১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই থেকে ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর- মানবজাতির ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অধ্যায় বললে বোধহয় অত্যুক্তি হবে না। কেন? কারণ এই সময়কাল ধরে চলেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, যা পাল্টে দিয়েছিলো অনেক হিসাবনিকাশ, নরকে পরিণত করেছিলো বহু মানুষের জীবনকেই।
গত পঁচিশ বছর ধরেই স্টিভ হামফ্রিস প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা অবলোকন করা মানুষগুলোর সাক্ষাৎকার নিয়ে যাচ্ছেন। নিজের মুখে বলা তাদের সেসব অভিজ্ঞতা যে কাউকেই বিস্মিত করে তুলবে। তেমনই চারজনের কাহিনী তুলে ধরা হলো আজকের এই লেখায়।
১. ফ্লোরেন্স বিলিংটন
ষোড়শী ফ্লোরেন্স বিলিংটনের সাথে পরিচয় হয় টেড ফেল্টনের। সেই পরিচয়ই আস্তে আস্তে প্রেমের রুপ লাভ করে। যুদ্ধ শুরু হলে টেড লিভারপুল রেজিমেন্টে যোগদান করেন। ১৯১৫ সালের শুরুর দিকে ইপ্রের দ্বিতীয় যুদ্ধে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার কোনো ছবিই ফ্লোরেন্সের কাছে ছিলো না। তবে ১০০ বছর বয়সে মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি টেডের স্মৃতি বুকে জড়িয়েই বেঁচে ছিলেন।
“আমরা দুজন একে অপরকে গভীরভাবে ভালোবাসতাম। রাত-দিন আমি ওর কথা ভাবতাম। সে-ও একই কাজ করতো। আমরা একে অপরের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যুদ্ধ শেষ হবার পর যত দ্রুত সম্ভব আমরা বাগদান সেরে ফেলবো। কিন্তু টেড অনেকটা নিশ্চিতই ছিলো যে, যুদ্ধে ও মারা যাবে। আমি বুঝতাম না এমন পরিস্থিতিতে কী বলতে হবে, কারণ যুদ্ধ সম্পর্কে আমি কিছুই বুঝতাম না। আমি কেবল ওকে আশার আলোই দেখাতে পারতাম, যুদ্ধ শেষে আমাদের জন্য যে সুখের দিনগুলো অপেক্ষা করছে, আমি ওকে সেসবের সোনালী স্বপ্নই দেখাতাম। এই দুঃখ-দুর্দশার অবসান ঘটবে শীঘ্রই- এমন স্বপ্ন বুকের গভীরে লালন করেই চলে গিয়েছিল ও।
আমি ওর কাছে চিঠি লিখতাম, লিখে জানাতাম ওকে আমি মিস করি, অনেক বেশিই মিস করি, এবং খুব করে চাইতাম যদি ও আরেকটু কাছে থাকতো, তাহলে ওকে আরো একটু বেশি করে প্রাণভরে দেখে নিতাম। ওকে আমি সবসময় বলতাম, ও দূরে থাকাকালে আমি অন্য কারো দিকেই তাকাবো না, আর আমি ওর জন্যই অপেক্ষা করবো। চিরকাল আমি ওর জন্য অপেক্ষা করবো। ওকে বলেছিলাম শুধু ভবিষ্যতের কথা ভাবতে, এবং সেই সাথে আমাদের কথাও। আমিও ভবিষ্যতের কথাই ভাবতাম। আমি বেঁচে ছিলাম ভবিষ্যতের জন্যই, যে ভবিষ্যৎ আমাদের দুজনের।
প্যালেস হোটেল বাক্সটনে (ডার্বিশায়ারে অবস্থিত) আমি পরিচারিকার কাজ করতাম। একজন দারোয়ান সমর কার্যালয় থেকে আমার জন্য একটি চিঠি নিয়ে আসলো। ওটা দেখেই আমার মনটা কেমন যেন করে উঠলো। মনে হলো, ওটা গুরুত্বপূর্ণ কিছুই হবে। ওটা খুলে আমি জানতে পারলাম, টেডের মৃত্যুর ব্যাপারে শোক প্রকাশ করেই তারা এটা আমাকে লিখেছে। আমার দেয়া চিঠিগুলো তার মৃতদেহের সাথেই পাওয়া গিয়েছিল। আমি বিশ্বাসও করতে পারছিলাম না যে, ও আর বেঁচে নেই। বারবার মনে হচ্ছিলো, একসময় তারা ভুল বুঝতে পেরে দেখবে ও আসলে মারা যায়নি, এবং একদিন সত্যি সত্যিই ও ফিরে আসবে। ওকে ছাড়া এই জীবনের কথা আমি চিন্তাও করতে পারছিলাম না।”
২. নরম্যান কলিন্স
১৯ বছর বয়সী নরম্যান কলিন্স এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে সমের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৯৮ সালে ১০০ বছর বয়সে মৃত্যুর আগপর্যন্ত সেই যুদ্ধের দুঃসহ স্মৃতি তাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে।
“নতুন যারা মারা গিয়েছিলো, তাদের মৃতদেহ সংগ্রহের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল আমাকে। কয়েকজন স্ট্রেচার বাহককে আমি আমার সাথে নিয়েছিলাম, যারা নিজেরাও আপন ভাই, কাজিনদের মতো ঘনিষ্ঠজনদের হারিয়েছিলো। স্বাভাবিকভাবেই তারা খুব কষ্টের মাঝে ছিল। একজন অফিসার হিসেবে তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়া, পিঠ চাপড়ে দেয়াটাই ছিল সান্ত্বনা দেয়ার সর্বোৎকৃষ্ট উপায়; কোনো শব্দ উচ্চারণ না করেই সান্ত্বনা দেয়া।
এরপর আমাকে বলা হয়েছিলো নো ম্যানস ল্যান্ডে ফিরে যেতে। সেখানে নিউফাউন্ডল্যান্ড রেজিমেন্টের যারা ১ জুলাইয়ে মারা গিয়েছিল, তাদের মৃতদেহগুলো কবর দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল আমাকে। অধিকাংশের মাংসই মুখের দিকে সবচেয়ে বেশি পচে গিয়েছিল। চুল তখনও ছিলো। কারো কারো দাড়িও বোঝা যাচ্ছিলো। তাদের বুকের মধ্যে ইঁদুর যাওয়া-আসা করছিলো। ওখানে ইঁদুরগুলো বৃষ্টি থেকে বাঁচার এক চমৎকার আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিল। কারণ বুকের খাঁচার ওপর কাপড় থাকায় সেটা ওদের জন্য ঘর হিসেবেই কাজ করছিলো। সেখানে স্পর্শ করা মাত্রই ঝাঁকে ঝাঁকে ইঁদুর বের হয়ে আসতে থাকলো। মাত্র ১৯ বছর বয়সী এই আমি যেন সামনের দিকে তাকিয়ে আমারও একই পরিণতি দেখতে পেয়েছিলাম। সেদিনের প্রভাব আজও আছে আমার ওপর। আপনি কখনোই এটা ভুলতে পারবেন না।”
৩. মার্জোরি গ্রিগসবি
কৈশোরেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা অবলোকন করে স্বেচ্ছাসেবী নার্স হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন মার্জোরি গ্রিগসবি। যুদ্ধ চলাকালে নার্স-জীবনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার খণ্ডচিত্রই ফুটে উঠেছিলো তার বর্ণনায়।
“দুবার আমার ইন্টারভিউ নেয়া হয়েছিল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার বয়স কত?” আমি বললাম, “২০, স্যার।” তিনি আবারও জানতে চাইলেন, “কত?” আমি দেখতে পেলাম, তিনি চশমার উপর দিয়ে চোখ বড় বড় করে আমাকে দেখছেন। “২০, স্যার“, আমি আবারও বললাম। আমি তাকে লিখতে দেখলাম, “বয়স ২০, দেখে মনে হয় ১৬।” তখন আমি বললাম, “স্যার, আমি জানি আপনি এটা পাকাপাকিভাবে লিখে ফেলেছেন। এটা আপনি আর পাল্টাতে পারবেন না। তবে এটা ১৬ না, ১৭।” তিনি আমার দিকে তাকিয়ে একটি বাঁকা হাসি দিয়ে ওটা যেমন ছিলো তেমনই রেখে দিলেন, এবং আমাকে পাস করিয়ে দিলেন।
সামনের দিকে যাবার পর আমাকে ‘নোংরা নার্স’ বলে ডাকা হচ্ছিলো এবং সকল রকমের নোংরা কাজই করা লাগছিলো। একটি পা কেটে বালতিতে ভরে তারা (ডাক্তাররা) সেটা আমার হাতে ধরিয়ে দিলো, আর আমাকে সেই জিনিসটি নিয়ে যেতে হচ্ছিলো দহন-চুল্লি পর্যন্ত। কেটে ফেলার পর একটা পা যে কতটা ভারি হতে পারে, সেই সম্পর্কে আপনাদের কোনো ধারণাই নেই। কাজটা আমার মোটেই ভালো লাগছিলো না।
আমার সমবয়সী মেয়েরা সবাই ছিলো অনভিজ্ঞ। কিন্তু যুদ্ধের সময় অবশ্যই আপনাকে এমন কাজই করতে হবে, যা সাধারণ সময়ে করা হয় না। আপনি কাজ করা চালিয়ে যেতে থাকবেন এবং আপনার কর্তব্য পালন করবেন।“
৪. হ্যারি প্যাচ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সর্বশেষ জীবিত ইংরেজ সৈনিক ছিলেন হ্যারি প্যাচ। স্বল্পভাষী এই মানুষটি এই সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় নিজের দুঃখ-কষ্টের কথা যেন সব উজাড় করে দিয়েছিলেন।
“আমাদের দলে সদস্য সংখ্যা ছিলো পাঁচজন। এদের মাঝে তিনজনকেই আমরা হারিয়েছিলাম। সেই তিনজনের কথা আমি কোনোদিন ভুলতে পারবো না। এই ঘটনা এখনও আমাকে বিষণ্ন করে তোলে।
সত্যি বলতে, তারা বিষ্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিলো। তাদের দেহের কোনো অংশই পরে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিষ্ফোরণের পুরো ধাক্কাটা তারা নিজেদের উপর নিয়েছিলো। বিষ্ফোরণের ধাক্কায় আমি জ্ঞান হারাই। ২২ সেপ্টেম্বরই আমার কাছে রিমেম্ব্রেন্স ডে (কমনওয়েলথভুক্ত দেশসমূহে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে দায়িত্ব পালনকালে নিহত যোদ্ধাদের স্মরণ করা হয় এই দিনে। নভেম্বর মাসের ১১ তারিখ পালন করা হয় এই দিনটি), আর্মিস্টিস ডে (প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি হিসেবে মিত্রপক্ষ ও জার্মানির মাঝে স্বাক্ষরিত যুদ্ধবিরতি চুক্তির বিষয়কে স্মরণীয় করে রাখতে প্রতি বছর এই দিনটি যুদ্ধবিরতির দিন হিসেবে পালিত হয়ে থাকে) না।
আমি তিনজন ভালো সঙ্গীকে হারিয়েছিলাম। আমার প্রতিক্রিয়া ছিলো ভয়াবহ। ব্যাপারটা ছিলো অনেকটাই জীবনেরই একটা অংশ হারিয়ে ফেলার মতো। দলের মানুষগুলোকে আমি খুবই পছন্দ করতাম, আপনি এটাকে ভালোবাসার সাথেও তুলনা করতে পারেন। সেই মানুষগুলো আপনার সাথে রাত-দিন থাকতো, আপনি তাদের সাথে সবকিছু শেয়ার করতেন এবং আপনারা গল্পও করতেন সব বিষয় নিয়েই। আপনি আসলে তাদেরই একজন হয়ে যেতেন, আমরা একজন আরেকজনের জন্যই ছিলাম, যদি আপনি সেটা অনুভব করতে পারেন।“