১
ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক থেকে সম্রাট আকবরের ব্যক্তিজীবন বেশ মজার এবং যে কারও কৌতূহল জাগানোর জন্য যথেষ্ট। তিনি জন্মেছিলেন একটি মুসলিম রাজপরিবারে, বেড়ে উঠেছিলেন একটি মুসলিম রাজপরিবারে। তার পিতা সম্রাট হুমায়ুন নিজেও ব্যক্তিজীবনে প্রচন্ড ধার্মিক একজন মানুষ ছিলেন। এমনকি সম্রাট হুমায়ুন ইন্তেকালও করেন সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় মাগরিবের আজান শুনে বসে পড়তে গিয়ে। সেই হিসেবে আকবরেরও একজন নিষ্ঠাবান মুসলিম হওয়ার কথা ছিলো। সাধারণত তা-ই হয়।
প্রাথমিক জীবনে সম্রাট আকবর একজন নিষ্ঠাবান মুসলিমই ছিলেন। এসময় তিনি নিয়মিত ধর্মীয় প্রার্থনা করতেন, ধর্মীয় বিধি-নিষেধ, আচার-অনুষ্ঠান মেনে চলতেন। মুসলিম ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের সাথে আকবরের সম্পর্ক খুবই ভালো ছিলো। আকবর তাদের প্রচন্ড সম্মান করতেন। এমনকি মাঝে মাঝে মসজিদে মুয়াজ্জিনের দায়িত্বও পালন করতেন তিনি। ১৫৭০ সালের দিকে তিনি সূফিবাদের দিকে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। সম্রাটের জীবন থেকে মূলধারার ইসলামের প্রভাব ক্ষীয়মাণ হওয়ার সূত্রপাত এখান থেকেই।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, সম্রাট হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পর ইসলামের পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মের ব্যপারেও তার আগ্রহ বেশ লক্ষ্যণীয়। নিঃসন্দেহে বিষয়টা দোষণীয় কিছু নয়। তবে একটা পর্যায়ে গিয়ে আকবর সম্রাট হিসেবে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিজের হাতে রাখতে চাইলেন। এক্ষেত্রে সম্রাটের পথের বাধা হয়ে রইলেন সাম্রাজ্যের মুসলিম স্কলাররা। একটি মুসলিম নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রভাবশালী ইসলামী ব্যক্তিত্বরা ও ধর্মীয় নেতারা রাষ্ট্রের নানা বিষয়েই হস্তক্ষেপ করতেন। বিষয়টি আকবর পছন্দ একেবারেই করেননি। তাই তিনি আলেমদের ক্ষমতা হ্রাসের সিদ্ধান্ত নিলেন।
অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আকবর শিক্ষা নিতে চাচ্ছিলেন। বৈরাম খানের পরবর্তীতে আকবরকে কেন্দ্র করে প্রসাদ ষড়যন্ত্র ডালপালা মেলেছিলো। আকবরকে হাতে রাখতে আকবরের দুধ মা মাহাম আগা, আকবরের দুধ ভাই আদম খান থেকে শুরু করে আকবরের অনেক আত্মীয়ই এসব ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আকবর একে একে সব ষড়যন্ত্রকারীদের পরাজিত করে সাম্রাজ্যের সার্বভৌম ক্ষমতা নিজ হাতে নিতে সক্ষম হন। আকবরের জন্য সমস্যা হলো, সাম্রাজ্যের আলেমরাও সাম্রাজ্যে বেশ বড় ধরনের প্রভাব রাখতেন। আকবর তাই কোনো ঝুঁকি নিতে চাননি।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৫৭৯ সালে তিনি ফতেহপুর সিক্রির মসজিদ থেকে একটি নির্দেশ জারি করে বসেন যে, এখন থেকে মুঘল সাম্রাজ্যের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা হিসেবে স্বীকৃত হবেন একমাত্র সম্রাট আকবর! এই মজহরনামা মোতাবেক আকবরকে ‘ইমাম-ই-আদিল’ ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ, সাম্রাজ্যের প্রধান বিচারপতির ভূমিকাও আকবর পালন করবেন।
২
ধর্মের প্রতি জানার আগ্রহ থেকেই ১৫৭৫ সালে গুজরাট অভিযান থেকে ফিরে আকবর ফতেহপুর সিক্রিতে ‘ইবাদতখানা’ নামে একটি ধর্মীয় ও দর্শনের আলোচনা করার স্থান প্রতিষ্ঠা করেন। আকবরের চরিত্রের একটি ভালো দিক হলো তিনি চিন্তাশীল ছিলেন, যেকোনো বিষয় নিয়ে গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে ভাবতে পছন্দ করতেন। বেশিরভাগ মানুষই চিন্তা-ভাবনা করে না।
শুরুতে এই ইবাদতখানায় শুধুমাত্র মুসলিম স্কলারদের আমন্ত্রণ জানানো হতো। ইবাদতখানায় তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা ছিলো। প্রতি বৃহস্পতিবার মাগরিবের পর আলোচনা শুরু হয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত চলতো। কখনো কখনো আলোচনা এত দীর্ঘায়িত হতো যে পরের দিন জুম্মার সালাতের পূর্ব পর্যন্ত আলোচনা চলত। আলেমগণ এখানে ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সম্রাটের সাথে আলাপ-আলোচনা করতেন। সম্রাটও খুব মনোযোগের সাথে তাদের আলোচনা শুনতেন, আলোচনায় অংশ নিতেন।
১৫৭৮ সালে প্রথমবারের মতো ইবাদতখানায় হিন্দু, খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধ, জরাথ্রুস্টসহ অন্যান্য ধর্মের পন্ডিতদের আমন্ত্রণ জানানো হতে থাকে। তারাও নিজেদের ধর্ম নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতেন। বিভিন্ন ধর্মের বিশেষজ্ঞদের আলোচনা শুনতে শুনতেই সবগুলো ধর্মের মূল কথা নিয়ে একটি সমন্বিত ধর্ম প্রচলনের বিষয়টি আকবরের মাথায় চলে আসে। শেষপর্যন্ত ১৫৮২ সালে সম্রাট আকবর জন্ম দেন নতুন একটি ধর্মের। যথাসময়ে সেই বিষয়ে আলোচনা করা হবে।
৩
বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকেই আদর্শের প্রশ্নে ইসলাম অনমনীয়। ইসলাম একত্ববাদে বিশ্বাসী একটি জীবনব্যবস্থা, যা সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহর দেওয়া পবিত্র গ্রন্থ আল কুরআন এবং হযরত মুহাম্মদ (স) এর সুন্নাহকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। অন্যদিকে হিন্দুস্তানের পরিচিত অন্যান্য ধর্মগুলো বহু ঈশ্বরবাদে বিশ্বাসী, যা একেবারে ইসলামের মূল শিক্ষার সাথেই সাংঘর্ষিক।
কাজেই ধর্মীয় মতাদর্শভিত্তিক আকবরের এ পরীক্ষা-নীরিক্ষায় মুসলিম স্কলাররা তেমন খুশি হলেন না। এদিকে সম্রাটের দিক থেকে চিন্তা করলে, সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্তগুলোতে স্কলারদের অংশগ্রহণ করার বিষয়টি তার কখনোই ভালো লাগতো না। তিনি এ থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিলেন, যার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ছিলো ১৫৭৯ সালের অধ্যাদেশটি। এই আদেশের মাধ্যমে আকবর নিজেকে সাম্রাজ্যের আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে ঘোষণা করলেন। মূলত এই ঘোষণার মাধ্যমেই আকবর রাষ্ট্র থেকে ইসলামের প্রভাবকে ক্ষুণ্ন করেন। আলেম সমাজে ক্ষোভ বাড়লো। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হলো বিদ্রোহের মাধ্যমে। সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রাদেশিক শাসক আর আলেমরা বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। আকবর কিছুটা চাপে পড়ে গেলেন।
আকবরের ধর্মীয় মতবাদের বিরোধীতা পোষণকারী আলেমদের সাথে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বে গেলেও আকবর অবশ্য সরাসরি ইসলামের উপর আঘাত হানেননি। ইসলামের কিছু প্রচলিত আচার-অনুষ্ঠান আকবর বন্ধ করেছিলেন বটে, কিন্তু মসজিদ, মাদ্রাসার দিকে হাত বাড়িয়ে দেননি, বা ইসলামের মূল আদর্শের বিরুদ্ধেও কখনো কোনো পদক্ষেপ নেননি। এমনকি ইসলাম প্রচারকদের কোথাও তেমন কোনো বাঁধা দেওয়া হয়নি।
৪
ব্যক্তিগত জীবনে হিন্দু ধর্মালম্বীদের প্রতি আকবরের উদারতা বেশ লক্ষ্যণীয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার ফলে সাম্রাজ্য পরিচালনায় আকবর হিন্দুদের পাশে পেতে চেয়েছিলেন। অবশ্য শুধু হিন্দুই না, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ আর সুষম অধিকারের ভিত্তিতে শক্তিশালী একটি সাম্রাজ্য তৈরি করতে চেয়েছিলেন আকবর।
হিন্দুদের মন জয় করতে আকবর হিন্দুদের উপর জিজিয়া ও তীর্থ কর উঠিয়ে নেন। জিজিয়া মূলত সাম্রাজ্যের নিরাপত্তায় বাধ্যতামূলক সামরিক সেবা থেকে অব্যহতি দেওয়ার বিনিময়ে নেওয়া হতো। করের পরিমাণও খুবই সামান্য ছিলো।
হিন্দুদের প্রতি নিজের আন্তরিকতার প্রকাশের জন্য আকবর রাজপুত নারীদের সাথে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন। এমনকি বেশ কয়েকজন রাজপুত দরবারের উচ্চপদও পেয়েছিলেন। এই বৈবাহিক সম্পর্কের সূত্র ধরে আকবর একেবারে সামনে থেকে হিন্দুদের ধর্মীয় বিশ্বাস আর রীতিনীতির সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পান। এর ফলে হিন্দু ধর্মের প্রতি তার আগ্রহ বাড়ে। হিন্দু স্ত্রীদের সুবিধার্থে প্রথমবারের মুঘল প্রাসাদে পূজা-অর্চণার অনুমতি দেওয়া হয়।
ইন্দ্র, বিষ্ণু, মহাদেবের প্রতি আকবর বেশ শ্রদ্ধা পোষণ করতেন। হিন্দু ধর্ম বিষয়ে জানার সময় তাদের বিভিন্ন উৎসবের সাথেও আকবরের পরিচিতি ঘটে। রাখীবন্ধন, বসন্তোৎসব, দীপাবলী, দশহারার মতো উৎসবগুলোকে আকবর অংশ নিতেন। হিন্দুদের বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবে হিন্দু পণ্ডিতদের আমন্ত্রণ জানাতেন। এমনকি আকবরের আগ্রহে যোগ, বলিষ্ঠ, রামায়ণ, মহাভারত, অথর্ব বেদ প্রভৃতি হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলো অনুবাদের ব্যবস্থা করা হয়।
বিভিন্ন সময়ে আকবর হিন্দুরীতিতে পোষাক পরতেন, সকালে সূর্যের দিকে তাকিয়ে মন্ত্রপাঠ করতেন। এছাড়াও আকবর হিন্দুদের মতোই গঙ্গা জলকে পবিত্র ভাবতেন। গরু হিন্দু ধর্মালম্বীদের কাছে পবিত্র হওয়ায় গরু জবাই করাকেও আকবর নিরুৎসাহিত করতেন। হিন্দু ধর্মের প্রতি আকবরের এত আগ্রহ দেখে অনেক পণ্ডিতই আকবরকে রাম-কৃষ্ণের অবতার বলতেন।
হিন্দু ধর্মের অনেক রীতিনীতি পছন্দ করলেও সতিদাহ প্রথা আকবর খুবই অপছন্দ করতেন। ইচ্ছার বিরুদ্ধে সদ্যবিধবা স্ত্রীকে দাহ করা থেকে বিরত রাখতে আকবর শাস্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। বেঁচে যাওয়া বিধবা হিন্দু মহিলাদের পুনরায় বিবাহের জন্য আকবর সবসময় উৎসাহ দিতেন। হিন্দু ধর্মের বর্ণপ্রথাকে আকবর বৈষম্যমূলক আচরণ মনে করতেন এবং অপছন্দ করতে।
৫
খ্রিস্টান ধর্মের সাথে আকবরের সরাসরি পরিচয় ঘটে গুজরাট আক্রমণের সময়। খ্রিষ্টধর্ম সম্পর্কে জানার জন্য গোয়াতে অবস্থানগ্রহণকারী পর্তুগীজদের আকবর এসময় অনুরোধ করেছিলেন দরবারে কয়েকজন খ্রিস্টান পাদ্রী পাঠাতে। খ্রিস্টানরা অত্যন্ত আনন্দের সাথে সম্রাটের এই আহ্বানে সাড়া দেন।
এনরিকেজ, রিদলজেন একোয়াভিভ আর এস্টোনিভ মনসারেতকে নিয়ে প্রথম দলটি ১৫৮০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারীতে মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানীতে পা ফেলে। প্রায় ২ বছর দরবারে অবস্থা করে ১৫৮২ সালের এপ্রিল মাসে দলটি রাজধানী ত্যাগ করে। এডওয়ার্ড লিউটন আর ক্রিস্টোফার দ্য ভেগার নেতৃত্বাধীন আরেকটি দল ১৫৯১ থেকে ১৫৯২ সাল পর্যন্ত আকবরকে সঙ্গ দিয়েছিলো। ফাদার জেরোম জেভিয়ার, বেনেডিক্ট দ্য গোয়োস আর ইমানুয়েল পিনহিরোর নেত্তৃত্বাধীন দলটি লাহোরে ১৫৯৫ সালে আকবরের দরবারে হাজির হন। ১৬০৫ সালে আকবরের মৃত্যু পর্যন্ত এই মিশনটি মুঘল রাজদরবারে অবস্থান করেছিলো।
জেসুইট এসব পাদ্রীদের সাথে আকবরের সম্পর্ককে অবশ্য অন্য একটি দিক থেকে বিবেচনা করা যায়। গুজরাট দখলের পদ প্রথমবারের মতো মুঘলরা সমুদ্রের দেখা পায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সমুদ্র ছিলো পর্তুগীজদের নিয়ন্ত্রণে। বাণিজ্যের সুবাদে উপকূলে এসে তারা রীতিমতো সামরিক ঘাটি বানিয়ে উপকূল নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে দেয়। জাহাজে স্থাপিত কামান তাদের সমুদ্রে অদ্বিতীয় করে তুলে। পর্তুগীজদের মতো উন্নত প্রযুক্তি মুঘলদের হাতে না থাকায় সম্রাট অনেকটা অসহায় বোধ করেন। অসহায়ত্বের মাত্রা বোঝা যায় যখন হজ্ব করার জন্য সমুদ্র যাত্রা অনুমতিও এই তস্কর শ্রেণীর থেকে নিতে হতো! এই অসভ্য দখলদাররা রাজপরিবারের নারীদেরও সম্মান জানাতো না। সম্রাটের স্ত্রীর হজ্ব যাত্রার সময় তারা ১ বছর তাকে গোয়া বন্দরে অপেক্ষা করায়।
কাজেই বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে আকবরের আগ্রহ এমনিতে তো ছিলোই, কিন্তু খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে আকবরের এই আগ্রহের পেছনে একটা রাজনৈতিক কারণ ছিলো এমনটাও বলা যায়। আবার পর্তুগীজরাও মুঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে নানান ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত থাকা এবং ইসলাম ও রাসুল (স) এর ব্যাপারে কুৎসা রটনা করলেও আকবর সহনশীলতার পরিচয় দেন। এদিকে মুঘল দরবারে পর্তুগিজদের ঘন ঘন আনাগোনা দেখে ব্রিটিশরা আতঙ্কিত হয়ে মুঘল দরবারে সাথে সম্পোর্কন্নোয়নের চেষ্টা চালায়। রানী এলিজাবেথের পক্ষ থেকেও আকবরের কাছে পত্র প্রেরণ করা হয়। সেই সূত্র ধরে পরবর্তীতে ব্রিটিশরা মুঘল সাম্রাজ্যে বাণিজ্যের অনুমতি পায়। কিন্তু ব্রিটিশদের এই দেশে ঘাটি গাড়তে দেওয়া যে মোটেও ভালো কোনো ফল বয়ে নিয়ে আসেনি, তা তো ইতিহাসের পাতা থেকে স্পষ্টই। যাক, সে অন্য আলোচনা।
৬
পারস্যের প্রাচীন জরথুস্ত্র ধর্মের দ্বারাও আকবর বেশ প্রাভাবিত ছিলেন। এ ধর্মটির অগ্নি উপাসনার রীতিটি আকবরের সবচেয়ে ভালো লেগেছিলো। এই কারণেই ধর্মটির প্রতি তার আগ্রহ জন্মে। তাই তিনি জরথুস্ত্র ধর্মগুরু দস্তর মাইরজী রাণাকে দরবারে আহ্বান জানান। দস্তর মাইরজী রাণা আকবরকে অগ্নি উপাসনার পদ্ধতিসহ জরথুস্ত্র ধর্মের বিভিন্ন প্রার্থনার নিয়ম শেখান। তারই উৎসাহে আকবর প্রকাশ্যে অগ্নি উপাসনা শুরু করেন। এমনকি এসময়ে দরবারে অগ্নি শিখা প্রজ্জলিত করা হতো, এবং দরবার শুরুর সময় সবাইকে দাঁড়িয়ে অগ্নি শিখাকে সম্মান জানাতে হতো। ধারনা করা হয় অগ্নিপূজারি রাজা বীরবলের প্রভাবেই আকবর জরথুস্ত্র ধর্মের প্রতি ঝুঁকে পরেন।
এছাড়াও অন্যান্য ধর্মের পাশাপাশি আকবর জৈন ধর্মের প্রতিও বেশ আগ্রহী ছিলেন। জৈন ধর্মের জীব প্রেমের দর্শনটি আকবরের ভালো লেগে যায়। জৈন ধর্মের বেশ কয়েকজন গুরুর মুঘল রাজদরবারে আনাগোনা ছিলো। জৈন ধর্মের প্রতি আকবরের পরিচয় হয় মূলত রাজস্থান থেকে। রাজস্থান ছিলো জৈনদের বেশ শক্তিশালী ঘাটি। আর রাজপুতদের সাথে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতার ফলে আকবর জৈনদের সাথেও ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন।
১৫৮২ সালে জৈন ধর্মগুরু হীরা বিজয় সুরি মুঘল দরবারে এসে প্রায় ২ বছর অবস্থান করেন। এই ২ বছরে তিনি নানাভাবে আকবরকে প্রাভাবিত করার চেষ্টা করেন। তার প্রচেষ্টাতেই আকবর আমিষ তথা মাংস খাওয়া প্রায় ছেড়ে দেন। হীরা বিজয় সুরি ছাড়াও পরবর্তীতে গুরু শান্তিচন্দ্র, ভানুচন্দ্র, জিন চন্দ্র সুরি মুঘল দরবারে অবস্থান করেছিলেন। তারাও বিভিন্নভাবে আকবরকে জৈন ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করেন।
এছাড়াও শিখ ধর্মের প্রতিও আকবরের আকর্ষণ বিশেষ লক্ষ্যণীয়। শিখ ধর্মগুরু অমরদাস, রামদাস আকবরের দরবারে এসেছিলেন এবং নানাভাবে আকবর তাদের দ্বারা প্রাভাবিত হয়েছিলেন। রামদাসকে আকবর একটি জায়গীর প্রদান করেন। রামদাস সেই জায়গীরে একটি পুকুর খনন করে নাম দেন অমৃতসর। পরবর্তীতে এই অমৃতসরই শিখ ধর্মালম্বীদের মূল কেন্দ্রে পরিণত হয়। শিখদের প্রতি আকবরের কৃতজ্ঞতা স্মরণ করে শিখ ধর্মগ্রন্থ গ্রন্থসাহেবে আকবরকে বেশ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়েছে।
৭
আকবরের ধর্মীয় বিশ্বাস যে বেশ বিচিত্র ছিলো, তা তো স্পষ্ট। যখন যে ধর্মের যে বিষয়গুলো আকবরের ভালো লেগেছে, তিনি তা-ই মনে-প্রাণে পালন করেছেন। রাষ্ট্রীয় কাজে মুসলিম স্কলারদের অংশগ্রহণের বিষয়টি ছাড়াও, বিভিন্ন তুচ্ছ কারণে স্কলারদের নিজেদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কলহে আকবর বেশ বিরক্ত ছিলেন। বহু-ঈশ্বরবাদী ধর্মগুলোর বিভিন্ন রীতিনীতি পালন করায় আকবরের প্রতিও মুসলিম স্কলাররা সন্তুষ্ট ছিলেন না। প্রায়ই তাদের এই অসন্তুষ্টির বিষয়টি প্রকাশ পেয়ে যেত, যা আকবর ও মুসলিম স্কলারদের মাঝে দূরত্ব বাড়িয়ে দিয়েছিলো।
অন্যদিকে অন্যান্য ধর্মের প্রতি আকবরের গভীর আগ্রহ দেখে অনেকেই সেই সুযোগ কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। যেমন- খ্রিস্টান মিশনারীরা শুরুর দিকে খ্রিস্টান ধর্মের প্রতি আকবরের টান দেখে ভেবেছিলেন আকবরকে খ্রিস্টান বানানো সম্ভব হবে। তারা বেশ কয়েকবার সেই চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পরেই বুঝে যান খ্রিস্টান ধর্মের প্রতি আকবরের এই আগ্রহ অন্যান্য ধর্মের প্রতি আকবরের আগ্রহের মতোই। পরে তারা হাল ছেড়ে দেয়।
চারিত্রিক দিক থেকে সম্রাট আকবর ছিলেন কৌতূহলী, তিনি যেকোনো বিষয় নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে পছন্দ করতেন। বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য, আদর্শিক আর বাহ্যিক রীতিনীতি দেখে আকবর ধর্মগুলো সম্পর্কে কৌতুহলী হয়েছিলেন। এসবের মধ্যে রাজনৈতিক সুবিধার জন্য এবং নিজের খামখেয়ালীপনা থেকে যা পছন্দ হয়েছে, তা-ই তিনি গ্রহন করেছে, পালন করেছেন। বিভিন্ন ধর্মের প্রভাবই পরবর্তীতে তাকে উব্ধুদ্ধ করে নতুন একটি ধর্ম প্রচলনের জন্য। আগামী পর্বে থাকছে সেই আলোচনা।
[এই সিরিজের পূর্বে প্রকাশিত পর্বটি পড়ুন এখানে। সিরিজের সবগুলো লেখা পড়তে চাইলে ক্লিক করুন এখানে।]