চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতির ফলে স্বাস্থ্যসেবার দিক দিয়ে চমৎকার একটি সময় পার করছে মানবজাতি। নিয়মিত বিরতিতে নানা ওষুধ ও যন্ত্রপাতির উদ্ভাবন, উন্নততর নানা গবেষণা মানুষকে দেখাচ্ছে আরো কিছুটা বেশি সময় সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন। তবে আজ থেকে কয়েকশ কিংবা কয়েক হাজার বছর আগে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিস্থিতি কিন্তু এর ধারেকাছেও ছিলো না। তখনকার দিনের নানা চিকিৎসা পদ্ধতির কথা শুনলে এখন হয়তো হাসতে হাসতে অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে অনেকের, প্রবল বিস্ময়ে হাঁ হয়ে যাবে গোটা মুখটিই! অতীতের সেসব কিছু বিচিত্র চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়েই সাজানো হয়েছে আজকের পুরো লেখা।
১। ত্যাগকৃত বায়ু
জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বায়ু ত্যাগের মতো ব্যাপারের মধ্য দিয়ে যেতে হয় প্রতিটি মানুষকেই। চিরন্তন সত্য এ বিষয়টি অবশ্য জনসমক্ষে ঘটলে এর শব্দ ও গন্ধের কারণে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে যায় সবাই। কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, এককালে চিকিৎসকেরা দুর্গন্ধযুক্ত এ বায়ুকেই চিকিৎসার উপাদান হিসেবে ব্যবহার করতেন!
মধ্যযুগে ব্ল্যাক ডেথের মতো মহামারীর সম্মুখীন হয়ে চিকিৎসকেরা ভেবেছিলেন, এটা বুঝি কোনো খারাপ বাতাসের প্রভাবে হচ্ছে। তাই ‘বিষে বিষক্ষয়’ নীতির দ্বারস্থ হয়ে সেই খারাপ বাতাসকে তারা মানবদেহ থেকে ত্যাগকৃত বায়ুর মতো আরেক খারাপ বাতাস দিয়ে প্রতিরোধের চিন্তা করেছিলেন। তারা সাধারণ মানুষকে সেই ত্যাগকৃত বায়ু কোনো জারে সংরক্ষণের পরামর্শ দিতেন! পার্শ্ববর্তী কোথাও আক্রমণের খবর পেলেই মানুষজনকে সেই জার খুলে তার গন্ধ শোঁকার পরামর্শই দিয়েছিলেন তখনকার চিকিৎসকেরা। অবশ্য ত্যাগকৃত বায়ুর গন্ধ যে প্লেগকে তাড়াতে পারে নি তা বোধ হয় না বললেও চলে।
২। অন্ডকোষ
গত শতকের শুরুর দিকে আমেরিকার বেশ পরিচিত এক ডাক্তার ছিলেন জন রিচার্ড ব্রিঙ্কলে। তাকে অবশ্য ডাক্তার না বলে হাতুড়ে ডাক্তার বলাই ভালো। কারণ চিকিৎসাশাস্ত্র সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিলো খুবই সীমিত। তবুও তিনি এ ‘ডাক্তার’ নাম ভাঙিয়ে বিপুল অর্থের মালিক হয়েছিলেন।
সক্ষমতা বাড়ানো, সন্তান ধারণে অক্ষমতা কিংবা এ ধরণের আরো নানা যৌন রোগের চিকিৎসা করতেন তিনি এক অদ্ভুত উপায়ে। সব ক্ষেত্রেই পাঁঠার অন্ডকোষ কেটে নিয়ে তা তিনি একজন অক্ষম পুরুষের অন্ডকোষের জায়গায় প্রতিস্থাপন করে দিতেন! তার এ অপচিকিৎসার শিকার হয়ে অকালে প্রাণ হারাতে হয়েছিলো অনেককেই।
৩। গ্ল্যাডিয়েটরের রক্ত
প্রাচীন রোমে নগরবাসীর বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম ছিলো গ্ল্যাডিয়েটরদের যুদ্ধ। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দাস ও বন্দীদের মাঝে আমরণ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধগুলো খুব উপভোগ করতো তারা। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এসব যুদ্ধ থেকে মানসিক আনন্দ লাভের পাশাপাশি সেসব যোদ্ধাদের রক্তকেও বৃথা যেতে দিতো না তারা। শেষ যুদ্ধটি শেষ হবার সাথে সাথেই মানুষজন ছুটে যেতো একেবারে যুদ্ধের জায়গায়। সেখানে মৃত গ্ল্যাডিয়েটরের রক্ত কে আগে খাবে তা নিয়ে কাড়াকাড়ি লেগে যেতো তাদের মাঝে! এ থেকে বাদ যেতো না মৃত যোদ্ধার যকৃতও। তারা মনে করতো, এভাবে মৃত গ্ল্যাডিয়েটরের রক্ত পান করলে মৃগী রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব!
৪। রক্ত
একসময় ধারণা করা হতো, মানুষের বিভিন্ন অসুস্থতার কারণ হলো ‘দূষিত রক্ত’। আর তাই এ রক্তকে শরীর থেকে বের করে দেয়াই ছিলো বিভিন্ন অসুস্থতার চিকিৎসা। প্রাচীন গ্রীস ও রোমে এমনটা দেখতে পাওয়া যায়। তখন কোনো রোগে আক্রান্ত হলে একজন চিকিৎসক তার রোগীর একটি শিরা কেটে কিছুটা রক্ত একটি পাত্রে জমা করে রাখতেন। এমনকি শরীর থেকে রক্ত বের করতে সরাসরি জোঁকও ব্যবহার করা হতো। মধ্যযুগীয় চিকিৎসকেরা গলা ব্যথা থেকে শুরু করে প্লেগ পর্যন্ত সবকিছুতেই শরীর থেকে রক্ত বের করার পথ বেছে নিতেন। এমনকি কিছু কিছু নাপিতও তাদের স্বাভাবিক চুল কাটা ও দাড়ি ছাঁটার পাশাপাশি এ দূষিত রক্ত বের করে দেয়াকে পার্শ্বব্যবসা হিসেবে বেছে নিয়েছিলো। এখনো কিছু কিছু রোগের চিকিৎসার জন্য এ পদ্ধতির সাহায্য নেয়া হয়।
৫। খুলিতে ছিদ্র
চিকিৎসা পদ্ধতির নামটা পড়েই তো ভয়ে কেমন যেন গা ছমছম করে ওঠে! এর প্রচলন ছিলো আজ থেকে প্রায় ৭,০০০ বছর আগে। তখন খুলিতে ছিদ্র করেই রোগমুক্তির পথ খোঁজা হতো। তবে সময়টা অনেক আগেকার বলে গবেষকেরা এর কারণ কিংবা প্রকৃত কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে কেবল অনুমান করতেই পারেন।
সবচেয়ে প্রচলিত ধারণা হলো- খুলিতে ছিদ্র করার এ ব্যাপারটি সম্ভবত কোনো ধর্মীয় আচারের অংশ যেখানে একজন শারীরিক বা মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিকে খারাপ আত্মার হাত থেকে রক্ষার ব্যবস্থা করা হতো। অনেকের মতে এ পদ্ধতিটি মৃগী রোগ, মাথা ব্যথা, ফোঁড়া এবং রক্ত জমাট বাঁধার মতো সমস্যার সমাধানে ব্যবহৃত হতো। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, এমন ভয়াবহ এক অস্ত্রোপচারের মধ্য দিয়ে যাবার পরও তখনকার সময়ে রোগী বেঁচে যাওয়ার প্রমাণ আছে!
৬। মানুষের চর্বি
শুরুর দিককার ইউরোপিয়ান ওষুধ প্রস্তুতকারকেরা দাঁতব্যথা, হাড়ে ব্যথা ও গেটেবাঁতের চিকিৎসার জন্য প্রস্তুতকৃত মলমে সরাসরি মানুষের চর্বিই ব্যবহার করতেন। একে অনেকটা সর্বরোগের ওষুধ হিসেবেই ধরা হতো।
৭। মায়ের দুধ
মায়ের বুকের দুধ একটি শিশুর জন্য কতটা দরকারি তা নিশ্চয়ই কারো অজানা নয়। তবে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, মধ্যযুগীয় বিভিন্ন ওষুধ প্রস্তুতিতেও একে ব্যবহার করা হতো।
চোখে দেখতে অথবা কানে শুনতে সমস্যা হচ্ছে? তাহলে লতাগুল্ম বা মধুর সাথে মায়ের বুকের দুধ মিশিয়ে তা চোখে-কানে ছিটিয়ে দেয়ার মাধ্যমেই খোঁজা হতো রোগমুক্তির পথ। ইংরেজরা তো ছিলো আরো এগিয়ে। ফ্লু, আলসার, ইনফেকশন, জন্ডিস, এমনকি পাগলামির প্রতিকারেও তারা দ্বারস্থ হতো এ মাতৃদুগ্ধের কাছে!
৮। মমীচূর্ণ
প্রাচীন মিশরীয়দের সময় থেকে শুরু করে আঠারো শতক পর্যন্ত গেঁটেবাত, টিউমারসহ বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে মমীচূর্ণ ব্যবহার করা হতো। এমনকি একে কামোদ্দীপক বস্তু হিসেবে ব্যবহারের কথাও জানা যায়।
৯। মানুষের মল
মানবদেহ থেকে বলপূর্বক (!) বের হওয়া দুর্গন্ধযুক্ত, হলুদাভ এ জিনিসটি থেকে মুক্তি চায় সবাই। কিন্তু প্রাচীনকালে চীনে ওষুধ হিসেবে এর ব্যবহার ছিলো খুবই সাধারণ এক ঘটনা। চতুর্থ শতকের দিকে সরাসরি পানি কিংবা মাছ, মাংস, তরকারি সিদ্ধ করা পানিতে সামান্য মল মিশিয়ে তা রোগীকে খাওয়ানো হতো পেটের বিভিন্ন রোগ সারানোর উদ্দেশ্যে! মিশরীয়রাও একে সর্বরোগের মহৌষধ মনে করে ব্যবহার করতো!
১০। ক্লাইস্টার
কোষ্ঠকাঠিন্যের জ্বালা কেমন তা এ সমস্যার ভেতর দিয়ে যাওয়া ব্যক্তিই ভালোভাবে বোঝেন। এ সমস্যা কাটাতে অধিকাংশ সময়ই আমরা খাদ্য তালিকায় কিছুটা পরিবর্তন এনে থাকি। এতেও কাজ না হলে দ্বারস্থ হতে হয় চিকিৎসকের। সতের থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত এ সমস্যার সমাধানে ক্লাইস্টার ছিলো বেশ জনপ্রিয়। এটি মলদ্বারের ভেতর সিরিঞ্জের সাহায্যে তরল পদার্থ ঢোকাতে ব্যবহার করা হতো। এর মূল ব্যবহারকারী ছিলো সমাজের উঁচু শ্রেণীর মানুষেরা। পানির সাথে লবণ, বেকিং সোডা কিংবা সাবান মিশিয়ে তৈরি করা হতো এ তরল দ্রবণটি। কোনো কোনো চিকিৎসক আবার সেই তরলে কফি, ভুষি, গুল্ম, মধু ইত্যাদি ব্যবহার করতেন।
কথিত আছে, ফ্রান্সের সম্রাট চতুর্দশ লুঁই নাকি তার জীবদ্দশায় ২,০০০ বারেরও অধিক সময় এ ক্লাইস্টারের দ্বারস্থ হয়েছিলেন!
১১। কুমিরের মল
জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য বর্তমানে কী কী পদ্ধতি প্রচলিত আছে তা বোধহয় আধুনিক মিডিয়ার কল্যাণে সন্তান জন্ম প্রক্রিয়া সম্পর্কে অজ্ঞ শিশুটিও জানে! কিন্তু প্রাচীনকালে তো পরিস্থিতি এখনকার মতো ছিলো না। এখনকার মতো হরেক রকম পদ্ধতির অনুপস্থিতি তখনকার সময়ের ব্যাপারটিকে করে তুলেছিলো বেশ জটিল, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মারাত্মক অস্বাস্থ্যকরও।
এই যেমন কুমিরের মলের কথাই ধরা যাক। প্রাচীন মিশরের স্ত্রীর সাথে মিলিত হবার আগে একজন স্বামী জন্ম নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে স্ত্রীর যোনিপথে কুমিরের শুকনো মল লাগিয়ে নিতেন! তাদের কথা ছিলো- শরীরের উত্তাপে ভেতরে থাকা সেই মল ভিজে গিয়ে বীর্যের জন্য এক চমৎকার বাধা হিসেবে কাজ করে নিয়ন্ত্রণ করবে সন্তানের সংখ্যা! একই কাজে আরো ব্যবহার করা হতো গাছের প্রাণরস, লেবুর অর্ধাংশ, তুলা, উল কিংবা হাতির মল।
১২। জিহ্বার কর্তন
আঠারো-উনিশ শতকের দিকে তোতলানোর চিকিৎসা হিসেবে চিকিৎসকেরা রোগীর জিহ্বার অর্ধেকই কেটে ফেলতেন।
১৩। ভেড়ার যকৃত
আদি যুগে তো এখনকার মতো রোগ নির্ণয়ের জন্য এতসব যন্ত্রপাতি ছিলো না, তাহলে তারা কীভাবে রোগ নির্ণয় করতো? এতক্ষণ ধরে উল্লেখ করা বিভিন্ন চিকিৎসাপদ্ধতি সম্পর্কে জেনে অন্তত এটকু বুঝে যাবার কথা যে তখনকার দিনে ছিলো মূলত কুসংস্কারের রাজত্ব। রোগ নির্ণয়ও এর বাইরে ছিলো না।
এই যেমন মেসোপটেমিয়ার কথাই ধরা যাক। সেখানে একজন চিকিৎসক তার রোগীর কী রোগ হয়েছে তা বুঝতে সরাসরি রোগীকে পরীক্ষা না করে বরং পরীক্ষা করতেন সেই রোগীর পক্ষ থেকে উৎসর্গ দেয়া ভেড়ার যকৃত!
১৪। মৃত ইঁদুরের মিশ্রণ
দাঁতের ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে আমরা সাধারণত কুসুম গরম পানিতে কিছুটা লবণ মিশিয়ে কুলি করে থাকি। তাতে স্থায়ী সমাধান না মিললেও অন্তত সাময়িক স্বস্তি ঠিকই মেলে। কিন্তু প্রাচীন মিশরীয়দের বোধহয় এটা জানা ছিলো না। তাই দাঁতের ব্যথায় তারা মুখে মরা ইঁদুর নিয়ে ঘুরতো! অনেকে আবার ইঁদুর চটকে সেটি অন্যান্য উপাদানের সাথে মিশিয়ে তারপর ব্যথার স্থানে লাগাতো ব্যথা থেকে মুক্তির অভিপ্রায়ে।
চিক
শুধু মিশর কেন, বর্তমানে অনেকের কাছেই ‘সভ্য’ জাতির রোল মডেল ইংরেজরাও এর ব্যতিক্রম ছিলো না। রাণী প্রথম এলিজাবেথের সময়কালে আঁচিল থেকে মুক্তি পেতে অর্ধেক করে কাটা ইঁদুর আক্রান্ত জায়গায় লাগিয়ে রাখা হতো। সেই সাথে হাম, হুপিং কাশি, স্মলপক্স কিংবা ঘুমের ঘোরে প্রস্রাব করে বিছানা ভেজানোর মতো উটকো ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতেও এককালে ইংরেজরা ইঁদুর ব্যবহার করতো।