রক্তক্ষয়ী সেভেন ইয়ার্স ওয়ার এরই মধ্যে কেড়ে নিয়েছে লাখো মানুষের প্রাণ। সব পক্ষই রণক্লান্ত। ফ্রান্স চাইছে যেকোনো উপায়ে হ্যানোভার হাত করে ইংল্যান্ডের সাথে সম্মানজনক নিষ্পত্তি। জারিনা এলিজাবেথ চান প্রুশিয়া ভেঙে-চুরে ভাগাভাগি হবে। মারিয়া থেরেসা এখনো সিলিসিয়ার আশা ছাড়তে রাজি নন। তিনি চান পরাশক্তিগুলোর একটি সম্মেলন যেখানে প্রুশিয়া সিলিসিয়ার উপর তাদের দাবি ত্যাগ করবে।
তৃতীয় জর্জের অভিষেকের সাথে ইংল্যান্ডের রাজনীতিতে প্রুশিয়ান বিরোধীরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তাদের একজন জন স্টুয়ার্ট ১৭৬১ সালের মার্চে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেলেন। এই অবস্থায় ফ্রান্সের সাথে শান্তি আলোচনা চালাচ্ছিলেন ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ উইলিয়াম পিট। তিনি দাবি করলেন ফ্রান্স অস্ট্রিয়াকে সহায়তা বন্ধ করবে এবং আমেরিকা ও ভারতে ব্রিটিশ দখলকৃত এলাকার উপর দাবি ছেড়ে দেবে। কিন্তু তিনি ইংল্যান্ডের তরফ থেকে প্রুশিয়াকে অর্থ সাহায্য বন্ধ করবার কোনো প্রতিশ্রুতি দিলেন না। ফলে জুলাই মাসে আলোচনা ভেঙে গেল।
ফ্রান্স স্পেনকে দলে টেনে নিতে অঙ্গীকার করল যদি তারা ফ্রান্সকে সহায়তা করে। এজন্য চূড়ান্ত শান্তিচুক্তিতে স্প্যানিশ উপনিবেশের দাবির ব্যাপারে ফ্রান্স তাদের সমর্থন দেবে। কাজেই স্পেন জানিয়ে দিল যদি পয়লা মে-র মধ্যে ব্রিটেন এবং ফ্রান্স চুক্তিতে একমত না হয় তাহলে তারা ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে। নির্দিষ্ট তারিখ পার হয়ে যাবার পরেও কোনো অগ্রগতি না দেখে স্প্যানিশরা কথা রেখেছিল, কিন্তু ততদিনে পানি অনেকদূর গড়িয়ে গেছে, কাজেই স্পেনের সহায়তা ফ্রান্সের কোনো কাজে আসেনি। তবে মূল ক্ষতি হয় পিটের। তিনি রাজাকে চাপ দিচ্ছিলেন স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত দিতে। রাজা অস্বীকার করলে ৫ অক্টোবর তিনি পদত্যাগ করেন। এরই সাথে প্রুশিয়ার প্রতি ইংল্যান্ডের অর্থ ও সেনা সাহায্যেরও সমাপ্তি হলো।
ফরাসি-স্প্যানিশ জোট
ব্রিটিশদের সাথে স্প্যানিশ এবং ফরাসিদের লড়াই হয়েছিল মূলত উপনিবেশগুলো ঘিরে। স্প্যানিশরা যুদ্ধ ঘোষণা করলেও তাদের নৌ আর স্থলবাহিনী একদমই প্রস্তুত ছিল না। এদিকে বছরের পর বছর লড়াই করে ব্রিটিশ সেনারা তখন অভিজ্ঞ। ফলে স্প্যানিশরা আসলে কোনো প্রতিরোধই গড়তে পারেনি।
ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ এবং ফিলিপাইনে ব্রিটিশ নৌবহর এবং সেনাবাহিনী যৌথভাবে স্প্যানিশ এবং ফরাসি কলোনির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে। ফরাসিদের অধীনস্থ গুয়াদালুপ দ্বীপ ১৭৫৯ সালেই ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল। একে ঘাঁটি করে ক্যারিবিয়ানে ডমিনিকা দ্বীপের দিকে ১৭৬১ সালের জুনে অভিযান পরিচালিত হয়। জুনের ৭ তারিখ ডমিনিকা আত্মসমর্পণ করে। ১৭৬২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর মার্টিনিক দ্বীপেও ব্রিটিশ পতাকা উত্তলিত হলো। ক্যারিবিয়ানের অধিকাংশ দ্বীপ দখল করে ব্রিটিশরা ১৭৬২ সালের ৬ জুন হাভানার কাছে এসে পৌঁছে। সেখানে ছিল স্প্যানিশ উপনিবেশ। ব্রিটিশরা জুলাই থেকে সাগরপথে হাভানা অবরোধ করে গোলাবর্ষণ করতে থাকে। আগস্টের ১০ তারিখে সর্বশেষ স্প্যানিশ কামানটিও স্তব্ধ হয়ে যায়।
এদিকে কানাডা থেকে ব্রিটিশ সেনাদের ক্যারিবিয়ান অভিযানে নিয়ে যাওয়া হলে ফ্রান্স ২৭ জুন, ১৭৬২-তে নিউফাউন্ডল্যান্ড দখল করে নেয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল আসন্ন শান্তি আলোচনাতে এই অঞ্চলকে বিনিময়ের ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা। কিন্তু সেপ্টেম্বরের ভেতরেই ব্রিটিশ হামলায় তারা নিউফাউন্ডল্যান্ড ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
এদিকে ১৭৬২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর স্প্যানিশ ফিলিপাইনের প্রধান শহর ম্যানিলা অবরোধ করল ভারত উপমহাদেশ থেকে আসা ব্রিটিশ নৌবহর। স্প্যানিশরা এখানে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে। অনেক কষ্টের পর অক্টোবরের ৬ তারিখ ব্রিটিশরা ম্যানিলা দখল করতে সমর্থ হয়। স্পেন ইংল্যান্ডের কাছে ফিলিপাইনের দ্বীপগুলো ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো।
একই বছরের এপ্রিলে স্পেন ইংল্যান্ডের মিত্র পর্তুগালকে আক্রমণ করেছিল। ইংল্যান্ড থেকে তাদের সহায়তায় ৭,০০০ সৈনিক পাঠান হয়। ফলে স্প্যানিশরা এখানেও খুব বেশি সফলতা অর্জন করতে পারল না। তবে ব্রিটিশরা তাদের পর্তুগাল থেকে একেবারে বেরও করে দিতে পারেনি। এর মধ্যে শান্তিচুক্তি হয়ে গেলে সব লড়াই থেমে যায়।
ব্রান্সউইকের ফার্দিন্যান্দ
১৭৬১ সালের শীতে ফার্দিন্যান্দ ওয়েস্টফ্যালেয়া ধরে দক্ষিণে অভিযান চালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু ভিক্টর ফ্রাঁসোয়া মার্চের ২১ তারিখে গ্রুনবার্গের কাছে তাকে থামিয়ে দেন। প্রায় ১,৩০,০০০ সেনার এক বিরাট বাহিনী এরপর ফরাসিরা একত্রিত করল। ১৫-১৬ জুলাই ভেলিঙ্ঘাউসেনের লড়াইতে ফার্দিন্যান্দ তাদের হারিয়ে দেন, কিন্তু সমূলে ধ্বংস করতে পারলেন না। নভেম্বর পর্যন্ত দুই বাহিনী বিক্ষিপ্ত কিছু সংঘাত ছাড়া আর কোনো বড় সংঘর্ষে জড়ায়নি।
ফার্দিন্যান্দ এরপর তীব্র এক অভিযানে এক সপ্তাহের ভেতরেই হ্যানোভারের সব এলাকা থেকে ফরাসিদের তাড়িয়ে দিলেন। ১৭৬২ সালের মে-র দিকে আবার ফরাসিরা নতুন হামলা চালাতে শক্তি সঞ্চয় করে। কিন্তু উইলহেমস্থালে ফরাসিরা যখন শিবিরে তখন ফার্দিন্যান্দ আচানক আক্রমণ করে তাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করেন। ফরাসিদের অন্যতম ঘাঁটি হেসে অঞ্চলের কেসেল নগরী পয়লা নভেম্বরে ফার্দিন্যান্দ ছিনিয়ে নিলেন। কয়েকদিন পর খবর এলো ফরাসি আর ব্রিটিশ সরকার শান্তি আলোচনা আরম্ভ করেছে। যুদ্ধ স্থগিত হয়ে গেল।
ফ্রেডেরিকের টিকে থাকা
শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই চালানোর পন করেছেন ফ্রেডেরিক। ব্রিটিশ সাহায্য বন্ধ, কোষাগার খালি, সৈনিক বলতে মূলত কাঁচা কিছু তরুণ যুবক আর বাধ্য করা যুদ্ধবন্দী। এই সৈনিকদের দিয়ে রণক্ষেত্রে জটিল কোন কৌশল অবলম্বন করা যাবে না। ফ্রেডেরিক জানেন যদি সন্ধি না হয় তাহলে এই বছরই হয়তো তার শেষ বছর। তিনি হতোদ্যম নন, পরাজিত হলেও বীরের মতো যুদ্ধক্ষেত্রেই মরবেন তিনি।
ফ্রেডেরিকের হাতে এক লাখের কিছু বেশি সৈন্য, এই শেষ। এদের দিয়ে প্রতিরক্ষামূলক লড়াই চালাতে তিনি মনস্থির করলেন। গ্লাতয থেকে ল্যুডন ৭২,০০০ সেনা আর রাশিয়ান জেনারেল বুতুর্লিন ৫২,০০০ সৈনিক নিয়ে সিলিসিয়ার দিকে রওনা হলেন। ফ্রেডেরিক শোয়াইডনিতজে ছাউনি করে কয়েকবার আক্রমণ চালালেন যাতে এই দুই দল একত্রিত না হতে পারে। কিন্তু অগাস্টের ২৩ তারিখে ঠিকই ল্যুডন আর বুতুর্লিন মিলিত হন পোল্যান্ডের লিগনিতজ আর জুয়ারে। অনন্যোপায় ফ্রেডেরিক সিলিসিয়াতে শোয়াইডনিতজের কাছে বঞ্জেভিটজে একটি সুরক্ষিত ঘাঁটি বানালেন। প্রাকৃতিকভাবে এই দুর্গ যথেষ্ট সুরক্ষিত। এর চারপাশের রুক্ষ ভূমির কারণে শত্রুদের কামান ব্যবহার করা সহজ ছিল না।
ফ্রেডেরিকের বিরুদ্ধে অস্ট্রো-রাশিয়ান ১,৩০,০০০ সেনা অগ্রসর হলো। তিনি মনে করেছিলেন তারা বঞ্জেভিটজে আক্রমণ করবে না। ফলে বুতুর্লিন চেরিনশেভের হাতে ২০,০০০ সেনা রেখে সেপ্টেম্বরে উত্তর দিকে সরে গেলে ফ্রেডেরিক ঘাঁটিতে স্বল্প সংখ্যক সেনা রেখে বাকিদের নিয়ে ২৬ সেপ্টেম্বর নিসে শহরের দিকে চলে যান। উদ্দেশ্য রাশিয়ানদের সাথে হেস্তনেস্ত করবার। এই সুযোগে ৩০ তারিখ অস্ট্রিয়ানরা বঞ্জেভিটজ দখল করে নেয়। এর পথ ধরে তাদের হাতে পতন ঘটে শোয়াইডনিতজের। এরপর ল্যুডন স্যাক্সোনিতে প্রুশিয়ান যুবরাজ হেনরির উদ্দেশ্য মার্চ করা শুরু করলেন। ওদিকে পোমেরানিয়ার উপকূলে প্রুশিয়ার কলবার্গ দুর্গ ও বন্দর অধিকার করেন রাশান জেনারেল রুমিয়ান্টসেভ। ব্রিটেন থেকেও সমস্ত সহায়তা তখন বন্ধ। ফ্রেডেরিক চোখে সর্ষেফুল দেখতে থাকলেন। ধ্বংসের আর বুঝি বাকি নেই। কিন্তু অলক্ষ্যে বসে বিধাতা বোধহয় মুচকি হাসছিলেন।
৫ জানুয়ারি, ১৭৬২। এই দিনেই সেভেন ইয়ার্স ওয়ারের জয়ের পাল্লা প্রুশিয়ার দিকে ঘুরে গেল।
রাশিয়ান সম্রাজ্ঞী এলিজাবেথ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। ফ্রেডেরিকের প্রধান শত্রুর স্থলে অভিষিক্ত হলেন পরম মিত্র, তৃতীয় পিটার। মারিয়া থেরেসা তার দু’চোখের বিষ। অবিলম্বে তিনি হুকুম দিলেন অস্ট্রিয়ার ক্যাম্প থেকে রাশিয়ান সেনাদের প্রুশিয়ার ক্যাম্পে চলে যেতে, তাদের দায়িত্ব ফ্রেডেরিককে সুরক্ষা দেয়া। তিনি এমন কি প্রুশিয়ান সেনাদল পরিচালনা করতেও ইচ্ছা প্রকাশ করে বসলেন। মে মাসের ২ বা ৫ তারিখে প্রুশিয়ার সাথে চুক্তি সম্পাদন করে পিটার মারিয়া থেরেসার জোট ত্যাগ করলেন। তার মধ্যস্থতায় একই মাসের ২২ তারিখ হামবুর্গ চুক্তি পোমেরানিয়া নিয়ে প্রুশিয়া আর সুইডেনের সংঘাতের অবসান ঘটাল। ফ্রেডেরিক এবার একাগ্রচিত্তে মনোযোগ দিলেন অস্ট্রিয়ানদের নিকেশ করতে।
পিটার মাত্র কয়েক মাস সিংহাসনে ছিলেন। জুলাইয়ে তিনি গুপ্তহত্যার শিকার হন। ১৮ জুলাই সিংহাসনে বসলেন তার স্ত্রী দ্বিতীয় ক্যাথেরিন, যিনি পরবর্তীতে ইতিহাসে পরিচিত হবেন ক্যাথেরিন দ্য গ্রেট নামে। তিনি রাশিয়ান সেনাদের ফ্রেডেরিকের পক্ষ থেকে উঠিয়ে নিলেও অস্ট্রিয়ার পক্ষেও যোগ দিলেন না। বাকি সময় রাশিয়া নিরপেক্ষ ভূমিকায় থেকে যায়। এমন না যে ক্যাথেরিনও ফ্রেডেরিকের অনুরক্ত ছিলেন, বরং অনেক ঐতিহাসিকই মনে করেন সম্রাজ্ঞী এলিজাবেথের মতই ক্যাথেরিন প্রুশিয়ানদের ঘৃণা করতেন। কিন্তু তিনি তখন মাত্র সিংহাসনে বসেছেন। ক্ষমতা শক্ত করাই তার বড় চ্যালেঞ্জ। এ সময় প্রুশিয়ার সাথে লড়াইয়ের কোনো সুফল ক্যাথেরিন দেখতে পাচ্ছিলেন না।
রাশিয়ানদের প্রস্থানের পর ফ্রেডেরিক শোয়াইডনিতজ পুনরুদ্ধার করতে মার্শাল ডনের মুখোমুখি হলেন।জুলাইয়ের ২১ তারিখ বার্কেসডর্ফে (বর্তমান পোল্যান্ডে) ডন হেরে যান। রাইখেনবাখে অগাস্টের ১৬ তারিখ দ্বিতীয়বার তিনি পরাস্ত হলে অক্টোবরের ৯ তারিখ শোয়াইডনিতজ আবার চলে গেল ফ্রেডেরিকের হাতে। ঠিক বিশ দিন পর হেনরি আর জেনারেল সেডলিটজ ফ্রেইবার্গের সংঘর্ষে অস্ট্রিয়ানদের পিছু হটতে বাধ্য করেন।
ইতোমধ্যে ফ্রেডেরিক কৌশলে অটোমানদের উস্কে দিতে থাকেন অস্ট্রিয়ার প্রতি। মারিয়া থেরেসা হতভম্ব। প্রুশিয়া প্রায় হাতের মুঠোয় চলে এসেছিল, কী থেকে কী হয়ে গেল! তিনি পরিস্কার বুঝে গেলেন যুদ্ধ করে আর ফ্রেডেরিককে টলানো যাবে না। রাশিয়ার পক্ষ ত্যাগের পরেও কয়েক মাস তিনি লড়াই জারি রাখেন, কিন্তু বিজয়ের পাল্লা ফ্রেডেরিকের দিকেই হেলে ছিল। সিলিসিয়া আর স্যাক্সোনির অধিকাংশ এলাকাতেই তার নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে। অবশেষে ২৯ নভেম্বর, ১৭৬২ সালে আলোচনার প্রস্তাব পাঠালেন হাবসবুর্গ সম্রাজ্ঞী।
শান্তিচুক্তি
যদিও যুদ্ধের শুরুতে ইংল্যান্ড আর প্রুশিয়া আলাদা আলাদা করে শান্তি স্থাপন না করার সমঝোতা ছিল, কিন্তু তৃতীয় জর্জের সিংহাসনে আরোহণ এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রুশিয়া বিরোধীদের প্রাধান্যে লড়াইয়ের ইতি টানতে দুটি আলাদা চুক্তির দরকার হয়। সেভেন ইয়ার্স ওয়ারের পটভূমিতে ইংল্যান্ড আর ফ্রান্সের মধ্যে ফ্রেঞ্চ-ইন্ডিয়ান ওয়ার এবং তৃতীয় কর্ণাটক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এই দুই পক্ষ ১০ ফেব্রুয়ারি ১৭৬৩ সালে ট্রিটি অফ প্যারিস সম্পাদন করে, যেখানে হ্যানোভার এবং স্পেনও স্বাক্ষর করেছিল। পর্তুগাল স্বাক্ষরকারী না হলেও তাদের একটি পক্ষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এদিকে অস্ট্রিয়া আর প্রুশিয়া নিজেদের সংঘাতকে তৃতীয় সিলিসিয়ান যুদ্ধ বলে বিবেচনা করত, তাদের মধ্যে আলোচনা আরম্ভ হয় ১৭৬২ সালের ডিসেম্বর থেকেই। শর্তাবলী নিয়ে দু’পক্ষ একমত হলে পরের বছর ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখে ড্রেসডেন এবং লিপজিগের মধ্যবর্তী এক স্থানে তারা ট্রিটি অফ হুবার্টসবার্গ (Treaty of Hubertusburg) স্বাক্ষর করে।
এই মহাযুদ্ধে বিজয়ী নির্ধারণ করা খুব কঠিন। যুদ্ধ যখন শেষ হয় তখন ইউরোপে মোটামুটি একটা অচলাবস্থা বিরাজ করছিল, যেহেতু কোনো পক্ষই প্রাধান্য ধরে রাখতে পারেনি। তবে উত্তর আমেরিকা এবং ভারত উপমহাদেশে স্পষ্টতই ফ্রান্স ইংল্যান্ডের কাছে পরাজিত হয়েছিল। তাই তাদের মূল্যও দিতে হয় সেরকম। ট্রিটি অফ প্যারিস অনুযায়ী আমেরিকার মিসিসিপি নদীর পূর্বে সমস্ত অঞ্চল (নিউ অরলিন্সের পার্শ্ববর্তী এলাকা ব্যতিত), ক্যারিবিয়ানের গ্রেনাডা, সেন্ট ভিনসেন্ট, ডমিনিকা, টোবাগো এবং ১৭৪৯ সালের পর ভারত উপমহাদেশের দখলকৃত সমস্ত এলাকা ফ্রান্স ইংল্যান্ডের কাছে ছেড়ে দেয়। জার্মানির হ্যানোভার, ব্রান্সউইক এবং হেসে অঞ্চল থেকেও তারা সেনা প্রত্যাহার করে। ইংল্যান্ড তাদের ফিরিয়ে দিল গুয়াডালুপ, মার্টিনিকসহ আরো কিছু ক্যারিবিয়ান ও আটলান্টিকের কয়েকটি দ্বীপ, সেন্ট লুসিয়া ও সেনেগালের উপনিবেশ। স্পেনও খালি হাতে ফিরল না। তারা হাভান এবং ম্যানিলা ফিরে পায়, বিনিময়ে ইংল্যান্ডের হাতে তুলে দিতে হয় ফ্লোরিডা। স্পেনের বিশ্বস্ততার জন্য ফ্রান্স তাদেরকে নিউ অরলিন্সসহ লুইজিয়ানা দিয়ে দিল।
রাশিয়া যখন ফ্রেডেরিকের সাহায্যার্থে এগিয়ে এসেছিল তখন ফ্রেডেরিক চিন্তা করেছিলেন পিটারকে পূর্ব প্রুশিয়া দিয়ে তার বিনিময়ে স্যক্সোনি অধিকার করে নেবার। কিন্তু পিটার নিহত হলে তিনি সেই পরিকল্পনা থেকে সরে আসেন। তার চাপাচাপিতে শান্তি আলোচনায় রাশিয়ার কোনো স্থান হলো না, অবশ্য তারা আগেই যুদ্ধ থেকে নাম কাটিয়ে নিয়েছিল। তবে ফ্রেডেরিক স্যাক্সোনি ত্যাগে অস্বীকৃতি জানাতে থাকলেন যদি না এর ইলেক্টর পোলিশ রাজা অগাস্টাস ক্ষতিপূরণের দাবি তুলে না নেন।
মারিয়া থেরেসা সিলিসিয়ার গ্লাতয এলাকা রেখে দিতে চাইলেও প্রুশিয়া তীব্র বিরোধিতা করে। শেষ পর্যন্ত ১৭৪৮ সালের আগে যে সীমান্ত ছিল সেখানেই ফিরে যেতে সবাই সম্মত হয়। ফ্রেডেরিক সম্পূর্ণ সিলিসিয়ার উপর ক্ষমতা অর্জন করেন, স্যাক্সোনি পূর্বের মতো তৃতীয় অগাস্টাসের হাতে চলে যায়। মারিয়া থেরেসার প্রাপ্তি বলতে এটুকুই যে ফ্রেডেরিক তার ছেলে জোসেফের হলি রোমান এম্পেরর নির্বাচনের উপর থেকে আপত্তি প্রত্যাহার করে নেন, ফলে জোসেফের অভিষেক নিশ্চিত হয়ে যায়।
সাত বছরের রক্তক্ষয়ী এই লড়াইকে চার্চিল প্রথম মহাযুদ্ধ বলে আসলে ভুল করেননি। সারা পৃথিবী জুড়ে এই সংঘাত যেকোনো সময়ের বিচারেই ভয়াবহ। তবে দুই বিশ্বযুদ্ধের মতো এখানে জার্মানির পরাজয় হয়নি। সুস্পষ্ট বিজয়ী না থাকলেও প্রুশিয়ার মতো ছোট একটি দেশের রাজা হয়ে ফ্রেডেরিক যেভাবে তৎকালীন তিন পরাশক্তির মোকাবেলা করে টিকে ছিলেন তাতে তিনি পুরো ইউরোপের শ্রদ্ধা অর্জন করেন। শক্তিশালী প্রতিপক্ষ বা বন্ধু হিসেবে প্রুশিয়ার সম্মান বহুগুণে বেড়ে যায়। সমীহ জাগানিয়া নেতা হিসেবে ফ্রেডেরিক সমাদৃত হন।