বিশ্বের সর্বপ্রথম মোটরগাড়িটি তৈরি হয়েছিল প্রায় ২০০ বছর আগে, ১৮০৮ সালে। এরপর প্রযুক্তির বহু উন্নয়ন ঘটেছে, জন্ম নিয়েছে বহু মোটরগাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে গোটা বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৬০ মিলিয়ন গাড়ি তৈরি হয়। বিশ্বজুড়ে নানা রকম নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এ গাড়িগুলো তৈরি করে থাকে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ গত কয়েক বছরেই জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, আবার কারো কারো বর্তমানের এই অবস্থায় আসতে সময় লেগে গেছে কয়েকশো বছর! এসব প্রতিষ্ঠানের নাম আমরা জানলেও তাদের এই অবস্থায় আসার পেছনের গল্প আমরা অনেকেই জানি না। চলুন আজকে জেনে নিই এখনও পর্যন্ত চালু থাকা বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন কয়েকটি মোটরগাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে।
১. রোলস-রয়েস
প্রতিষ্ঠাকাল: ১৯০৬ সাল
বিলাসবহুল গাড়ির জগতে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় গাড়ির নাম রোলস-রয়েস। ১৯০৬ সালে ইঞ্জিনিয়ার হেনরি রয়েস ও যুক্তরাজ্যের প্রথম মোটরগাড়ি ডিলারশিপের মালিক চার্লস রোলস মিলে এই রোলস-রয়েস কোম্পানির সূচনা করেন।
রোলস-রয়েসের প্রথমদিকের গাড়ি ‘সিলভার ঘোস্ট’ এর মাধ্যমেই তাদের কোম্পানির সফলতার দৌড় শুরু হয়। অনেকগুলো রেকর্ড ভাঙা এই গাড়িটি সেসময় ‘বিশ্বের সেরা মোটরগাড়ি’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এই গাড়িটি একটানা ২৭ বার লন্ডন থেকে গ্লাসগো ভ্রমণ করে মোট ১৪,৩৭১ মাইল পাড়ি দেয়। এর ফলে বিলাসবহুল গাড়িতে চড়ে একটানা সবচেয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার বিশ্ব রেকর্ড করে এই গাড়িটি। বর্তমানে রোলস-রয়েস বিশ্বের আরেক জনপ্রিয় গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বিএমডাব্লিউ এর সাথে যুক্ত হয়েছে। এখনও বিশ্বের অন্যতম সম্মানীত গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখা হয় রোলস-রয়েসকে।
২. ক্যাডিলাক
প্রতিষ্ঠাকাল: ১৯০১ সাল
মোটরগাড়ির জগতে অন্যতম এক নাম ক্যাডিলাক। মজার ব্যাপার হলো, এই কোম্পানির জন্ম হয় কিন্তু বিশ্বের অন্যতম এক জনপ্রিয় গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ফোর্ডের মালিক হেনরি ফোর্ডের হাত ধরে। ১৯০১ সালে হেনরি ফোর্ড দ্বিতীয় আরেকটি গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘হেনরি ফোর্ড কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করেন। তবে এই কোম্পানির আর্থিক সাহায্যকারী লিমুয়েল বোয়েন ও উইলিয়াম মার্ফির সাথে কিছু মতের মিল না হওয়ায় হেনরি ফোর্ড এই কোম্পানি ছেড়ে চলে যান।
মার্ফি এবং ব্রাউন প্রথমে হেনরির এই কোম্পানির যন্ত্রপাতি বিক্রি করে দেয়ার কথা চিন্তা করেন। তবে পরবর্তীতে তারা তা বিক্রি না করে নতুনভাবে গাড়ি নির্মাণ শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯০২ সালে নতুন এই কোম্পানি নামকরণ করা হয় ক্যাডিলাক। ১৯০৯ সালে এই কোম্পানিটি জেনারেল মোটরস কিনে নেয়।
এরপর থেকে বিলাসবহুল গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ক্যাডিলাক ভালোই সুনাম অর্জন করেছে। ১৯০৮ ও ১৯১২ সালে সম্মানজনক ‘ডেওয়ার ট্রফি’ লাভ করে তারা।
৩. ফিয়াট
প্রতিষ্ঠাকাল: ১৮৯৯ সাল
ইতালির সবচেয়ে বড় মোটরগাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ফিয়াটের জন্ম হয় ১৮৯৯ সালে। ফিয়াট (FIAT) এর পূর্ণরূপ ‘Fabbrica Italiana Automobili Torino’, যার অর্থ ‘ইতালীয় মোটরগাড়ি ফ্যাক্টরি, তুরিন’। ফিয়াট তাদের প্রথম গাড়িটি নির্মাণ করে ১৮৯৯ সালে। এরপর ১৯১০ সালের দিকে কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর জিওভানি অ্যানেল্লি হেনরি ফোর্ডের গাড়ি নির্মাণ কারখানাটি দেখতে আসেন। তিনি ফোর্ডের কারখানার উৎপাদন ব্যবস্থাপনা দেখে মুগ্ধ হন এবং পরবর্তীতে নিজের কারখানাতেও একই পদ্ধতি চালু করেন।
ফিয়াটের সবচেয়ে জনপ্রিয় গাড়িগুলো প্রধানত ‘সিটি কার’ ও ‘সুপারমিনি’ এ দুই শ্রেণীর। ১৯৭০ সালে ফিয়াট ইলেকট্রিক যানবাহন তৈরি শুরু করে। বর্তমানে মোটরগাড়ি ছাড়াও অস্ত্র নির্মাণে অংশ নিয়েছে ফিয়াট।
৪. ল্যান্ড রোভার
প্রতিষ্ঠাকাল: ১৮৯৬ সাল
১৮৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই মোটরগাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটির নাম প্রথমে ছিল ‘ল্যানক্যাশিয়ার স্টিম মোটর কোম্পানি’। এরপর বহুবার নাম পরিবর্তন করা হয়েছে এই কোম্পানিটির। প্রথমদিকে এই কোম্পানিটি শুধুমাত্র বাষ্পীয় ঘাস কাটার যন্ত্র তৈরি করতো। এরপর তারা বাষ্পীয় মালবাহী গাড়ি নির্মাণ শুরু করে। ১৯০৭ সালে কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে ‘লেল্যান্ড মোটরস’ করা হয়।
১৯৭৮ সালে আরো অনেক ধাপ নাম পরিবর্তনের পর শেষমেশ কোম্পানির নাম রাখা হয় ‘ল্যান্ড রোভার’। ১৯৪৮ সালে কোম্পানিটির সবচেয়ে জনপ্রিয় মডেল ‘রোভার’ এর নির্মাণ শুরু করে লেল্যান্ড মোটরস। ব্রিটিশ আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে প্রচলিত এই মডেলের উৎপাদন চালু রয়েছে এখন পর্যন্ত। ১৯৫১ সালে রাজা ষষ্ঠ জর্জ কর্তৃক একটি রাজকীয় সনদ লাভ করে ল্যান্ড রোভার কোম্পানি।
৫. মার্সিডিজ-বেঞ্জ
প্রতিষ্ঠাকাল: ১৮৮৩ সাল
বিপুল জনপ্রিয় মোটরগাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মার্সিডিজ বেঞ্জ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২৬ সালে। পুরনো দুটি ভিন্ন মোটরগাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান একীভূত হয়েই কিন্তু গঠিত হয়েছে এই কোম্পানিটি।
এই দুটি প্রতিষ্ঠানের একটি ‘ডাইমলার মোটোরেন গেসেলস্ক্রাফট’। ১৮৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানিটি প্রথমদিকে শুধুমাত্র পেট্রোল ইঞ্জিন প্রস্তুত করতো। এরপর তারা ছোটখাট রেস কার তৈরি শুরু করে এবং পরবর্তীতে মার্সিডিজ ব্র্যান্ডের নানা মডেল নির্মাণে যোগ দেয়।
একইভাবে, ‘বেঞ্জ অ্যান্ড কোম্পানিজ’ নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের সূচনা হয় ১৮৮৩ সালে। প্রথমদিকে তারা গ্যাস ইঞ্জিন ও শিল্পকারখানার বিভিন্ন যন্ত্র নির্মাণ করতো। এরপর কোম্পানির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কার্ল বেঞ্জ তার বহুদিনের স্বপ্নের মোটরগাড়ি নির্মাণের দিকে মন দেন। ১৮৮৬ সালে তিনি বিশ্বের সর্বপ্রথম পেট্রোল চালিত মোটরগাড়ি নির্মাণ করেন।
১৯২৬ সালে এই দুটি কোম্পানি একত্রিত হয়ে মার্সিডিজ-বেঞ্জ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে।
৬. টাট্রা
প্রতিষ্ঠাকাল: ১৮৫০ সাল
অন্যতম প্রাচীন মোটরগাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টাট্রার সূচনা হয় ঘোড়ায়টানা গাড়ি নির্মাণের মাধ্যমে। ১৮৯১ সালে তারা রেলপথে চলার উপযোগী গাড়ি নির্মাণ শুরু করে।
এরপর ১৮৯৭ সালে টাট্রার প্রযুক্তিগত পরিচালক হুগো ফিশার নিজের ব্যবহারের জন্য একটি বেঞ্জ মোটরগাড়ি কেনেন। আর এই গাড়ি থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি পরের বছরেই তার কোম্পানির প্রথম মোটরগাড়ি ‘প্রাসিডেন্ট’ নির্মাণ করেন।
গাড়ি ছাড়াও টাট্রা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান সেনাবাহিনীর জন্য ট্যাংক ইঞ্জিন ও ট্রাক তৈরি করতো। তবে এই ট্রাকগুলো চলার সময় এত দ্রুত মোড় নিতো যে বহু জার্মান সৈন্য এই গাড়ির নিচে চাপা পড়ে মারা যায়। ফলে পরবর্তীতে জার্মান সৈন্যদের এই টাট্রা ট্রাকগুলো ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
১৯৯৯ সালে এই কোম্পানি তাদের যাত্রীবাহী গাড়ি নির্মাণ বন্ধ ঘোষণা করে। তবে এখনো পর্যন্ত টাট্রা ট্রাক নির্মাণ করে আসছে।
৭. পিউজো
প্রতিষ্ঠাকাল: ১৮১০ সাল
আজকের প্রাচীন গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের তালিকার সবেচেয়ে পুরানো প্রতিষ্ঠানটি হলো পিউজো। প্রাচীন এই প্রতিষ্ঠানটির শুরু হয় ১৮১০ সালে এক কফি গুঁড়ো করার মিল হিসেবে। ১৮৩০ সালে তারা বাইসাইকেল নির্মাণ শুরু করে। এরপর ১৮৪২ সালে তারা লবণ, মরিচ ও কফি গুঁড়ো করার মেশিন নির্মাণ শুরু করে। তবে এসবের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা পিউজোর মোটরগাড়ি নির্মাণের প্রতি ছিল ব্যাপক আগ্রহ। ফলে ১৮৮২ সালের দিকে তিনি মোটরগাড়ি নির্মাণ শুরু করেন।
১৮৮৯ সালে লিওন সারপোলেটের সহযোগিতায় পিউজোর প্রথম গাড়ি বাজারে আসে। এটি ছিল একধরনের বাষ্পচালিত তিন চাকার গাড়ি। তবে ব্যাপক আকারে উৎপাদনের জন্য এটি ছিল অনুপযোগী। ফলে ১৮৯০ সালে কিছু উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে গাড়িটির উন্নত মডেল বাজারে আনা হয়।
পারিবারিক কিছু সমস্যার কারণে পিউজো তার পূর্বের কোম্পানি ত্যাগ করেন এবং ‘সোসাইটি ডেস অটোমোবাইলস পিউজো’ নামে ১৮৯৬ সালে আরেকটি প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। এর দু’বছর আগে তিনি গাড়ির পাশাপাশি মোটরসাইকেল নির্মাণ শুরু করেন। পরবর্তীতে ১৯২৬ সালে মোটরগাড়ি ও মোটরসাইকেল নির্মাণের জন্য দুটি ভিন্ন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
এ পর্যন্ত বহু পুরষ্কার ও সম্মাননা জিতে নেয়া পিউজো এখনো পর্যন্ত চালু থাকা বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন মোটরগাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান