যুক্তরাষ্ট্রের সর্বপ্রথম রাষ্ট্রপতি জর্জ ওয়াশিংটন। যেহেতু তিনিই প্রত্থম, তাই রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার অভিষেক হবার ঘটনটিও যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ একটি ঘটনা। ১৭৮৯ সালের ৩০ এপ্রিল, রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার দায়িত্ব গ্রহণের অনুষ্ঠান, যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ জনগণের উপস্থিতি এবং উৎসবমুখর পরিবেশের মধ্যে সম্পন্ন হয়েছিল। নিউ ইয়র্কের রাস্তাগুলো এই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে জনারণ্যে ভরে উঠেছিল। যা-ই হোক, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হিসেবে জর্জ ওয়াশিংটনের অভিষেকের ঘটনাকে অনেকেই নবযুগের সূচনা হিসেবেও বলে থাকেন।
আমেরিকার স্বাধীনতা বিপ্লবের পর, কয়েক বছর ধরেই দেশটি আর্টিকেল অফ কনফেডারেশন নিয়ে বেশ প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছিল। তাই সে সময়ে দেশটির জন্যে কার্যকরী একটি রাষ্ট্রীয় সরকার গঠন করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। এবং তারই সূত্র ধরে, ১৭৮১ সালের গ্রীষ্মে, ফিলাডেলফিয়া সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার পরিচালনার জন্য একটি সংবিধান তৈরি করা হয়েছিল এবং রাষ্ট্রপ্রধান সংসদ ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য রাষ্ট্রপতির কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল।
সাংবিধানিক অধিবেশন পরিচালনার জন্য জর্জ ওয়াশিংটনকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবার পর থেকেই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নায়ক হয়ে উঠতে শুরু করেন। যেহেতু তার আগে কোনো সাংবিধানিক সরকার ব্যবস্থাই ছিল না, তাই রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবার সাথে সাথেই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সর্বপ্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে নাম লেখান। ১৭৮৮ এর শেষ দিকে প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে খুব সহজেই রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিজয়ী হয়েছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন। তারই কয়েকমাস পর ম্যানহাটনের ফেডালেরল হলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে যখন রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করছিলেন, তখনই স্থিতিশীল একটি সরকার পেয়ে, একটি নবীন জাতি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল।
ফেডারেল হল বিল্ডিংয়ের বারান্দায় এসে, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হিসেবে জনগণের দিকে হাত উঁচিয়ে আশ্বাস দেয়ার রীতি এতটাই অবিস্মরণীয় হয়ে উঠেছিল যে, এখন প্রতি চার বছর পর পরই নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি শপথ গ্রহণ করে, একই কায়দায় বারান্দা থেকে হাত নাড়িয়ে জনগণের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে থাকেন।
শপথ গ্রহণের প্রস্তুতি
ভোট গণনা এবং নির্বাচনের ছাড়পত্র পেতে দেরি হবার ফলে, ১৭৮৯ সালের ১৪ এপ্রিল জর্জ ওয়াশিংটনকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়, তিনি আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। কংগ্রেস সেক্রেটারি এই খবর দেয়ার জন্য ওয়াশিংটনের বাসভবন মাউন্ট ভার্ননে গিয়েছিলেন। একটি অনাড়ম্বর সাক্ষাতে রাষ্ট্রীয় বার্তাবাহক চার্লস থমসন এবং জর্জ ওয়াশিংটন একে অপরের কাছে প্রাথমিক বিবৃতি আদান প্রদান করেছিলেন। সেদিনই যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করার জন্য জর্জ ওয়াশিংটন সম্মতি প্রদান করেছিলেন।
এর দু’দিন পর তিনি নিউ ইয়র্কের উদ্দেশে যাত্রা করেন। মাউন্ট ভার্নন থেকে নিউ ইয়র্কের এই যাত্রা বেশ দীর্ঘ একটি পথ ছিল। এমনকি ওয়াশিংটনের নিজস্ব গাড়িতে করেও এই সড়কযাত্রা খুব একটা সহজ ছিল না। তবে সবচাইতে মজার ব্যাপার হলো, যাত্রাপথের প্রতিটি স্টপেজেই তার দায়িত্ব গ্রহণের অপেক্ষায় থাকা এবং তাকে এক পলক দেখার জন্য ভিড় করে থাকা উৎসাহী জনগণের দেখা পেয়েছিলেন তিনি। এমনকি রাতের বেলা স্থানীয় কোনো সরকারি কর্মকর্তার বাড়িতে তাকে নৈশভোজের জন্যও বাধ্য হতে হয়েছিল।
ফিলাডেলফিয়ার বিশাল জনসমাগমে উৎসবমুখর পরিবেশে স্বাগত হলেও, তিনি একটু চুপচাপ পরিবেশে নিউ ইয়র্কে পৌঁছানোর কথা মনে মনে ভেবেছিলেন। কিন্তু তার মনের সে ইচ্ছে পূরণ হয়নি। রাষ্ট্রপতি হিসেবে যেদিকেই তিনি পা রেখেছেন, সেদিকেই মানুষের উষ্ণ অভ্যর্থনায় সিক্ত হয়েছেন।
১৭৮৯ সালের ২৩ এপ্রিল, জর্জ ওয়াশিংটনকে বিলাসবহুল এবং সুসজ্জিত একটি বজরা নৌকায় করে নিউ জার্সির এলিজাবেথ থেকে ম্যানহাটনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। নিউ ইয়র্কে তার পদার্পণ যেন পরিণত হয়েছিল জাতীয় উৎসবে। জাতীয় পত্রিকাগুলোতে এই উৎসবমুখর পরিবেশের বর্ণনা করে ক্রোড়পত্র ছেপেছিল। এরকম একটি ক্রোড়পত্রে বলা হয়, জর্জ ওয়াশিংটন যখন ম্যানহাটনের দক্ষিণ প্রান্তের সামরিক ঘাঁটি অতিক্রম করছিলেন, তখন তাকে কামানের তোপধ্বনির মাধ্যমে সম্মান জানানো হয়েছিল।
তিনি যখন নিউ ইয়র্কে পা রাখেন, তখন অশ্বারোহী বাহিনী কর্তৃক সুসজ্জিত একটি প্যারেড আয়োজন করা হয়েছিল। অশ্বারোহী বাহিনীর সাথে এই প্যারেডে সামরিক কর্মকর্তা, ১ম পদাতিক বাহিনীর মাধ্যমে গঠিত ‘প্রেসিডেন্ট গার্ড ইউনিট’ সদস্যরাও অংশ নিয়েছিলেন। নগর এবং রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা এবং হাজার হাজার সাধারণ মানুষের উপস্থিতিতে, জর্জ ওয়াশিংটন প্রথমবারের তার জন্য নির্ধারিত ‘রাষ্ট্রপতি ভবনে’ প্রবেশ করেছিলেন।
১৭৮৯ সালের ৩০ এপ্রিল, বোস্টন ইন্ডিপেন্ডেন্ট ক্রোনিকলে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল যে,
“নিউ ইয়র্কের দেয়ালে দেয়ালে পতাকা এবং ব্যানার প্রদর্শনের হিড়িক লেগে গিয়েছিল। কোনো কোনো ভবন থেকে ঘণ্টাও বাজানো হয়েছিল। নারীরা তাদের ঘর থেকে হাত নেড়ে জর্জ ওয়াশিংটনকে স্বাগত জানিয়েছিল।”
এর পরের সপ্তাহে জর্জ ওয়াশিংটন তার চেরি স্ট্রিটের বাসভবনে পারিবারিক এবং রাষ্ট্রীয় সভা নিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় কাটান। এর কিছুদিন পরেই তার স্ত্রী মার্থা ওয়াশিংটন নিউ ইয়র্কে এসে পৌঁছান। তার স্ত্রীর সাথে মাউন্ট ভার্ননের ভার্জিনিয়া এস্টেটের বাসভবনে থাকা কয়েকজন গৃহপরিচারিকাও নিউ ইয়র্কে এসেছিলেন।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হিসেবে জর্জ ওয়াশিংটনের আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব গ্রহণের দিনটি ছিল ১৭৮৯ সালের ৩০ এপ্রিল। সেদিন দুপুরে চেরি স্ট্রিটের রাষ্ট্রপতির বাসভবন থেকে একটি র্যালি বের হয়েছিল। র্যালিতে সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে জর্জ ওয়াশিংটন এবং অন্যান্য নেতারা রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে ফেডারেল হলের দিকে অগ্রসর হন।
শপথ গ্রহণের এই দিনে জর্জ ওয়াশিংটনের প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি কর্মকাণ্ড এতটাই তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছিল যে তিনি নিজেও তা নিয়ে বেশ সচেতন ছিলেন। এই মহৎ দিনে পরিধানের জন্য তিনি নিজের পোশাক নিজেই নির্বাচন করেছিলেন। যদিও সে সময়ে জর্জ ওয়াশিংটন একজন সামরিক ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন, তবুও তিনি তার পোশাক-আষাকের মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েচিলেন যে, একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান সেই দেশের সাধারণ জনগণের মতোই একজন মানুষ। তাই তিনি সামরিক ইউনিফর্ম বা ইউরোপীয় পোশাক না পরে নিজ দেশে তৈরী সাধারণ পোশাকই গায়ে জড়িয়েছিলেন।
তিনি আমেরিকান সুতোয় বোনা একটি স্যুট, কানেকটিকাটের বাদামি ভেলভেটে তৈরী একটি গলাবন্ধনী পরেছিলেন। তার সামরিক মর্যাদা রক্ষার্থে শুধুমাত্র একটি তলোয়ার সাথে রেখেছিলেন।
নাসাউ এবং ওয়াল স্ট্রিটের কোণে অবস্থিত বিল্ডিঙের সামনে এসে দাঁড়ালে এক দল সামরিক সৈন্য তাকে অভ্যর্থনা জানায় এবং সামরিক সেনাদের পাহারায় তিনি ভবনটিতে প্রবেশ করেন। ১৭৮৯ সালের ২ মে’তে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুসারে বলা হয়, ভবনটিতে প্রবেশের পর তার সাথে কংগ্রেসের উভয় দলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছিল। যদিও এই পরিচয় পর্ব শুধুমাত্র একটি আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আর কিছুই না, কারণ জর্জ ওয়াশিংটন কংগ্রেস হাউজ এবং সিনেটের সদস্যদেরকে আগে থেকেই চিনতেন।
নিউ ইয়র্কের কাউন্সিলর রবার্ট বাল্টিমোর, জর্জ ওয়াশিংটনকে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ বাক্য পাঠ করিয়েছিলেন। শপথ গ্রহণের সময় জর্জ ওয়াশিংটন ওয়াল স্ট্রিটের সেই ভবনের সামনে একটি খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে শপথ গ্রহণ করেছিলেন। বর্তমানে নিউ ইয়র্কের প্রধান বিচারপতি কর্তৃক রাষ্ট্রপতির শপথ গ্রহণের যে রীতি দেখা যায়, তা জর্জ ওয়াশিংটনের সময় প্রচলিত ছিল না। কারণ, আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের পথচলাই শুরু হয়েছিল ১৭৮৯ সালের সেপ্টেম্বরে, এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম বিচারপতি ছিলেন জন জে।
১৭৮৯ সালের ২ মে, সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জর্জ ওয়াশিংটনের শপথ গ্রহণের ঘটনাকে বর্ণনা করা হয়েছিল এভাবে,
১৩ বার কামানের তোপধ্বনি হবার পর আমেরিকার চ্যান্সেলর জর্জ ওয়াশিংটনকে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেন। এর পরপরই বাতাসে ‘দি প্রেসিডেন্ট , দি প্রেসিডেন্ট’ ধ্বনি উচ্চারিত হতে থাকে। সকলের ভূয়সী প্রশংসা সাথে নিয়ে জর্জ ওয়াশিংটন কংগ্রেসের দুই হাউজের সদস্য ও সিনেটদের সাথে অন্দরমহলে প্রবেশ করেন। সিনেট চেম্বারে বসে রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি তার প্রথম বক্তৃতা প্রদান করেন। তিনি একটি দীর্ঘ বক্তৃতা লিখিত আকারে নিয়ে এসেছিলেন।
বক্তৃতা প্রদানের পর, জর্জ ওয়াশিংটন নবনিযুক্ত ভাইস প্রেসিডেন্ট জন অ্যাডামস সহ, কংগ্রেসের সদস্যদের সাথে ব্রডওয়েতে অবস্থিত সেন্ট পলস চ্যাপেল চার্চে প্রার্থনায় অংশ নেন। চার্চে প্রার্থনা পর্ব শেষ করে তিনি তার জন্য নির্ধারিত রাষ্ট্রপতির বাসভবনে ফিসে আসেন।
নিউ ইয়র্কের জনগণ তখনও তাদের আনন্দ উদযাপন চালিয়ে যাচ্ছিল। পত্রিকার প্রতিবেদন অনুসারে, রাতের নিউ ইয়র্কের বিভিন্ন ভবন-বাসা-বাড়ি থেকে আলোকসজ্জার আলো চারদিকে ছিটকে পড়ছিল। বিশেষ করে ফরাসি এবং স্প্যানিশ রাষ্ট্রদূতের বাড়ির আলোকসজ্জা ছিল বেশ নজরকাড়া।
এই মহান দিনটির সমাপ্তির বর্ণনা করতে গিয়ে তৎকালীন আমেরিকান পত্রিকা দ্যা গ্যাজেট অফ ইউনাইটেড স্টেট একটি প্রতিবেদনে লিখেছিল-
সেদিন সন্ধ্যার উৎসব ছিল খুবই মনোরম এবং স্বতঃস্ফূর্ত। হাজার হাজার মানুষ এই ঘটনার সাক্ষী হবার জন্য জড়ো হয়েছিল নিউ ইয়র্কের রাস্তায় রাস্তায়। তারপরও সেদিন কোনো অঘটনের মেঘ এই উৎসবকে গ্রাস করতে পারেনি।