ধরে নিন, পৃথিবী থেকে ২,০৫,০০০ মাইল দূরে চাঁদের পথে আপনার ৩৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের স্পেসশিপটির অক্সিজেন ট্যাঙ্কের একটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আপনার সাথে আছে আরো দুই অভিযাত্রী। বাতিটা নিভে আসবে, পর্যাপ্ত খাবার পানি নেই, ইমার্জেন্সি সিস্টেম চালু হয়ে গেছে। পুরো স্পেসশিপে কার্বন ডাই-অক্সাইড ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। শত প্রতিকূলতা কাটিয়েও কিনা আপনি চার দিন পর চাঁদের পৃষ্ট থেকে মাত্র ২৫৪ কিলোমিটার কাছ থেকে, চাঁদে পা না রাখার কষ্ট বুকে চেপে পৃথিবীতে ফিরে এলেন।
কল্পকাহিনীর মতো শোনাচ্ছে? কল্পকাহিনীকেও হার মানিয়ে দিয়ে এপোলো-১৩ এর অভিযাত্রীরা ঠিক এমনই কঠিন পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করেও পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন। ১৯৬৯ এই এক বছরেই এপোলো-১১ আর এপোলো-১২ এর সফলতা নাসাকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলো। তাই ১১ এপ্রিল ১৯৭০ এ ১৩ সংখ্যার সব কুসংস্কার ভেঙ্গে এপোলো-১৩ এর উৎক্ষেপণ।
কমান্ডার হিসাবে ছিলেন জেমস আর্থার লাভেল। তার সাথে কমান্ড মডিউলের পাইলট হিসাবে ছিলেন জন সুইগার্ট এবং লুনার মডিউলের পাইলট হিসাবে ছিলেন ফ্রেড হেইজ। এপোলো মিশনের এর প্রতীক হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছিলো গ্রীক সৌর দেবতা ‘এপোলো’-কে । এপোলো-১৩ মিশনের স্লোগান ছিলো একটি ল্যাটিন বাক্য “Ex Luna, Scientia” যার অর্থ ছিলো “চাঁদ থেকে, জ্ঞানের জন্যে!” মিশনের কমান্ড মডিউলের নাম ছিলো ওডিসি (Odyessey), আর লুনার মডিউলের নাম ছিলো অ্যাকুয়ারিস (Aquaris)।
মূলত চাঁদের ফ্রা মাউরো ফর্মেশন (Fra Mauro Formation) এলাকায় বিস্তর অনুসন্ধান চালানোর পরিকল্পনার অংশ হিসাবে এপোলো-১৩ কে ডিজাইন করা হয়েছিলো। এটি সেই উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হলেও পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭১ সালে এপোলো-১৪ সেই ফ্রা মাউরো এলাকায় পৌছাতে সক্ষম হয়। ১১ এপ্রিল ১৯৭০ সালে কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে চাঁদের উদ্দেশ্যে এপোলো-১৩ মিশন শুরু হয়। উৎক্ষেপণের সময় লঞ্চপ্যাডের ভোল্টেজে সামান্য তারতম্য দেখা যায়, কিন্তু সেটি তাৎপর্যপূর্ণ কিনা তা নিয়ে উৎক্ষেপণকেন্দ্রে থাকা বিজ্ঞানীরা সেই সময়ে একমত হতে পারেননি।
পরবর্তীতে নাসার অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে লঞ্চ প্যাডের এই সমস্যাটি স্পেসশিপের অক্সিজেন ট্যাঙ্কটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে বেশ বড় রকমের ভূমিকা পালন করেছিলো। এপোলো-১৩ মিশনের সময় ক্ষতিগ্রস্ত অক্সিজেন ট্যাঙ্কটি (No. 2 oxygen tank, serial number 10024X-TA0009) এপোলো-১০ এর পরীক্ষামূলক অভিযানেও ব্যবহৃত হয়েছিলো। এমনকি এই ট্যাঙ্কটির সূক্ষ্ম ত্রুটিগুলো বিশেষজ্ঞদের ছাড়পত্র নিয়েই চাঁদের দিকে রওনা হয়েছিলো। পরবর্তীতে এই সূক্ষ্ম ভুলই কাল হয়ে দাঁড়ায় এই এপোলো-১৩ মিশনের জন্যে। চাঁদের দিকে রওনা হবার সুদীর্ঘ ৫৬ ঘণ্টা পরে বিপত্তির শুরু।
মহাকাশযান থেকে প্রায় সাড়ে ছয় মিনিটের লাইভ টিভি সম্প্রচার শেষ করেন লুনার মডিউলের পাইলট হেইজ। হিউস্টনে অবস্থিত নাসার জনসন স্পেস সেন্টারটি থেকে এই যানটির নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছিলো। তাই তাদের রুটিন কমান্ড অনুযায়ী ২ নম্বর ট্যাঙ্কটি চালু করার নির্দেশ দেয়। চালু করার মিনিট দুয়েক পরেই মহাকাশযানে থাকা সবাই একটি শব্দ শুনতে পান এবং পৃথিবীর সাথে ১.৮ সেকেন্ডের জন্যে সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তখনই মহাকাশযান থেকে হিউস্টন ফ্লাইট কন্ট্রোল সেন্টারে কমান্ডার লাভেল বার্তা পাঠান- “Houston, we’ve had a problem”
প্রথমে মনে করা হয়েছিলো কোনো গ্রহাণু সম্ভবত মহাকাশযানে আঘাত করেছে। কিন্তু দ্রুতই সে ভুল ভাঙে। দেখা যায় যে, কমান্ড মডিউলের এক নাম্বার ট্যাংকটি খালি, দুই নাম্বারটি ক্ষতিগ্রস্ত। এই সংকটাপন্ন অবস্থায় নাসার ফ্লাইট কন্ট্রোল সেন্টার থেকে চাঁদে যাবার প্ল্যান সম্পূর্ণ বাতিল করে পৃথিবীর দিকে ফিরে আসার নির্দেশ দেয়া হয়। তাই এই অবস্থায় তাই বাধ্য হয়ে ২ জনের জন্যে নির্মিত লুনার মডিউলে ৩ জনকেই চলে আসতে হয়। এই মডিউলকে লাইফবোট হিসাবে ব্যবহার করে পৃথিবীমুখে যাত্রা শুরু করে এপোলো-১৩।
লুনার মডিউলে কার্বন ডাই অক্সাইড অপসারণকারী রাসায়নিক ক্যানিস্টার ২ জনের এবং খুবই স্বল্প সময়ের প্রয়োজনের জন্যে নির্মিত হওয়ায় জীবনের আশা একরকম বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন তিন অভিযাত্রী। কিন্তু কমান্ডার জেমস আর্থার লাভেল ছিলেন ভিন্ন ধাতুতে গড়া। পৃথিবীতে ফিরবেন বলে সিদ্ধান্ত নেয়ার পরেই নিজেদের মতো করে ক্যানিস্টার ডিজাইন করে কমান্ড মডিউলের স্পেয়ার পার্টস দিয়ে তৈরী করে নেওয়া হয়েছিল ক্যানিস্টার! কমান্ড মডিউলের ব্যাটারি পাওয়ার বাঁচাতে সেটি পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারণ পৃথিবীতে ফিরে এসে ল্যান্ডিং করতে কমান্ড মডিউলটি সচল করতে হবে।
নাসার ইঞ্জিনিয়াররা ততক্ষণে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বিকল্প রাস্তা খুঁজে বের করা শুরু করেন যা অনুসরণ করে ফিরে আসা যাবে পৃথিবীতে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে পৃথিবীর কক্ষপথে ফিরে আসার জন্যে শুরু হয় যুদ্ধ। হিউস্টন মিশন কন্ট্রোলের দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারদের সূক্ষ্ম হিসাব থেকে বের হয়ে আসে কাঙ্ক্ষিত ল্যান্ডিং কক্ষপথটি যাতে চাঁদের মহাকর্ষ শক্তিকে কাজে লাগিয়েই কম জ্বালানি খরচ করে ফেরা যাবে পৃথিবীতে।
পৃথিবীর কক্ষপথে পৌছে এপোলো-১৩ মিশন মুখোমুখি হয় শেষ চ্যালেঞ্জের। চার দিন ধরে লাইফবোট হিসাবে ব্যবহার করে আসা লুনার মডিউলকে ছেড়ে দিতে হবে, যাতে কমান্ড মডিউল নিয়ে প্রত্যাশিত ল্যান্ডিং করা যায়। কিন্তু তখনো মহাকাশচারীরা নিশ্চিত ছিলেন না যে কমান্ড মডিউলটিকে পুনরায় সচল করে তোলা যাবে কিনা। ভাগ্য নিতান্তই ভালো ছিলো এপোলো-১৩ মিশনের অভিযাত্রীদের। মানসিকভাবে তীব্র চাপের মধ্যেও ঠিক সময়ে লুনার মডিউলকে ছেড়ে দিতে পেরেছিলেন তারা, যেটি পরে বায়ুমন্ডলে ঢোকার সময় পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
কমান্ড মডিউল ওডিসি তখন রুপকথা লেখার দ্বারপ্রান্তে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢুকেই রেডিও কন্টাক্ট আবার চালু হয়ে যায় আর এর কিছুক্ষণ পরেই সফলভাবে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ল্যান্ড করে এপোলো-১৩। নাসার ফ্লাইট কন্ট্রোলের একাধিক রিকভারি জাহাজ সেখানে উপস্থিত ছিলো। আশ্চর্যজনক হলে ও সত্য যে অভিযাত্রীদের সবাই সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলেন। যদিও লুনার মডিউলের পাইলট ফ্রেড হেইজের অপরিমিত পানি গ্রহণের কারণে মূত্রথলিতে সংক্রমণ দেখা দেয়। মূলত চাঁদের দিক পৃথিবীর দিকে গতিপথ পরিবর্তনের সময়টুকুতে ফ্লাইট কন্ট্রোল থেকে সাময়িক মূত্র বিসর্জনের উপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিলো। আর ভুল করে বেচারা হেইজ সারা রাস্তা মূত্র চেপে গিয়েছিলেন। যদিও এটি তেমন গুরুতর ছিলো না।
এপোলো-১৩ এখনো পর্যন্ত মনুষ্যবাহী স্পেসশিপ হিসাবে সবচেয়ে বেশী দূরত্ব (৪,০০,১৭১ কিলোমিটার) অতিক্রম করার রেকর্ডধারী। কারণ এই মহাকাশযানটি এমন এক সময়ে চাঁদে যাচ্ছিলো যখন চাঁদ পৃথিবী থেকে সর্বোচ্চ দুরত্বে ছিলো।
নাসা অফিসিয়ালি এপোলো-১৩ মিশনকে “সাকসেসফুল ফেইলিউর“ হিসাবে আখ্যা দিয়েছে। নাসার তদন্তকারী দলগুলো প্রমাণ করেছে মহাকাশযানটিতেই ত্রুটি ছিলো। প্রেসিডেন্ট নিক্সন ১৯৭০ সালে সেই মহাকাশযানের অভিযাত্রী এবং মিশন কন্ট্রোলের দলটিকে তাদের অসামান্য মানসিক দক্ষতা দিয়ে দুর্যোগ মোকাবেলার উদাহরণ সৃষ্টির জন্যে আমেরিকার সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অভ ফ্রিডম’-এ ভূষিত করেন।
এপোলো-১৩ ছিলো আশির দশকের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়ের একটি। ১৯৭৪ এই ঘটনা অবলম্বনে প্রথম সিনেমা “Houston, We’ve Got a Problem” নির্মিত হয়। একই নামে ১৯৭৮ এ বিবিসি এই ঘটনার উপর বানায় একটি ছোট ডকুমেন্টারি। এ ঘটনার উপজীব্য নিয়ে কমান্ডার আর্থার লাভেল ১৯৯১ সালে লিখেন Lost Moon: The Perilous Voyage of Apollo 13, যা প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ সালে। পরের বছর এই বই অবলম্বনে রন হাওয়ার্ড এর নির্দেশনায় Apollo 13 মুক্তি পায়, যাতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে লাভেল হিসাবে খ্যাতিমান অভিনেতা টম হ্যাংকস অভিনয় করেন। বেশ কয়েকটি ক্যাটাগরিতে অস্কার মনোনয়নও পায় এই সিনেমা।
প্রেসিডেন্ট নিক্সন এর কাছে জমা দেয়া চূড়ান্ত রিপোর্টে নাসার মিশন ফাইলে বলা হয়েছিলো- “এপোলো-১৩, একটি সাফল্যে মোড়ানো ব্যর্থতার গল্প হিসাবে চিরদিন মানুষের চাঁদের দিকে যাত্রার পথে অবিস্মরণীয় এক মাইলফলক হিসাবে পথ দেখিয়ে যাবে।”