কুকুলকে কেন্দ্র করে একত্রিত হয়েছিল মায়ারা, এতে করে তাদের সমাজ ব্যবস্থা ভারসাম্য পেয়েছিল অনেকটাই। কুকুলকানের এই পিরামিডটি তারা তৈরি করেছিল এক বিশেষ পদ্ধতিতে। সূর্য যখন বিষুবরেখা অতিক্রম করে, অর্থাৎ যখন পৃথিবীতে দিন আর রাতের দৈর্ঘ্য সমান হয়, তখন সূর্যের আলো পিরামিডের উপর পড়লে এমনভাবে ছায়ার সৃষ্টি হয় যে দেখে মনে হয় পিরামিড বেয়ে একটি সরীসৃপ নেমে আসছে।
এই দুই দেবতা ছাড়াও মায়াদের ছিল মৃত্যুর দেবতা ‘আহপুছ’, উর্বরতার দেবতা ‘চিয়াক’, মায়া সূর্য দেবতা ‘কিনিস আহাউ’, জীবন ও মৃত্যু নিয়ন্ত্রক দেবতা ‘বি’, নরকের দেবতা ‘এল’ ইত্যাদি।
দীর্ঘ ৪০০০ বছর আগে, যখনও পৃথিবীর অন্যান্য জাতি সবেমাত্র আগুন জ্বালিয়ে কাঁচা মাংস সেদ্ধ করে খেতে শিখেছিল, মায়ানরা তখন একের পর এক বানিয়ে চলেছিল পাথরের তৈরি সুউচ্চ সব স্থাপনা, জ্যোতির্বিদ্যা, ক্যালেন্ডার তৈরি থেকে শুরু করে খানিকটা সাহিত্যচর্চাও করত তারা। কেমন করে তারা এই উন্নতির শিখরে পৌঁছে গিয়েছিল, তা এক রহস্যই বটে! মায়ানদের এসব দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা দেখতে ভ্রমণপিপাসু পর্যটকরা ছুটে যান মধ্যআমেরিকার এসব অঞ্চলে, অদ্ভুত সুন্দর মায়ান পুরাকীর্তি আর বাড়িঘর দেখে উপভোগ করবেন না এমন লোক পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ।
ফিচার ইমেজ: garzablancaresort.com