দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা, আরো সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বর্তমান বৃহত্তর নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরা অঞ্চলে আঠার শতকের মাঝামাঝি সময়টাতে বিস্ময়করভাবে উত্থান ঘটে এক বিল্পবীর। যিনি সফলভাবে প্রতিরোধ করেছিলেন মগ-পর্তুগীজ-হার্মাদ জলদস্যুদের। যে সময়টায় শাসকদের সাথে প্রজাদের সম্পর্ক ছিল খাজনা দেওয়া-নেওয়া আর অত্যাচারের, সেই সময়টাতে জমিদার হয়ে তিনি নিজ প্রজাদের সংঘবদ্ধ করেছিলেন দোর্দন্ড প্রতাপের সামন্ত প্রভু ও ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে! অত্যাচারী বিক্রমশালী ত্রিপুরা রাজকে কৃষক-জনসাধারণের সহায়তায় পরাজিত করে গঠন করেছিলেন নিজ রাজ্য। ফেনীর এক হতদরিদ্র ঘরের সন্তান থেকে বীরত্ব আর রাজনৈতিক মেধায় অধিপতি হয়েছিলেন বিশাল এক ভূখণ্ডের। নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, ও ত্রিপুরা রাজ্যের নানা জায়গার নামকরণ আর নানা কেচ্ছা-কাহিনীতে নানাভাবে জড়িয়ে আছে তার নাম। তিনি শমসের গাজী। অকুভোতয় বীরত্বের জন্য যাকে ডাকা হয় ‘ভাটির বাঘ’!
ফেনীর চম্পকনগর ছিল শমসের গাজীর রাজধানী
ত্রিপুরা রাজবংশকে উচ্ছেদ করার পর শমসের গাজী আগরতলা থেকে উদয়পুরে রাজধানী স্থানান্তর করেছিলেন তবে তিনি প্রকৃতপক্ষে তার শাসন পরিচালনা করতেন ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলাধীন রঘুনন্দন পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত চম্পকনগর গ্রাম থেকে।
ফেনীর শুভপুর বাজার থেকে দুই কিলোমিটার পশ্চিমে চম্পকনগর গ্রাম। এই চম্পকনগরেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন রাজপ্রাসাদ, দরবার হল, অস্ত্রাগার সহ তার বিশাল আবাসস্থল। এখানে তার বাসস্থানের স্মৃতি চিহ্ন এখনো বিলীন হয়ে যায়নি। কিছু ধ্বংসাবশেষ, যেমন প্রাসাদের নিরাপত্তার জন্য খনন করা গড়খাই (খন্দক), রাজপ্রাসাদের মাঝখানে তৈরি এককুল্লা দীঘি, পাহাড় কেটে তৈরি সুড়ঙ্গ পথ ইত্যাদি টিকে আছে এখনো। তবে তার বাড়ি ও দিঘীর বড় অংশই রয়েছে ভারতের ত্রিপুরা অঞ্চলের সীমানায়।
শমসের গাজীর শৈশব
শমসের গাজীর জন্ম নিয়ে রয়েছে মতভেদ। কারো মতে ১৭০৫ কিংবা ১৭০৬ সালে, আবার কারো মতে ১৭১২ সালে বর্তমান ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানার ঘোপাল ইউনিয়নের নিজকুঞ্জরা গ্রামে। তার পিতা পীর মোহাম্মদ তৎকালীন ওমরাবাদ পরগনার একটি কাছারিতে খাজনা আদায় করতেন। তার মায়ের নাম কৈয়ারা বেগম। আর্থিক অনটনের কারণে ভাগ্য অন্বেষণে শমসের গাজীর পিতা চাকরি ছেড়ে বেদরাবাদ এলাকায় সস্ত্রীক চলে আসেন এবং এখানেও নিদারুণ আর্থিক সংকটে পড়লে স্থানীয় জমিদার নাসির মোহাম্মদ চৌধুরী তাকে আশ্রয় দেন। সেই বাড়িতেই জন্ম শমসের গাজীর। শৈশবেই পিতাকে হারানোর ফলে শমসের অভাব-অনটনের মধ্যে বড় হন।
কথিত আছে, একদিন মায়ের বকুনি শুনে ফেনী নদীর তীরে বসে কান্না করার সময় সে পথ ধরে নিজামপুর থেকে ধনুঘাট হয়ে বাড়ি ফিরছিলেন শুভপুরের তালুকদার জগন্নাথ সেন ও তার স্ত্রী সোনা দেবী । তালুকদার সাহেবের সন্তান ছিল না বলেই হয়তো শমসের গাজীর প্রতি দুর্বল হয়ে তাকে সাথে করে বাড়িতে নিয়ে যান। তারপর থেকে জগন্নাথ সেনের স্নেহ-মমতায়ই বেড়ে উঠতে থাকেন শমসের। বড় হওয়ার সাথে সাথে লাঠি, কুস্তি, তলোয়ার কিংবা তীর-ধনুক চালনা সব ক্ষেত্রেই শমসের পারদর্শীতা শমসের গাজীকে চারদিকে পরিচিতি এনে দেয়।
শমসের গাজীর উত্থান
তালুকদার জগন্নাথ সেনের ইন্তেকালের পর শমসের গাজী শুভপুর কাছারির খাজনা আদায় ও নানাবিধ কাজের তদারকি করতে থাকেন। সেই সময়ে মহুরী নদীর তীরে পানুয়াঘাট নামক একটি কেল্লা ছিল। ফেনী, কুমিল্লা অঞ্চলে এখনো সে ঘাটের নাম মানুষের মুখে মুখে ফেরে, বলা হয়-
দিঘির মধ্যে জগন্নাথ
পাড়ের মধ্যে বীরসিংহ
পানির মধ্যে কৈয়ারা
হাটের মধ্যে লেমুয়া
ঘাটের মধ্যে পানুয়া।
শমসের গাজীর শৌর্য-বীর্য তখন চারদিকে বিদিত। এই সময় জমিদার নাছির মোহাম্মদ তার বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে গাজীকে পানুয়াঘাট কেল্লার অধ্যক্ষ নিযুক্ত করেন। এখান থেকেই শুরু হয় শমসের গাজীর উত্থানের গল্প।
দক্ষিণ বাংলার এ অঞ্চলটি তখন মগ, পর্তুগীজ, হার্মাদ জলদস্যুদের কাছে জিম্মি তো ছিলই, উপরন্তু পানুয়াঘাটেই প্রায় পাঁচ শতাধিক চোর ডাকাতের একটি শক্তিশালী দল এই এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল।
শমসের গাজী তখন ত্রিশ বছরের টগবগে যুবক। পানুয়াঘাটের কেল্লা প্রধান হয়েই তিনি মগ, পর্তুগীজ এবং স্থানীয় দস্যুদের সাফল্যের সাথে বিতাড়ন করেন। এই সাফল্য তাকে রীতিমতো আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।
একটি ব্যর্থ প্রেম ও কাহিনী ও দুঃখজনক অধ্যায়
শমসের গাজীর উত্থানের পেছনে জমিদার নাছির মোহাম্মদের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। তিনি শমসের গাজীকে খুবই স্নেহ করতেন। শমসের গাজীর পিতাকেও তিনিই আশ্রয় দিয়েছিলেন। পানুয়াঘাট কেল্লার অধ্যক্ষ হিসেবে তিনিই শমসের গাজীকে নিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ শমসের গাজী নাছির মোহাম্মদের কন্যা দৈয়া বিবিকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালে সব সমীকরণ উল্টে যায়।
নাছির মোহাম্মদ খুবই অপমান বোধ করেন এবং ক্ষুব্ধ হয়ে গাজীকে কেল্লা প্রধানের পদ থেকে বহিষ্কার করেন। সেই সাথে তাকে ধরে আনার জন্য সৈন্যও পাঠান।
শমসের গাজী এত সহজে হেরে যেতে রাজি ছিলেন না। তিনি ও তার চাচাত ভাই ছদু পালোয়ান জমিদারের সৈন্যদের পরাজিত করে সেখান থেকে সরে পড়েন ও পার্শ্ববর্তী বেদারাবাদ এলাকায় গিয়ে আশ্রয় নেন।
এর কিছুদিনের মধ্যেই জমিদার নাছির মোহাম্মদ শমসের গাজীর চাচাত ভাই ছদু পালোয়ানের হাতে নিহত হন। যদিও শমসের গাজী এই হত্যাকাণ্ড সমর্থন করেননি বলেই মনে করা হয়, তথাপি কিছুদিনের মধ্যেই তিনি নাছির মোহাম্মদের পুত্রদের সাথে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন এবং তাদের হত্যা করে নাছির মোহাম্মদের জমিদারী নিজের দখলে নেন। এ প্রসঙ্গে গাজীনামায় কবি বলেন,
অন্দরে আছিল যত ধন বস্ত্র দ্রব্য।
অনলে দহিল আর গাজী নিল সর্ব্ব।।
হাতি-ঘোড়া, তোষা জোড়া আর যত মাল।
গাজী ছাদু নিয়া গেল আপন মহাল।।
নাছির মোহাম্মদ ও তারপর তার পুত্ররাও নিহত হওয়ার পর তাদের অনুগত সৈনিকরা অধিকাংশই পালিয়ে যায় আর কিছু শমসের গাজীর পক্ষেও যোগ দেয়। তবে যার জন্য এত কিছু, নাছির মোহাম্মদের কন্যা দৈয়া বিবিকে তিনি পেয়েছিলেন কিনা, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মন্তব্য পরস্পরবিরোধী। তবে কুমিল্লা অঞ্চলের দৈয়া বিবির হাট আজো কালের স্বাক্ষী হয়ে জানান দিচ্ছে এক হৃদয়বিদারক ইতিহাসের।
ত্রিপুরা বিজয়
শমসের গাজী সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসলেও তার রাজনৈতিক মেধা ও দূরদৃষ্টি ছিল অসাধারন। তিনি জমিদারি দখল করে নিজেকে ভাগ্যের হাতে সমর্পণ করেননি, বরং ত্রিপুরা রাজের সাথে সংঘর্ষ নিশ্চিত ধরে নিয়ে প্রস্তুতি নিতে থাকেন। তিনি দ্রুতই প্রজাদের সাথে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তিনি শুধু ক্ষমতা কিংবা লোক দেখানোর জন্য নয়, বরং সত্যিকার অর্থেই মানুষের দুর্দশা দূর করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। আর সে কারণেই জনগণও তার প্রতিদান দিতে ভোলেনি। শমসের গাজীর সাফল্যের অন্যতম নিয়ামক ছিলেন তার কৃষক-প্রজাগণ!
যা-ই হোক, শমসের গাজী গোপনে রণ প্রস্তুতি নিতে থাকেন। বিশাল ভবন নির্মাণ করে তার চারপাশে প্রায় ৫০ গজ প্রশস্ত পরিখা খনন করেন, নিয়োগ করেন সশস্ত্র প্রহরী।
কৃষ্ণ মাণিক্য তখন ত্রিপুরার রাজা। নাছির চৌধুরীরর পতনের পরই তার অংশীদার রতন চৌধুরী ত্রিপুরার কৃষ্ণ মাণিক্যের কাছে অভিযোগ করলে ত্রিপুরারাজ উজির জয়দেব ও সেনাপতি লুচি দর্পনারায়ণকে পাঠান শমসের গাজীকে পরাস্ত করতে। শমসের গাজী প্রমাদ গুনলেন, যদিও তিনি গোপনে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন যুদ্ধের জন্য, কিন্তু তা ছিল কেবল শুরু। উজির জয়দেব ও সেনাপতি দর্পনারায়ণ তিন হাজার সৈন্যসমেত ছাগলনাইয়া কেল্লায় উপস্থিত হলে শমসের গাজী সুকৌশলে উজির জয়দেবকে নিজ কব্জায় নিয়ে আসেন। উজিরের বন্দী হওয়ার খবর শুনে সেনাপতি দর্পনারায়ণ সৈন্যসমেত পালিয়ে যান।
শমসের গাজী উজিরকে কার্যত বন্দী করলেও তাকে মেহমানদারী করে নিজের বশে আনেন আর দক্ষ রাজনৈতিক মারপ্যাঁচে উজিরের মুক্তির বিনিময়ে ত্রিপুরারাজের কাছ থেকে দক্ষিণ শিকের জমিদারিও লিখে নেন। জমিদারী লিখে নেওয়ার পর শমসের গাজী থেমে যাননি। তিনি একদিকে ত্রিপুরারাজের সাথে সখ্যতা বজায় রাখছিলেন, অপরদিকে নিজেও প্রস্তুতি নিচ্ছিলিন নিজের মতো করে।
জমিদার কিংবা শাসক হিসেবে শমসের গাজী প্রজাদরদী শাসক ছিলেন। কৃষক-শ্রমিকদের তিনি ভালোবাসতেন এবং জমিদার হয়েও তাদেরকে ভুলে যাননি কিংবা দূরে সরিয়ে দেননি।
জমিদারির প্রথম দিকেই পাহাড়ি ঢালে ফসলের ক্ষতি হওয়ায় তিনি কৃষকদের খাজনা মওকুফ করে দেন। যদিও তার জমিদারীর প্রথম তিন বছরে দশ হাজার মুদ্রা খাজনা দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তিনি কানাকড়িও তিনি ত্রিপুরারাজকে প্রদান করেননি।
খাজনা না দেওয়াকে কেন্দ্র করে শমসের গাজী ও ত্রিপুরার রাজার মধ্যে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠে। আর শমসের গাজীও যুদ্ধের জন্যই এতদিন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ত্রিপুরার রাজদরবার তখন অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাতে রীতিমতো দুর্বল। শমসের গাজীও ঠিক এই সময়টিই বেছে নেন যুদ্ধের জন্য।
ত্রিপুরারাজ শমসের গাজীকে শায়েস্তা করতে সেনাবাহিনী পাঠান। ত্রিপুরা রাজার সৈন্যরা খণ্ডলের কিল্লা এলাকায় অবস্থান নিয়ে লুটতরাজে লিপ্ত হয়। গ্রামবাসী ও কৃষকরাও ত্রিপুরা রাজার বিপক্ষে অবস্থান নেন। তারা রাজার সৈন্যদের কাছে খাদ্যশস্য বিক্রয় বন্ধ করে দেয়। ফলে ত্রিপুরা রাজার সৈন্য শিবিরে শুরু হয় খাদ্য সংকট। শমসের গাজী ও তার চাচাতো ভাই ছাদু পালোয়ান এই সময় চালান প্রাণপণ আক্রমণ। তুমুল আক্রমনে ত্রিপুরা রাজের সৈন্যরা রণে ভঙ্গ দেয়।
শমসের গাজী ও ছাদু পালোয়ান রাজার সৈন্যদের তাড়া করে রাজধানী পর্যন্ত নিয়ে যান। এ বিষয়ে আজো কুমিল্লা, নোয়াখালী অঞ্চলে কাউকে শাসাতে প্রবাদ হিসেবে বলা হয়, “এক্কেরে দোম্বাই উদেপুর নিমোগোই!” অর্থাৎ “দৌড়িয়ে উদয়পুর নিয়ে যাব!”
এ প্রসঙ্গে গাজীনামায় মনোহর শেখ বলেন,
সামান্য গাজীর সনে না জিনিল রণে।
হেন অপমান বল সহিবে কেমনে।।
রাজারে তাড়ায়ে যায় রাজধানী তক।
এহতে লজ্জা কিবা আছে সমধিক।।
এ যুদ্ধে উভয় পক্ষের প্রায় তিন সহস্রাধিক সৈন্য নিহত হয়। ত্রিপুরা রাজার সহায়তায় মনিপুরি সৈন্যরা এগিয়ে আসলেও শমসের গাজীর বীরত্বের কাছে কেউই টিকতে পারেনি। ত্রিপুরার রাজা কৃষ্ণ মাণিক্য আগরতলা ছেড়ে মনিপুরের দিকে পলায়ন করেন। আগরতলা থেকে সিলেটের মনু নদী পর্যন্ত শমসের গাজীর সীমানা বিস্তৃত হয়।
শুধু বিজয়ী নন, ছিলেন কৌশলীও
শমসের গাজীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং দূরদর্শিতা ছিল অসাধারণ। তিনি শুধু তরবারির জোরে রাজ্য শাসন করতে চাননি। ত্রিপুরা জয়ের পর তিনি অনুমান করেছিলেন, ত্রিপুরাবাসী তাকে বহিরাগত হিসেবে চিন্তা করতে পারে। তাই তিনি নিজে সিংহাসনে বসা থেকে বিরত থাকেন। তারচেয়ে বরং লক্ষণ মানিক্য নামক রাজপরিবারের এক সদস্যকে সিংহাসনে বসিয়ে তিনি অন্তরালে থেকে সব নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল গ্রহন করেন।
প্রথমদিকে যদিও কৃষ্ণমাণিক্য অর্থের বিনিময়ে ত্রিপুরার কুকি আদিবাসীদের শমসেরের বিরুদ্ধে লড়তে রসদ যোগান, কিন্তু প্রতিবারই কুকিরা শমসের গাজীর নিকট পরাজিত হয়। শমসের গাজী নিজ প্রজাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে রাজি ছিলেন না। তাই তিনি কুকিদের বুঝিয়ে নিজের পক্ষে নিয়ে আসতে সফল হন। কুকিরা গাজীর উদার মনোভাব, প্রজাদের প্রতি দরদ ও অকৃত্রিম দেশপ্রেমের কারণে গাজীকে রাজা হিসেবে মেনে নেয়। শুধু কুকিরা নয়, ত্রিপুরারাজের বহু অমাত্য, যেমন- উজির রামধন, উত্তর সিংহ, সেনাপতি রণ মর্দ্দন নারায়ণসহ অনেকে গাজীর বশ্যতা শিকার করেন ও তার পক্ষে নানা দায়িত্ব পালন করেন।
সাফল্যের অন্যতম নায়ক সাদুল্লাহ বা ছাদু পালোয়ানের সাথে বিবাদ
শমসের গাজীর সাফল্যের প্রধানতম সহযোগী ও ছোটবেলা থেকে সুখ-দুঃখের আজন্ম সাথী ছিলেন ছাদু পালোয়ান। কোনো কারণে তাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। নিজ ক্ষমতার জন্য হুমকি মনে করে শমসের কৌশলে ছাদু পালোয়ানকে হত্যা করেন। কিন্তু তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও শক্তিশালী বন্ধু হারিয়ে তিনি নিজেও শক্তিতে দুর্বল হয়ে পড়েন, যা তার জন্য মোটেই সুখকর হয়নি।
শমসের গাজীর মৃত্যু, একটি নক্ষত্রের পতন
এ বিষয়ে সকলেই একমত যে শমসের গাজী স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেনননি, তবে ঠিক কীভাবে শমসের গাজীর মৃত্যু হয়েছিল, তা নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা।
অনেকে মনে করেন, পলাশীর যুদ্ধের পর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে ইংরেজদের রোষানলের শিকার হন তিনি। ইংরেজরা প্রথমত তাকে দস্যু হিসেবে অপপ্রচার চালায়, অতঃপর ত্রিপুরারাজের সহায়তায় সুদক্ষ ইংরেজ বাহিনী প্রেরণ করে তাকে বন্দী ও হত্যা করে। এই হিসেবে ১৭৬০ বা ১৭৬১ সালে শমসের গাজীর মৃত্যু হয়। রাজমালা এবং ত্রিপুরার ইতিহাস গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী, মুর্শিদাবাদের নবাব মীর জাফর কিংবা মীর কাশেমের শাসনকালে এবং তাদের নির্দেশেই শমসের গাজী নিহত হন।
তবে এই বক্তব্যের যথার্থতা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। গাজীনামা বিবরণ অনুযায়ী, শমসের নিজামপুর পরগনার জমিদার আগা বাকেরের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছিলেন। আগা বাকের নবাব সিরাজের আস্থাভাজন ছিলেন। মুর্শিদাবাদের নবাবের দরবার থেকে আমন্ত্রণ এলে শমসের গাজী নবাব সিরাজের সাথে দেখা করে আসার পথে আগা বাকেরের পুত্র আগা সাদেকের বাহিনী কর্তৃক বন্দী হন। পরে তাকে হত্যা করা হয়। গাজীনামার লেখক মনোহর শেখের বিবরণ অনুযায়ী-
এগারশ উনষাইট সন জৈষ্ঠ্য মাসে।
জুম্মাবারে জান তুমি জোহরের শেষে।।
উনত্রিশ তারিখ সেই ছিল শুক্রবার ।
চলিল পশ্চিম মুখে গাজি মরিবার।।
কাজী মোজাম্মেল হকের লেখা তিন হাজার বছরের নোয়াখালী গ্রন্থেও আগা বাকের ও জসারত খাঁর ঘড়যন্ত্রে শমসের গাজী মুর্শিদাবাদ হইতে রংপুরের ঘোড়াঘাটে নীত হয়েছিলেন এবং সেখানেই তাকে হত্যা করা হয় বলে মত দেন। তার মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে যদিও সব ঐতিহাসিক এখনো একমত নন। তবে আগা বাকেরকে শমসের গাজীর হত্যাকারী ধরে নিলে আগা বাকেরের শাসনকাল ও গাজীনামায় উল্লিখিত ঘটনার বিবরণ অন্যান্য বিষয় মিলিয়ে ১৭৫২ থেকে ১৭৫৪ সালের মধ্যেই শমসের গাজী নিহত হয়েছিলেন বলে ধরে নেওয়া যায়। কারণ ১৭৫৪ সালেই মির্জা আলী নকীর আক্রমণে আগা বাকের নিহত হন ও আগা সাদেক পালিয়ে যান। আহমদ মমতাজের লেখা শমসের গাজী গ্রন্থেও ১৭৫৩ সালেই শমসের গাজী মৃত্যুবরণ করেন বলে মত পাওয়া যায়।
শমসের গাজীকে নিয়ে সমালোচনা
ঐতিহাসিকগণ নানাভাবে তার চরিত্রের বিশ্লেষণ করেছেন। কারো মতে, তিনি ন্যায়পরায়ণ, দূরদর্শী, প্রজাদরদী শাসক, আবার কারো চোখে ডাকাত, অর্থলোলুপ এবং অকৃতজ্ঞ একজন মানুষ। কেউ কেউ আবার ডাকাত হিসেবে দেখলেও তার মহৎ উদ্দেশ্যের জন্য তাকে দেখেন রবিনহুডের মতো মহান ব্যক্তি হিসেবে। তবে অনেক ঐতিহাসিক তার বিরুদ্ধে আনা অধিকাংশ অভিযোগগুলোকে অতিরঞ্জিত বলে মনে করেন।
কথিত আছে, পানুয়াঘাট কেল্লার অধ্যক্ষ নিযুক্ত হলে এই এলাকার চোর–ডাকাতের দলটি প্রমাদ গোনে। তারা একত্র হয়ে শমসের গাজীর কাছে এই মর্মে আপোষ প্রস্তাব নিয়ে আসে যে, শমসের গাজীর সাথে তাদের কোনো বিরোধ নেই। এখন থেকে তারা পানুয়াঘাট এলাকায় আর কোনো ডাকাতি করবেই না, বরং বাইরের এলাকা থেকে যে ডাকাতি করবে, তারও অর্ধেক গাজীকে দিতে রাজি হয়। এছাড়াও সবসময় গাজীর পাশে থাকবে বলে অঙ্গীকার করে।
সমালোচকগণ অভিযোগ করেন, শমসের গাজী ডাকাতদের সাথে সন্ধি করেছিলেন এবং তাদের কাছ থেকে উৎকোচ গ্রহণ করতেন এবং এছাড়াও বিভিন্ন সময় পাশ্ববর্তী জমিদারদের উপর আক্রমণ পরিচালনা, লুন্ঠন ও তার অাশ্রয়দাতা নাছির মোহাম্মদকে হত্যার অভিযোগ আনেন।
পৃথিবীতে কোনো শাসকই বিতর্কের উর্ধ্বে ছিলেন না। তাই শমসের গাজী শতভাগ নিষ্কলুষ ছিলেন, তা দাবি করা বাহুল্য মাত্র। শমসের গাজীও হয়তো লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য চতুরতা, শঠতার আশ্রয় নিয়েছেন, প্রয়োজনে পাশ্ববর্তী জমিদারদের সম্পদে হানা দিয়েছেন। তবে শমসের গাজীকে যে বিষয়গুলোতে অভিযোগ করা হয় তা যদি সমকালীন ইতিহাসের মানদণ্ডে বিচার করা হয়, তবে সেটা অত্যন্ত স্বাভাবিক হিসেবেই ধরে নিতে হয়। কারণ রাজনীতি ও রণকৌশলে নৈতিকতার চর্চা সমকালীন শাসন ব্যবস্থার ইতিহাসে বিরল।
শমসের গাজীর কৃতিত্ব
শমশের গাজী সামান্য সময় শাসন ক্ষমতায় ছিলেন, কিন্তু সে সময়টাই ইতিহাসে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। শমসের গাজী রণকৌশলের দিক থেকে, সাহসের দিক থেকে কিংবা সুশাসনের দিক থেকে পর্যালোচনা করলে তাকে একজন মহৎ শাসক ছাড়া অন্য কোনো অভিধা বেমানান। এমনকি শমসের গাজীর কট্টর সমালোচক ‘রাজমালা’র লেখক কৈলাস চন্দ্র সিংহও গাজীর অসাম্প্রদায়িকতা ও প্রজাদরদী চরিত্রের প্রশংসা করতে বাধ্য হয়েছেন।
তিনি কৃষক-প্রজার সম্মিলিত শক্তির সহায়তায় রাজ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন কিন্তু ক্ষমতায় আরোহণ করে কৃষক-শ্রমিকদের ভুলে যাননি। তার শাসনামলে প্রজাদের ভালো-মন্দের দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন সর্বাধিক। তখনকার সময়ে কৃষকদের খাজনা মওকুফ করে দিয়ে সামন্ত রাজার বিপক্ষে লড়ার হিম্মত আর কোনো শাসক, জমিদার, নবাবরা দেখাতে পেরেছিলেন কি? এখানেই শমসের গাজী অন্যদের থেকে আলাদা।
মাত্র এক দশক সময় দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে তিনি যে প্রজাহিতকর কাজ সম্পন্ন করেছেন, তার উদাহরণ সমসাময়িক ইতিহাসে জুড়ি মেলা ভার। বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য তিনি ফেনী নদীতে বাঁধ নির্মান করেছিলেন, যা আদতেই একটি ঐতিহাসিক চিন্তা। ফেনী নদীর দক্ষিণ শিক (বর্তমান ছাগলনাইয়া) ও নিজামপুরে ফেনী নদীর দুটি অস্বাভাবিক বাঁক ছিল, যার জন্য প্রত্যেক বছর বন্যা হত। শমসের গাজী খাল কেটে বাঁকা নদীকে সোজা করেন, যা আজও কাটা গঙ্গা ও মরা গঙ্গা নামে পরিচিত।
প্রজাদের পানীয় জলের সমস্যা সমাধানে ছাগলনাইয়ায় তার মায়ের নামে খনন করা কৈয়ারা দীঘি আজো কালের স্বাক্ষী হিসেবে বিদ্যমান। তাছাড়া একখুইল্লা দীঘি, বুড়া সামন্তের দীঘি, তার মেয়ের নামে তনু বিবির দীঘি, বল্লভপুরের আলীয়া গাজীর দীঘি, পূর্ব ছাগলনাইয়ার দেয়ান আব্দুর রাজ্জাকের দীঘি সহ অসংখ্য দীঘি খনন করেছিলেন।
হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে দরিদ্র ধর্মপ্রচারকদের তিনি অর্থ, নিষ্কর জমি প্রদান করেছিলেন, বিভিন্ন জায়গায় রাস্তাঘাট, মসজিদ-মন্দির স্থাপন করেছিলেন। ফেনীর জগন্নাথ সোনাপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ ও জগন্নাথ মন্দির আজও তার স্মৃতি বহন করে চলছে।
জনসাধারণের চলাচলের সুবিধার্থে বিভিন্ন জায়গায় তিনি অসংখ্য সড়ক নির্মান করেছিলেন, যা এখনো ত্রিপুরা ও নোয়াখালী-ফেনী অঞ্চলে গাজীর আইল নামে পরিচিত। নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন জায়গায় তিনি নির্মাণ করেছিলেন দুর্গ ও সেনানিবাস।
পণ্যদ্রব্যের ওজন ও মূল্য নির্ধারণের মতো জনহিতকর সিন্ধান্ত তিনি নিয়েছিলেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও বিনামূল্যে ছাত্রদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করার মতো উদ্যোগ সেই সময়টাতে শমসের গাজী নিয়েছিলেন, যখন জমিদার কিংবা ভূস্বামীরা কৃষকদের উপর কীভাবে খাজনা আরো বাড়ানো যায়, সে চিন্তায় মশগুল ছিলেন।
দক্ষিণ শিক (ছাগলনাইয়া), আরামরাবাদ-ফেনী, খণ্ডল, জগৎপুর, সীতাকুন্ড-চট্টগ্রাম, তিষ্ণা-চৌদ্দগ্রাম, খাঞ্জানগর, বাগাসাইর, পার্টিকরা, নূরনগর, গঙ্গামণ্ডল, সরাইল-কুমিল্লা, বিসালগড়-সিলেট, কুমিল্লা , জাহাননগর, মেহেরকুল, বলদাখাল, কসবা, অষ্টজঙ্গল, চাকলা-রৌশনাবাদ, ভুলুয়া (নোয়াখালী) নিজামপুর পরগণা সহ বিশাল অঞ্চল অল্প সময়ে তার শাসনাধীন হয়েছিল।
তার শাসনাধীন অঞ্চলে তিনি যে সুশাসনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সমর্থ হয়েছিলেন, তা একজন শমসের গাজীকে ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। তাই তো ‘গাজীনামা’য় শেখ মনোহরের পুঁথির লাইনের মতো বলতে হয়-
“এখানে আসিয়া কবি শেখ মনোহর ভনে
শমসের গাজী ভাটির বাঘ জানুক জনে।”
তথ্যসূত্র:
১. শমশের গাজী- আহমদ মমতাজ, প্রকাশক- বাংলা একাডেমি (২০১৩)
২. গাজীনামা- মনোহর শেখ
৩. রাজমালা- ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী
৪. রাজমালা- কৈলাসচন্দ্র সিংহ
৫. The Land of Fourteen Gods: Ethno-cultural Profile of Tripura- Banikantha Bhattacharyya
ফিচার ইমেজ- wikimedia commons