চিল-শকুনের জন্য মৃতদেহ উৎসর্গ করা! এ কী ধর্মের প্রথা!

মৃত্যু মানুষের জীবনের এক অবধারিত সত্য। কেউ একে অস্বীকার করতে পারেন না। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মানুষের কর্মময় জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। তবে একথা বলতে দ্বিধা নেই, প্রিয়জন হারানোর বেদনা কখনোই ভোলার নয়। অনুভূতিটাই কেবল একটু একটু করে ঝাপসা হয়ে আসে। কিন্তু তা কখনোই মন থেকে হারিয়ে যায় না।

মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তির সৎকার করা বহু প্রাচীন ও প্রচলিত প্রথা। আমাদের সমাজে আমরা মৃতদেহকে কবর দিতে কিংবা শ্মশানে চিতায় পোড়ানোতেই বেশি অভ্যস্ত। কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে মৃতদেহ সৎকার নিয়ে রয়েছে নানান অদ্ভুত রীতিনীতি। এর বেশ কিছু যেমনই অদ্ভুত, তেমনই বীভৎসও বটে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, ইন্দোনেশিয়ার দক্ষিণ সুলাওয়েসির তোরাজা গ্রামের লোকেরা মারা যাওয়ার পর মৃতদেহকে বিশেষ উপায়ে মমি করে সমাহিত করে থাকে। আবার, ভেনেজুয়েলার ইয়ানোমামি গোত্রের লোকেরা মৃতদেহকে সিদ্ধ করে স্যুপ হিসেবে খেয়ে থাকে। ফিলিপাইনের ইফুগাও অঞ্চলের মানুষেরা মৃতদেহকে বাড়ির সামনে সাজিয়ে রাখে।

বিভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী লোকজন এই নিয়ম-কানুন অত্যন্ত বিশ্বাস ও সম্মানের সাথে যুগ যুগ ধরে পালন করে আসছে, একবিংশ শতাব্দীতে এসেও যা বর্তমান।

মৃতদেহ নিয়ে এমনই এক অদ্ভুত প্রথা প্রচলিত রয়েছে পার্সি সমাজের মানুষের মাঝে। পার্সি ধর্মাবলম্বীদের প্রথা অনুসারে, তাদের কোনো প্রিয়জনের মৃত্যু হলে তারা মৃতদেহের সৎকার করেন না। মৃতদেহ কবর দেয়া বা পুড়িয়ে ফেলার সংস্কারেও তারা বিশ্বাসী নয়।

মৃতদেহ সৎকারের উদ্দেশ্যে চিল শকুনকে উৎসর্গ করার নির্দিষ্ট স্থান

বরং মৃতদেহকে খোলা আকাশের নিচে রেখে যাওয়াই পার্সিদের রীতি। চিল-শকুনে যাতে মৃতদেহ ছিঁড়ে খেতে পারে, সেই উদ্দেশ্যে কোনো খালি নিরিবিলি জায়গায় রেখে আসা হয় সেটি। হয়তো এটা ভেবে আপনি শিহরিত হচ্ছেন, প্রিয়জনের মৃতদেহকে এভাবে প্রাণীর খাদ্য হিসেবে রেখে আসা! এও কি সম্ভব? অবাক হলেও এটিই পার্সিদের ধর্মীয় রীতি যা তারা যুগ যুগ ধরে অনুসরণ করে আসছে।

পার্সিদের বিশ্বাস, এর মধ্য দিয়ে জগতের মাঝে মৃতদেহকে উৎসর্গ করা হয়৷ তারা বিশ্বাস করে, মারা যাওয়ার পরও পৃথিবীর খানিকটা উপকারে নিজেদের নিয়োগ করার মধ্যেই নিহিত মানব জীবনের পরিপূর্ণতা। যুগ যুগ ধরে তাই এই রীতি পালন করে আসছে পার্সি ধর্মাবলম্বী লোকেরা।

পার্সিদের চিল-শকুন কর্তৃক মৃতদেহ আহারের অবশিষ্টাংশ

পার্সিরা যে স্থানটিতে মৃতদেহ রেখে আসে, সেই সৎকার স্থানটিকে বলা হয় ‘টাওয়ার অফ সাইলেন্স’৷ টাওয়ার অফ সাইলেন্স জায়গাটি একটি ছাদবিহীন সুউচ্চ কাঠামো, নিচে একটি দরজা রয়েছে এবং ভিতরে রয়েছে কয়েকটি তাক। শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু ধর্মীয় ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে এবং নানা রীতিনীতির মাধ্যমে পার্সি পরিবারগুলি তাদের প্রিয়জনের মৃতদেহকে ঐ সকল তাকে রেখে আসেন। পরে ঐ স্থানে মৃতদেহ রেখে দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। অন্য কোনো মৃতদেহ রাখার জন্য বা বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ঐ দরজা আর খোলা হয় না।

খোলা ছাদ দিয়ে চিল, শকুন ইত্যাদি পাখি ভিতরে প্রবেশ করে মৃতদেহ খেতে আরম্ভ করে। আর এ প্রথার মাধ্যমে মৃতদেহ পৃথিবীকে উৎসর্গ করে সেখান থেকে ফিরে যান মৃতের পরিবারের লোকজন৷ আর তারপর সেই মৃতদেহের কী পরিণতি হয় তা তো সকলেরই জানা৷

পার্সি সভ্যতার নিদর্শন

কেন পার্সিয়ানরা এমন ধর্মীয় রীতিতে বিশ্বাসী? জানতে হলে এ ধর্মের একটু গভীরে যেতে হবে। মূলত পার্সিয়ানরা জরথ্রুস্ট ধর্মে বিশ্বাসী। ভারতীয় উপমহাদেশে এটি পারসিক বা পার্সি ধর্ম নামেও পরিচিত। ধর্মটি বহু প্রাচীন। ঐতিহাসিক মতানুসারে, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪৫৮ সাল থেকে এই ধর্মের প্রচলন শুরু হয়। জরথ্রুস্ট এমন একটি ধর্ম, যা একসময় প্রাচীন ইরানের একামেনিড, পার্থিয়ান, সাসানিয়ান সাম্রাজ্যের জাতীয় ধর্ম ছিল। বর্তমানে ধর্মটি আধুনিক ইরানের জরথ্রুস্ট সম্প্রদায় এবং ভারতের পার্সি সম্প্রদায় কর্তৃক পালিত হয়।

জরথ্রুস্টবাদে, পানি (আপো, আবান) এবং আগুন (আতার, আযার) হলো ধর্মীয় পবিত্রতার প্রতিনিধি। এ সম্পর্কিত শুদ্ধিকরণের আচার-অনুষ্ঠানসমূহকে ধর্মীয় জীবনব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পার্সি ঐতিহ্য অনুসারে মৃতদেহকে অপবিত্র ভাবা হয়। এ কারণে পানিতে মৃতদেহ ভাসিয়ে দেয়া বা আগুনে পুড়িয়ে ফেলা এ ধর্মে একদম নিষিদ্ধ। কারণ মৃতদেহকে কবর দেওয়া বা পোড়ানো অর্থ প্রকৃতিকে দূষিত করা বলেই পার্সিদের বিশ্বাস।

টাওয়ার অফ সাইলেন্সে রেখে আসা মৃতদেহ

মৃতদেহকে টাওয়ার অফ সাইলেন্সে রেখে আসার পক্ষে পার্সি ধর্মাবলম্বীদের যুক্তি হলো, ৫,০০০ বছর আগে পৃথিবীতে এমন এক সমাজ ছিল যেখানে গোর খননের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। কবর না দেওয়ার কারণে মৃতদেহ পঁচে যাতে জীবিত মানুষকে অসুস্থ ও জীবাণু আক্রান্ত করতে না পারে সেজন্য মৃতদেহকে সমাজ থেকে দূরে কোথাও ফেলে আসার ব্যবস্থা করা হয়। এ ব্যবস্থা অনুসরণের মধ্য দিয়ে সমাজের কোনরূপ বিনাশ না ঘটিয়ে মৃতদেহকে পশু পাখীদের ভক্ষণের জন্য রেখে আসাটাই ছিল সৎকারের নিয়ম। এরপর থেকেই লোকাচারের সূচনা এবং তা পরবর্তীতে পার্সিদের ধর্মীয় ব্যবস্থার সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে পড়ে।

মৃতদেহ রেখে আসার জন্যে নিরিবিলি স্থান

যতদূর শোনা যায় এই টাওয়ার অফ সাইলেন্সে মানুষের যাতায়াত একেবারেই নেই বললেই চলে। কোনো পার্সিয়ান মারা গেলে শুধুমাত্র তখনই ঐ পরিবারের নিকট আত্মীয়স্বজনের উপস্থিতি চোখে পড়ে এই স্থানটিতে। মৃতদেহ রাখতেই পার্সি পরিবারগুলি হাজির হয় এখানে। মৃতদেহ প্রকৃতিকে উৎসর্গ করে সেখান থেকে ফিরে যান মৃতদেহের পরিবারের লোকজন৷ এভাবে মৃতদেহকে পশুপাখির উদ্দেশ্যে রেখে আসার মধ্য দিয়ে পার্সি ধর্মে বিশ্বাসী মানুষেরা প্রকৃতিকে কিছু ফিরিয়ে দেন। আর এভাবেই তারা জীবনের সার্থকতা খুঁজে নেন। এমনতর বিশ্বাসে তারা বংশ পরম্পরায় মৃতদেহকে প্রকৃতির মাঝে ফেলে আসেন।

টাওয়ার অফ সাইলেন্সে পড়ে থাকা হাড়-গোড়

শোনা যায়, দিনের বেলাতেও এই টাওয়ার এত চুপচাপ থাকে যে পাতা পড়ার সামান্যতম আওয়াজেও আপনি চমকে উঠতে বাধ্য। ভাবতে পারেন কেউ বুঝি আপনাকে অনুসরণ করছে। ভারতের মুম্বাইয়ের মালাবার পাহাড়ের কাছে পার্সিদের এমনি এক টাওয়ার অফ সাইলেন্স রয়েছে যা কেবল অগুণতি মৃতদেহের অবস্থানের কথা জানান দেয়। মুম্বাইয়ের মতো এত জনবহুল শহরেও মৃতদের এমন ডেরার কথা জানলে চমকে উঠতেই পারেন! মৃতদের এই ডেরায় দিনের বেলাতেও অনেকে একা যেতে সাহস পান না। একটু ভাবুন তো, এমন এক দুর্গের সন্ধান আপনি পেলেন যেখানের ছাদে রয়েছে মৃতদেহের সারি! যার কোনোটা খাচ্ছে চিলে, কোনোটা শকুনে!

পার্সি টাওয়ার অফ সাইলেন্সের প্রবেশ পথ

মৃতের সৎকার করা মোটেও শুধুমাত্র মৃতব্যক্তির জন্য নয়, বরং সেটা জীবিতের প্রয়োজনে। তাকে মাটি চাপা দেওয়া, তাকে পুড়িয়ে ফেলা কিংবা নির্জন কোনো ভাগাড়ে ফেলে আসা এসবই করা হয় বিভিন্ন ধর্মীয় সংস্কার হিসেবে। তবে এসব কাজের পেছনে জীবিত মানুষের নিরাপত্তার বিষয়টিও ভাবা হয়। কোনো সৎকার প্রক্রিয়াই আসলে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার সুবিধা ও সুযোগের বাইরের কিছু নয়।

 

This article is Bangla Language. It's about Persian funeral system.

Rererences: 
1.socks-studio.com/2012/02/09/towers-of-silence-zoroastrian-architectures-for-the-ritual-of-death/
2. en.wikipedia.org/wiki/Tower_of_Silence
3. en.wikipedia.org/wiki/Parsi
4. treehugger.com/culture/vultures-may-again-dispose-dead-mumbai-parsi-community.html
5. hinduwebsite.com/zoroastrianism/funeral.asp

Featured Image: shikharkhabar.com

Related Articles

Exit mobile version