পনের শতকের মাঝামাঝিতে জন্ম নেওয়া কাতেরিনা স্ফোরৎজা ছিলেন একজন সত্যিকার সাহসী যোদ্ধা ও শাসক। জন্মেছিলেন ইতালীয় এক অভিজাত পরিবারে, জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত তাকে তৈরি করেছে একজন যোদ্ধা হিসেবে। মানুষকে শাসন করার অভ্যাসটা তার রক্তেই ছিল, তার সঙ্গে আভিজাত্য মিশে হয়ে গিয়েছেন মানুষের সমীহের কারণ। খুব অল্প বয়সেই বিয়ে হয়েছিল তার, তারপর বাস্তবতার সম্মুখীন হয়ে বারবার বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়েছে।
তার চিন্তার দক্ষতা আর রণাঙ্গনে দেখানো সাহসের কারণে সবার চোখে তিনি হয়ে গিয়েছিলেন একজন সাহসী, আপোষহীন যোদ্ধা। স্বামী-সন্তান হারানোর বেদনা কিংবা কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠের নীরবতা তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। সুপ্রাচীন সৌন্দর্যচর্চাকে আবার জীবন্ত করে তুলেছেন বইয়ের পাতায়। তার আলকেমির চর্চা পথ দেখিয়েছিল পরবর্তী শতাব্দীকে। কীভাবে কাতেরিনা এত কিছু করে গেলো ৪৬ বছরের এই ক্ষুদ্র জীবনে, আজ সেটাই জানাবো।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা
কাতেরিনার জন্ম ১৪৬৩ সালে ইতালির মিলানে। তার বাবার নাম গেলিয়াৎসো মারিয়া স্ফোরৎজা এবং মা লুক্রেৎসিয়া লেন্ড্রিয়ানি। কাতেরিনার বাবা ছিলেন মিলানের একজন স্বাধীন শাসক, সেখানে তার পরিচিতি ছিল একজন নৃশংস, নারীলোভী এবং অত্যাচারী শাসক হিসেবে। কাতেরিনা গেলিয়াৎসোর অবৈধ সন্তান হওয়ার কারণে তার শৈশব কেটেছে পরিবারের বাইরে। অবশেষে ৪ বছর বয়সে তার বাবা তাকে গ্রহণ করে নেন এবং নিজের অন্যান্য সন্তানদের সঙ্গে একত্রে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দেন। এখানে পিতার দায়িত্ব পালনের চেয়ে গেলিয়াৎসো আঞ্চলিক রাজনীতির ভবিষ্যত চিন্তা থেকেই কাতেরিনাকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। কারণ সেই সময়ে রাজনীতি এবং যুদ্ধের একটা বিশাল পর্ব আবর্তিত হতো বিয়ের মাধ্যমে।
বাবার কাছে সৎ মায়ের তত্ত্বাবধানে বেড়ে উঠতে থাকে ছোট কাতেরিনা। তার জন্য সমসাময়িক সব শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। তার বয়স যখন ১০ বছর ততদিনে কাতেরিনার সৌন্দর্য আর দেহসৌষ্ঠব ফুটে উঠতে শুরু করেছিল। ঠিক তখনই তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া জিরোলামো রিয়ারিওর। তাদের পরিচয়ের ৪ বছরের মাথায় কাতেরিনার সঙ্গে জিরোলামোর বিয়ে হয়। এখানেই তার কৈশোরের পর্ব শেষ হয়ে বিবাহিত জীবনের সূচনা হয়।
প্রথম বিয়ে এবং ক্ষমতায় আরোহণ
জিরোলামো যখন কাতেরিনাকে বিয়ে করে তখন তার বয়স ছিল ২৯ বছর। সে একজন সুপুরুষ ছিল না, কিন্তু পোপ চতুর্থ সিক্সটাসের ভাইপো হওয়ার জেরে নিজেকে কাতেরিনার যোগ্য করে নেয় সে। চারিত্রিক দিক থেকে জিরোলামো ছিল খুবই নিষ্ঠুর প্রকৃতির, কাতেরিনার বাবার মতোই নারীলোভী। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে কাতেরিনা তার এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকেই আপন করে নিয়ে ভালোবেসে ফেলে। তাদের বিবাহিত জীবনে স্বামীকে ভালোবাসার উপহারস্বরূপ কাতেরিনা ৮ সন্তানের মা হয়।
১৪৭৭ সালে কাতেরিনা রোমে চলে আসে স্বামীর কাছে, পরবর্তীতে ১৪৮১ সালে তাকে ‘কাউন্টেস অব ফর্লি‘ পদবিতে ভূষিত করা হয়। এর মাধ্যমেই মূলত কাতেরিনা আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতার স্বাদ উপভোগ করতে শুরু করে।
১৪৮৪ সালে পোপ সিক্সটাসের মৃত্যুর পরপরই একদল বিক্ষোভকারী রিয়ারিওর একটি বাসস্থানে হামলা করে এবং লুটপাট চালায়। তাদের হামলার কারণে সেটি প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। এই ঘটনার পর কাতেরিনা নিজে থেকে তদন্ত করার উদ্যোগ নেয়, পরবর্তীতে বাহিনী পাঠিয়ে রোমের ‘সেন্ট এঞ্জেলো‘ দুর্গ দখল করে নেয়। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২১ বছর এবং সে ছিল ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা! এই অভিযানের মাধ্যমেই মূলত কাতেরিনার প্রতি তার সেনাবাহিনীর সমর্থন প্রকাশ পায়। বিয়ের পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় আরোহণও তৎকালীন রোমান সমাজে ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তারা সেটা সাদরেই গ্রহণ করেছিল।
কাতেরিনার অভিযানের পর রোমের কার্ডিনালরা জিরোলামোকে ‘ইমোলা’ এবং ‘ফর্লির’ শাসক হিসেবে সমর্থন ব্যক্ত করে, সেই সাথে তাকে চার্চের ক্যাপ্টেন জেনারেল পদে ভূষিত করে। এছাড়াও হামলার কারণে তার বসতবাড়ির যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার জন্যও যাবতীয় অর্থ সহায়তার প্রস্তাব দেয়। জিরোলামো কার্ডিনালদের এসব পদবি ও প্রস্তাব মেনে নেন।
কার্ডিনালদের সঙ্গে জিরোলামোর সমঝোতাগুলো কাতেরিনা পর্যবেক্ষণ করছিল। কার্ডিনালদের ‘স্বপ্রণোদিত’ হয়ে সব দাবি মেনে নেওয়ায় তার মনে কীসের জন্য সন্দেহ জাগে। তাই কাতেরিনা কার্ডিনালদের সঙ্গে একপ্রকার অসহযোগীভাব প্রকাশ করে। কার্ডিনালরা কাতেরিনার মনোভাব বুঝতে পেরে সকল সিদ্ধান্ত তার নির্দেশনাতেই হবে বলে মেনে নেয়। এতে করে চুক্তিগুলো মেনে চলার ব্যাপারে কাতেরিনা শক্ত একজন সাক্ষীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এদিকে জিরোলামো কাতেরিনাকে দেওয়া পদবি কেড়ে নেয়। কারণ কার্ডিনালরা তাকে বুঝাতে সক্ষম হয় যে, একজন নারী হয়ে এমন ক্ষমতার ব্যবহার তার জন্য গলার কাঁটা হবে। এর মধ্য দিয়ে মূলত তার দুর্গটি কার্ডিনালদের হস্তগত হয়ে পড়ে। প্রায় ১৩ দিনের অচলাবস্থা কাটিয়ে কাতেরিনা দুর্গটি ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়।
‘ইমোলা’ এবং ‘ফর্লির’ লর্ডশিপ নেওয়ার পর থেকেই সেখানকার লোকজন রিয়ারিওকে মেনে নিতে পারছিল না। লোকেদের সম্পদ জব্দ করা এবং ক্রমবর্ধমান ট্যাক্সের কারণে মানুষ তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। কাতেরিনা নিজের সেনাবাহিনীর সহায়তায় একে একে বিদ্রোহীদের দমন করতে শুরু করে, যাদের বেশিরভাগেরই শিরচ্ছেদ করা হয়। ১৪৮৮ সালে ওর্সি ভ্রাতৃদ্বয় রিয়ারিওকে মারার চূড়ান্ত ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা করে এবং সফলও হয়। রিয়ারিওকে হত্যা করার পর তারা কাতেরিনা ও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বন্দি করে।
স্বামী হত্যার প্রতিশোধ
কাতেরিনা বন্দি হওয়ার আগমুহূর্তে মিলানে তার চাচার কাছে চিঠি পাঠায়, যেখানে লেখা ছিল, যেকোনো পরিস্থিতিতে যাতে দুর্গের প্রবেশাধিকার ওর্সিদের হাতে না যায়। সেই সময় দুর্গের প্রধান দায়িত্বে ছিলেন তোমাজো ফিও। ওর্সিরা যখন দুর্গে আসে সেটা দখল করার জন্য, তারা বন্দি কাতেরিনা ও তার পরিবারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কিন্তু ফিও তাতে সাড়া না দিয়ে তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। ওর্সিরা কাতেরিনাকে মেরে ফেলার হুমকি দিলে ফিও বলেন,
তোমরা এটা কখনোই করতে পারবে না। কারণ কাতেরিনার ভাই বর্তমানে মিলানের শাসক। তোমরা তার প্রতিশোধের কথা ভুলে যেও না।
প্রথমবার দুর্গ দখলে ব্যর্থ ওর্সিরা আবার ফিরে আসে। এবার কাতেরিনা নিজের বুদ্ধি কাজে লাগায়। দুর্গের বাইরে অপেক্ষমান দখলকারীদের কাছে সে প্রস্তাব দেয়, তাকে যেনো ভেতরে গিয়ে ফিওর সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হয়। যাতে ফিওকে সে তাদের দাবির ব্যাপারে রাজি করাতে পারে। তারা কিছুক্ষণ দ্বিধাগ্রস্ত থাকলেও পরে তাকে ভেতরে যেতে দিতে রাজি হয়। কারণ তাদের হাতে এখনো কাতেরিনার সন্তানরা রয়েছে।
ছাড়া পেয়ে কাতেরিনা দুর্গের ভেতর চলে যায়, কিন্তু আর ফিরে আসে না। পরবর্তীতে সে আবার আততায়ীদের মুখোমুখি হয়ে জানিয়ে দেয়, “এই দুর্গ তাদের হাতে কিছুতেই দেবে না।” এতে আততায়ীরা তার সন্তানদের মেরে ফেলার হুমকি দিলে কাতেরিনা তাদের হুমকি কর্ণপাত না করেই জানায়,
“তাদের মেরে ফেললে সে আবারও সন্তান জন্ম দিতে সক্ষম।”
কাতেরিনার এমন আচরণে তারা ঘাবড়ে যায়। দ্বিধাগ্রস্ত ওর্সি বাহিনীকে দুর্গের সৈন্যরা সহজেই কাবু করে ফেলে। পরবর্তীতে আততায়ীদেরসহ তাদের পরিবারের লোকজনদেরও হত্যা করা হয়।
কাতেরিনার দ্বিতীয় বিয়ে এবং ক্ষমতার পালাবদল
প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পর কাতেরিনার বড় ছেলে ওত্তোভিয়ানোকে শাসক হিসেবে নিয়োগ দেয় সে। কিন্তু ওত্তোভিয়ানো সেই সময় প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়ায়, আড়াল থেকে কাতেরিনাই সকল শাসন কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে; যার স্থায়িত্ব ওত্তোভিয়ানো বড় হওয়ার পরও রয়ে যায়। ছায়া শাসক হিসেবে কাতেরিনা বেশ কিছু সামরিক ও রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করে।
ভৌগোলিক দিক থেকে তার শহরের অবস্থান ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই কাতেরিনা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করে। যার মাঝে অন্যতম ছিল পার্শ্ববর্তী শহরের শাসকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরির জন্য পারিবারিক বিয়ের ব্যবস্থা করা এবং তাদের বিভিন্ন উপঢৌকন পাঠানো। এতে করে আশপাশের শহরগুলোর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব তৈরি হয়। টালমাটাল রোমান যুগে এমন সিদ্ধান্ত খুবই প্রয়োজনীয় ছিলো, যাতে করে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হলে সহায়তা পাওয়া যায়।
শহরের নিরপত্তা আর শান্তি নিশ্চিত করতে গিয়ে একসময় কাতেরিনা বুঝতে পারে, সে সঙ্গীর অভাববোধ করছে। কিছুদিনের মাথায় কাতেরিনা প্রেমে পড়ে যায় দুর্গের সেনাপতি ফিওর ছোটোভাই জ্যাকোমোর। সেই সময় জ্যাকোমোর বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর। ইতোমধ্যে তাদের এই প্রেম বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত জ্যাকোমোও ছিল তার প্রথম স্বামীর মতো নিষ্ঠুর প্রকৃতির, যা তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে তাকে অল্প কিছুদিনের ভেতর প্রাণ দিতে হয়। ধারণা করা হয়, এই হত্যাকান্ডে পারিবারিক সমর্থনও পেয়েছিল আততায়ীরা।
তৃতীয় বিয়ে এবং ক্ষমতার পতন
কাতেরিনার সঙ্গে কারোরই যেন বেশিদিন থাকা হচ্ছিল না! কারণ তার দুজন স্বামীই আততায়ীদের হাতে নিহত হয়েছিল। ভাগ্য যখন তার সঙ্গে এমন করছিল, কাতেরিনাও আরেকবার ভাগ্যের দরজায় কড়া নাড়ে। সন্তানদের অনুমতি নিয়ে ১৪৯৭ সালে সে আবার বিয়ের পিড়িতে বসে! এবার সে বিয়ে করে জোভান্নি ডি পিয়ারফ্রান্সেসকো ডি মেডিসিকে। তারপর ১৪৯৮ সালে তাদের শেষ সন্তান জোভান্নি দেলে বান্দে নেরে জন্মগ্রহণ করে, এর কিছুদিন পরেই কাতেরিনার তৃতীয় স্বামীও মৃত্যুবরণ করে! তবে এবার কোনো আততায়ীর হাতে নয়, বরং তার মৃত্যু হয়েছিল প্রাকৃতিক কারণে।
কাতেরিনা নিঃসঙ্গতার ভাগ্যের খেলায় হেরে গিয়ে মনোযোগ দিল নিজ শহর ‘ইমোলা’ ও ‘ফর্লির’ উপর। তখন পার্শ্ববর্তী ‘মিলান’ ও ‘নেপলস’-এ যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছিলো। নিজ শহর রক্ষায় কাতেরিনা দৃঢ়প্রতিজ্ঞা ছিলো এবং যুদ্ধের সময়গুলোতে নীরব ভূমিকা পালন করে। নীরব থাকলেও ফ্রান্সের বিপক্ষে মিলান এবং পোপের প্রতি তার সমর্থন বজায় ছিল।
যুদ্ধপরবর্তী সময়ে পোপের পরিকল্পনা অনুযায়ী কার্ডিনাল ‘সেইজারে বর্জিয়া‘ ১৪৯৯ সালে ইমোলা’য় আক্রমণ করলে, কাতেরিনা নিজ সন্তান এবং পরিবারের লোকজনদের ফ্লোরেন্সে পাঠিয়ে দেয়। তারপর পোপ ষষ্ঠ আলেকজান্ডারকে বিষ প্রয়োগে হত্যার ষড়যন্ত্র করে সে, কিন্তু তার এই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়। সেনাবাহিনীর সহায়তায় নিজ শহর রক্ষায় স্বশরীরে কাতেরিনা রণাঙ্গনে নেমে পড়ে। কিন্তু বন্ধু শহরগুলো থেকে পর্যাপ্ত সেনা সহায়তা না পেয়ে তার বাহিনী নিয়ে একাই লড়তে শুরু করে সে। বর্জিয়া বারবার কাতেরিনাকে আত্মসমর্পন করার আহবান জানায়। কাতেরিনা এতে কর্ণপাত না করে নিজের সর্ব্বোচ্চ সামর্থ দিয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু অল্পসংখ্যক সেনাবাহিনী নিয়ে শহরকে রক্ষা করা তার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এতে করে বর্জিয়ার হাতে ইমোলার পতন হয়। সেই সাথে ফর্লিরও বিদায়ঘন্টা বেজে ওঠে।
সব কিছু হারিয়ে কাতেরিনা শেষ চেষ্টা হিসেবে রাভালদিনো দুর্গ রক্ষার জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে থাকে। সামান্য কিছু সেনাবাহিনী নিয়ে কাতেরিনা বর্জিয়ার মুখোমুখি হয়। কাতেরিনাকে এভাবে সম্মুখে দেখতে পেয়ে বর্জিয়া অবাক হয়, কারণ তার লড়াই করার মানসিকতা তখন পর্যন্ত টিকে ছিল। কিছুদিন পর্যন্ত দুর্গ রক্ষা করতে পারলেও, বর্জিয়া দুর্গ দখল করতে সমর্থ হয় অবশেষে এবং কাতেরিনাকে বন্দি করে। তাকে ভ্যাটিকানের বেলদেভেরে প্রাসাদে ৪ মাস বন্দি রাখা হয়। অদম্য কাতেরিনা সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার ফন্দি আঁটে, কিন্তু তার সকল কৌশল ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে তাকে ভ্যাটিকান থেকে সেইন্ট এঞ্জেলোতে স্থানান্তর করা হয়। এখানে সে এক বছর বন্দি জীবন কাটানোর পর লর্ডশিপ পদবি ছেড়ে দেওয়ার শর্তে মুক্তি পায়।
আলকেমি চর্চা এবং মৃত্যু
মুক্তি পাওয়ার পর কাতেরিনা ফ্লোরেন্সে চলে আসে নিজ পরিবারের কাছে। তার বাকি জীবন কাটে নিজ সন্তান ও নাতি-নাতনিদের সঙ্গ পেয়ে। কাতেরিনার সন্তানদের ভেতর একমাত্র ছোট ছেলে জোভান্নি ছিলো তার মতো সাহসী যোদ্ধা।
একসময় কাতেরিনা আলকেমি চর্চার দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং মৃত্যু পর্যন্ত নিজের গবেষণা কাজ চালিয়ে যায়। তার সম্পাদিত বইয়ের নাম ছিল ‘এক্সপেরিমেন্তি‘, যেখানে সে প্রায় ৪৫৪ রকমের বিভিন্ন রেসিপির বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে। মৃত্যুর আগপর্যন্ত সংগ্রহ করা এসব রেসিপিগুলো ছিলো মূলত ওষুধ, কসমেটিক্স এবং আলকেমি চর্চা নিয়ে। তার বইতে নারীদের রূপচর্চার বিভিন্ন উপাদান এবং উপায় লিপিবদ্ধ হয়েছে। নারীদের ঠোঁটের বিভিন্ন রঙ, চুলের জন্য বিভিন্ন রকম রঙ, অপ্রয়োজনীয় লোম অপসারণ, স্পা, ওজন কমানো এবং নারীদের গর্ভের উর্বরতা বজায় রাখার উপায় নিয়ে লেখা রয়েছে।
এছাড়াও প্লেগের প্রতিষেধক, বিভিন্ন দূরারোগ্য ব্যাধি থেকে বেঁচে থাকার উপায়, বিষ তৈরি, সার্জারির সময় চেতনানাশকের ব্যবহার, বয়স ধরে রাখার মতো বিষয়গুলো সংযুক্ত ছিলো। তবে এই কাজ কাতেরিনা একা করেনি, তার সঙ্গে যোগ দিয়েছিল ইতালির জ্ঞানপিপাসু বহু নারী। পরবর্তী শতাব্দীর জন্য তাদের পথ দেখিয়ে গিয়েছে কাতেরিনার এই নিরলস বিজ্ঞানচর্চা।
ইতালি তো বটেই, সেই সময়ের আলকেমি চর্চার জন্য কাতেরিনার সংগ্রহীত রেসিপিগুলো ছিলো যুগান্তকারী এক সংযোজন। যার মূল্যায়ন সবাই করতে পেরেছিল, তৈরি হয়েছিল বিজ্ঞানের নতুন-নতুন শাখা নিয়ে আরও বিস্তর গবেষণার পথ। ইতালির রাজনীতিতেও তার এই গবেষণা বিশাল প্রভাব ফেলেছিল। অবশেষে ২৮ মে ১৫০৯ সালে ইতালির ফ্লোরেন্সে কাতেরিনা মৃত্যুবরণ করে। তার মৃত্যুর কারণ নিয়ে বহু কথা প্রচলিত হলেও, বেশিরভাগ মনে করেন, কাতেরিনা নিউমোনিয়া ভুগে মারা গেছে। বর্তমানে তার সম্পাদিত ‘এক্সপেরিমেন্তি’র একটিমাত্র কপির সন্ধান পাওয়া যায়, সেটাও একজন ব্যক্তিগত সংগ্রাহকের কাছে।