যুগে-যুগে বিভিন্ন সভ্যতার উৎকর্ষে পুরুষদের নাম সবসময় উঠে আসে। তাদের দেশপ্রেম, সাহস, বীরত্বপূর্ণ আচরণ আর নিজ দেশের জন্য জীবন উৎসর্গের কত শত গল্প জানি আমরা ইতিহাস থেকে। একটা সভ্যতা গড়ে তুলে সেটাকে সুউচ্চ আসনে নিয়ে যেতে অনেকগুলো মানুষের স্বপ্ন আর কর্মপ্রচেষ্টার সম্মিলন ঘটাতে হয়। এভাবেই তারা পৃথিবীর বুকে টিকে থাকে এরপর ইতিহাসের পাতায়। পাতায় পাতায় তখন সেই সভ্যতার বীরদের নাম আর তাদের গল্প বলা হয়। সেদিক থেকে একটা সভ্যতার পরিচয় ফুটিয়ে তুলতে নারীদের সেভাবে উপস্থাপন করা হয় না। তারা নিত্যদিনের অভ্যাস আর কর্মের সঙ্গে মিশে থাকেন। তাই তো কেউ ইতিহাস লেখার সময় তাদের আলাদা বৈশিষ্ট্য খুঁজে পান না।
এদিক থেকে স্পার্টার নারীরা ভিন্ন ছিলেন। সভ্যতার চরম শিখরে পৌঁছে যাওয়া স্পার্টা নগরীর পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও অবদানের দিক থেকে কোনো অংশে কম ছিলেন না। তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাদের নিত্যদিনের কাজ-কর্ম আর পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার অভ্যাস থেকে। তাদের এসব কর্মচঞ্চলতা পুরুষশাসিত স্পার্টান সমাজে যথেষ্ট বাহবা আর অনুপ্রেরণা পেত। আজকের লেখায় স্পার্টার নারীদের সামাজিক জীবন আর অবদান নিয়ে জানব আমরা।
১. স্পার্টান নারীরা শিক্ষিত ছিলেন
প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার কথা সবসময় উঠে এলেও তাদের নারীদের সেভাবে ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস ছিল না। বরং কোনো নারী শিক্ষা গ্রহণ করে সমাজে অবদান রাখছে, এটা গ্রিকদের আড্ডার টেবিলে হাস্যরসের বিষয় ছিল। কোনো নারী নিজ প্রচেষ্টায় এগিয়ে গেলেও তাকে সেভাবে মূল্যায়ন করা হতো না।
এদিক থেকে স্পার্টান নারীরা অনেক বেশি উদারতা পেয়েছিলেন সমাজ থেকে। ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এসব নগর সভ্যতার নারীরা ছেলেদের মতো শিক্ষার সুযোগ পেতেন। সমবয়সী ছেলে-মেয়ে একই সঙ্গে পড়ালেখার সুযোগ পেতেন। নারীরা সঙ্গীত, কাব্য, দর্শন এবং অন্যান্য বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনার সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছিলেন। এসব ব্যাপারে তাদের পরিবার থেকেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হতো, যাতে তারা নির্বিঘ্নে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে।
স্পার্টা সমাজে একটা বিশ্বাস প্রচলিত ছিল যে, একজন বুদ্ধিমতী নারীর গর্ভে বুদ্ধিমান সন্তানরা বেড়ে উঠবে। তাই নারীদের সেভাবেই তৈরি করা হতো, যাতে সবাই সুযোগ পায়। দুঃখজনক ব্যাপার হলো সমসাময়িক অন্যান্য সভ্যতাগুলোর নারীরা সেভাবে নিজেদের মেলে ধরার সামান্যতম সুযোগটুকুও পায়নি। সেখানে বর্তমানের আধুনিকতার খোলস মোড়ানো অনেক দেশের জন্য স্পার্টান নারীরা উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে থাকবে।
২. স্পার্টান নারীরা জমির মালিক হতেন
উনিশ শতকের গোড়ার দিকে এসেও আধুনিক সভ্যতার লেবাস ধারণ করা আমেরিকাও নারীদের জমির মালিক হওয়ার ব্যাপারে কার্যকরী কোনো আইন সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। সেদিক থেকে হাজার বছর পুরনো আর অর্ধেক বিশ্ব থেকে আড়ালে থাকা একটি সভ্যতা সেই আইন প্রতিষ্ঠিত করে দেখিয়েছিল। এদিক থেকে তারা আমাদের চেয়েও উদার মন-মানসিকতার পরিচয় বহন করে।
এরিস্টটল স্পার্টান নারীদের নিয়ে বলেন,
“তারা স্পার্টায় প্রায় ৪০ শতাংশ জমির মালিক ছিলেন।”
মালিক হিসেবে তারা জমিকে যেকোনো কাজে লাগানোর স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। নিজের যোগ্যতায় তারা যেমন জমি কিনতে পারতেন, উত্তরাধিকারী হিসেবেও তারা জমি-জমার ভাগ পেতেন।
পরিবারের অন্যান্য পুরুষ সদস্যদের মতো নারীদেরও সম্পত্তি বন্টনের সময় তাদের অংশ বুঝিয়ে দেওয়া হতো। আর নারীদের এমন সুযোগের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছিল ‘নারীদের নাগরিকত্ব’। স্পার্টান পুরুষদের মতো নারীদেরও নাগরিকত্ব দেওয়ার নিয়ম ছিল, যা নারী ক্ষমতায়নে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। নারীদের মতো স্পার্টায় স্বায়ত্ত্বশাসিত গোষ্ঠী কিংবা দাসদেরও স্পার্টান হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
৩. স্পার্টান নারীরা খেলাধুলা করতেন এবং যুদ্ধে যেতেন
গ্রিসের ছোট ছোট নগররাষ্ট্রগুলোতে স্পার্টান নারীদের নিয়ে প্রায়ই হাসি-তামাশা করা হতো। তারা নাকি তাদের পুরুষদের পিছুপিছু ঘোড়া ছুটিয়ে ধূলোর মেঘ জমাতো চারপাশে। এমন ডানপিটে স্বভাবের নারীদের নিয়ে তারা হা-হুতাশ করত!
এথেনিয়ান মেয়েরা গামলায় জল ভর্তি করা কিংবা শেষকৃত্যে অংশগ্রহণ বাদে বাইরের আলো দেখতে পেত না তেমন। এদিকে স্পার্টায় নারীদের বেশি করে খেলাধুলায় অংশগ্রহণে উৎসাহ দেওয়া হতো। সাত বছর পার হলেই মেয়েদের ঘরের বাইরে নিয়ে যাওয়া হতো, যাতে তারা দৌড়ে অংশ নিতে পারে। এভাবে সমবয়সী ছেলেদের সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিত তারা। তাই যুদ্ধকালীন সময়ে যোদ্ধারা যখন জীবন বাজি রেখে লড়ছে, নারীরাও ঘরে বসে না থেকে দৌড় খেলায় নিজের প্রতিদ্বন্দ্বীদের হারিয়ে দিয়ে ইতিহাস রচনা করছে।
এদিক থেকে পিছিয়ে ছিলেন না স্পার্টা রাজকন্যা সিনিস্কাও। ঘোড়া ছুটিয়ে চলার দক্ষতা তাকে প্রাচীন ঘোড়দৌড়ের প্রতিযোগিতায় জায়গা করে দিয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩৯৬ সালে রাজকন্যা সিনিস্কা ঘোড়দৌড়ে সকল প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে প্রথম হন। তার এই বিজয় স্পার্টান নারীদের উৎসাহ দিয়েছিল এবং পুরুষশাসিত স্পার্টায় নারীদের নতুন উচ্চতার মাইলফলক এটি। স্পার্টান রাজকন্যার বিজয় আশপাশের নগররাষ্ট্রগুলোর নারীদের মাঝেও প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিল।
৪. স্পার্টান নারীদের স্বাধীন মতামতের সুযোগ ছিল
এরিস্টটলের দর্শনে নীরবতাকে নারীর গৌরব হিসেবে তুলে ধরা হতো। অপরদিকে তার দর্শনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে স্পার্টান নারীরা সমাজে নিজেদের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা আদায় করে নিয়েছিলেন। যদিও তারা ভোট দিতে পারতেন না, তবে নির্বাচনী প্রচারে অংশগ্রহণ করতেন তারা। রাজনীতির গুটিকে নিজেদের অনুকূলে আনতে নারীদের পরিকল্পনা আর পরামর্শ নিতেন পুরুষরা।
নারীদের সন্তানরা যখন যুদ্ধের ডাক পেতো তখন তারা নির্ভয়ে বেরিয়ে পড়ত। এই কাজে তাদের মায়েরা উৎসাহ যোগাতেন এবং বিজয় ছিনিয়ে আনার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। নারীরা নিজ সন্তানদের যুদ্ধে যোগ না দেওয়াকে অপমান হিসেবে দেখতেন। তাই তো তাদের সন্তানদের অলস আর অযোগ্য হিসেবে পরিচয় দিতেন, যাতে তারা দ্বিতীয়বার যুদ্ধের ময়দানে ফিরে যাবার কথা ভাবে। এভাবে নারীদের মতামত তাদের সন্তানদের জীবনে বিশাল প্রভাব ফেলত। যুদ্ধের ময়দানে বীরদের লড়ার পেছনে স্পার্টান নারীদের উৎসাহ তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হতো।
মায়েদের কঠোরতার কারণেই একজন স্পার্টান ছেলে সাত বছর হলেই সামরিক প্রশিক্ষণে বাধ্য থাকতেন। একজন পুরুষকে তখন বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে হতো এবং বিজয় না আসা পর্যন্ত ঘরে ফেরার কোনো পথ খোলা থাকতো না তাদের। পরিবারে পুরুষের অনুপস্থিতিতে অর্থনৈতিক দিকটা স্পার্টান নারীরাই সামলাতেন। কেনাবেচা এবং খরচাপাতির হিসাব-নিকাশ নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন এবং স্বাবলম্বী করে তুলেছিল। এসব পরিবারগুলোর নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড স্পার্টার মূল অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলেছিল।
৫. বিয়ে এবং মাতৃত্ব উপভোগ করতেন তারা
স্পার্টান নারীদের কাছে বিয়ে মানে কেবল ‘বিয়ে করা’ ছিল না। তারা বিয়েকে নিজের জন্য পুরুষের সমান উপভোগ্য বানিয়ে নিতেন। বর্তমানেও যেখানে যৌনতা উপভোগ নারীদের জন্য লজ্জা আর সামাজিক ভ্রুকুটির ব্যাপার, সেখানে স্পার্টান নারীরা বিয়ে পরবর্তী যৌনতা উপভোগে সমান উৎসাহী হয়েছিল। তবে অল্প বয়সে এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়া বহু নারীই সন্তান প্রসবের সময় মারা গিয়েছেন।
স্পার্টান পুরুষদের শক্তিশালী হওয়ার পেছনে নারীদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। একজন নারীকে সম্মানিত করার মাধ্যমেই কেবল একজন সামর্থ্যবান পুরুষ বেড়ে উঠবে তার ঘরে, স্পার্টানরা এমনটা বিশ্বাস করতো। রানী জর্জোকে একবার এক এথেনিয়ান নারী প্রশ্ন করেছিল, কোন গুণে স্পার্টান নারীরা পুরুষদের শাসন করার যোগ্যতা রাখে?” রানী জবাবে বলেছিলেন,
“স্পার্টান নারীরা ‘সত্যিকার পুরুষদের’ জন্ম দেয়, তাই পুরুষদের শাসন করার যোগ্যতা রাখে স্পার্টান নারীরা।”
নারীদের খেলাধুলায় এজন্যই জোর দেওয়া হয়েছিল যাতে তারা একটা সুস্থ-স্বাভাবিক বাচ্চার জন্ম দিতে পারে। তাদের বেড়ে ওঠার পেছনে প্রায় পুরোটা সময় জুড়ে তার মা ছায়ার মতো লেগে থাকেন। সমাজে বেশি বাচ্চা জন্ম দেওয়া মায়েদের আলাদাভাবে সম্মান দেখানো হতো। আর সন্তান কিংবা স্বামী যদি যুদ্ধে গিয়ে মারা পড়তো, তবে একজন নারীর সম্মান হতো আকাশচুম্বী। এভাবেই সমাজের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে অবদান রাখার মাধ্যমে শক্তিশালী একটি জাতি গঠনে নারীরা সবসময়ই ছিলেন আড়ালের কাণ্ডারি।
ইতিহাসের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/