আজ থেকে অনেক বছর আগেকার ঘটনা। তা প্রায় যিশু খ্রিস্টের জন্মের তিনশো বছর পূর্বের কথা। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, পরাক্রমশালী এক যোদ্ধা ও সম্রাট, প্রাচীন গ্রিসের ম্যাসিডনের রাজা ছিলেন তিনি। তাকে বলা হতো অর্ধেক পৃথিবীর রাজা। তিনি ছিলেন মেসিডোনিয়ার রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ ও তার চতুর্থ স্ত্রী অলিম্পাসের সন্তান। তার অধীনে মূল রাজ্য ছিল গ্রিসের ছোট্ট রাজ্য ম্যাসিডন।
অত্যন্ত সুপুরুষ ছিলেন আলেকজান্ডার। বলিষ্ট চেহারায় রূপ আর শক্তির মিশেলে তিনি অন্য সকল রাজার থেকে ছিলেন স্বতন্ত্র। সিংহের মতোই বিক্রম ছিল তার। মাথায় সবসময় সিংহের চামড়া জড়িয়ে রাখতেন। তার বাবা ফিলিপ আলেকজান্ডারকে বলেছিলেন, “ম্যাসিডন বড়ই ছোট তোমার পক্ষে, একদিন সারা পৃথিবী জয় করবে তুমি।” তার বাবার কথাই সত্যি হয়েছিল। একের পর এক দেশ জয় করতে করতে পারস্য, মিশর, এশিয়া মাইনর হয়ে ভারতের পশ্চিমেও চলে এসেছিল আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনী।
মাত্র ত্রিশ বছরের মধ্যেই অ্যাড্রিয়াটিক সাগর থেকে সিন্ধু নদ পর্যন্ত এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধিশ্বর হয়ে ওঠেন আলেকজান্ডার। তিনি নিজেকে দেবতা জিউসের বরপুত্র ভাবতেন। তাকে নিয়ে প্রতিনিয়ত তৈরি হতে থাকে নানা রোমাঞ্চকর গল্প। শোনা যায়, প্রাচীন গ্রিসে দেবী আর্টেমিসের মন্দির ছিল পৃথিবীর অন্যতম এক আশ্চর্যময় স্থান। আলেকজান্ডারের জন্মের দিন সেই মন্দিরটি নাকি পুড়ে যায়। চারদিকে রটে যায়, স্বয়ং আর্টেমিস নাকি এসেছিলেন আলেকজান্ডারের জন্মের সাক্ষী থাকতে। এরকম নানা কিংবদন্তীতে ভরপুর সম্রাট আলেকজান্ডারের জীবন। তার মৃত্যু নিয়েও রয়েছে নানারকম কাহিনী।
৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্যাবিলনে দ্বিতীয় নেবুচাদনেজারের প্রাসাদে তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর কারণ নিয়েও নানা মতভেদ আছে। কারো কারো মতে, তিনি ম্যালেরিয়ায় মারা গেছেন, কারো মতে অত্যাধিক মদ্যপানের কারণে তার মৃত্যু হয়। আবার কেউ কেউ বলে বিষ দিয়ে নাকি মারা হয়েছিলো তাকে। তখন তার বয়স ছিলো মাত্র বত্রিশ বছর। কিন্তু বিষ দিয়ে মেরে ফেলার পেছনে কোনো বিশ্বাসযোগ্য তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি ওটাগো বিশ্ববিদ্যালয় এবং ‘ন্যাশনাল পয়জন সেন্টার’-এর টক্সিকোলজিস্ট ড. লিও এসচেপ এক দীর্ঘ গবেষণার পর জানান যে, ইউরোপীয় ‘হোয়াইট হেলেবোর’ নামক বিষাক্ত উদ্ভিদই আলেকজান্ডারের মৃত্যুর জন্য দায়ী। তবে আজকের এই লেখায় আমরা আলেকজান্ডারের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করবো না। বরং মৃত্যুর পর তার শবদেহ নিয়ে ঘটা নানা রহস্যময় ও চমকপ্রদ কাহিনীই জানার চেষ্টা করবো।
অল্প বয়সে বিশাল সাম্রাজ্যের রাজা হয়ে খুব আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়েন আলেকজান্ডার। আর তাই মারা যাওয়ার প্রাক্কালে জিউসের সন্তান হিসেবে তিনি চেয়েছিলেন গ্রিসের আমন শহরে জিউসের মন্দিরেই যেন তাকে সমাধিস্থ করা হয়। ইতিহাসবিদ প্লুটার্ক ও কোরিটিসের বর্ণনায়, মৃত্যুর ছ’দিন পর্যন্ত আলেকজান্ডারের সমাধির কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। সবাই ব্যস্ত ছিল শোক আর পরবর্তী সরকার গঠনের রাজনীতি নিয়ে। তার রানী রোক্সান তখন সন্তানসম্ভবা ছিলেন। তার সন্তান না হওয়া পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয় সেনাপতি পারডিকাস ও রানী রোক্সান যৌথভাবে দেশ পরিচালনা করবেন।
এরপর সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন রাজার শেষযাত্রা সম্পন্ন করার কাজে। ঐতিহাসিক ডিওডোরাস লিপিবদ্ধ করেন আলেকজান্ডারের অন্তিম শবযাত্রার পুরো ঘটনাবলী। এক বিশাল সোনার শববাহী গাড়ি তৈরি করা হলো। সোনার কফিনের মধ্যে তার মৃতদেহ রেখে দ্বিতীয় আরেকটি সোনার ক্যাসকেটে তা ভরা হয়। তারপর যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্র সহ কফিনটি তোলা হয় গাড়িতে। সে একটি জমকালো ব্যাপার। উপযুক্ত সোনা দিয়ে তৈরি শবাধার আর তার সাথে রাজকীয় গাড়ি। প্রায় দু’বছর লেগেছিল তার শবযাত্রা করতে। সেনাপতি পারডিকাসের নেতৃত্বে শববাহী গাড়ি চলতে লাগলো মেসিডোনিয়ার উদ্দেশ্যে।
কিন্তু আলেকজান্ডারের শেষ ইচ্ছে পূর্ণ হলো না। মেসিডোনিয়ায় যাওয়ার পথে ঘটলো এক দুর্ঘটনা। আর এর মধ্য দিয়েই তৈরি হলো এক রহস্যময় ধাঁধা। ৩২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সেই বিশাল শবযাত্রাকে বাঁধা দিতে ঢুকে পড়লেন আলেকজান্ডারেরই এক ক্ষমতাশালী সেনাপতি প্রথম টলেমি সোটার। সমাধিবাহী গাড়িটি বেমালুম ছিনতাই করে প্রথমে সিরিয়া, তারপর মিশরের মেমফিসে নিয়ে আসেন তিনি। এ চুরির পেছনে রয়েছে আলেকজান্ডারের রাজজ্যোতিষী অ্যারিস্টান্ডার এক ভবিষ্যদ্বাণী। তিনি বলেছিলেন, যেখানে আলেকজান্ডারের সমাধি হবে, সেই দেশ হবে সমৃদ্ধশালী, অপরাজেয় এবং চিরশান্তির এক দেশ।
এ কারণেই টলেমির মাথায় কুবুদ্ধিটি চাপে। তিনি ভেবেছিলেন, মিশরে সম্রাটের দেহ সমাধিস্থ করলে এর উন্নতি কেউ ঠেকাতে পারবে না। তারপর তিনি এখানকার রাজা হয়ে বসবেন। টলেমির ইচ্ছে ফলেও অবশ্য। টলেমীয় বংশ দীর্ঘদিন রাজত্ব চালায় মিশরে। এসব ভেবেই টলেমির ছিনতাই করে আনা আলেকজান্ডারের শবদেহকে মিশরীয় রীতিতে মমি করে (যেহেতু পূর্বে তিনি মিশরের ফারাও ছিলেন) কফিনের মধ্যে রাখা হয় এবং মিশরীয় প্রথায় সমাধিস্থ করা হলো গ্রিক সম্রাটকে। এত বড় সম্রাটের কী শেষ পরিণতি!
কিন্তু ইতিহাস এখানেই থেমে থাকলো না। রাজাকে নিয়ে চলতে লাগলো টানাহেঁচড়া। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের শেষ বা তৃতীয় শতকের শুরুর দিকে প্রথম টলেমির মৃত্যুর পর তার ছেলে দ্বিতীয় টলেমি হন মিশরের রাজা। তিনি মেমফিস থেকে আলেকজান্ডারের সমাধি নিয়ে আসেন আলেকজান্দ্রিয়ায়। এবার তাকে সমাধিস্থ করা হলো তারই নামে রাখা সেই শহরে। এতেও থেমে থাকেনি কাহিনী। তারও কিছুদিন পর রাজার মনে হলো প্রয়াত রাজার প্রতি আরো একটু বেশি সম্মান জানানো উচিত। তখন আলেকজান্দ্রিয়া শহরের ‘সোমা’ বা ‘সেমা’ (গ্রিক ভাষায় দেহ) নামক এক জেলায় একটি সমাধিসৌধ করে তাকে চিরকালের মতো বিশ্রাম দেওয়া হলো।
ইতিহাসে এ পর্যন্ত তথ্যই পাওয়া যায়। কিন্তু তারপর? সৌধের বড় বড় পাঁচিলের আড়ালে থাকা আলেকজান্ডারের সোনার কফিনের কথা মনে আছে তো? শোনা যায়, টলেমি বংশেরই এক অপদার্থ উত্তরাধিকারী, নবম টলেমি নাকি আলেকজান্ডারের সোনার কফিন পাল্টে করে দেন ক্রিস্টালে। আর পুরনো সোনার কফিনটি গলিয়ে মুদ্রা করে নেন লোভী রাজা! তিনি ভাবলেনও না ইতিহাসের কত বড় ক্ষতি তিনি করে গেলেন।
অনেকের মতে, দীর্ঘদিন আলেকজান্দ্রিয়াতেই ছিল এই গ্রিক বীরের মরদেহ। আলেকজান্ডারের খ্যাতি ছিল সারা পৃথিবী জুড়ে। আর তাই যিশু খ্রিষ্টের জন্মের ৪৫ বছর আগে তার সমাধি দেখতে অগাস্টাস, ক্যালিগুলা, জুলিয়াস সিজারের মতো ডাকসাইটে রোমান সম্রাটরা আলেকজান্দ্রিয়ায় এসেছিলেন বলে জানা যায়। সম্রাট ক্যালিগুলা নাকি তার সারকোফেগাসের (মানুষের মতো দেখতে শবাগার) বুক থেকে বর্ম ছিড়ে স্মারক হিসেবে রেখেও দেন! আর রাজা অগাস্টাস সমাধির উপরে ফুল ছড়িয়ে দেন, মমির মাথায় পরিয়ে দেন মুকুট। তবে তিনি নাকি সারকোফেগাসের উপর ঝুঁকে সম্রাটকে চুমু খেতে গিয়ে তার নাকও ভেঙে দিয়েছিলেন! যদিও এ ধরনের সম্মান জানানো অনেকেরই পছন্দ হয়নি।
তখনো আলেকজান্ডারের সমাধি নিয়ে খুব এক গন্ডগোলের কথা শোনা যায়নি। তৃতীয় শতক পর্যন্ত এ সৌধ সাধারণ জনগণকে দেখার অনুমতি দেয়া হয়নি। এ মহান বীরের মরদেহ যদি সেখানেই চিরকালের জন্য থাকতো, তাহলে তো আর কথা ছিল না। কিন্তু আবারো ঘটলো এক দুর্ঘটনা।
(৩৭৯-৩৯৫) সময়কালে আলেকজান্দ্রিয়ার ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হয়। পঞ্চদশ শতকে এ শহরের গুরুত্ব ধীরে ধীরে কমতে থাকে। এর পাঁচ দশক পরই হঠাৎ আলেকজান্ডারের সমাধি অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু বিখ্যাত এ গ্রিক সম্রাটের দেহাবশেষ কোথায় রাখা আছে- তার উত্তর এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
এখন পর্যন্ত ১৪০ বার অনুসন্ধান চালিয়ে আজও মিশরের পুরাতত্ত্ববিদরা বলতে পারেননি কোথায় রয়েছে রাজার দেহাবশেষ। তবে মাঝেমধ্যে হঠাৎ একেকটা আবিষ্কারে চমকে উঠতেই হয়। ঠিক তেমনি কয়েক বছর আগরে এক ঘটনা। একদল বিজ্ঞানী জানান দেন যে, একসময় যেখানে ম্যাসিডন ছিল, সেখানে প্রাচীন শহর অ্যাম্ফিপোলিসের কাস্তা সমাধিক্ষেত্রে পাওয়া গেছে মার্বেলে মোড়া এক রাজকীয় সমাধির খোঁজ। সবাই ভেবে নিল এটাই বুঝি সম্রাটের সমাধি। অনেকে অনুমান করতে লাগলেন, রোমান সম্রাট কারাকালা ছিলেন আলেকজান্ডারের শোর্যবীর্যের খুব ভক্ত। দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দ নাগাদ হয়তো তিনিই রাজার মরদেহকে সসম্মানে রাজার নিজ জন্মভূমি গ্রিসে এনে সমাধিস্থ করেছেন।
এখানেও প্রশ্ন থেকে যায়। অনেকেই বলেন, সমাধিটি আলেকজান্ডারের জন্যই তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু টলেমি সোটার সম্রাটের শববাহী গাড়ি নিয়ে কেটে পড়ায় এটি পরিত্যক্ত ছিল। পরে রাজপরিবারেরই কাউকে এখানে সমাধি দেওয়া হয়।
ফলে আজও এ কাহিনীর ইতি টানা সম্ভব হয়নি। বিজ্ঞানীরা এখনো হন্য হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন রাজা আলেজান্ডারের সমাধি। সময়ের সাথে সাথে ঐতিহাসিক স্থানসমূহের পরিবর্তন ঘটেছে। বিভিন্ন দেশের মানচিত্রেও এসেছে নানা পরিবর্তন। তাই অনেক ঐতিহাসিক স্থানেরই এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই। অনেক স্থানেই তৈরি হয়েছে বিশাল বিশাল অট্টালিকা। এর ফলে দিন দিন এ রহস্যের উন্মোচন করা আরো কঠিন হয়ে পড়ছে। তারপরও বিজ্ঞানীদের মতো আমরাও আশায় আছি একদিন না একদিন হয়তবা এ রহস্যের যবনিকাপাত ঘটবে। আর ততদিন পর্যন্ত এ রাজকাহিনীর শেষটা হয়ে থাকবে এক রহস্যের আধার।